বিয়ের আগে পরিচিতি পর্ব যেমন হওয়া উচিত

December 3, 2017 5:51 am0 commentsViews: 68

মাওলানা দেলওয়ার হোসাইন ।।
“””””””””””””””””””””””””””””””””””””
বিয়ে করতে গেলে তিনটি পর্ব বা তিনটি সময় অতিক্রম করতে হয়।

এক- খিতবাহ خطبة বা মেয়ের সাথে পরিচিতি পর্ব।
দুই- আকদ عقدة বা বিয়ের চুক্তি পর্ব।
তিন- নিকাহ نكاح বা দাম্পত্য জীবন পর্ব।

আমাদের দেশে বিয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বটি সম্পর্কে অনেকের স্বচ্ছ ধারণা থাকলে ও প্রথম পর্বটি নিয়ে কেউ কেউ বেশ দ্বিধায় থাকেন। অর্থাৎ, খিতবাহ পর্ব বা মেয়ের সাথে পরিচয় পর্বটা আসলে কেমন হবে? এটা অনেকের কাছে স্বচ্ছ নয়।
খিতবাহ হলো বিয়ের উদ্দেশ্যে ছেলে-মেয়ে পরস্পরকে দেখা ও জানা-বুঝার পর্ব। মেয়ে যদি বিধবা হয়, তা হলে মেয়ের পরিবারের অজ্ঞাতেই ছেলে মেয়েটিকে জানা-বুঝার চেষ্টা করতে পারে। কিন্ত মেয়ে যদি কুমারী হয়, তা হলে মেয়ের পরিবারের সম্মতিতে মেয়েকে দেখা ও জানা-বুঝার চেষ্টা করাটাকে খিতবাহ পর্ব বলা হয়।

খিতবাহ পর্বটি ভালভাবে না বুঝার কারণে সাধারণত দু’টি ভুল হয়।

প্রথম ভুলঃ
অনেকে বলেন, বিয়ের আগে কিছুদিন প্রেম না করলে কিভাবে মেয়েটি সম্পর্কে জানব?
এ কথাটি ভুল,আসল কথা হল,
কেউ যদি কোন মেয়েকে দেখতে, জানতে বা বুঝতে চায়,তা হলে এ মেয়ের পরিবার থেকে আগে অনুমতি নিয়ে নিতে হবে।
এরপরই দেখা, জানা ও বুঝাবুঝি শেষে অপছন্দ হলে মেয়েটিকে “না” করে দিতে হবে। আর পছন্দ হলে পরিবারের সাথে বিয়ের চুক্তি করে ফেলতে হবে।

দ্বিতীয় ভুলঃ
অনেকে বলেন, পরিবারের সাথে বিয়ের চুক্তি করার আগে ছেলে-মেয়ে পরস্পরকে দেখাদেখি করা, কথাবার্তা বলা বা জানাশোনার চেষ্টা করা উচিত না।
এখানে ভুলটা হল, তঁরা খিতবাহ ও আকদকে এক সাথে মিলিয়ে ফেলেন।

ধরুন একটি মেয়ের স্বামী মারা গেল। তখন চার মাস দশদিন পর্যন্ত ঐ মেয়ের সাথে বিয়ের চুক্তি করা বা আকদ করা বৈধ নয়। কিন্তু ঐ বিধবা মেয়েটিকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে তার সাথে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলা বা খিতবাহর সম্পর্ক করাতে কোন গুনাহ নেই।

