মদমত্ত ক্ষমতার রাজনীতির একাল সেকাল!
মানুষের জীবনে যখন রাষ্ট্রক্ষমতার তাণ্ডব শুরু হয়ে যায়, তখন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কতটা বিষাদময় ও অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে- তা যেমন আমরা অতীত-বর্তমানের দৃশ্যমান ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে জানতে পারি; তদ্রুপ গল্প-সাহিত্য ও উপন্যাসের মাধ্যমেও বিষাদের ঘনঘটার নিদারুণ সব কাহিনী পড়ে থাকি। এসব ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, লোককাহিনী ও কল্পকাহিনীতে মদ-মত্ত-ক্ষমতার দম্ভ এবং দাম্ভিকদের করুণ পরিণতির চমকপ্রদ সব উপাখ্যান বর্ণিত রয়েছে। অত্যাচারী রাজা এবং তার রাক্ষসী স্ত্রীর কারণে রাজ্য যখন প্রাণীশূন্য হতে চলল, ঠিক তখন ভিনদেশের সিন্দবাদ তার দলবল নিয়ে হাজির হয়ে জনগণকে উদ্ধার করে নতুন রাজা নির্বাচন করে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা কিভাবে প্রতিষ্ঠিত করল, এমনতর গল্প আমরা আলিফ-লায়লার কাহিনীতে অহরহ পাই। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে অত্যাচারী বাদশাহ এবং তাদের পতন নিয়ে যেসব কাহিনী রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সনাতন ধর্মে মহাভারত ও রামায়ণের কাহিনী, ওল্ড টেস্টামেন্ট, নিউ টেস্টামেন্ট ও পবিত্র আল কুরআনে বর্ণিত বনি ইসরাইল, ইয়াজুজ, মাজুজ, কারুন, নমরুদ ও ফেরাউনের কাহিনী উল্লেখযোগ্য।
মহাকালের ইতিহাসের সব দাম্ভিক রাজা-মহারাজা, আমির-ওমরাহ, উজির-নাজির, পাইক-পেয়াদা, কোতোয়াল কিংবা দ্বাররক্ষী সবার চরিত্রই মোটামুটি এক ছিল, আছে এবং আগামীতেও একই রূপ থাকবে। তাদের কোনো ধর্ম থাকে না- বর্ণও থাকে না। সাম্প্রদায়িক বিভেদ-বিপত্তিতেও তারা জড়ান না। তাদের চরিত্র, গুণাগুণ, কথাবার্তা কিংবা আচার-অনুষ্ঠান সব কিছুই ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। সিংহাসনকে কেন্দ্র করে তারা এমনভাবে ঘূর্ণায়মান থাকেন, যেমনটি সাধারণত পদার্থের নিউক্লিয়াসের মধ্যে ইলেকট্রন ও প্রোটন কণাগুলো করে থাকে। তারা ক্ষমতার জন্য যেমন হাসতে হাসতে অপরের প্রাণ কেড়ে নিতে পারেন, তেমনি আবার মৃত্যুর দরজায় অতি দ্রুত পৌঁছে যাওয়ার সময় একটু কান্না করারও সময় পান না। অর্থাৎ ক্ষমতার মদ-মত্ততায় উল্লসিত হয়ে কখন যে মালাকুুল মউতকে ডেকে নিয়ে আসেন, তা তারা টেরও পান না।
আদিকালের অত্যাচারী রাজা-বাদশাহরা নিজেদের জুলুম, অত্যাচার ও কুকর্মগুলোকে বর্ণাঢ্য ও উৎসবমুখর করার জন্য নিকৃষ্ট ও ধুরন্ধর প্রকৃতির লোকজনকে একান্ত কাছের মানুষ হিসেবে নিয়োগ দিতেন। এসব লোককে উচ্চ রাজপদে সরাসরি নিয়োগ দেয়া হতো না বটে, কিন্তু রাজা-বাদশাহর ধামাধরা হিসেবে তারা যেকোনো রাজকর্মচারীর চেয়ে ক্ষমতাবান ছিলেন। অন্য দিকে রাজা তার আপন কুকর্ম জায়েজ করার জন্য অত্যন্ত সুকৌশলে তিনটি কর্ম করতেন। তিনি তার রাজ্যের জ্ঞানী, গুণী, চরিত্রবান, সাধু-সজ্জন ও জনপ্রিয় লোকদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অপমান ও নানাভাবে নাজেহাল করতেন।
