যে সব কারণে নারী মাদকাসক্ত হয়!
নারীরা মাদকাসক্ত হয় অসত্ বন্ধুর প্ররোচনায়
৩১ অক্টোবর ২০১৫।।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সাজিয়া (ছদ্মনাম)। বয়স ২২ বছর। বাড়ি জামালপুর জেলায়। বর্তমানে থাকেন লালমাটিয়ার ই-ব্লকের একটি প্রাইভেট হোস্টেলে। একান্ত আলাপচারিতায় সাজিয়া জানান, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার সময় প্রথমে স্রেফ মজা করে সিগারেটে দুই এক টান দিতাম। তারপর একদিন গেলাম গুলশানের একটি সীসা বারে। মজা পেয়ে সেখানে আরো চার/পাঁচবার গিয়েছি। একদিন এক বন্ধু লাল একটি ট্যাবলেট হাতে দিয়ে বলল: ‘বল দেখি এটা কি?’ আমি বলি, ‘ইয়াবা’। ট্যাবলেটটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে টপ করে মুখে দিয়ে গিলে ফেললাম। খাওয়ার পর বন্ধুদের বললাম, ‘আমাকে চা খাওয়া, নেশা যেন বেশি না হয়।’ কিন্তু ১০/১৫ মিনিট পরেই বুঝতে পারি শরীরটা কেমন জানি হাল্কা হয়ে আসছে। প্রথমে কিছুটা ভয় কাজ করলেও, একটু পরে বেশ মজাই লাগছিল। এরপর মাঝে-মধ্যে সেবন করতাম। এখন নিয়মিত মাদক না হলে চলে না।
সাজিয়া বলেন, সঙ্গদোষে তার জীবনটাই এলোমেলো হয়ে গেল। ইচ্ছা করলেই আগের সেই দিনগুলো আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, মাদকাসক্ত কোন মানুষের সঙ্গে মেশা উচিত নয়। তাহলে আজ হোক কাল হোক ওই মাদক তাকে স্পর্শ করবে একদিন। কৌতূহলবশত দু’য়েকদিন হাতে নেয়ার পর সেই মাদক একসময় নিজের সঙ্গী হয়ে যাবে। এ ধরনের বন্ধুদের সংস্পর্শে না এলে কোনোদিন মাদক চিনতামই না।
মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকার ১৪ বছর বয়সী রেশমা (ছদ্মনাম)। ছোটবেলায় তার বাবা-মা মারা যান। পাড়ার বন্ধুদের সংস্পর্শে এসে সে প্রথমে ড্যান্ডি ও ঘুমের ওষুধ, পরে ইয়াবা সেবন শুরু করে। একইভাবে পুরানো ঢাকার আনুমানিক পঞ্চাশোর্ধ্ব আনোয়ারা বেগম (ছদ্মনাম)। ডিপ্রেশন থেকে পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে ঘুমের ট্যাবলেট কিনে খেতেন। একপর্যায়ে তিনি বাসায় পাড়ার যুবক ও নিকট আত্মীয়দের কাছে ইয়াবা ট্যাবলেট পান এবং ইয়াবাতে আসক্ত হয়ে পড়েন। বখাটে বন্ধুদের সাহচর্যে এসে মাদকাসক্ত হয়েছিল ২০১৩ সালে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এসবি পুলিশ ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও স্বপ্না রহমানের একমাত্র কন্যা ঐশী রহমান। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মাদকাসক্তরা মাদকের জন্যে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে অনেক ধরনের নৃশংস ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। মাদকাসক্ত হয়ে ঐশি যেমন হত্যা করেছিল তার জন্মদাতা বাবা-মাকে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) গবেষণা ও তথ্য অনুযায়ী, মাদকাসক্ত ৮০ ভাগ নারী বখাটে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। নারীরা এই জগতে পা বাড়ায় মাদকে অভ্যস্ত বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে। আড্ডার মাঝে ‘স্মার্টনেস’ দেখাতে গিয়ে ছেলেবন্ধুদের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে তাতে টান মারে। মূলত সেখান থেকেই হয়ে যায় নেশার জগতে ঢোকার ‘হাতেখড়ি’। বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) পরিচালিত-২০১২ সালের জরিপে দেখা গেছে, এ দেশে মাদকাসক্তদের ৭৯ দশমিক ৪ শতাংশ পুরুষ ও ২০ দশমিক ৬ শতাংশ নারী। অর্থাত্ মোট মাদকাসক্তের পাঁচ ভাগের এক ভাগই নারী। অন্যদিকে জাতিসংঘের এক জরিপ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে ৬৫ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত। সেই হিসেবে এ দেশে ১৩ লাখের বেশি নারী কোন না কোন মাদক সেবন করছেন। বেসরকারি তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৬০ লাখের বেশি। এর মধ্যে নারী ৫ লাখ।
ঢাকা আহসানিয়া মিশনের নারী মাদকাসক্ত নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট (কাউন্সিলর) জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, গত একবছরে ৬৮জন নারী এই কেন্দ্র থেকে চিকিত্সা নিয়ে ফিরে গেছেন। বর্তমানে আছেন ১৪ জন নারী। এদের কেসস্টাডি থেকে জানা যায়, বেশিরভাগই বখাটে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাদক সেবন শুরু করে এবং একপর্যায়ে নিজেই আসক্ত হয়ে পড়েন। এর বাইরে কৌতূহল থেকে, স্বামী কিংবা প্রেমিক দ্বারা প্রতারিত হয়ে, পারিবারিক অশান্তি, হতাশা, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, নৈতিকতার অভাব ইত্যাদি কারণেও মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে অনেকে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে-১৯৯০ অনুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে বিনা খরচে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিত্সা করানোর দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু পুরুষ মাদকাসক্তদের জন্য কিছু নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র থাকলেও সরকারিভাবে নারী মাদকাসক্তদের জন্যে সারাদেশে কোন ব্যবস্থা নেই। বেসরকারিভাবে কিছু নারী মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র থাকলেও তা ব্যয়বহুল। তবে ২০১৪ সালের ১২ এপ্রিল দেশে প্রথমবারের মতো শুধু নারী মাদকাসক্ত নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র চালু করে ঢাকা আহসানিয়া মিশন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের ২০টি জেলায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত বেসরকারি মাদকাসক্ত নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র আছে ৬৯টি।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল ইত্তেফাককে বলেন, মেয়েরা অসত্ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে কিংবা অসত্ প্রেমিকের সঙ্গে মিশে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। অনেক সময় ফাস্টফুডের দোকানে কোকের বোতলেও মাদকদ্রব্য মিশিয়ে অসত্ বন্ধুরা মেয়েদের আসক্ত করে থাকে। মেয়েদের সচেতন হতে হবে।
ঢাকা আহসানিয়া মিশনের ডেপুটি ডিরেক্টর ইকবাল মাসুদ বলেন, সেন্টারে তিনমাস ধরে অবস্থান করে আবাসিকভাবে চিকিত্সা নেয়ার মানসিকতা এখনো আমাদের সমাজে গড়ে ওঠেনি। আর সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে বড় কোন উদ্যোগ নেই। অন্যদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর জাফরুল্লাহ কাজল বলেন, মাদকাসক্ত নারীদের জন্য সরকারিভাবে কোন চিকিত্সা ব্যবস্থা নেই। তবে ১০০ শয্যার হাসপাতাল চালু হলে সেখানে নারীদের চিকিত্সার ব্যবস্থা থাকবে বলে জানান।
উৎসঃ ittefaq
