জনগণ-প্রশাসনে সরকারবিরোধী মানসিকতাঃ দুশ্চিন্তায় আ’লীগ
আসন্ন রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে জনগণ এবং প্রশাসনের মধ্যে এক ধরনের ‘সরকারবিরোধী মানসিকতা’ এবং দলীয় কোন্দল ভয়াবহ রূপ নেয়ায় ক্ষমতাসীন এ দলটিকে বেশ ভাবাচ্ছে। পাশাপাশি বিএনপির কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের ঢলে বাড়তি চিন্তা যোগ হয়েছে।
সূত্র জানায়, এসব নির্বাচনের প্রচারণায় বিএনপির কেন্দ্রীয় সব নেতাই অংশগ্রহণ করবেন। এমনকি এলাকাগুলো চাঙ্গা করতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সফর করতে পারেন। কিন্তু আইনি বাধ্যবাধকতায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও নেতারা নির্বাচনী কাজে অংশ নিতে পারবেন না। এতে বিএনপি প্রার্থী স্বাভাবিকভাবেই বেশকিছুটা এগিয়ে থাকবে। এছাড়া দলের প্রার্থীর বিপরীতে কোন্দলরত অংশ বিপক্ষে কাজ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নেতারা। আর কুমিলস্না সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রশাসনের ভূমিকা বিরূপ ছিল; তাই এবার প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে আগে থাকতেই সতর্ক দলটি।
দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মতে, প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের কিছু করার থাকে না। কেননা ভোটের দিন তাদের সেখানে থাকার সুযোগ নেই। এছাড়া দলীয় প্রার্থীর পরাজয় নিশ্চিত করতে অভ্যন্ত্মরীণ কোন্দলে জড়িয়ে থাকা নেতারাও নানাভাবে প্রশাসন প্রভাবিত করেন।
অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, কোন্দল দূর করে নেতাকর্মীদের কাজে লাগানো কষ্টকর। গতবার পাঁচ সিটিতে পরাজয়ে হেফাজতের অপপ্রচারের আড়ালে দলীয় কোন্দলই মূলত প্রার্থীদের পরাজিত হওয়ার কারণ ছিল।
তবে এতকিছুর পরও জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেরে ইমেজ নষ্ট করতে চায় না আওয়ামী লীগ। তাই যে কোনোভাবেই জয় তুলে আনতে এই পাঁচ সিটির নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন নেতারা। এজন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা, কর্মকৌশল, জয়লাভ
করবে এমন প্রার্থী বাছাইসহ সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে ক্ষমতাসীনরা।
তবে নির্বাচনে কোনো বিতর্কিত কা- ঘটুক তা চায় না আওয়ামী লীগ। সেজন্য সুষ্ঠু, সুন্দর, বিতর্কমুক্ত নির্বাচন উপহার দিতে নির্বাচন কমিশনকে কঠোর হতে আহ্বান জানান দলটির নেতারা। এছাড়া দলীয় মনোনয়ন নিয়ে বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে নেতাকর্মীদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করতেও মনোযোগী হয়েছেন তারা। নির্বাচনগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের এরকম নির্দেশনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারম্নক খান যায়যায়দিনকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি নির্বাচনগুলো আওয়ামী লীগ, বিএনপি, নির্বাচন কমিশন সবার জন্যই বড় ধরনের পরীক্ষা। জয়লাভের জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি গ্রহণ ও প্রচেষ্টা করা হবে। কারণ সিটির ফলাফল জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রংপুর, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুরে প্রার্থীদের মধ্যে বড় ধরনের কোন্দল রয়েছে যা সামাল দিতে পারছে না আওয়ামী লীগ। অথচ কুমিলস্নায় কোন্দল নিরসন করতে না পারায় দলের প্রার্থীকে পরাজিত হতে হয়েছে। তাই এবার এ বিষয়টিকে গুরম্নত্ব দিচ্ছে ক্ষমতাসীনরা।
যদিও এসব তৎপরতার মাঝেই অনেক জায়গায় দলের অভ্যন্ত্মরীণ কোন্দল প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। রংপুরে সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু ও মনোনয়ন বঞ্চিত আওয়ামী লীগ নেতা রাশেক রহমানের দ্বন্দ্ব প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছে স্থানীয় নেতারা। এর মধ্যে তার সঙ্গে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী মোস্ত্মাফিজুর রহমান মোস্ত্মফার বৈঠককে ঘিরে রংপুরে তোলপাড় শুরম্ন হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে বইছে সমালোচনার ঝড়। তবে রাশেক রহমান ও মোস্ত্মাফিজার রহমান এটি সৌজন্য সাক্ষাৎকার বলে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন।
সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাবেন এটা মোটামুটি নিশ্চিত। এর বাইরে সিলেট নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ প্রায় এক বছর ধরে তৎপর। ‘আসাদ ভাইকে মেয়র পদে দেখতে চাই’ শিরোনামে পোস্টার, বিলবোর্ডও চোখে পড়ে নগরজুড়ে। এছাড়া অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাহি উদ্দিন আহমদও নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করতে চান।
বরিশালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুলস্নাহর বড় ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুলস্নাহ, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম আব্বাস চৌধুরী ও সহ-সভাপতি আফজালুল করীম, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জাহিদ ফারম্নক, প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেনের স্ত্রী সাংসদ জেবুন্নেছা আফরোজ, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছোট ছেলে খোকন সেরনিয়াবাত। একাধিক প্রার্থী ও সাদিক আবদুলস্নাহর সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের একটি অংশের কোন্দল ভোটে ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন স্থানীয় নেতারা।
গাজীপুরে গতবার দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন পরাজিত প্রার্থী গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উলস্নাহ খান। সেবার এক রকমের জোর করে দলের অপর প্রার্থী গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে বসিয়ে দেয়া হয়। গতবারই এর প্রভাব ভোটে পড়েছিল। স্থানীয় নেতারা জানান, এবারও দুজনই মেয়র পদপ্রার্থী এবং উভয়ের রেশারেশি ভোটে প্রভাব ফেলবে।
এদিকে এই নির্বাচনগুলো আগামী বছরের মার্চ বা এপ্রিলে আবার ৫ মে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি। যদি পাঁচ সিটির নির্বাচন এপ্রিলে হয় তাহলে হেফাজতের কর্মসূচিতে নেতিবাচক প্রভাব নির্বাচনে পড়বে বলে মনে করছে দলটির নেতারা। এক্ষেত্রে বিএনপি যেন হেফাজতকে উস্কানি দিয়ে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে মাঠে না নামাতে পারে সেজন্য সচেষ্ট থাকবে আওয়ামী লীগ। কওমি শিক্ষার স্বীকৃতিসহ অনেকগুলো দাবি পূরণ করার পরও ৫মের ইসু্যতে হেফাজত সরকারের পক্ষে থাকবে না মনে করেন দলের নেতারা।
এ বিষয়ে ফারম্নক খান বলেন, অনেকেরই ইচ্ছা থাকে এমপি বা মেয়র হওয়ার। সে অনুযায়ী তারা প্রচারণাও চালান। তবে দলের মনোনয়ন দেয়ার পর সবাই এক সঙ্গে দলের হয়ে কাজ করবেন এটা প্রত্যাশা। আর তা যদি কেউ না করেন বিপক্ষে ভূমিকা রাখেন তাহলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোন্দলের কারণে পরাজয় চান না তারা। হেফাজতের ভূমিকার বিষয়ে তিনি বলেন, তাদের ভোটের হিসেব তারা করছেন না এবং ভোট পাওয়ার আশাও করেন না।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, আসন্ন ছয়টি সিটি করপোরেশনে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করবেন চার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ছয় সাংগঠনিক সম্পাদক। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ সিলেটে; ডা. দীপু মনি গাজীপুরে; অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক রাজশাহী ও রংপুরে এবং আবদুর রহমান বরিশাল ও খুলনা সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে থাকবেন। সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে আহমদ হোসেন সিলেটে; বি এম মোজাম্মেল হক রংপুরে; আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বরিশালে; আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন খুলনায়; খালিদ মাহমুদ চৌধুরী রাজশাহীতে এবং ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল গাজীপুর সিটি করপোরেশনে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করবেন।
ইতোমধ্যে তারা কাজও শুরম্ন করেছেন। তারা জানান, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেটে দলের শক্ত প্রার্থী ও জয়ের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী হলেও বিএনপিকে খাটো করে দেখছেন না তারা। বর্তমানে যেহেতু পাঁচ সিটির মেয়ররা বিএনপির সেজন্য প্রভাব ও জনসমর্থন বেশি ধরেই হিসেব কষছে আওয়ামী লীগ। আর দলীয় কোন্দল যাতে কোনো প্রভাব না ফেলে সে জন্য তা সমাধানের চেষ্টা করা হবে।
কিন্তু একদিকে জনপ্রিয়তা পুনরম্নদ্ধার করে ভোটে জয়লাভ করা অপরদিকে দলীয় কোন্দল মিটিয়ে সব নেতাকর্মীকে কাজে লাগানো ও নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখাকে বেশ কঠিন হিসেবেই ভাবছে দলটি। তবে নেতারা আশাবাদী।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও প্রার্থী বাছাই কমিটির সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, এখন স্থানীয় নির্বাচনকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, এগুলোতে দলীয় প্রতীকে ভোট হয়। জাতীয় নির্বাচনের আগে হওয়ায় এর গুরম্নত্ব আরও বেড়ে গেছে। যত বেশি জয়, তত বেশি কর্মীরা উজ্জীবিত হবেন।
সূত্রঃ যায়যায়দিন