ফলে হাতেগোনা দু-চারজন ছাড়া বেশির ভাগ ভালো মানুষ গা বাঁচিয়ে চলতেন। কেউ কেউ স্বেচ্ছানির্বাসনে যেতেন। অনেকে নিজের নীতি-আদর্শ, কাণ্ডজ্ঞান, শিক্ষাদীক্ষা সাগরে নিক্ষেপ করে প্রাণভয়ে প্রথমে রাজ তোষণ করতেন, পরে এই শ্রেণীটি এমন জঘন্য ও ভয়ঙ্কর দুষ্কর্মের দোসর হয়ে যেতেন, যা দেখে শয়তান, দানব, ভূতপ্রেত ইত্যাদি অশরীরী আত্মা আশ্চর্য হয়ে নিজেদের বুক নিজেরা চাপড়ে বলত- ইয়া আল্লাহ, ওদেরকে আমাদের গুরু বানিয়ে দাও।
অত্যাচারী শাসকেরা জ্ঞানী-গুণী, সাধু-সজ্জনদের নির্জীব ও নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে সাধারণ জনগণকে নির্বোধ, ভাবলেশহীন, অথর্ব, অশিক্ষিত ও অভদ্র বানানোর জন্য রাষ্ট্রীয় মদদে বাহারি চেষ্টা-তদবির চালাতেন। মানুষকে মেধাশূন্য করে তোলার জন্য রাষ্ট্রীয় অর্থে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হতো। জনগণ যেন রাজাকে ভয় পান, এ জন্য সর্বত্র ভয়, সন্ত্রাস, জুলুম ও অত্যাচারের আবহাওয়া তৈরি করা হতো।
রাজার লোকেরা সারাক্ষণ বকবক করত এবং জনগণ সেটা শুনতে শুনতে এমন অভ্যস্ত হয়ে পড়তেন, যার কারণে রাজার বাইরে তাদের চিন্তা-চেতনা বলতে কিছুই থাকত না। অমর চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তার হীরক রাজার দেশের কাহিনীতে বিষয়টি অনবদ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। একইভাবে হিন্দি চলচ্চিত্র কিসসা কুরসি কাহা সিনেমাতেও রাজনীতির একাল-সেকালের অনেক নির্মম বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। চলচ্চিত্রের বাইরে গিয়ে আমরা যদি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পূর্ববতী জার্মানির রাজনীতি এবং এডলফ হিটলারের জীবন পর্যালোচনা করি তবে দেখব, জার্মানদের মতো উন্নত, সুসভ্য ও ঐতিহ্যবাহী জাতিও মনে করত, হিটলার হলেন সত্যিকার অর্থে তাদের জাতির পিতা, ত্রাণকর্তা ও রক্ষাকর্তা। এ জন্য তারা তাকে স্বঃস্ফূর্তভাবে ‘কুয়েরার’ বা ত্রাণকর্তা হিসেবে সম্বোধন করতেন।
পাক ভারতের অবিসংবাদিত স্বাধীনতাকামী নেতা সুভাস চন্দ্র বসু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মানিতে ছিলেন বেশ কিছুদিন। ভারতের তৎকালীন ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ আরম্ভ করার লক্ষ্যে তিনি জাপান ও জার্মানির সাহায্য লাভের জন্য সেই সময়ে হিটলারের সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়েছিলেন। আমি যে সময়টার কথা বলছি, তখন হিটলারের গুরুত্ব ও বিশালত্ব এতটাই উঁচুতে ছিল, যা বর্তমান জমানায় বসে কল্পনাও করা যায় না। তিনি বহু রাষ্ট্রীয় প্রটোকল, বহুমুখী