ইসলামে নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব।।

February 11, 2018 3:55 pm0 commentsViews: 48

শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী।।

 ..

নৈতিক শিক্ষা ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলির অন্তর্গত। ইসলামি দর্শনে আদি শিক্ষক হলেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। তাই ফেরেশতারা বলেছিলেন: ‘হে আল্লাহ, আপনি পবিত্র! আপনি যা শিখিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের কোনই জ্ঞান নেই; নিশ্চয় আপনি মহাজ্ঞানী ও কৌশলী।’ (সুরা বাকারা, আয়াতঃ ৩২)।
আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রতি ওহির প্রথম নির্দেশ ছিলঃ ‘পড়ে তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানব ‘আলাক’ হতে। পড়ো, তোমার রব মহা সম্মানিত, যিনি শিক্ষাদান করেছেন লেখনীর মাধ্যমে। শিখিয়েছেন মানুষকে যা তারা জানত না।’ (সুরা আলাক, আয়াতঃ ১-৫)। ‘দয়াময় রহমান (আল্লাহ)! কোরআন শেখাবেন বলে মানব সৃষ্টি করলেন; তাকে বর্ণ শেখালেন।’ (সুরা রহমান, আয়াত ১-৪)।
ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব
আচরণে (আমলে বা কর্মে) ইতিবাচক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধনই শিক্ষার উদ্দেশ্য। নৈতিক শিক্ষার সঙ্গে যেসব বিষয় সরাসরি সম্পর্কিত সেগুলো হলো সুশাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, দুর্নীতি দমন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি। আচরণে অভীষ্ঠ ইতিবাচক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধনের জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তথ্য প্রদান বা জ্ঞান দান করাকে শিক্ষা বলে। খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর এক প্রশ্নের জবাবে হজরত উবায় ইবনে কাআব (রা.) বলেন, ‘ইলম হল তিনটি বিষয়—আয়াতে মুহকামাহ (কোরআন), প্রতিষ্ঠিত সুন্নত (হাদিস) ও ন্যায় বিধান (ফিকাহ)।’ (তিরমিজি)।
হজরত উবায় ইবনে কাআব (রা.) বলেন, ‘(শিক্ষিত তিনি) যিনি শিক্ষা অনুযায়ী কর্ম করেন (অর্থাৎ শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষাও থাকে)।’ (সহিহ তিরমিজি ও সুনানে আবু দাউদ)। ইলম বা জ্ঞান হলো মালুমাত বা ইত্তিলাআত তথা তথ্যাবলি। এটি দুভাবে অর্জিত হতে পারে: (ক) পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা। যথা (১) চক্ষু, (২) কর্ণ, (৩) নাসিকা, (৪) জিহ্বা ও (৫) ত্বক। এ প্রকার ইলমকে ইলমে কাছবি বা অর্জিত জ্ঞান বলে। (খ) ওয়াহি। যথা (১) কোরআন ও (২) হাদিস। এ প্রকার ইলমকে ইলমুল ওয়াহি বা ওয়াহির জ্ঞান বলে।

নৈতিক শিক্ষা সম্বন্ধে কোরআনের ভাষ্য

হজরত ইব্রাহিম (আ.) দোয়া করলেন: ‘হে আমাদের প্রভু! আপনি তাদের মাঝে পাঠান এমন রাসুল, যিনি আপনার আয়াত উপস্থাপন করবেন, কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী স্নেহশীল ও কৌশলী।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১২৯)। মানুষ দোষে-গুণে সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর তাতে ঢেলে দিলেন অপরাধপ্রবণতা ও তাকওয়া। অবশ্যই সফল হলো সে যে তা পবিত্র করল; আর বিপদগ্রস্ত হলো সে যে তা ছেড়ে দিল।’ (সুরা শামছ, আয়াত: ৮-১০)। ‘নিশ্চয় যারা অকৃতজ্ঞ, হোক সে কিতাবধারী ও অংশীবাদী, সে জাহান্নামের আগুনে চিরকাল দগ্ধ হবে; তারাই সৃষ্টির নিকৃষ্টতম। আর যারা বিশ্বাসী ও সৎ কর্ম করে, তারাই সৃষ্টির সেরা।’ (সুরা বাইয়িনা, আয়াত: ৬-৭)।

নৈতিক শিক্ষা সম্বন্ধে হাদিস শরিফের ভাষ্য

হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জেনে রাখো, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরা (মুদগাহ) আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীর তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীর তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখো, সে গোশতের টুকরাটি হলো কলব।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস: ৫০)।

অর্জনীয় উত্তম বৈশিষ্ট্য বা সদ্‌গুণাবলি

আত্মিক ও মানবিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন সদ্‌গুণাবলি অর্জন ও ষড়্‌রিপু নিয়ন্ত্রণ। সদ্‌গুণাবলির মধ্যে আছে কৌমার্য, সতীত্ব, শক্তিমত্তা, সত্যবাদিতা, ন্যায়বোধ, দয়া, মহানুভবতা, পরোপকারিতা, ধৈর্য-সহনশীলতা, মিতাচার বা সংযম ইত্যাদি। ধর্মীয় সদ্‌গুণ তিনটি; যথা (১) বিশ্বাস, (২) আশা ও (৩) ভালোবাসা।

