বড় কেলেঙ্কারির শঙ্কা।।
সাড়ে ৮শ কোটি টাকার ডিজিটাল চুরির রেশ কাটতে না কাটতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ভল্টে জমা রাখা স্বর্ণের গরমিল’ নিয়ে দেশব্যাপি তোলপাড়। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ৪০ দিন গোপন রেখে গভর্নর ড. আতিউর রহমান দিল্লী যান। বিদেশী পত্রিকায় খবর প্রচারের পর শুরু হয় হৈ চৈ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্যাংক চুরির নেপথ্যের কারণ এখনও জানতে পারেনি জাতি। দীর্ঘদিনেও আলোর মুখ দেখেনি ওই সময়ে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট। স্পর্শকাতর ওই ঘটনার কোনো সুরাহা হয়নি। চিহ্নিত হয়েও শাস্তির বাইরে হোতারা। এ ঘটনার পর আরো কয়েকটি ব্যাংকে কেলেঙ্কারীর কারছে ব্যাংকিং অবস্থার ওপর আস্থা হারাচ্ছে গ্রাহক। এরই মধ্যে নতুন করে রাষ্ট্রীয় কোষাগার বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে সোনা কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটি গ্রাহকদের মধ্যে ভীতি-অবিশ্বাস সৃষ্টির পাশাপাশি রাজনৈতিক মহলেও তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এ নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোও বিব্রত। পরিস্থিতি সামলাতে দফায় দফায় বৈঠক চলছে কর্মকর্তাদের মধ্যে।
ব্যাংকিং ব্যাবস্থা নিয়ে গবেষণা করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন-আগের ঘটনাগুলোর ‘সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হওয়ায়’ নতুন করে ঘটছে এ ধরনের ঘটনা। তাদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বর্ণ গচ্ছিত রাখার বিষয়ে খাতা-কলমে এত সব আটঘাট বাঁধা থাকার পরও কেন এর মান ও পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে তা খুবই উদ্বেগজনক। অভিযোগ সত্য হলে এটি হবে বড় ধরনের বিপর্যয়। সে ক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে রক্ষকই ভক্ষক। আর তাদের শেকড় খুব গভীরে। যা এখন জনস্বার্থে বের করে আনতে হবে। না হলে জনমনে সংশয় ও প্রশ্ন আরও বাড়তে থাকবে।
বিশ্লেষকরা জানান, রিজার্ভ চুরি থেকে ভল্টে রাখা সোনায় গরমিল। খেলাপি ঋণ, তারল্য সংকট ও ডলারের অস্থিরতায় ব্যাংক খাত অস্থির। পাশাপাশি ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংকসহ নানা কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংকিং খাতের প্রতি মানুষ আস্থার সঙ্কটে। এখনই লাগাম টানতে না পারলে চির ধরা এই আস্থা ফিরিয়ে আনা আরও দুরূহ হয়ে পড়বে। পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে আরও বড় ধরণের কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এসব অনিয়মের মূল কারণ হলো- আগের দোষীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া। বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। অর্থনীতিবীদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটির মাধ্যমে স্বর্ণ কেলেঙ্কারির বিষয়টি তদন্ত করা উচিত।
এদিকে নতুন করে বাংলাদেশ ব্যাংকে গচ্ছিত স্বর্ণের গরমিলে দেশের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারের উচ্চপর্যায়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও এ ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করেছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে তার অফিসে ডেকে নিয়ে কথা বলেছেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আদুল মুহিতও দেশে ফিরে এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা বলেছেন। এর আগে গত গত বুধবার অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে বৈঠক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে থাকা স্বর্ণের মান তৃতীয় কোনো পক্ষ দিয়ে যাচাই করার উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে এম এ মান্নান বলেছেন, ‘আমি মনে করি বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমে ত্রুটি আছে। প্রয়োজনে আমরা তদন্ত করব। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছ থেকে পাওয়া বক্তব্য পৃথকভাবে নোট নিয়েছি। দুটো সংস্থার কারো ভুল থাকলে ধরা হবে। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে এলেও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সামান্য ফাঁক থাকলেও তা থেকে ভবিষ্যতে বড় সমস্যা দেখা দিতে পারে।’ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরাপত্তাব্যবস্থা সময়োপযোগী কি না তা পরীক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী মান্নান।
স্বর্ণের হিসাব-নিকাশের গরমিলের ঘটনায় এখনও ধোঁয়াশা বিরাজ করছে। ভল্টে স্বর্ণের রক্ষণাবেক্ষণ, গ্রহণ পদ্ধতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মাঝে সন্দেহ বাড়ছে। গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা স্বর্ণকান্ড নিয়ে প্রকৃত পরিস্থিতি উপস্থাপন করতে চাইলেও বিষয়টি নিয়ে আরও অসংলগ্নতা স্পষ্ট হয়। স্বর্ণ হ্যান্ডেলিংয়ের সঙ্গে সরকারের দুই এজেন্সি বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এনবিআর নিশ্চিত করার পর বিষয়টি ব্রিফ করলেও বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়নি। অর্থনীতিবীদ, রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও এসব বিষয়ে গত কয়েকদিন থেকে কথা বলছেন। সবারই অভিমত নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটির মাধ্যমে ঘটনার তদন্ত করতে হবে।
