ঢাকা মহানগরীতে অপরাধ সমীক্ষাঃ খুন বেশি ওয়ারিতে, নারী নির্যাতন বেশি মিরপুরে।।
শুধু এ চারটি হত্যার ঘটনায় নয়, ঢাকা মহানগরে পুলিশের আটটি অপরাধ বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটে ওয়ারীতে। এ বিভাগের সাতটি থানা এলাকায় গত তিন বছরে খুনের ঘটনা ঘটেছে ১১৯টি। শিশু নির্যাতনের ঘটনাও এখানেই বেশি। খুনের সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মিরপুর এলাকা, সেখানে একই সময় খুনের ঘটনা ঘটেছে ১০৬টি। খুনের ঘটনায়
তৃতীয় স্থানে গুলশান। অপহরণ, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি মিরপুর বিভাগে। ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে শীর্ষে রমনা এবং সিঁধেল চুরিতে শীর্ষে মতিঝিল বিভাগ। অপহরণ ও শিশু নির্যাতনে মতিঝিলের স্থান দ্বিতীয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সদরদপ্তরের অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) কৃষষ্ণপদ রায় সমকালকে বলেন, এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান, বসবাস করা নাগরিকদের পেশা, তাদের বয়স, তারা কোথা থেকে এসে বসবাস করছেন- এগুলোর ওপর অপরাধের ধরন নির্ভর করে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না, ভৌগোলিক অবস্থান ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে অপরাধের ভিন্নতা থাকে। তিনি বলেন, নির্দিষ্ট সময় পরপর মহানগরের অপরাধপ্রবণতা বিশ্নেষণ করে অপরাধ প্রতিরোধে করণীয় কৌশল নির্ধারণ করা হয়।
ঢাকা মহানগরীতে পুলিশের আটটি অপরাধ বিভাগ রয়েছে। ৪৯টি থানা এসব বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। সর্বনিম্ন ৫টি থেকে সর্বোচ্চ ৭টি থানা রয়েছে একটি বিভাগে। জনসংখ্যা ও এলাকার আয়তনও কম-বেশি রয়েছে এসব বিভাগে। এসব থানায় দায়ের করা মামলার ওপর ভিত্তি করে ডিএমপি সদরদপ্তর অপরাধ পরিসংখ্যান তৈরি করে। ২০১৫ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত অর্থাৎ দুই বছর ১০ মাসে আটটি অপরাধ বিভাগে সর্বমোট মামলার সংখ্যা ৬০ হাজার ৮৫৫টি। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মিরপুর বিভাগে, এ বিভাগের সাতটি থানায় ১১ হাজার ৭১১টি মামলা। এরপর রয়েছে যথাক্রমে ওয়ারী বিভাগের সাতটি থানায় ৯ হাজার ১১৯টি, মতিঝিলের সাতটি থানায় ৮ হাজার ৮৪৮টি, তেজগাঁওয়ের পাঁচটি থানায় ৮ হাজার ১২৮টি, রমনার ছয়টি থানায় ৫ হাজার ৯১৫টি, উত্তরার ছয়টি থানায় ৫ হাজার ৯০৮টি, গুলশানের ছয়টি থানায় ৫ হাজার ৮১৩টি ও লালবাগ বিভাগের পাঁচটি থানায় ৫ হাজার ৪১৩টি মামলা। তবে সব এলাকায় অপরাধের ধরন এক নয়। খুন, অপহরণ, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, মাদক, অস্ত্র, ডাকাতি, দস্যুতা, হাঙ্গামা, চাঁদাবাজি, প্রতারণাসহ বিভিন্ন ঘটনায় এসব মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান সমকালকে বলেন, অপরাধের ভিন্নতার কারণ নির্ণয়ে এ দেশে গবেষণা নেই। অপরাধের শ্রেণিবিন্যাসের বাইরেও এলাকাভিত্তিক অপরাধপ্রবণতা কমবেশি হয় শ্রেণি, অর্থ ও শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে। তিনি বলেন, যে এলাকায় উচ্চবিত্তরা থাকে সেই এলাকায় এক ধরনের অপরাধ হয় এবং যে এলাকায় নিম্নমধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ থাকে সেখানে আরেক ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়। অপরাধ প্রতিরোধে কতটুকু ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে সেটিই আসল বিষয়।
সমাজবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এএসএম আমানুল্লাহ সমকালকে বলেন, অপরাধের সঙ্গে এলাকার একটা নিবিড় সংযোগ আছে, বহু আগেই সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিজ্ঞানীরা এটা আবিস্কার করেছেন। যে এলাকায় ভাসমান জনসংখ্যা বেশি, ঘনবসতিপূর্ণ এবং অপরাধ ঘটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার অবাধ সুযোগ আছে সেসব এলাকায় অপরাধ বেশি হয়। তবে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মানুষের বসবাসের এলাকার অপরাধের ধরন আলাদা। এটার সঙ্গে ভূগোল, জনমিতি, মানুষের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ জড়িত।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগের মধ্যে খুন ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ওয়ারীতে। ২০১৫ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত দুই বছর ১০ মাসে এ বিভাগের সাতটি থানা এলাকায় খুনের ঘটনা ঘটেছে ১১৯টি এবং শিশু নির্যাতনের সংখ্যা ১২৫টি। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ মামলায় এ এলাকা দ্বিতীয়। এ ঘটনায় মামলার সংখ্যা ৬৯৭টি। অপহরণ মামলায় এ এলাকার অবস্থান তৃতীয়, যার মামলা সংখ্যা ৫৫টি। ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনায় এ এলাকার অবস্থান চতুর্থ। এ বিভাগের সাতটি থানায় ২ বছর ১০ মাসে বিভিন্ন ঘটনায় সর্বমোট মামলার সংখ্যা ৯ হাজার ১১৯টি। আটটি অপরাধ বিভাগের মামলার সংখ্যার দিক থেকেও এর অবস্থান দ্বিতীয়।
