শেখ হাসিনার ভারত সফর থেকে কী পেল বাংলাদেশ?
যখনই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কিত কোন ইস্যু সামনে আসে, উভয় দেশের মানুষ নড়েচড়ে বসে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক এমনই অম্লমধুর যে ‘ভাল’ বা ‘খারাপ’, এমন এক কথায় পূর্ণ সত্য প্রকাশ করা যায় না।
বাংলাদেশের কেউ যদি ভারতের গুণগান গাইতে গিয়ে বেহুঁশ হয়ে যান, তখন যেমন আমাদের সমাজে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হয়; আবার কেউ যদি ভারতের নাম শুনলেই ক্রোধে অন্ধ হয়ে যান, তাহলেও তাকে ঘিরে ভয়ানক সন্দেহ এবং সংশয় তৈরি হয়।
ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক এমনই এক জটিল সমীকরণে বাধা যে, এক/দু শব্দে এর পুরোপুরি মূল্যায়ন সম্ভব নয়। ভারত আমাদের জন্য নানা কারণে খুব প্রাসঙ্গিক।
এক সময় তো আমরা একই রাষ্ট্র ছিলাম। কলকাতা ছিল আমাদের রাজধানী। কৃষকের খাজনার অর্থে গড়ে উঠেছিল সে শহর। রাজনীতির কারণে আমরা বিভক্ত হয়েছি। যাই হোক, সে ইতিহাস বললে আলাপ শেষ হবে না কোন ভাবেই।
এমনিতে সামগ্রিক বিবেচনায় ভারত থেকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার মান ভাল হলেও কিছু উচ্চ মানসম্পন্ন হাসপাতাল আছে ভারতে। ফলে আমাদের অনেক মানুষ সে সব হাসপাতালে গিয়ে মোটা অংশের অর্থ দিয়ে আসেন, নিজেরা ‘ভাল’ সেবা পেয়ে খুশি থাকেন।
এছাড়া কম টাকা খরচ করে মরুভূমি বা তুষারপাত দেখতে হলে ভারতই আমাদের একমাত্র ভরসা। তাছাড়া উপমহাদেশের ইতিহাসের অজস্র গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে ভারতে।
অন্যদিকে সিপিডির হিসাবে বাংলাদেশ হল ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম রেমিটেন্স খাত। বাংলাদেশে প্রচুর ভারতীয় নাগরিক ব্যবসা এবং চাকরি করে।
ভারতের কোটি কোটি মানুষের সাথে আমাদের আছে হৃদয়ের সম্পর্ক। আমরা যেমন বাঙালি, ভারতেও বাঙালি আছে। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন বসবাস করে। ভাষার টান ও সংস্কৃতির সম জাতীয়তা, ইতিহাসের খুব ঘনিষ্ঠ কর্মধারা এবং ক্রমধারা আমাদেরকে এমন এক বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে যে, কাঁটাতারের বেড়া আমাদেরকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করতে পারে নি, কোনদিন পারবেও না।
কূটনৈতিক বা বাণিজ্যিক সম্পর্কের বাইরেও তাই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের আরেকটি জায়গা হচ্ছে, আবেগের সম্পর্ক। বিশেষ করে ভারতীয় নাগরিক, যাদের আদি বাড়ি বাংলাদেশে ছিল, তারা কোন ভাবেই এই আবেগকে অস্বীকার করতে পারবে না।
আবেগ মাঝে মাঝে এমনই উচ্চতায় পৌঁছে যে, বাংলাদেশি কাউকে পেলে তাঁদের চোখে পানি আসে। আবেগে জড়িয়ে ধরে বহুদিন আটকে রাখা কান্না ছেড়ে দিয়ে সাময়িক মুক্তি খুঁজেন তারা।
মাতৃভূমি ছেড়ে ভারতে চলে গিয়ে সেটল করা স্বজনরা আমাদের বুকের মাঝেও ব্যাথা সৃষ্টি করেন। আবার ভারত-বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্ক শুধু মাত্র আবেগের বন্ধনেই আবদ্ধ নয়, বৈধ-অবৈধ নানা ব্যবসাও চলে সীমান্ত জুড়ে।
বাংলাদেশে ভারতের নানা পণ্যের বিশাল বাজার রয়েছে। বাংলাদেশ থেকেও নানা পন্য রপ্তানি হয়, যদিও বাণিজ্য ব্যবধান আছে বিশাল। তাছাড়া, ভারত থেকে চোরাপথে বাংলাদেশে আসে গরু, ফেনসিডিলসহ নানা মাদক বা চুরি-ছিনতাই এর কাজে ব্যবহারের ছোটখাট নানা আগ্নেয়াস্ত্র। বাংলাদেশ থেকেও বিশাল পরিমাণে রাসায়নিক সার ও ডিজেলসহ নানা জিনিস পাচার হয়ে ভারত চলে যায়। আরও পাচার হয় বাংলাদেশের শিশু ও নারী।
সরকারি পর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগে রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক সম্পর্কের নানা দিকই প্রাধান্য পায়। ফলে যতই ইলিশ দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আপ্যায়ন করা হউক, তিনি তিস্তার পানি দিতে চান না।
বাংলাদেশ কি কখনো তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাবে? তিস্তা ছাড়াও যে আরও ৫৩টি অভিন্ন নদীর ব্যাপার আছে ভারতের সাথে। বাংলাদেশ হল পলি ও নদীর দেশ। নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ হলে পলিপ্রবাহ বন্ধ হবে, বাংলাদেশের অস্তিত্বই বিলীন হবে। এমন নির্মম সত্য কি ভারতের সরকার উপলব্ধি করবে না? তাহলে এবারের ভারত সফরে কী পেল বাংলাদেশ?
এবারের সফরের মূল উদ্দেশ্য বা এজেন্ডা ‘তিস্তা’ ছিল না। পশ্চিমবঙ্গে ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধন এবং নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানসূচক ডি লিট গ্রহণ উপলক্ষ্যে শেখ হাসিনা ভারত গিয়েছিলেন।
এমন সফর আগে কখনো হয়নি। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্বোধন করলেন বাংলাদেশ ভবন। আর নজরুলের চুরুলিয়ায় পেলেন ডি লিট! এক কথায়, অসাধারণ এক সফর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলামই তো আমাদেরকে ধরে রেখেছেন বহুদিন থেকে।
এই অসাধারণ সম্পর্কের প্রধান রাজনৈতিক অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পশ্চিমবঙ্গে অবহেলিত কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে এনে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর জীবনে নজরুলের প্রভাব ছিল অনেক। নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত পশ্চিমবঙ্গে শেখ হাসিনা এবার অনন্যসাধারণ সম্মান পেয়েছেন। শেখ হাসিনার সম্মান মানে বাংলাদেশের সম্মান। তবে কিছু মানুষের কাছে সম্মান বড় বিষয় নয়, এরা সবকিছুতে শুধু নোংরা রাজনীতি করতে পারেন।
বিএনপির নেতা রুহুল কবির রিজভী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। শেখ হাসিনা নাকি তিস্তা নিয়ে কিছুই বলেন নি! অথচ শেখ হাসিনা একাধিক বার তিস্তা নিয়ে কথা বলেছেন। ভেতরের খবর হল, শেখ হাসিনা তিস্তা নিয়ে বেশ শক্ত কথা বলেছেন।
আনন্দবাজার পত্রিকা সংবাদ ছেপেছে, ‘দিল্লির পাশে থেকেছে ঢাকা, মোদির কাছে ‘প্রতিদান’ চান হাসিনা’ শিরোনামে। আনন্দবাজার লিখেছে, ‘শুক্রবার ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধনের পরে সেখানেই মোদীর সঙ্গে বৈঠকে হাসিনা জানিয়েছেন- তার সরকার উত্তর-পূর্বের জঙ্গিদের দেশছাড়া করেছে, ট্রানজিট দিয়েছে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে বরাবর দিল্লির পাশে থেকেছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের বছরে এ বার তাই ভারতের সহযোগিতা চাই।
আনন্দবাজারের দাবি মোদিকে হাসিনা বলেছেন, তার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বপ্ন ছিল পাকিস্তানি শোষণে ছিবড়ে হয়ে যাওয়া বাংলাদেশকে মর্যাদার সঙ্গে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড় করানো। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নেমেছেন তিনি। মুক্তিযু্দ্ধের মতো এই কাজেও ভারতকে পাশে চান’।
ইংরেজি অনলাইন লুকইস্ট লিখেছে, ‘হাসিনা গোস ব্যাক উইথ হোপ’। প্রতিবেদনের শুরুতে লুকইস্ট লিখেছে, ‘ Bangladesh prime minister Sheikh Hasina is going back home with some hope of a breakthrough on the vexed issue after her meetings with Indian prime minister Narendra Modi and West Bengal chief minister Mamata Banerjee’. সুতরাং, শেখ হাসিনা এবার কৌশলে তিস্তা ইস্যুতে শক্ত ভূমিকা রেখেছেন, এতে কোন সন্দেহ নাই।
শেখ হাসিনার এই সফর কাভার করতে ঢাকা থেকে পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলেন একাত্তর টেলিভিশনের সাংবাদিক মাহবুব স্মারক। সেখানকার শীর্ষ সাংবাদিকদের মধ্যে যারা মমতার ঘনিষ্ঠ তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে তার মনে হয়েছে, তিস্তা নিয়ে ইতিবাচক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।
ফেসবুকে স্মারক লিখেছেন, ‘ কলকাতার সাংবাদিকরা বলছেন, তিস্তা নিয়ে অগ্রগতি আছে ভেতরে! ‘তিস্তা বল’ গড়াতে পারে দিল্লী পর্যন্ত! … সফরের শেষ দিন । মমতার সাথে বৈঠক শেষ করে তাজ বেঙ্গল হোটেল থেকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রওয়ানা দিয়েছেন বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। বেরিয়ে যাবার সময় কলকাতার দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের দেবদ্বীপ পুরোহিত জানতে চেয়েছিলেন…আপা, সফর কেমন হলে? শেখ হাসিনা বললেনঃ খুব ভালে, খুব ভালে।’
‘দেবদ্বীপ আবার জানতে চাইলেন… আপা আপনার মনের আশা কী পূরণ হয়েছে? (মানে তিস্তা নিয়ে কোন অগ্রগতি আছে কি না?) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোন জবাব দেননি কিন্তু তাঁর হাসির মধ্যে ছিল তীব্র আশাবাদের এক সুবর্ণ রেখা! … কলকাতার সাংবাদিক নেতাদের অনুমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের কলকাতা সফরে তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভেতরে ভেতরে বড় অগ্রগতি আছে। তবে তারা নিশ্চুপ থাকবেন এমনটাই মনে হয় সিদ্ধান্ত।’
‘মৌনতার শক্তি পর্বতসম! সেই নীতি নিয়েছেন শেখ হাসিনা আর মমতা ব্যানার্জি। তার মানে হলে, তিস্তা নিয়ে আরেও কিছু হবে। হাসিনা-মমতা বৈঠকের পর ‘তিস্তা বল’ দিল্লী পর্যন্ত গড়াবে। সম্মত হলে, চুক্তির আয়োজন দিল্লীই করবে।’
আনন্দবাজার ও লুকইস্ট পত্রিকার প্রতিবেদন কিংবা কলকাতার সাংবাদিকদের কথাবার্তা থেকে এটা পরিষ্কার যে, তিস্তা বিষয়ে শেখ হাসিনা অত্যন্ত শক্তিশালী বার্তা দিয়েছেন। সে বার্তায় ইতিবাচক সাড়া দেবে ভারত, এমনটাই আশা করা হচ্ছে।
দিল্লী যেহেতু কেন্দ্র, দিল্লী থেকেই আসবে মূল ঘোষণা। তবে সময় হয়ত লাগবে। গঙ্গার পানি চুক্তি কিংবা সাম্প্রতিক ছিটমহল বিনিময় চুক্তি করতেও কিন্তু সময় লেগেছিল।
আমাদের ভরসার জায়গা শেখ হাসিনাকে ঘিরে। ভারতও নিশ্চয় বাংলাদেশের গুরুত্ব বুঝতে পারছে। বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীল ও মৌলবাদী শক্তির আবার উত্থান হলে ক্ষতি কিন্তু ভারতেরও কম না।
লেখক: সহকারি অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়