তদবির এবং অনেক গোয়েন্দা সংস্থার হাজারো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পাস করে শেষ পর্যন্ত হিটলারের সাক্ষাৎ লাভে সমর্থ হয়েছিলেন। নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু একটি বিষয় খুব অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, জার্মানির সাধারণ জনজন হিটলারকে যেমন প্রচণ্ড ভয় করে, তেমনি মনে করে হিটলার ছাড়া তাদের কোনো গতি নেই। পারিবারিক খানাপিনা, ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনা থেকে শুরু করে সরকারি ও বেসরকারি সব পর্যায়ে একের অধিক অর্থাৎ মাত্র দুইজন লোকও যদি কোনো আলোচনা শুরু করত, তবে তারা শুরুতে বিশেষ ভঙ্গিমায় হাই হিটলার বলে হাত তুলে তারপর অন্য কথা বলত।
হিটলার জমানার জার্মানবাসী মনে করতেন, হিটলার সব বোঝেন এবং সব জানেন। এমনকি দুইজন জার্মান যদি কথা বলতেন, তবে তারা উভয়েই মনে করতেন, তাদের মধ্যকার অপরজন অবশ্যই হিটলারের গুপ্তচর। ফলে সবাই ততটাই সতর্ক হয়ে কথাবার্তা ও চালচলন করতেন, যার কারণে কিছু দিনের মধ্যেই জার্মান জাতির জাতীয় সংহতি ও ঐক্য ভেঙে যায়। তারা ব্যক্তিগত জীবনে এতটাই ভীরু, বাকরুদ্ধ ও চিন্তা-চেতনায় উদ্ভাবনী ক্ষমতাহীন বা বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েন, যা তাদের হাজার বছরের ইতিহাসে কোনো দিন ঘটেনি। লোকদের আনন্দ-বিনোদন, শিল্প-সাহিত্য চর্চা এবং উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ড স্থবির ও স্থূল হয়ে পড়ে। বেশির ভাগ মানুষ খাওদাও ফুর্তি করো, নিজের মতো প্রাণে বাঁচোÑ এই সূত্রে জীবন চালাতে থাকেন। রাজ্য, রাজা ও রাজনীতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা জার্মান জাতির অভিধান থেকে তিরোহিত হয়ে যায়। উল্টো হিটলারের কথা শোনার জন্য মানুষের মধ্যে এমন এক উন্মাদনা পয়দা হয়, যার নজির পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই।
হিটলারের উত্থান, স্থিতি, তার জনপ্রিয়তা, ক্ষমতা গ্রহণ, জুলুম ও নির্যাতন ইত্যাদি পর্যালোচনা করে বিশ্বের নামকরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন, তিনি কোনো স্বাভাবিক মানুষ ছিলেন না। তার সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব, ধুরন্ধর চরিত্র, অসৎ উদ্দেশ্য, মানুষকে ক্ষেপিয়ে দেয়ার দুরন্ত ক্ষমতা, প্রতিপক্ষকে সর্বনাশ করার যাবতীয় কূটকৌশল জানা এবং অনর্গল মিথ্যা বলা ও মিথ্যা নাটক সাজানোর দুর্নিবার সামর্থ্যরে কারণে তিনি ক্ষণে ক্ষণে ইচ্ছেমতো লাখো কোটি জার্মানবাসীকে বিভ্রান্ত করে বিপথে চালিত করতে পারতেন। এসব কাজ তিনি শুরু করেছিলেন জার্মান জাতিকে এক অভূতপূর্ব উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের সফলতা দেখিয়ে। নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বেকার সমস্যা দূরীকরণ জাতীয় পর্যায়ে সড়ক ও রেল যোগাযোগের বিস্ময়কর সফলতা দেখিয়ে তিনি জনগণকে প্রথমে নিজের পক্ষে নিয়ে নেন এবং পরে তাদের সাথে বেঈমানি ও নিষ্ঠুরতা শুরু করেন। হিটলার যেভাবে জাতীয় উন্নয়নের স্লোগান তুলে জনগণকে তার পক্ষে নিয়েছিলেন, ঠিক একইভাবে অন্য কোনো স্বৈরাচার তা পারেননি। রোমান সম্রাট নিরো তার স্বল্পকালের শাসনামলে পুরো রোমান সাম্রাজ্যে উন্নয়নের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু জনগণের সমর্থন তিনি পাননি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা একটি বিষয় নিয়ে বহু বছর গবেষণা করেও কোনো সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। তারা ভেবে পান না- কেন একজন জনপ্রিয় শাসক স্বৈরাচারী হয়ে যান। অথবা জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে কোনো জননেতা যখন ক্ষমতার মসনদে বসেন, তখন তার মধ্যে এমন কী জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, যার কারণে তিনি মুহূর্তের মধ্যে জনগণের ভালোবাসার প্রতিদান অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন ও নির্বাসন দ্বারা ফেরত দেন। একশ্রেণীর গবেষকের মতে, রাজনৈতিক নেতানেত্রী যখন ধাপ্পাবাজি করে জনগণের ভালোবাসা ও সমর্থন পেয়ে যান, তখন তাদের হৃদয়ে জনগণের জন্য কোনো মায়া-মমতা থাকে না। আমাদের সমাজের ভণ্ডপীর, ফকির, দয়াল বাবা, জটা বাবা, ঘেটু বাবা প্রভৃতি লোক যেভাবে জনগণকে নানা ভেল্কিবাজি দেখিয়ে জড়ো করেন; ঠিক তেমনি রাজনীতির ময়দানের ভেল্কিবাজি ও ব্যাপ্তি আরো অনেক বড়। ভণ্ডপীর-ফকিররা যেভাবে জনগণের সর্বনাশ করে তেমনি মুনাফেক রাজনীতিবিদ ক্ষমতালাভের পর সর্বনাশের পাগলা ঘোড়া জনগণের বুকের ওপর দিয়ে চালিয়ে দেন।
অনেকে হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন- কেন তারা ক্ষমতার দম্ভে বলতে গেলে গায়ে পড়ে জুলুম-অত্যাচার করেন। প্রতারণা, ছলচাতুরী, মুনাফেকি, মিথ্যাচার কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে গুম, হত্যা ইত্যাদি কাণ্ড করে ক্ষমতার মসনদে বসার পর যৌক্তিকভাবে কেউ হয়তো তার প্রতিদ্বন্দ্বী বা শ্রেণিশত্রুকে খতম করবেন। কিন্তু ওসব করার পরও কেন তারা নিরন্তরভাবে সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম-অত্যাচারের স্টিমরোলার চালান। প্রশ্নকারীদের মতে, সব স্বৈচরাচারী কি পারেন না তাদের অতীত অপকর্মকে ভবিষ্যৎ শুভকর্ম দ্বারা পুষিয়ে দিতে! এসব প্রশ্ন যারা করেন তারা হয়তো প্রকৃতির অমোঘ বিধান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। বিধাতার নিয়ম মতে, কেউ পাপাচার করলে তার চিন্তা ও চরিত্রের বিকৃতি কেউ রুখতে পারে না।
