আসুন সাংবাদিক পেটাই…!
সাংবাদিক পেটানো এখন অনেকের কাছে একটা বীরত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে হয়। তাই বাংলাদেশে সাংবাদিকরা এখন অপরাধীদের কমন টার্গেট।
এটা একদিনে হয়নি। দীর্ঘদিনের অপরাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হিসেবে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সামান্য একটু সুযোগ-সুবিধা নিতে শাসকগোষ্ঠীর কাছে নতজানু হয়ে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছেন সমাজের বিবেক বলে পরিচিত সাংবাদিকদের একটি বড় অংশ।
নানা ঘটনা পরিক্রমায় জানা অথবা অজানা শঙ্কায় সেলফ সেন্সরশিপের বৃত্তের মধ্যে সাংবাদিক সমাজ। বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীনরা সব সময় চান গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। সেটাই স্বাভাবিক। ভয়াবহ এই অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে ব্যতিক্রম দু-একটি ছাড়া বাকি সব গণমাধ্যম। পেশাদারিত্বের জায়গাটাকে বড় বেশি ক্ষয়িষ্ণু করে তোলা হয়েছে।
হালুয়া রুটির ধান্ধায় বহুধা বিভক্ত সাংবাদিক সমাজ। আদর্শিক ঐক্যের জায়গাটি ভঙ্গুর হয়ে পড়ায় সন্ত্রাসী-দুর্নীতিবাজ-আমলা-প্রশাসন-মাদক ব্যবসায়ী-কালো টাকার মালিক-অসৎ রাজনীতিবিদ-পুলিশের অতি উৎসাহী সদস্য থেকে শুরু করে সুবিধাবাদী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রত্যেকের টার্গেট তাই সাংবাদিকরা। এমন কি হলুদ সাংবাদিকদের টার্গেটও আদর্শবান সাংবাদিকরা। আর ট্রাম্প প্রশাসন থেকে শুরু করে ভারত উপমহাদেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর কাছে সাংবাদিকরা যে কতখানি চক্ষশূল তা বলাবাহুল্য।
জাতিসংঘের ইউনেস্কোর হিসাব বলছে, সারা বিশ্বে প্রতি পাঁচ দিনে কর্তব্যরত অবস্থায় একজন করে সাংবাদিক নিহত হন। গত দেড় যুগে বাংলাদেশে অন্তত ৪০ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন (বিভিন্ন পত্রিকার সূত্র অনুযায়ী)। আহত কিংবা নির্যাতনে শিকার হচ্ছে প্রতিদিন অসংখ্য সাংবাদিক। আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স ‘উইদাউট বর্ডার্সের ২০১৭’-এর বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, মুক্ত সাংবাদিকতায় ১৮০টি দেশের মধ্যে ওপর থেকে নিচ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬তম।
সংস্থাটির হিসাবে ২০১৬-এর তুলনায় এটি আরও দুই ধাপ নেমেছে। আর এখন থেকে প্রায় এক যুগ আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ২০০৫ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫১-তে। নিউইয়র্কভিত্তিক সংস্থা প্রোটেক্ট টু জার্নালিস্টের তথ্য বলছে, বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক হত্যাকারীদের দায়মুক্তির ক্ষেত্রে ২০১৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১-তে (ভয়াবহতার তীব্রতায় ওপর থেকে নিচে)।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে বলে মনে করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন আর্টিকেল-১৯।
এটির গত বছরের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার ৩৫৫ বার লঙ্ঘিত হয়েছে। ২০১৫ সালে প্রকাশিত সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে সাংবাদিক নির্যাতনের হার ছিল ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে এই হার হয়েছে ৩৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তবে অন্য দেশে সাংবাদিক নির্যাতন হলেও গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হাত গুটিয়ে বসে থাকে না।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত ৯ জুলাই দিল্লি গেটের ছবি তোলার সময় পুলিশি হামলার শিকার হন ‘হিন্দু ডেইলী’র এক ফটোসাংবাদিক। দেশটির প্রেস কাউন্সিল এই অভিযুক্ত ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের শাস্তি চেয়ে নোটিস পাঠায় দিল্লির পুলিশ কমিশনারের কাছে। কারণ, সেখানে জবাবদিহির সংস্কৃতি বিদ্যমান। সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশেও যে ‘প্রেস কাউন্সিল’ বলে কোনো একটা সংস্থার অস্তিত্ব রয়েছে সাধারণ সাংবাদিকরা জানেনই না। কারণ হলো সংস্থাটির নিষ্ক্রিয়তা।