আল-কোরআনে মহান আল্লাহ পাক বলেন :
ولا جناح عليكم فيما عرضتم به من خطبةالنساء أو اكننتم في انفسكم ،علم الله إنكم ستذكرونهن ولكن لاتواعدوهن سرا الا ان تقولو قولا معروفا،ولا تعزمواعقدةالنكاح حتي يبلغ الكتب اجله ،واعلموا ان الله يعلم ما في انفسكم فاحذروه، واعلموا ان الله غفور حليم.
[سورة البقرة ٢٣٥]
“নারীদেরকে যদি তোমরা বিয়ের প্রস্তাব (খিতবাহ) দাও,অথবা বিষয়টি তোমাদের অন্তরে গোপন রাখ,তাহলে তাতেও তোমাদের কোন পাপ নাই।আল্লাহ জানেন যে, তোমরা অবশ্যই সে নারীদের কথা স্মরণ করবে এবং তাদের সাথে ভাল কথাবার্তা বলবে, কিন্তু গোপনে তাদের সাথে বিয়ে করার অঙ্গীকার কর না। অবশ্য শরীয়তের নির্ধারিত প্রথা অনুযায়ী কোন কথা সাব্যস্ত করে নেবে। আর বিয়ের চুক্তি (আকদ) করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার নির্দিষ্ট ইদ্দত পূর্ণ হয়। আর এ কথা জেনে রেখ, তোমাদের মনে যে কথা রয়েছে, আল্লাহ তা জানেন। কাজেই তাঁকে ভয় কর। আরও জেনে রাখ আল্লাহ ক্ষমাকারী ও ধৈর্যশীল।
[সূরা বাকারা-২৩৫]
এ আয়াতে স্পষ্ট যে,খিতবাহ (خطبة)ও আকদ (عقدة)এক নয়। দুটি আলাদা আলাদা শব্দ।
বিধবা নারীর ইদ্দত শেষ হওয়ার আগে বিয়ের উদ্দেশ্যে কেউ তার সাথে কথাবার্তা বলা বা “খিতবাদ” দোষের কিছু নয়, কিন্তু সে সময়ে বিয়ের চুক্তি করা বা “আকদ” জায়েজ নেই।
বিষয়টি আরও স্বচ্ছভাবে বুঝার জন্যে এ আয়াতের পরবর্তী আরও দুটি আয়াত আমরা দেখতে পারি।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-
لا جناح عليكم ان طلقتم النساءمالم تمسوهن اوتفرضوا لهن فريضة،ومتعو هُن علي الموسع قدره و علي المقتر قدره،متاعا بالمعروف،حقا علي المحسنين.•
[سورة البقرة-٢٣٦]
وان طلقتموهن من قبل ان تمسوهن وقد فرضتم لهن فريضة فنصف ما فرضتم الاان يعفون أو يعفوا الذي بيده عقدة النكاح،و ان تعفوا اقرب للتقوي،ولا تنسواالفضل بينكم،ان الله بما تعملون بصير•
سورة البقرة-٢٣٧
“যদি তোমরা স্ত্রীদেরকে স্পর্শ করার পূর্বে এবং কোন মাহর সাব্যস্ত করার পূর্বে তালাক দিয়ে দাও,তবে তাতেও তোমাদের কোন পাপ নেই। কিন্তু তাদেরকে কিছু খরচ দেবে, সামর্থ্যবানদের জন্য তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী এবং কম সামর্থ্যবানদের জন্য তাদের সাধ্য অনুযায়ী। যে খরচ প্রচলিত রয়েছে, তা সৎকর্মশীলদের উপর দায়িত্ব।” (সুরা বাকারা-২৩৬)
“আর যদি মাহর সাব্যস্ত করার পর কিন্তু স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দিয়ে দাও, তা হলে মোহর হিসেবে যা সাব্যস্ত করা হয়েছে, তার অর্ধেক দিতে হবে। অবশ্য যদি নারীরা মাফ করে দেয় কিংবা বিয়ের বন্ধন যার অধিকারে (স্বামী ) সে যদি মাফ করে দেয়, তবে তা স্বতন্ত্র কথা। আর তোমরা পুরুষরা যদি ক্ষমা কর, তবে তা হবে তাকওয়ার নিকটবর্তী। তোমরা পারস্পরিক সহানুভূতির কথা বিস্মৃত হয়ো না। নিশ্চয় তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ সেসবই অত্যন্ত ভাল করে দেখেন।” সূরা বাকারা-২৩৭

উপরোক্ত আয়াত দুটি থেকে স্পষ্ট যে বিয়ের তিনটি পর্ব রয়েছে।

এক. খিতবাহ خطبة বা মেয়ে ও মেয়ের পরিবারের সাথে পরিচিতি পর্ব।এ পর্বে থাকালীন সময়ে যদি ছেলে-মেয়ে পরস্পরের মিল না হয়, তাদের বিচ্ছেদ (তালাক) হয়ে যায়,তা হলে তাতে কোন পাপ নেই। তখন মেয়েকে কিছু উপহার দিয়ে দিলেই হবে।

দুই. আকদ عقدة বা বিয়ের চুক্তি ও মাহর নির্ধারণ করার পরের পর্ব।এ পর্বেও যদি কোন কারণে ছেলে-মেয়ের মধ্যে সম্পর্ক বিচ্ছেদ (তালাক) ঘটে যায়, তা হলে ছেলেকে অর্ধেক মাহর দিতে হবে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে মেয়ে চাইলে ক্ষমাও করে দিতে পারে।