পাপীর মন এবং তার পঞ্চইন্দ্রিয় তখন তার প্রধান শত্রু হয়ে যায়। নিজের অজান্তে তার হাত, পা, ঠোঁট, জিহ্বা, চোখ বারবার তাকে পুনঃপুনঃ পাপকাজে উদ্বুদ্ধ করে। সে যত বেশি সতর্ক হওয়ার চেষ্টা করে, ততই অশ্লীল ও কদর্যভাবে তার পাপকার্যগুলো প্রকাশ্য হয়ে ওঠে, যা দেখে জনগণ তার প্রতি শ্রদ্ধা, মায়া ও মমতা হারিয়ে ফেলেন এবং তাকে ঘৃণা ও অভিশাপের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে ফেলেন।
স্বৈরাচারী রাজা-বাদশাহ সব সময় চান যে জনগণ কায়মনোবাক্যে তার সব কিছু স্বীকার করে নিক। জনগণ রাজার ভয়ে চুপ থাকেন। কিন্তু তাদের চোখ ও অঙ্গভঙ্গি স্পষ্ট করে দেয়, কতটা প্রবলভাবে তারা রাজাকে ঘৃণা করেন। অন্য দিকে রাজা অনেক কিছু না বুঝলেও এ কথা খুব ভালো করে বোঝেন, লোকজন তাকে কিভাবে অপছন্দ করেন এবং তাদের ঘৃণার মাত্রা কতটা ভয়ঙ্কর। ফলে এক অযাচিত ভয়ভীতি ও আতঙ্ক তাকে সব সময় অস্থির করে তোলে। অতিরিক্ত ভয়ের কারণে পৃথিবীর সব স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী রাজার ঘুম হারাম হয়ে যায়। তাদের পরিপাকতন্ত্র ও রেচনতন্ত্রে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। আধুনিক গবেষকেরা প্রমাণ করেছেন, ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিস বলতে গেলে সারা বছরই পেটের পীড়ায় আক্রান্ত থাকতেন। ফেরাউনের মতো শাসকেরা সব সময় নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন এবং দুনিয়ার কাউকে বিশ্বাস করেন না। তারা আপন পরিবার-পরিজন, অনুগত লোকজন এবং সাধারণ মানুষ সবাইকে নিজেদের মৃত্যুদূত কল্পনা করে বেঁচে থাকার জন্য বহু স্তরের নিরপত্তা দেয়াল গড়ে তোলেন এবং না ঘুমিয়ে জীবনকে পাহারা দেয়ার নামে অন্য সবার ঘুম হারাম করে দেন।
মদ-মত্ত ক্ষমতার অধিকারী রাজনীতিবিদেরা একালে অথবা সেকালে সর্বদাই এমন অহঙ্কার প্রদর্শন করেন, যা দেখে শুনে মনে হয় তারা কোনো দিন মরবেন না। তাদের কথা শুনলে মনে হয়, তারা কারো অধীন নন। পৃথিবীর যাবতীয় সুখ-সম্পদ কেবল তাদেরই জন্য এবং তামাম দুঃখ-যাতনা কেবলই তাদের শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য প্রযোজ্য। তাদের আচরণ দেখলে মনে হয়, তারা আজন্ম ক্ষমতাধর ছিলেন ও থাকবেন। দারিদ্র্য, দুঃখ, কষ্ট বা অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা নামক শব্দ তারা হয়তো জীবনে শোনেননি। তাদের চোখ দেখলে বজ্রপাতের কথা মনে পড়ে। তাদের কণ্ঠস্বরের ওঠানামা কেবলই ভূমিকম্পের মতো ভয় সৃষ্টি করে। তাদের আঙুলের হেলনি যেন নিরীহ মানুষের মৃত্যু পরোয়ানার ভয়ঙ্কর বার্তাবাহক জল্লাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আর তাদের উপস্থিতি মানুষকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বানিয়ে ফেলে এবং সেই সুযোগ নিয়েই স্বৈরাচারীরা জনগণকে বোকা বানিয়ে নিজেদের সিংহাসনকে তাদের বুকের ওপর চাপিয়ে দিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে বলে ওঠেন- আসলাম, দেখলাম এবং জয় করলাম!