কিছুদিন ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং নির্যাতনের খবর পাওয়া যাচ্ছে একের পর এক। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের খবর সংগ্রহের সময় গত শনিবারের পর রোববারও রাজধানীতে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয় ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডারা। এ অভিযোগ হামলার শিকার সাংবাদিকদের। কেবল রোববারের হামলাতেই অন্তত এক ডজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
আহত সাংবাদিকদের মধ্যে ৫ জনের অবস্থা গুরুতর। তাদের একজন জানিয়েছেন, ‘ক্যামেরা দেখলেই তেড়ে আসছিলেন তারা। মাথায় তাদের হেলমেট আর হাতে লাঠিসোঁটা, রড। কারও হাতে রামদা-কিরিচের মতো ধারালো দেশীয় অস্ত্র। পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে চলছিল যুবকের দলটি। নিরাপদ সড়কের দাবিতে মাঠে নামা শিক্ষার্থীদের ধরে ধরে পেটাচ্ছিলেন তারা। এ সময় সাংবাদিকদের বেধড়ক পেটানো হয়েছে, ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে’।
অদ্ভুত বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, অন্য আর দশটি সন্ত্রাসী হামলার খবর যতটা গুরুত্ব দিয়ে গণমাধ্যমগুলো প্রচার করে, রোববার সাংবাদিকদের ওপর দুর্বৃত্তদের ভয়াবহ হামলার খবরটি ছিল ততটাই গুরুত্বহীন। আমি জানি না এই খবরটি প্রচার অথবা প্রকাশে সরকারের ওপর মহল থেকে কোনো ধরনের নেতিবাচক নির্দেশনা ছিল কি না। অথবা স্বনিয়ন্ত্রিভাবে সাংবাদিক নির্যাতনের ওই খবরটি অনেকখানি চেপে যাওয়া হয়েছে কি না তাও জানি না। দুটির যে কোনো একটি হলেও সেটিই গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে সরকারের সরাসরি চাপ বলে ধরে নিতে হবে।
এতে করে ক্ষমতাসীনরা সাময়িক সুবিধা আদায় করতে পারে বটে। কিন্তু পরিণতি কখনোই সুখকর হয়নি কারোর জন্য। আধুনিক সভ্যতায় এই তথ্যপ্রযুক্তি যুগে কোনো সংবাদই চাপা থাকে না। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের হামলার খবরই যদি সাংবাদিকরা প্রকাশ করতে না পারেন সাধারণ মানুষের মনে গুজব ছড়াবে আরও বেশি। তাতে অস্থিতিশীলতা আরও দ্রুত ঘনীভূত এবং ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
পৃথিবীর বুকে ইতিহাস জাগানিয়া এক আন্দোলনের নাম বাংলাদেশের ‘কিশোর আন্দোলন’, যা এরই মধ্যে পুরো বাংলাদেশকে নাড়া দিয়েছে। অথচ সহজ-সরল নিরীহ কিশোর-তরুণরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারেনি রাজপথে নামার দুদিনের মাথায় ছিনতাই হয়ে যায় তাদের আন্দোলন। সরকারবিরোধীরা আন্দোলনকারীদের কাঁধে ভর করে সরকার উৎখাতের স্বপ্নে অনেক ধরনের ষড়যন্ত্র করতে থাকে। কোমলমতি শিশু-কিশোর-তরুণদের রাজপথে উচ্ছৃঙ্খল আচরণে উৎসাহিত করতে থাকে।
পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করতে ষড়যন্ত্রকারীরা বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়াতে থাকে। গুজব ছড়িয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারে তারা খানিকটা সফলও হয় এবং তাদের ফাঁদে সরকারও পা বাড়াতে থাকে। শুরুর দিকে সরকার যথেষ্ট সহনশীলতা এবং সতর্কতা অবলম্বন করলেও পরে এসে আন্দোলন দমাতে বল প্রয়োগের চেষ্টা করে কোথাও কোথাও।
রাজধানীসহ দেশের বেশকিছু জায়গায় দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ, সঙ্গে ছাত্রলীগের ক্যাডার বাহিনী। শুধু রাজধানীতেই আহত হয় কয়েকশ ছাত্র। এক পর্যায়ে সাংবাদিকদের ওপর ঘটতে থাকা ন্যক্কারজনক হামলাগুলোর পর মনে হচ্ছে সরকার এবার সত্যিই বিএনপির ফাঁদে পা দিল।
কারণ, তাদের উদ্দেশ্য সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলা। কথাগুলো ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে থাকা মানুষগুলোর কাছে ভুল মনে হতে পারে। যদি তাই হয় গণমাধ্যমকে চাপে রাখার পাশাপাশি সাংবাদিক পেটালেই যদি সব ঠাণ্ডা রাখা যায় তবে আসুন, আমরা একযোগে সাংবাদিক পেটাই!
মঞ্জুরুল আলম পান্না : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
monjurpanna777@gmail.com