বর্জনীয় ও নিন্দনীয় বিষয়সমূহ

বর্জনীয় বিষয় হলো ষড়্‌রিপু বা কুপ্রবৃত্তিসমূহ। যথা (১) কাম, (২) ক্রোধ, (৩) লোভ, (৪) মোহ, (৫) মদ, (৬) মাৎসর্য। সাধারণত মানুষের মধ্যে ১০টি সদ্‌গুণ ও ১০টি বদগুণ বিদ্যমান থাকে। পরিভাষায় এগুলোকে রজায়িল (কুপ্রবৃত্তি) ও ফাজায়িল (সুকুমারবৃত্তি) বলা হয়। মানুষের উচিত বদগুণ বর্জন ও সদ্‌গুণ অর্জনের মাধ্যমে পূর্ণতা অর্জন করা। এ ছাড়া কিছু উত্তম বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অর্জন করা মানুষের জন্য বাঞ্ছনীয় ও প্রশংসনীয় এবং কল্যাণের পথে সহায়ক।

রজায়িল বা কুপ্রবৃত্তিসমূহ

রজায়িলগুলো হলো (১) হিরছ (লোভ), (২) তমা (লালসা), (৩) রিয়া (প্রদর্শনের ইচ্ছা), (৪) কিবর (অহংকার), (৫) কিজব (মিথ্যা), (৬) গিবত (পরনিন্দা), (৭) হাছাদ (হিংসা), (৮) উজব (অহমিকা), (৯) কিনা (পরশ্রীকাতরতা) ও (১০) বুখল (কৃপণতা)।

ফাজায়িল বা সুকুমার বৃত্তিসমূহ

ফাজায়িলগুলো হলো (১) তাওবা (গুনাহের জন্য অনুতাপ করা, ক্ষমা চাওয়া), (২) ইনাবাত (আল্লাহর দিকে মন সর্বদা রুজু রাখা), (৩) জুহদ (দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি, প্রয়োজনের অতিরিক্ত আশা পরিত্যাগ করা), (৪) অরা (সন্দেহজনক জিনিস থেকে বেঁচে থাকা), (৫) সবর (ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন করা), (৬) শোকর (কৃতজ্ঞতা, উপকারীর উপকার স্বীকার করা), (৭) তাওয়াক্কুল (আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হওয়া), (৮) তছলিম (আল্লাহর হুকুম-আহকাম/নিয়ামত ও মুসিবত সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়া এবং আল্লাহর নিকট পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা), (৯) রেজা (আল্লাহর ইচ্ছার ওপর রাজি থাকা), (১০) কানাআত (অল্পে তুষ্টি)।

বিদ্যা মানে জ্ঞান, শিক্ষা মানে আচরণে পরিবর্তন। সব শিক্ষাই বিদ্যা কিন্তু সব বিদ্যা শিক্ষা নয়; যদি তা কার্যকর বা বাস্তবায়ন করা না হয়। জ্ঞান যেকোনো মাধ্যমেই অর্জন করা যায়, অধ্যয়ন জ্ঞানার্জনের একটি পন্থা মাত্র। অধ্যয়ন মানে পঠন বা পাঠ করা অথবা পাঠ গ্রহণ করা; অধ্যাপনা মানে পাঠন বা পাঠদান বা পাঠ প্রদান করা। অধ্যয়ন সব সময় জ্ঞানার্জনের সমার্থক নয়; জ্ঞানার্জন সর্বদাই অধ্যয়নের সমার্থক হয়। বর্তমানে বস্তুবাদী শিক্ষা ও আর্থসামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় আমাদের সমাজকে করেছে কলুষিত, জাতিকে করেছে কলঙ্কিত, দেশকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ।

নৈতিক শিক্ষায় পিতা, মাতা ও

অভিভাবকের করণীয়

শিশুর বা সন্তানের নৈতিক শিক্ষার প্রথম ও প্রধান উৎস হলেন তার পিতা, মাতা ও অভিভাবকেরা। তাঁদের জীবন ও কর্ম পৌষ্য বা সন্তানের জীবনে সরাসরি প্রতিফলিত হয়। তাঁরা যদি সৎ ও সুন্দর পরিশীলিত চরিত্র ও মার্জিত আচরণের অধিকারী হন, সন্তানেরা দেখে দেখেই তা আয়ত্ত করবে। সন্তানেরা তাঁদেরই প্রতিবিম্ব।

নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষকের করণীয়

শিক্ষক হলেন শিক্ষার্থীর জীবনের প্রধান প্রভাবক। শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষক হলেন হিরো (নায়ক) বা আইকন (মডেল)। তাই শিক্ষককে হতে হবে শিক্ষার্থীর রোল মডেল বা আদর্শের বাস্তব নমুনা।

নৈতিক শিক্ষায় সমাজের করণীয়

মানুষ সামাজিক জীব। পরিবেশ ও প্রতিবেশের প্রভাব সমাজজীবনে প্রকট। সুতরাং আমাদের সমাজজীবনের প্রতিচ্ছায়া শিক্ষার্থীর মন, মানস ও শিক্ষাকে প্রভাবিত করে। তাই সুশিক্ষার জন্য চাই সহায়ক পরিবেশ; ন্যায়বিচার, সুশাসন, স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক সহনশীলতা।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 1366 White Plains Road, Apt. 1J, The Bronx, New York-10462

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com