তিন. বিবাহ পর্ব বা নিকাহ نكاح পর্ব।এ পর্বে এসে দাম্পত্য জীবন শুরু হয়। তখন যদি কেউ স্ত্রীকে (তালাক) বিবাহ বিচ্ছেদ করতে চায়,তা হলে সুরা বাকারার ২২৬ নং আতাত থেকে ২৩৩ নং আয়াতের নিয়মানুযায়ী তালাক দিতে হবে।
এ পর্বে এসে তালাক দিলে পূর্ণ মাহর প্রদান করতে হবে।

সুতরাং, খিতবাহ خطبة পর্ব এমন একটি পর্ব, যেখানে আকদ বা বিয়ের কোন চুক্তি হয় না, কিন্তু মেয়ে ও মেয়ের পরিবারের সাথে ছেলের বোঝাপড়া চলতে থাকে। এ অবস্হায় যদি মেয়েকে বা মেয়ের পরিবারকে পছন্দ না হয়, তখন ঐ মেয়েকে ছেড়ে দেওয়াটা অন্যায়ের কিছু না।

আমাদের দেশে বিয়ের ক্ষেত্রে ”খিতবাহ” বা মেয়ের সাথে পরিচয় পর্বটিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না।অর্থাৎ, বিয়ে করতে গেলে মেয়েকে ভালভাবে দেখা এবং মেয়েকে বোঝার চেষ্টা করাকে অনেকেই খারাপ ভাবে দেখেন। তাদের কথা হল,বিয়ের আগে ছেলে-মেয়ের কথাবার্তা বলা জায়েজ নয়।
অথচ অসংখ্য হাদীসে মেয়েকে ভালভাবে দেখে নিতে বলা হয়েছে।
যেমনঃ একটি হাদীস হল-
ان المغيرة بن شعبة اراد ان يتزوج امرأة،فقال له النبي صلي الله عليه وسلم:”اذهب فانظر اليها ،فانه احري ان يودم بينكما،فتزوجها ،فذكر من موافقتها
মুগিরা বিন শোয়াইব (রাঃ) রাসুল (সাঃ)কে বললেন- “আমি একটি মেয়েকে বিয়ে করতে চাই। রাসুল (সাঃ) তাকে বললেন—তুমি আগে মেয়েটিকে দেখ, যাতে তোমাদের উভয়ের ভুল বুঝাবুঝি না হয়। অতঃপর মুগিরা (রা) তাই করলেন। ফলে তাদের উভয়ের মধ্যে মেলবন্ধন হয়।”  [সুনানে ইবনে মাজাহ ,মাকতাবায়ে শামেলা-১৮৬৫]

এ রকম অনেক হাদীস আছে। রাসুল (সাঃ) বিয়ের আগে মেয়েকে ভালভাবে দেখে নিতে বলেছেন।
এখানে দেখা মানে শুধু মুখ দেখা নয়। যা আমাদের সমাজে প্রচলিত। যে কোন নারীর মুখ দেখা অনেক ইমামের মতে জয়েজ। সুতরাং বিয়ের উদ্দেশ্যে কোন নারীকে দেখা মানে ঐ নারীটিকে ভালভাবে জেনেবুঝে নেয়া।
সুরা বাকারার ২৩৫ নং আয়াতে আমরা দেখেছি খিতবাহ خطبة অবস্হায় নারীর সাথে ভাল কথাবার্তা বলাটা দোষের কিছু নয়। দাম্পত্য জীবন সুখের হওয়ার জন্যে বিভিন্ন হাদীসের দেখাতে বলা হয়েছে, যাতে একে-অপরকে ভালভাবে বুঝতে পারে জানতে পারে।
আমাদের দেশে খিতবাহ পর্বটিকে গুরুত্বের সাথে দেখা হয় না। ফলে কেউ পরিবারের অজ্ঞাতে প্রেম করে বেড়ায় ,আবার কেউ বলেন, বিয়ে বা আকদের আগে মেয়েদের সাথ কথা বলা উচিত নয়।
কিন্তু কোরআন ও হাদীসে আমরা দেখি,বিয়ের দ্বিতীয় পর্ব আকদ বা বিয়ের চুক্তি হওয়ার , প্রথম পর্ব খিতবাহ বা পরিচয় পর্বের জন্যে মেয়ের পরিবারের অনুমতি নিয়ে মেয়েকে ভালোভাবে দেখে-জেনে-বুঝে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।।।

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 400E Mosholu Parkway South Apt # A23,The Bronx, New York 10458, USA

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com