অনিয়মের পুরনো ‘নিয়মে’ ফিরল ঢাকা
২৯ জুলাই কয়েকটি বাসের রেষারেষিতে প্রাণ গেল শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম ও দিয়া খানম মীম। সেই প্রতিবাদে ৯ দিন পর্যন্ত উত্তপ্ত থাকল রাজপথ। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পথে পথে দাঁড়িয়ে দেখিয়ে দিলো, চাইলেই নিয়মে আনা যায় এই বিশৃঙ্খল শহরকে। মাত্র দুই দিনের ব্যাবধানে কোথায় সেই সুশৃঙ্খল শহর? কোথায় নিয়মের অধীনে আসা জনতা যারা রাজপথের আন্দোলনের জোর সমর্থন জানিয়েছিলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে? আসলেই কি এমন ঘটনা ঘটেছিল, না কি তা ছিল কোনো স্বপ্ন?
পল্টন মোড় থেকে বিজয়নগর। পথচারীদের সুবিধার্থে চওড়া করা হয়েছে ফুটপাথ। সেও বছর ঘুরতে চলল। তারপরেও পথজুড়ে ইতস্তত হেঁটে বেড়াচ্ছেন পথচারীরা। তাদের একজন বছর ১২’র কিশোর আহাদ। সে কাজ করে এখানকারই একটি রেস্টুরেন্টে। ফুটপাথ থাকতে রাজপথে কেন হাঁটছে— জানতে চাইলে আহাদের বক্তব্য, ফুটপাথ সব দোকানের মালপত্রে ঠাসা। যেটুকু খালি, তা দিয়ে চলছে মোটরসাইকেল। ফুটপাথে উঠলেই কি আর নিরাপত্তা মিলবে? তারচেয়ে রাজপথেই হাঁটা যাক!
আহাদের অভিযোগ নেহায়েত মিথ্যে নয়। তার সঙ্গে আলাপচারিতার ফাঁকেই একজন চালক মোটরসাইকেল দাপিয়ে চলে গেলেন ফুটপাথ ধরে। কিছুদূর এগিয়ে যখন মোটরসাইকেলগুলো ফুটপাথ থেকে নামার চেষ্টা করছে, সেখানে তৈরি হওয়া জটলার রেশ ধরে একটা জ্যাম হয়েছে ফুটপাথেও!
এই পথে প্রতিটি ফুটপাথে বসানো রম্পার। এই রম্পার দিয়েই যেকোনো জায়গায় তুলে দেওয়া যায় বাইক। চওড়া ফুটপাথ পার হয়েও প্রায় একফুট পথ দখল করে রেখেছে এই রম্পার। দেখেও না দেখার ভান করছেন সেখানে থাকা ট্রাফিক সার্জেন্ট নুরুজ্জামান।
এদিকে, নাইটিংগেল মোড়ের প্রতিটি প্রান্তে যানবাহন দখল করে আছে জেব্রা ক্রসিং। পথচারীরা এদিক-ওদিক দিয়ে কোনোমতে পার হচ্ছেন রাস্তা। সারাবাংলা’র ক্যামেরা তাক করতেই সার্জেন্ট নুরুজ্জামান তার কনস্টেবলদের নির্দেশ দিতে থাকেন জেব্রা ক্রসিং খালি রাখতে। এর আগে কেউ খেয়ালই করেননি, সিগনালে জেব্রা ক্রসিং পার করেও দাঁড়িয়ে ছিল যানবাহন।
সার্জেন্ট নুরুজ্জামানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ক্যামেরার উপস্থিতিতেই সার্জেন্টের চোখ এড়িয়ে জেব্রা ক্রসিংয়ে এসে পড়ছে গাড়ি। তারা বরং বিরক্ত সার্জেন্টের ওপর। দুয়েকজন তো বলেই বসলেন, আন্দোলন শেষ না? আবার কী!
একই চিত্র হোটেল ৭১’র গেটে। সেখানে রম্পার ধরে একটি গাড়ি দিব্যি পার্ক করে রাখা হয়েছে ফুটপাথে। গাড়ির চালক গাড়ি ধরেই দাঁড়িয়ে। অথচ টিপটপ এই হোটেলটির নিজস্ব পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
সেখানে কর্তব্যরত গার্ড রায়হানকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, গাড়ির মালিক মাত্র ১০ মিনিটের জন্য ওপরে কাজে গিয়েছেন। এখনই তিনি নেমে আসবেন। যদিও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও দেখা মেলেনি তার।
সেই পথেই অনেকগুলো গাড়ি মেরামত ও সজ্জার দোকান। ফুটপাথে তো জিনিস তারা রেখেছেনই, সোফা পেতেও বসে পড়েছেন সেখানে। যেন এটা ফুটপাথ নয়, এটা তাদের বাড়ির বৈঠকখানা। ক্যামেরা দেখেও বিচলিত নয় কার প্যালেস নামে দোকানের দোকানিরা। উল্টো আরও অনুরোধ করেন, তাদের ছবি যেন ভালোভাবে তোলা হয়! এও বলতে ভুলে না, এইসব ছবি দিয়ে কোনো কিছুই হবে না। জায়গামতো ম্যানেজ করা আছে। পারলে যেন কিছু করে দেখানো হয়।
একমাত্র পরিবর্তন দেখা যায় পাঠাও মোটরবাইকে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের কারণেই হোক আর পুলিশ সপ্তাহের কারণেই হোক— মোটরসাইকেলের প্রায় সব চালক ও আরোহীর মাথায় দেখা যায় হেলমেট। এমনকি যেসব বাইকে আরোহী নেই, সেগুলোর পেছনেও ঝুলছে হেলমেট।
একজন পাঠাও বাইকচালক মোহাম্মদ বশির শেখ সারাবাংলা’কে জানান, চলমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পাঠাও কর্তৃপক্ষ পাঁচ দিন হলো অতিরিক্ত একটি হেলমেট দিয়েছেন তাদের। এর আগে প্রতিবারই পাঠাও কর্তৃপক্ষ চালকদের একটি অতিরিক্ত হেলমেট কেনার তাগাদা দিত বলে জানান তিনি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাফিক পুলিশের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল আলম সারাবাংলা’কে বলেন, ‘ট্রাফিক নিয়ম মানার বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশ দীর্ঘ সময় ধরে মানুষকে সচেতন করে আসছে। আমরা নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করি, জরিমানা করি। কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণ একটু কমে গেলেই যে যার মতো করে পথে চলাচল করতে শুরু করে।’
ফুটপাথ দখল এবং ফুটপাথে গাড়ি পার্ক করার বিষয়ে ট্রাফিকের ভূমিকা খুব কম জানিয়ে রেজাউল আলম বলেন, ফুটপাথের অভিভাবক সিটি করপোরেশন। আমরা উপযাচক হয়ে যখন ফুটপাথে শৃঙ্খলা আনতে চাই, তাদের সঙ্গে আমাদের মনোমালিন্য হয়।
রাস্তায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ট্রাফিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি উল্লেখ করে পুলিশের এই অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ‘সবাই নিজের মতো আইন মানলে এই সমস্যা হয় না। সবাই মিলে যদি আমরা চেষ্টা করি, তবেই ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।’
সারাবাংলা