নিরাপদ সড়ক কেন সম্ভব হচ্ছে না
ভাবতে পারেন মানুষের জীবন কত সস্তা আমাদের দেশে? বাংলাদেশের সড়কে ও পরিবহন চালকদের কাছে আজ কত অসহায় দেশে মানুষ! যেন বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার নামে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড মহামারির আকার ধারণ করেছে, সঙ্গে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। এতদিন এটা নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যথা ছিল না।
সড়কে প্রাণ দেন সাধারণ মানুষ। পরিবারে নামে শোক। একটু হইচই হলে কিছু টাকার ক্ষতিপূরণ দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়। এইতো আমাদের জীবন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও নিয়ন্ত্রণহীন গতি।
বড় দুর্ঘটনাগুলোর ধরণ বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মূলত বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন যানের আধিক্য এবং মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহনের অনুপ্রবেশ এসব দুর্ঘটনার কারণ। আর এসব নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারার কারণ হল পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অতি মুনাফার লোভ এবং পরিবহন ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি।
দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। পরিবেশ-পরিস্থিতিসহ অন্য কারণে দুর্ঘটনার পরিমাণ ১০ শতাংশ।
এই তথ্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই)। দুর্ঘটনার কারণ-সংক্রান্ত পুলিশের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এআরআই এই চিত্র পেয়েছে। ১৯৯৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার বিশ্লেষণ রয়েছে এআরআইয়ের কাছে। প্রতিষ্ঠানটি নিজেও বড় দুর্ঘটনাগুলো তদন্ত করে থাকে। তাদের গবেষণা বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৪৩ শতাংশই ঘটছে জাতীয় মহাসড়কগুলোতে।
সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার প্রথম ও প্রধাণ কারণ হচ্ছে—আইনের চেয়ে যাদের হাত লম্বা, সেই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হাতে পরিবহন খাতটি নিয়ন্ত্রিত হওয়া। পরিবহন শ্রমিকরা যে কারণে ধরাকে সরা জ্ঞান করে বেপরোয়াভাবে দাপিয়ে বেড়ায় সড়ক-মহাসড়কে। চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, বিপদজনক কায়দায় ওভার টেকিং, দুর্ঘটনায় চিহ্নিত চালককে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে না পারা ইত্যাদি সড়ক দুর্ঘটনার কারণ। এছাড়াও হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, রাস্তা নির্মাণে ক্রটি, গাড়ির ক্রটি, যাত্রীদের অসতর্কতা, ট্রাফিক আইন না মানাও সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তারপর জনসচেতনতার অভাব সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার মিছিলকে দীর্ঘ করছে।
সড়ক দুর্ঘটনাকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সরকারের সতর্কতা জরুরি। প্রথমেই দরকার আইনের যথাযত প্রয়োগ ও শাস্তি নিশ্চিত করা। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে বাণিজ্যিক দূরপাল্লার যানবাহনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক বাধ্যতামূলক করা, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, গাড়ির ত্রুটি এই সব বিষয়ে নজরদারি বাড়ানোর দরকার। ট্রাফিক আইন মেনে চলা এবং ট্রাফিক পুলিশের দূর্নীতি বন্ধ করতেই হবে। পাশাপাশি ওভারটেকিং, ওভারস্পিড ও ওভারলোড, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়াসহ অন্যান্য সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড আরও গতিশীল করতে হবে।
কিন্তু এইসব বাস্তবায়ন করতে হলে দরকার হবে একটি জনগণের সরকার। প্রয়োজন একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। কাজেই আজকের যে ছাত্রজাগরণ তা একই সাথে রাষ্ট্র ব্যবস্থার দস্যুপনার দিকেও আমাদের মনযোগ নিয়ে যাচ্ছে। নিরপদ সড়ক আর নিরাপদ জীবন এখন সমার্থক হয়ে উঠেছে। সরকারি গুন্ডাদের অনিয়মের বিরুদ্ধে এই জাগরণকে মানুষের মুক্তির নিশানা হিসেবে দাঁড় করানো প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব।