যেসব কারণে আওয়ামী লীগই ভারতের একমাত্র পছন্দ।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখালে আগামী ৮ এপ্রিল রোববার ঢাকায় আসছেন। গত ১৮ জানুয়ারি তিনি পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর এটাই তাঁর প্রথম বাংলাদেশ সফর। দুই দিনের এই সফরে বিজয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। কূটনৈতিক পাড়ায় খবর হল, তিস্তা পানি চুক্তি ত্বরান্বিত করা এবং চলতি মাসে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠেয় কমনওয়েলথ সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক চূড়ান্ত করতেই তিনি ঢাকায় আসছেন। কিন্তু নির্বাচনের মাত্র নয় মাস আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বাংলাদেশ সফরের রাজনৈতিক তাৎপর্য কেউই উড়িয়ে দিতে পারছে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা এখন আর লুকোচুরির বিষয় নয়। বিশেষ করে ২০১৪’র ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে ভারত খোলাখুলি ভাবেই আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। সে সময়ও ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকায় ঝটিকা সফরে এসে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে আনতে সুজাতা এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ভারত ওই নির্বাচনকে বৈধতা দেয়। মূলত: ভারতের সমর্থনের জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য ওই নির্বাচন নিয়ে আর প্রশ্ন তোলেনি। তখন ছিল সোনিয়া গান্ধীর কংগ্রেস সরকার। কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের আলাদা একটা মাত্রা আছে। এরপর ভারতে নির্বাচন হয় এবং কংগ্রেসকে হটিয়ে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসে। সে সময় অনেকে মনে করেছিল, দক্ষিণপন্থী দল হিসেবে বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের টানাপোড়েন হবে। আওয়ামী লীগের সব কিছুতেই বিজেপি সায় দেবে না। উল্লসিত বিএনপি নেতারা বিজেপির ক্ষমতায় আসার পর মিষ্টি বিতরণ করে আনন্দ উল্লাস করেছিল। লন্ডন থেকে তারেক জিয়া পাঠিয়েছিল অভিনন্দন বার্তা।
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে মোদি শেখ হাসিনার উপরই আস্থা রাখলেন। তাঁকে পূর্ণ সমর্থন দিলেন। যদিও প্রথম বলা হচ্ছিল, ৫ জানুয়ারির মতো এক তরফা নির্বাচন মোদি সরকার সমর্থন দেবে না। গত অক্টোবরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ সফর করে স্পষ্ট করেই বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। এমন নির্বাচন চাই যাতে জন আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।’ কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে ততোই স্পষ্ট হচ্ছে, ভারতের আস্থা শেখ হাসিনাতেই। কংগ্রেসের মতো বিজেপি সরকারও চায়, একটি সেক্যুলার, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণকারী দল আগামী নির্বাচনে জয়ী হোক। বিজেপি সরকারও যে বিএনপির উপর এখনো ভরসা করতে পারছে না, তা বিএনপি নেতাদের হতাশাতেই স্পষ্ট। সুযোগ পেলেই ভারতকে ইঙ্গিত করে বিএনপি নেতারা বলেন, ‘তাবেদার সরকার’ ‘ভারতকে খুশি করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে ইত্যাদি কথাবার্তা। কিন্তু ভারতের কূটনীতিতে এতে কোনো হেরফের হয়নি।
বাংলাদেশে ভারতের ইচ্ছাই অন্যান্য দেশগুলোর ইচ্ছা। তাই প্রশ্ন, কেন ভারত আওয়ামী লীগকে চায়? কেন তাঁরা এখনো আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য কাউকে ক্ষমতায় দেখতে অস্বস্তি বোধ করে। বাংলা ইনসাইডার, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কূটনীতিক এবং ভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে, এর ১০টি কারণ খুঁজে পেয়েছে। এগুলো হলো:
১. বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের জিরো টলারেন্স নীতি। বিভিন্ন আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতে ভারতের বছরে প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হতো। আর বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য ছিল বাংলাদেশ। এখানে বিভিন্ন গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ারও অভিযোগ ছিল। ২০০৮ সালে হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে, ঘোষণা করে ‘বাংলাদেশের মাটি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। ভারতের আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ দমন হয়েছে শেখ হাসিনার দৃঢ়তায়। একারণেই এই অবস্থা অটুট রাখতে ভারত আওয়ামী লীগকে চায়।
২. ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য আছে যে, বিএনপির সঙ্গে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আইএসআই ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সবচেয়ে বড় মদদদাতা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার সঙ্গে উলফাসহ বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যোগাযোগ আছে বলে ভারতের কাছে তথ্য আছে। বিশেষ করে ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যাপক মদদ দিয়েছিল। দশ ট্রাক অস্ত্র তার বড় উদাহরণ। এজন্য বিজেপি সরকার খাল কেটে কুমির আনতে চায় না।
৩. আওয়ামী লীগ সরকার সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে বিশেষ করে হিন্দুদের ব্যাপারে অনেক বেশি দায়িত্ববান। এখনো হিন্দু নির্যাতনের মত ঘটনা ঘটলেও তাতে কোন রাষ্ট্রীয় মদদ নেই বলেই ভারত বিশ্বাস করে। এ কারণে বিজেপি সরকারের প্রথম পছন্দ আওয়ামী লীগ।
৪. শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদ দমনে বিশ্বের রোল মডেল- ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর অন্তত তিনটি বক্তৃতায় এমন মন্তব্য করেছেন। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হলে তা ভারতের জন্যও বিপদের। বিএনপির সঙ্গে জঙ্গিদের সম্পর্ক রয়েছে বলে ভারত মনে করে। এজন্য মোদির আস্থা শেখ হাসিনায়।
৫. ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ১৯৭৫ এর পর থেকে খারাপ হতে থাকে। এক সময় এটা তিক্ততার পর্যায়ে চলে যায়। কিন্তু শেখ হাসিনা দুই দেশের সম্পর্ককে সম্মানজনক সমঝোতার দিকে নিয়ে এসেছেন। অনেক অমীমাংসিত সমস্যা তিনি সৌহার্দের মাধ্যমে সমাধান করেছেন। এই অগ্রযাত্রায় ভারত ছেদ চায় না। ট্রানজিটসহ দ্বিপাক্ষিক অনেক ইস্যুতে ভারত লাভবান হয়েছে। এই সুবিধাগুলোকে ভারত হুমকির মুখে ফেলতে চায়না।
৬. ভারতের জন্য এই অঞ্চলে সবথেকে বড় হুমকি চীন। চীনের অর্থনৈতিক আগ্রাসন এখন ভুটান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো হলেও তা ভারতের কাছাকাছি নয়। অন্যদিকে বিএনপি চীন পাকিস্তানমুখী কূটনীতিতে আগ্রহী।বাংলাদেশে চীনের কর্তৃত্ব বাড়লে সবচেয়ে ক্ষতি হবে ভারতের।
৭. বাংলাদেশ- পাকিস্তান সম্পর্ক এখন স্মরণকালের সবচেয়ে খারাপ। এটা ভারতের জন্য খুবেই আনন্দের। অথচ বিএনপি এখনো পাকিস্তানমুখী।
৮. আওয়ামী লীগ পছন্দের একটি বড় কারণ হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি জাতির পিতার কন্যা। আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ভারতের রাজনীতিবিদদের কাছে খুবই শ্রদ্ধার পাত্র। তাই কংগ্রেস, বিজেপি যেই ক্ষমতায় আসুক না কেন, শেখ হাসিনা আলাদা মর্যাদা সব সময়ই পান। আর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রমাণ করেছেন, কথা ও কাজে তাঁর অসম্ভব মিল। এ কারণে শেখ হাসিনা ভারতে সম্মানের পাত্র।
৯. ভারতের অপছন্দের তালিকায় প্রথম দিকেই আছে তারেক জিয়া। ভারতে তারেক দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজ হিসেবেই পরিচিত। ভারতের অভিযোগ, তারেকের সঙ্গে দাউদ ইব্রাহিমের সম্পর্ক রয়েছে। ভারত বহুবার তারেক জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। সর্বশেষে সুষমা স্বরাজও বেগম খালেদা জিয়াকে এ বিষয়ে ভাবতে বলেন। কিন্তু ভারত বুঝে গেছে তারেক জিয়াকে বিএনপি থেকে বাদ দেওয়া অসম্ভব।
১০. ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিজেপির প্রভাবশালী নেতার সবচেয়ে পছন্দের রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার প্রশংসা করতে তিনি কূটনীতিও ভুলে যান। তার প্রকাশ্য শেখ হাসিনার প্রতি পক্ষপাত-ভারতের রাজনীতিতে কারও অজানা নয়।
সংবাদ >> জাতীয়
বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন নিয়ে আল-জাজিরা যে লিখেছে

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কারাবাস ও রাষ্ট্রের হাতে ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্যাতনের ফলে দেশটির আগামী নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, পরবর্তী নির্বাচন হবে সহিংস উপহাস মাত্র। ২০১৪ সালের সর্বশেষ নির্বাচন প্রায় সব ক’টি বিরোধী দলই বর্জন করেছিল। ব্যাপক আকারে সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের ফলে ওই নির্বাচন হয়েছে বিতর্কিত। এবারও তারই পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা বিরাজ করছে বাংলাদেশে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে এমনটা বলা হয়েছে।
খবরে বলা হয়, সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীরা কারাবন্দি বা তার চেয়েও খারাপ কিছু হওয়ার আশঙ্কায় দিনতিপাত করছে। সাধারণ মানুষের মনেও নির্বাচনী বছর নিয়ে বাড়ছে উৎকণ্ঠা। এ বছরের ডিসেম্বরে সংসদীয় নির্বাচন হবে বাংলাদেশে।
ঢাকার একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নাদিয়া তাবাসসুম খান মনে করেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেভাবে সকল ধরনের ভিন্নমত দমন করেছে, তাতে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস কারোই হবে না। ঢাকাভিত্তিক একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিক হাসান হাবিব বলেন, ‘প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে শত্রুতা’র দরুন নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দ্াড়িয়েছে।
বলপূর্বক অন্তর্ধান: প্রধান বিরোধী নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গত মাস থেকে বন্দি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষে এখন এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করা ক্রমেই দুরূহ ঠেকছে যে, সরকার ক্রমেই কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠছে।
৮ই ফেব্রুয়ারি নিজের স্বামী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নামে প্রতিষ্ঠিত একটি দাতব্য সংস্থার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। তার বড় ছেলে ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী তারেক রহমান ও আরও চার জনকে ১০ বছরের সাজা দেয়া হয়েছে।
প্রায় এক মাস পর খালেদা জিয়াকে জামিন দেয়া হয়। তবে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ওই জামিন স্থগিত করেন। ফলে অন্তত আগামী ৮ই মে পর্যন্ত ৭২ বছর বয়সী খালেদা জিয়া কারাগারে থাকছেন।
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর গ্রেপ্তার ও বন্দিত্ব বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে সহিংসতা সৃষ্টি করেছে। বিএনপি অভিযোগ করছে, খালেদা জিয়াকে রাজনীতির বাইরে রাখতে সরকারি চক্রান্তের অংশ হিসেবে তাকে জেলে ঢুকানো হয়েছে। পুলিশের হিসাব মতে, খালেদা জিয়ার রায় প্রদানের দিন প্রায় ৩০০ বিএনপি নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারির পর থেকে এখন অবধি ৩ হাজারেরও বেশি নেতাকর্মী কারাগারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশি রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে আসছেন। তাদের তিক্ত শত্রুতা বাংলাদেশকে প্রায়ই সহিংসতা ও অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
বিএনপি অভিযোগ করছে, ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকে দলটির প্রায় ৫ শতাধিক সমর্থককে হত্যা ও প্রায় ৭৫০ জনকে ‘অপহরণ’ করা হয়েছে। দলটি দাবি করে, নিখোঁজ নেতাকর্মীদের মধ্যে কমপক্ষে ১৫০ জনকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে অথবা গুম করা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার রায়ের পর কর্মপরিকল্পনা এখনও ঠিক করেনি বিএনপি। এখন পর্যন্ত অসহিংস কর্মসূচিই দিয়েছে দলটি। তবে রাজনৈতিক সভার জন্য অনুমতি বাতিল হওয়ায় বিএনপির অনেকেই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছেন। বড় আকারে সহিংসতা অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে অস্থিতিশীল করে ফেলতে পারে।
সম্প্রতি জার্মান থিংক ট্যাংক বার্টলসম্যান ফাউন্ডেশন কর্তৃক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে; যাতে বলা হয়, দেশটি এখন স্বৈরতান্ত্রিক শাসনাধীন। ১৩টি দেশকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে যেখানে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ, লেবানন, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া ও উগান্ডায় গণতন্ত্র কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে অবনমনের মধ্যদিয়ে গেছে। ফলে এই ৫টি দেশ এখন গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড রক্ষা করতে পারছে না।
নির্বাচন নিয়ে সংশয়: বাংলাদেশের ভেতরের ও বাইরের পর্যবেক্ষকরা বার্টলসম্যান ফাউন্ডেশনের ওই কড়া প্রতিবেদনের সঙ্গে মোটামুটি সহমত পোষণ করেছেন। ১০ বছরের শাসনামলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করে বিরোধী দলের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনমন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, ২০১০ সালের পর থেকে বলপূর্বক অন্তর্ধানের শিকার হয়েছে প্রায় ৫১৯ জন। এছাড়া ৩০০ জন এখনও নিখোঁজ।