স¤প্রতি শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের তৈরি একটি গোপনীয় তদন্ত রিপোর্টের আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা স্বর্ণের মান নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভল্টে রাখা তিন কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের চাকতি ও আংটি হয়ে গেছে মিশ্র বা সংকর ধাতু। ২২ ক্যারেটের স্বর্ণ এখন হয়ে গেছে ১৮ ক্যারেট। এর পর থেকে চাঞ্চল্যকর বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। যা এখন টক অব দ্য কান্ট্রিতে রূপ নিয়েছে।
নিউইয়র্ক থেকে অর্থমন্ত্রী বলেন, স্বর্ণ নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তা কোনোভাবেই ছোট করে দেখার বিষয় নয়। যাদের কাছে স্বর্ণ রাখা হলো তাদেরই বেশি দায়িত্ব। ভল্টে স্বর্ণ ঢোকানোর আগে তা প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া উচিত ছিল। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারে না। অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, আমি দেশে ফিরে বিষয়টি পর্যালোচনা করবো এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
গত মঙ্গলবার অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করে, শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের প্রতিবেদন সঠিক নয়। অপরদিকে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের প্রতিবেদন সঠিক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে যে স্বর্ণ রাখা হয়েছে সেগুলো ঠিকমতোই আছে। কোনো হেরফের হয়নি। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলেছেন, ঘটনা যাই হোক না কেন নিরপেক্ষভাবে স্বর্ণের মান যাচাই করে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ চলমান অবস্থায় তৃতীয় পক্ষ দিয়ে স্বর্ণের মান যাচাইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। গত বুধবার অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নানের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের বৈঠকের সময় তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে স্বর্ণের মান যাচাইয়ে একমত হন তারা।
এদিকে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে সুইফট কোডের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি করে নেয় দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে দুই কোটি ডলার চলে যায় শ্রীলংকা এবং আট কোটি ১০ লাখ ডলার চলে যায় ফিলিপাইনের জুয়ার আসরে। এই ঘটনার প্রায় একমাস পর ফিলিপাইনের একটি পত্রিকার সংবাদের মাধ্যমে বিষয়টি বাংলাদেশ জানতে পারে। এ ঘটনা চেপে রাখতে গিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে গভর্নরের পদ ছাড়তে বাধ্য হন ড. আতিউর রহমান। বড় ধরনের রদবদল করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষপর্যায়ে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা মানি লন্ডারিং আইনে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরির অভিযোগ এনে ১৫ মার্চ (২০১৬) মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর সিআইডি এখনও পর্যন্ত আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর সেলিম রায়হান বলেন, ব্যাংক খাতে আস্থার সংকট এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সব মিলিয়ে আস্থার সংকট আমানতকারীদের ধীরে ধীরে ব্যাংকবিমুখ করছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সংকট দেখা দিয়েছে। তার মতে, বেসরকারি ব্যাংকগুলো এখন নিজেদের ইচ্ছেমতো চলছে। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো নিয়ম-নীতি মানছে না তারা।
ব্যাংক খাত নিয়ে মানুষের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। এই সন্দেহ ও অবিশ্বাসকে ব্যাংকের জন্য একটি অশনি সংকেত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, একদিকে আমানত আসছে না, অন্যদিকে ঋণ ঠিকই বিতরণ করা হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংক খাতে নগদ টাকার সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য (এক্সেস লিক্যুইডিটি) ছিল ৯৭ হাজার ১২২ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের মার্চের শেষে তা কমে দাঁড়ায় ৭৬ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। অথচ গত বছরের শুরুতেও ব্যাংক খাতে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা অতিরিক্ত তারল্য ছিল। বিনিয়োগ করতে না পারায় ওই সময় ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কমিয়ে দেয়। তখন অনেকে সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এতে ব্যাংকের আমানত কমতে থাকে। এরই মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের ঘটনায় আস্থা হারান আমানতকারীরা। এমনকি সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকে রাখা আমানত প্রত্যাহার করতে থাকে। ফলে ব্যাংকিং খাতে নগদ টাকার সংকট হতে দেখা যায়। বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের টান পড়ায় ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি এ সংকট মেটাতে ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহে মরিয়া হয়ে ওঠে।
জেনেভাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিব্রিউইএফ) প্রকাশিত ‘গ্লোবাল কম্পিটিভনেস রিপোর্ট ২০১৭-১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিষদ সদস্যদের স্বেচ্ছাচারিতা, অব্যবস্থাপনা আর অদক্ষতার কারণে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে ব্যাংকিং খাতে।