মমতা সরব আমরা নীরব কেন?
ভারতকে হিন্দুত্ববাদী তথা ‘রামরাজত্ব’ কায়েমের কৌশল নিয়েছে বিজেপি। মুসলিমসহ সে দেশের সংখ্যালঘু নাগরিকদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে ৩০ শে জুলাই আসামে এনআরসি’র চূড়ান্ত খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে ৪০ লক্ষাধিক মানুষকে তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ তারা ভারতের নাগরিক নন। এসব মানুষকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী। এর বেশির ভাগই হলেন বাংলাভাষী মুসলিম। মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যা এবং তাদের বাংলাদেশে তাড়ানোর কর্মসুচির মতো যদি আসাম ৪০ লাখ মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন করে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়, তাহলে আমাদের অবস্থা কেমন হবে? এখানে উল্লেখ, মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিমদের ‘সন্দেহজনক নাগরিক’ হিসেবে চিহ্নিত করে আদমশুমারির গণনা থেকে বাদ দেয়। ১৯৮১ সালের আদমশুমারিতে রোহিঙ্গারা শুধু গণনা থেকেই বাদ পড়েনি; তাদের বিদেশি (বাংলাদেশী) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৮২ সালে বার্মার নাগরিকত্ব আইনে তিনটি স্তর করা হয়। বিচিত্র ও অভিনব এই আইনে প্রথম শ্রেণির নাগরিকদের ‘জাতীয় নাগরিক’ হিসেবে চিহ্নিত; দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকদের ‘সহযোগী নাগরিক’ হিসেবে বর্ণনা; এবং তৃতীয় ধাপে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ‘অনুগত’ হিসেবে ‘একশ্রেণির নাগরিক’ চিহ্নিত করা হয়। তৃতীয় স্তরের নাগরিকদের সংজ্ঞায়িত ও সুযোগ-সুবিধার পরিধি হলো; যারা ব্রিটিশ-পূর্ব বার্মায় বসতি স্থাপন করেছে তারা জাতীয় নাগরিক; যারা ১৯৪৮ সালের নাগরিকত্ব আইনের আওতায় আবেদন জমা দিয়েছে তারা সহযোগী নাগরিক; এবং ১৯৪৮ সালের নাগরিকত্ব আইনে যারা আবেদন করেনি তারা অনুগত শ্রেণি নাগরিক। মিয়ানমারে নাগরিকত্ব নির্ধারণের এই ‘অপকৌশল’ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাংলাদেশে তাড়িয়ে দিয়ে। সুদূর প্রসারী চিন্তা থেকে ভারতের আসাম সরকারও সে পথে হাটছে। আসামের পর হয়তো আরো অন্যান্য রাজ্যে বিজেপি এভাবে মুসলিমদের বিতারণের ‘ছক’ তৈরি করবে।
বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তের ওপারে ভারতের আসাম রাজ্যে জনসংখ্যা ৩ কোটির কিছু বেশী। ভাষাগত ভাবে ৫৮ শতাংশ মানুষ ‘অহমিয়া’ এবং ২২ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষাভাষি। ভারতের প্রগতিশীল পত্রিকা ‘ফ্রন্ট লাইন’ এর তথ্য হলো ১৯৪৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত আসামে ১৩,৯০৫টি মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। সে দেশে প্রতি বছর গড়ে ৩০৯টি মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে ২০০১-২০০৯ সাল পর্যন্ত ভারতে ৬৫৪১টি সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ৪৬৫ বছরের সুপ্রাচীন ‘বাবরী মসজিদ’ ভেঙ্গে ‘রাম মন্দির’ এবং ২০০২ সালে গুজরাটে দাঙ্গায় প্রায় ২০০০ মুসলিম হত্যা করা হয়। বাংলাভাষী মুসলিমদের বাংলাদেশে ‘প্শু ইন’ এর ঘটনা বহুবার ঘটেছে। সেই ভারতের আসাম রাজ্যে বিজেপি সরকার গঠনের পর বাংলা ভাষাভাষি মুসলিমদের ওপর চলছে জুলুম-নির্যাতন এবং নাগরিক অধিকার হরণের অপচেষ্টা। আসাম সরকার যে বাংলা ভাষাভাষি মানুষকে এনআরসি তালিকা থেকে বাদ দিয়ে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশে খেদিয়ে দেয়ার (রাখাইন থেকে যেভাবে রোহিঙ্গাদের বিতারণ করা হয়) নীল নকশা করছে সেটা বোঝার বাকি আছে? শুধু কি তাই, যে ৪০ লাখ নাগরিককে এনআরসি তালিকায় অন্তভূক্ত করা হয়নি তাদের বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের জন্য অপমানজনক। এ নিয়ে প্রথমেই প্রতিবাদ করা উচিত ছিল বাংলাদেশের; কিন্তু করা হয়নি। আসামের নীল নকশার এনআরসি তালিকার সুদূরপ্রসারী কারণে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বুঝে প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু আমরা?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘আসামে এনআরসি’র খসড়া তালিকা প্রকাশ প্রতিবেশি বাংলাদেশের জন্য অপমানজনক। বিজেপি বোঝাতে চাইছে এই ৪০ লাখ মানুষ বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারী। বাংলাদেশ অবৈধ বা সন্ত্রাসী দেশ নয়’। দিল্লীতে গিয়ে মমতা বলেছেন, ‘নাগরিকত্বের তালিকা তৈরি নিয়ে আসামে যা হচ্ছে তা বাংলাদেশে বিরুপ প্রভাব পড়বে। ৪০ লাখ মানুষ বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী রটনা মিথ্যা। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এসব প্রচার গুরুত্বর সমস্যার সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের নাম করে লাখ লাখ মানুষকে আসাম থেকে বিতাড়ন ঠিক নয়। ’৪৭ এর দেশ ভাগের পর পাকিস্তান থেকে অনেক মানুষ ভারতে চলে এসেছে। নেপাল থেকেও এসেছে। পাকিস্তান ও নেপালের নাম উচ্চারণ না করে শুধু বাংলাদেশের নাম কেন বলা হচ্ছে?’ আসামের এই অপপ্রচারের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ বাংলাদেশ করেছে বলে শোনা যায়নি। ঢাকায় কর্মরত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার বক্তব্য, ‘আসামের নাগরিক তালিকা বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো ধরণের প্রভাব ফেলবে না। এটি ভারতের একান্তই অভ্যন্তরীণ বিষয়, বাংলাদেশের আতঙ্কের কোনো কারণ নেই’। সত্যিই কী বাংলাদেশের দুচিন্তার কারণ নেই? বার্মার রোহিঙ্গা খেদানোর পথে আসাম। সেখানে মুসলিম নাগরিকদের ক্রাইসিসে মমতা প্রতিবাদী; আমাদের নীরকতার রহস্য কী?