কাতার ও ভিয়েতনামে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামানকে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা উঠিয়ে নিয়ে যায়। তার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘সরকার বিরোধী পোস্ট’ দেওয়ার অভিযোগ উঠানো হয়।
তার মেয়ে শাবনম জামান বলেন, ‘৪ঠা ডিসেম্বর থেকে আমার পিতা নিখোঁজ।’ তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ যখন আমার পিতার অন্তর্ধান হওয়ার সম্যক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হয়েছে, তখন থেকেই তারা তদন্ত থামিয়ে দিয়েছে।’ এ বছরের মার্চে বিএনপি’র ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের এক নেতা জাকির হোসেন হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, তাকে নির্যাতন করেছে পুলিশ। গত বছর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলেছে, সরকার গোপনে শ’ শ’ মানুষকে আটক করেছে। এদের বেশির ভাগই সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী।
তবে এ সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছে আওয়ামী লীগ। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে বিএনপির ওপর রাজনৈতিক নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে বিরোধী দল। ‘তবে তার মানে এই নয় যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সেসব কর্মকাণ্ডে বাধা দেবে না, যেগুলোর কারণে সাধারণ মানুষের ক্ষতি হতে পারে,’ বলেন তিনি।
২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সংবিধান অনুযায়ী। বিএনপির ওই নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ছিল রাজনৈতিক। তারা এখন বুঝতে পারছে সেই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল।’ বাংলাদেশি এই মন্ত্রী জার্মান থিংকট্যাংকের ওই পর্যবেক্ষণের সঙ্গেও একমত নন। সরকার স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে, এমন দাবিকে তিনি উদ্দেশ্যমূলক ও ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, বার্টলসম্যান স্টিফটাং তাদের উপাত্ত কোন সূত্র থেকে সংগ্রহ করেছে, তা জানতে আগ্রহী তিনি। তার মতে, ‘গণতন্ত্রের সকল শাখা, বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যম বাংলাদেশে সম্পূর্ণ স্বাধীন।’ আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ফারুক খান বলেন, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ সঠিক নয়। তার ভাষ্য, ‘আমাদের সরকার বরং মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার নজির স্থাপন করেছে।’
তবে বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা সরকারের এসব যুক্তি মানতে রাজি নন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিকভাবে সাড়া প্রদানের ফলে বাংলাদেশ হয়তো আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা পেয়েছে। তবে দেশটির ঘরোয়া মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, ‘সরকার এখনও গুমের বিষয়টি অস্বীকার করে চলেছে। সরকারকে অবশ্যই নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটককৃত ব্যক্তিবিশেষকে মুক্তি দিতে হবে। গুম হওয়া অনেকেই রাজনৈতিক বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত।’ মিনাক্ষী গাঙ্গুলি আরও বলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা এক ভয়ের পরিবেশে কাজ করছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করায় অনেক নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে অনুকূল নয়, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন তো দূরের কথা। আলী রীয়াজ মনে করেন, চাপের মুখে থাকা বিএনপি যদি আগামী নির্বাচনও বয়কট করতে বাধ্য হয়, তাহলে সেই নির্বাচনেরও ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো কোনো নৈতিক বৈধতা থাকবে না। তার ভাষ্য, ‘বিরোধী পক্ষকে অব্যাহতভাবে নির্যাতন করা শুধু অবিচক্ষণ সিদ্ধান্তই নয়, এটি হিতে বিপরীত ফল বয়ে আনে। বাংলাদেশের শাসক দলগুলোর মধ্যে তা ভুলে যাওয়ার প্রবণতা থাকে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, সরকার নিরাপত্তার অজুহাতে বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দিচ্ছে না। অথচ, নির্বাচনকে সামনে রেখে শাসক দল বিরাট বিরাট সভা-সমাবেশ করেই যাচ্ছে। নজরুল বলেন, ‘এটি এমন এক সরকার ও রাজনৈতিক দল যারা বিশ্বাস করে তারা কারও কাছেই জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। এটি গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক এক লক্ষণ।’