জানতে চাইলে পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপ কমিশনার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন সমকালকে বলেন, যে এলাকা নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস হয়, সেখানে অপরাধের সংখ্যা বেশি থাকে। ওয়ারী বিভাগ ঘনবসতিপূর্ণ এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের বসবাস। ভাসমান লোকজনও বেশি এখানে। এ কারণে এখানে সাধারণত অপরাধ বেশি। তবে খুনের ঘটনার ক্ষেত্রে পারিবারিক খুনের সংখ্যাই বেশি।
নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, অপহরণ, গাড়িসহ অন্যান্য চুরির ঘটনা সবচেয়ে বেশি হয় মিরপুর বিভাগে। গত দুই বছর ১০ মাসে মিরপুর বিভাগের সাতটি থানা এলাকায় এক হাজার ১৯১ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৬১ জন। এ সময়ে অপহরণের মামলা হয়েছে ৬০টি। গাড়িসহ অন্যান্য চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে ৮৮০টি। সিঁধেল চুরি ও খুনের ঘটনার দিক থেকে এ এলাকার অবস্থান দ্বিতীয়। খুনের মামলা ১০৬টি এবং সিঁধেল চুরির মামলা ২৫৮টি। এছাড়া বিভিন্ন ঘটনার মামলার দিক থেকেও এই এলাকা প্রথম অবস্থানে রয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত মোট মামলার সংখ্যা ১১ হাজার ৭১১টি।
জানতে চাইলে পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আহম্মদ সমকালকে বলেন, জনসংখ্যার অনুপাতে মিরপুরে অপরাধের সংখ্যা কম। কারণ, মিরপুরে বসবাস করে ৮০ থেকে ৯০ লাখ মানুষ। সে হিসাবে উত্তরা, গুলশানসহ অন্যান্য বিভাগে জনসংখ্যা কম। নারী নির্যাতনের বিষয়ে তিনি বলেন, আর্থসামাজিক বিবেচনায় মিরপুরে নিম্ন আয়ের লোকজন বেশি থাকে। এ কারণে এ ধরনের অপরাধ বেশি হয়ে থাকে।
সিঁধেল চুরি সবচেয়ে বেশি হয় মতিঝিল বিভাগে। গত দুই বছর ১০ মাসে এই বিভাগের সাতটি থানায় সিঁধেল চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৯৪টি। অপহরণ, শিশু নির্যাতন, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মামলার দিক থেকে এ এলাকার অবস্থান দ্বিতীয়। ২০১৫ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনায় মোট মামলার সংখ্যা আট হাজার ৮৪৮টি, যা মামলার সংখ্যায় তৃতীয়। এরমধ্যে অপহরণের ঘটনায় ৫৭টি, শিশু নির্যাতনে ১২৪টি এবং ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৭৯টি মামলা হয়েছে। ৬৪টি খুনের ঘটনায় এ এলাকার অবস্থান চতুর্থ। নারী নির্যাতনে তৃতীয়, যার মামলা সংখ্যা ৬০৫টি। নারী নির্যাতনে তেজগাঁও বিভাগ চতুর্থ স্থানে এবং রমনা বিভাগ পঞ্চম স্থানে। শিশু নির্যাতনে তৃতীয় অবস্থানে আছে উত্তরা বিভাগ।
পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার আনোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, তিন বছরের পরিসংখ্যানে যে ক’টি অপহরণের ঘটনায় মামলা হয়েছে, সব কিন্তু মুক্তিপণ আদায় কিংবা চাঁদাবাজির ঘটনা নয়। অধিকাংশই পারিবারিক এবং আর্থিক লেনদেন-সংক্রান্ত অপহরণের মামলা। প্রেমঘটিত কারণে কেউ বাসা থেকে চলে গেলেও সেটি পরিবারের সদস্যরা অপহরণ মামলা করেন। এ ছাড়া আর্থিক লেনদেনের ঘটনাতেও এ ধরনের মামলা হয়। প্রকৃত অপহরণের ঘটনা খুবই কম।
মহানগরের মধ্যে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা সবচেয়ে বেশি রমনা বিভাগে। এসব ঘটনায় গত দুই বছর ১০ মাসে ছয়টি থানায় মামলা হয়েছে ৯৭টি। গাড়িসহ অন্যান্য চুরির ঘটনার দিক থেকে এ এলাকার অবস্থান দ্বিতীয় এবং সিঁধেল চুরিতে চতুর্থ। সিঁধেল চুরি এবং ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনার মামলায় তৃতীয় স্থানে তেজগাঁও বিভাগ। গাড়িসহ অন্যান্য চুরির ঘটনায় গুলশান বিভাগের অবস্থান তৃতীয় স্থানে।
বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় ২০১৫ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত রমনা বিভাগের ছয়টি থানায় মোট মামলা সংখ্যা পাঁচ হাজার ৯১৫টি।
জানতে চাইলে পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার বলেন, মারুফ হোসেন সরদার সমকালকে বলেন, রমনা এলাকা ঢাকা মহানগরের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে অসংখ্য রাস্তাঘাট আছে। এ কারণে ভাসমান অপরাধীরা এ এলাকায় এসে অপরাধ সংঘটিত করার চেষ্টা করে। অনেক সময় টুকটাক ঘটনা ঘটলে তা তদন্ত করে আসামি গ্রেফতার করা হয়।
সূত্রঃ বিডিটুডে