কোথায় আছে গুম হওয়া শিবির নেতা শাফিউল?
শাফিউল কোথায় আছে, কেমন আছে কেউ তা সঠিকভাবে জানেনা। তবে আমি কিছুটা কল্পনা করতে পারি হয়তো ।
ঢাকার মিন্টু রোডের ডিবি অফিস। নিচ তলার অস্ত্রাগারের পাশের ছোট্ট দুই রুমের কোন একটিতেই আছে শাফিউল। বামের রুমটা বেশি অন্ধকার, ময়লা আবর্জনাযুক্ত কিছু কম্বল মেঝেতে বিছানো। খোলা বাথরুমের দরজাটা নিচের থেকে অনেকটা ভাঙা। শরীরের সাথে শরীর লাগিয়ে যেখানে সর্বোচ্চ দশজন শুইতে পারে, সেখানে তারা রাখে বিশ জনেরও বেশি। শাফিউল হয়তো সেখানেই আছে। হাত, পা, কোমরের বিভিন্ন জোড়ায় ইতোমধ্যে কয়েকদফা বেদম লাঠিপেটার নির্মম যন্ত্রনা (ন্যুনতম ও সম্মানজনক কষ্ট) নিয়ে হয়ত কাতরাচ্ছে সে।
ওরা আমাকেও এখানে রেখেছিল ৩ দিন ৩ রাত।
অথবা শাফিউল আছে এর পাশের রুমেই। এই রুমটাতে অন্যটির চেয়ে একটু বেশি আলো আছে। মেঝে মোজাইক করা। এখানে কোন কম্বল নেই। রুমটা একটু বড় এবং বাথরুমটা অন্যটার চেয়ে একটু পরিস্কার। বড় মাপের নেতা ও ভিআইপিদের ডিবি এখানেই রাখে। পাশেই অস্ত্রাগার। ডিবি কর্মকর্তাদের অস্ত্র নেয়া ও অস্ত্র জমা দেয়ার শব্দ এখান থেকে পরিস্কার শুনা ও বুঝা যায়। এখানে শিবিরের সাবেক সভাপতি সাঈদী ভাই ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, আমারদেশ সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমান এবং দেশ খ্যাত টপ লেভেলের কিছু সন্ত্রাসীসহ আমাকেও এক রাত এক দিন থাকতে হয়েছিল।
শাফিউল যদি বেঁচে থাকে এখনো (প্রাত্যাশা ও দোয়া তাই) তাহলে এ দু’রুমের কোন একটিতেই আছে। প্রথমটাতে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। দিনে দু ‘একবার করে হয়ত তাকে দু তলার ডিবি অফিসারদের কোন একটি রুমে নিয়ে চোখ বেধে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নানা রকম নির্যাতন করা হচ্ছে। দু-তিন ঘন্টা নির্যাতনের পর পাঁজাকোলা করে নিয়ে এসে আবার এই রুমের মেঝেতেই ধপাস করে ফেলে দিচ্ছে হয়তো । পায়ের উপর ভর করে বাথরুমে যেতে পারছে কিনা জানিনা। পাশে কোন দরদী আসামী বা অন্য কেউ থাকলে হয়ত তাকে সাহায্য করছে।
পাশের অস্ত্রাগারের অস্ত্রের শব্দ শুনতে শুনতে সে হয়তো প্রস্তুতি নিয়েই আছে যে কোন সময় একটি বুলেটই তার প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। ময়লা মেঝেতেই সিজদা করতে করতে মাবুদের কাছ থেকে আমলের ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য মাফ চেয়ে নিচ্ছে। পরবর্তী জিজ্ঞাসাবাদে কি প্রশ্ন করতে পারে, তার সম্ভাব্য উত্তর গুলো হয়তো এলোমেলোভাবে মাথায় সাজিয়ে নেবার চেষ্টা করছে। সে হয়ত কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। কিন্তু চোখের পানি এখন আর পড়ছে না। শুকিয়ে যাবার কথা অনেক আগেই।
না, শাফিউল তার নিজের প্রাণের মায়ায় কিংবা আঘাতের যন্ত্রনায় কাঁদছেনা। সে কাঁদছে তার সন্ধানে পাগলপারা ও কান্নার নোনাজলে ভেসে যাওয়া তার মা ববার কথা ভেবে। যাদের জন্য সে এ পৃথিবীর আলো দেখতে পেরেছে, সেই বাবা মা নাজানি কি কষ্টে আছেন তাকে না পেয়ে। কাঁদত কাঁদতে, না খেয়ে, না ঘুমিয়ে নাজানি কি এক অসহ যন্ত্রনায় সময় পার করছেন তারা। এ সময়টাতে মাবুদের পর সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে এই মা বাবার কথাই। তারপর আন্দোলন, সংগঠন ইত্যাদি।
এই গুম হয়ে থাকা সময়ের চেয়ে অসহায় কোন সময় মানুষের জীবনে আসে কিনা আমার জানা নেই। সারাদিন মটর সাইকেল হাকিয়ে রাজধানী ঢাকার কিংবা দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়ানো যার কাজ, সে আজ জানেইনা বাইরে কি হচ্ছে। জেল থেকে অনেক কিছু জানা গেলেও ডিবি অফিস বা তাদের টর্চার সেল থেকে কিছুই জানার সুযোগ নেই।
শাফিউলের আগে কত শত ভাই, কত নেতা এভাবে এই স্থানে থেকে নির্যাতনের স্টীমরোলার সহ্য করেছেন তার হিসাব হয়তো কোন দিন কেউ জানবেনা। কত মজলুম ভাই, কত নিষ্পাপ তরুন এখান থেকে ফিরে আসতে পারেন নি। টীমে (ডিবির ভাষা) নেয়ার কথা বলে রাতের অন্ধকারে দূরে কোথাও নিয়ে হায়েনারা ঝাঝরা করে দিয়েছে তাদের তরতাজা বুকগুলো। মিডিয়ার সামনে সাজিয়েছে ক্রসফায়ারের গল্প। কারো লাশ পাওয়া গেছে পরিত্যক্ত অবস্থায় কোন খাল, মাঠ বা নর্দমার পাশে। কারো লাশ খুজেই পাওয়া যায়নি এখনো। ইতিহাসের কোন পাতায় হয়তো কোনদিন খুঁজে পাওয়া যাবেনা এদের কাহীনি।
কেউ কেউ আবার মাবুদের ইচ্ছায় নতুন জীবন ফিরে পাবার মত করে এখান থেকে ফিরে এসেছেন। দেখে এসেছেন কিছু নরপিশাচদের ভয়ংকর কিছু চেহারা। মানুষের রুপে এই সমাজে ঘুরে বেড়ানো কিছু মানুষ, ডিবি অফিসের চার দেয়ালের ভেতরে অসহায় বন্দী মানুষের সাথে কেমন ভয়ানক হিংস্র জানোয়ারে পরিণত হতে পারে, তার সাক্ষী হয়ে এসেছেন তারা। মিডিয়ার সামনে মিষ্টি ভাষায় বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলা মানুষগুলো যে একেকটা কত বড় মাপের কিলার,
পরিস্থিতির শিকার না হলে নিজেও হয়ত কোন দিন বিশ্বাস করতে পারতাম না।
যাই হোক, শাফিউল, তার ভাই ও দলের অন্য কর্মীরা সুস্থভাবেই ফিরে আসুক তাদের মায়ের কোলে, প্রাণভরে এই দোয়াই করছি।
।।আবু সালেহ ইয়াহইয়া।।