উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে বলে হকারকে বাবা পরিচয় দিতে যত কুণ্ঠা!
বাসে উঠে একটা খালি সিট পেলাম। জানালার পাশে আমি বসলাম, আর পাশের সিটটা খালি ! একটু পরই দেখি ১৮ কি ২০ বছর বয়সী একটা সুন্দরী মেয়ে উঠল। বোরকা পরা, মাথায় হিজাব দেয়া। মেয়েটাকে এক নজর দেখলেই বোঝা যায়, খুবই ভদ্র ও অবস্থা সম্পন্ন ঘরের মেয়ে। এদিক ওদিক সিট খুঁজে না পেয়ে শেষে আমার পাশে এসে বসল। হাতে একটা মোবাইল। দেখে বোঝা যায় অনেক দামী একটা মোবাইল। কিছুদূর যাবার পর বাস আবার জ্যামে পড়ল। মেয়েটা বলে উঠল, অসহ্য জ্যাম ! আমিও হুম বলে সম্মতি জানালাম । এরপর টুকটাক কথা হতে লাগল । বাসও চলতে শুরু করল ! কথায় কথায় জানলাম, মেয়েটি ইংরেজিতে অনার্স করছে। খুব সহজ,সাবলীল ও অকপটেই কথা বলছিলাম আমরা !
এয়ারপোর্টের ওখানে গিয়ে আবারও জ্যামে পড়ল বাস। বিরক্তিকর জ্যাম ! জ্যামের মধ্যেই বাসে উঠল সাদা শার্ট পড়া কাল চেহারার মধ্যবয়সী একজন লোক। যে শার্টটি পরেছে, তা অনেক দিনের পুরনো মনে হল। শার্টটা ময়লা হয়েও আছে।
তার হাতে অনেকগুলো নামাজ শিক্ষা বই। কাঁধে কালো রঙের একটা ব্যাগ। লোকটা ’নামাজ শিক্ষা’ বই বিক্রি করছে ! লোকটা অনেকক্ষণ যাবৎ, বইতে কি কি গুরুত্বপূর্ণ দোয়া, সূরা, মাসলা মাসায়েল, ইত্যাদি আছে, তা বর্ণনা করল। কিন্তু বাসের কেউ একটা বইও কিনল না ! আমার খুব খারাপ লাগল। ইচ্ছে করছিল লোকটাকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করি ! কিন্তু, লোকটাকে টাকা দিতে চাইলে যদি কিছু মনে করে। তাই দিলাম না ! একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, লোকটা বাসে ওঠার পর থেকে মেয়েটি আমার সাথে একটা কথাও বলে নি। মাথা নিচু করে মোবাইল টিপতেছে !
বাড়িতে ‘নামাজ শিক্ষা’ বই থাকা সত্বেও শুধুমাত্র লোকটিকে সাহায্য করার ইচ্ছায় বিশ টাকা দিয়ে দু’টো বই কিনলাম। লোকটিকে পঞ্চাশ টাকার নোট দিলে সে ত্রিশ টাকা ফেরত দিল ! টাকা ফেরত দেবার পরও দেখি সে পকেট থেকে আরও টাকা বের করছে ! একটা একশ টাকার নোট আর কয়েকটা দশ টাকার নোট ! আমার দিকে এগিয়ে ধরল ! আমি তো অবাক। আমাকে টাকা দেবেন কেন উনি ? না, অবশেষে তার ডাক শুনে আমার ভুল ভাঙল ! তিনি আমাকে না, আমার পাশে বসা মেয়েটিকে টাকা দিচ্ছেন ! তিনি বললেন, ‘সোমা টাকাটা রাখ । কিছু কিনে খেয়ে নিও! তোমার মা বলল, ‘তুমি সকালে না খেয়েই ভার্সিটিতে চলে এসেছ‘। মেয়েটি লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। সে অত্যন্ত রেগে লোকটার দিকে তাকাল !
বলল,লাগবে না ! লোকটি জোর করে টাকাটা তার হাতে দিয়ে বাস থেকে নেমে গেল ! মেয়েটার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না ! রেগে টং হয়ে ঢং সেজে আছে ! আমি কৌতুহল সামলাতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে যে টাকা দিলেন, উনি কে ? মেয়েটা বলল, আমাদের বাড়ির পাশে থাকে ! আমি বললাম, কিছু মনে করবেন না। একটা কথা বলি, উনি কি আপনার বাবা ? মেয়েটি রেগে তাকাল আমার দিকে ! জবাব দিল না ! এমন ভাব করল যেন আমি তাকে ও’কথা বলে মহা অপরাধ করে ফেলেছি ! আমি বুঝতে পারলাম, তার রাগের কারণ। তার বাবা একজন ভ্রাম্যমাণ হকার। বাসে বাসে ঘুরে বই বিক্রি করে। আর সে দামী পোশাক পরে হিজবের আড়ালে ভার্সিটিতে যায় ! সে এখন একজন শিক্ষিত মানুষ ! এজন্য সে বাবার পরিচয় দিতে লজ্জা পায় ! এ ময়লা শার্ট পরা লোকটাকে বাবা বলে স্বীকার করাটাকে সে ঘৃণার চোখে দেখে ! মেয়েটি চায় না, দুনিয়ার কেউ জানুক, ময়লা শার্ট পরিহিত এ হকার ব্যাটা তার বাবা ! হতবাক হলাম ভেবে, হায়রে কত বড় বিবেক সম্পন্ন মানুষ সে ! যে লোকটা রাতদিন পরিশ্রম করে বাসে বাসে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বই বিক্রি করে মেয়েটাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছে। অমন কষ্ট করে তাকে লেখাপড়া শেখাচ্ছে। নিজে কয়েক বছরের পুরনো একটা শার্ট পরে, অথচ মেয়েটিকে দামী পোশাক, ব্যাগ, দামী মোবাইল কিনে দিয়ে তার সমস্ত চাওয়া পূরণ করছেন। সেই মানুষটাকে বাবা বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করছে মেয়েটির ! কত বড় নির্লজ্জ ! যে মানুষটা তাকে লালন পালন করে এত বড় করল, যারটা খেয়ে বেঁচে আছে, তাকে বাবা বলে পরিচয় দিতে তার এত কুণ্ঠা, এত লজ্জা !
মেয়েটি হয়ত শিক্ষিত হচ্ছে, কিন্তু তার ভেতর বিবেক ও মানুষত্ব তৈরি না হয়ে লোপ পাচ্ছে। হকার লোকটির প্রতি শ্রদ্ধায় মনটা ভরে উঠল ! লোকটা হাজার কষ্টের মাঝেও পরম মমতায় নিজের মেয়েটিকে উচ্চশিক্ষিত করে তুলছেন ! আদর্শ বাবা মনে হয় একেই বলে। ভাবলাম, অন্য কেউ হলে হয়ত অনেক আগেই মেয়েটিকে কোন শ্রমিক বা রিক্সাওয়ালা বা মুটে মজুরের সাথে বিয়ে দিয়ে দিত। সেটাই বোধহয় ভাল হত! তাহলে তখন হয়ত মেয়েটি বাবার পরিচয় দিতে এত লজ্জা বোধ করত না। ময়লা জামা পরা মানুষটিকে বাবা হিসেবে অস্বীকার করত না ! সারা পথ শুধুই ভাবলাম, যে শিক্ষা আমাদের মধ্যে বিবেক ও মনুষত্ব তৈরি করে না, সে শিক্ষা অর্জন করেই বা কী লাভ! উৎসঃ দেশিনিউজ।