পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম বন্দি!
অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ।।
বেশ ক’বছর আগে পাশ্চাত্যের একটি ম্যাগাজিনে স্পান্দো কারাগারের কথা পড়েছিলাম। এই কারাগারটি জার্মানির পশ্চিম বার্লিনের স্পান্দো বোরোতে অবস্থিত ছিল। ১৮৭৬ সালে এটি নির্মাণ করা হয় এবং ১৯৮৭ সালে এর শেষ বন্দির মৃত্যুর পর এটিকে ধূলিসাৎ করে দেয়া হয়। রুডলফ্ হেস ছিলেন এর শেষ বন্দি। কারাগারটি ধূলিসাৎ করে দেয়ার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল এটি যাতে নব্যনাজিদের তীর্থস্থানে পরিণত হতে না পারে। পরবর্তীকালে কারাগারটির স্থানে জার্মানিতে অবস্থানরত ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য একটি শপিং সেন্টার নির্মাণ করা হয়।
প্রথমদিকে এই কারাগারটি ছিল একটি সামরিক আটক কেন্দ্র। ১৯১৯ সাল থেকে এটি বেসামরিক বন্দিদের জন্যও ব্যবহৃত হতে থাকে। এই কারাগারে ৬০০ বন্দির স্থান সংকুলান হতো।
১৯৩৩ সালে রাইখস্টাগে অগ্নিসংযোগের পর হিটলারের বিরোধী ব্যক্তি ও সাংবাদিক, যেমন এগন কিশ এবং কার্ল ভন ওসিৎস্কি নামক বন্দিদের তথাকথিত নিরাপত্তামূলক আটক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। স্পান্দো কারাগার নাজি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের আদি রূপ ছিল বলা যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রুশিয়ার বিচার মন্ত্রণালয় দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচালিত হতো এটি। হিটলারের গুপ্ত পুলিশ গেস্টাপো এই কারাগারে বন্দিদের ওপর নির্যাতন চালাত। ১৯৩৩-এর শেষদিকে প্রথম নাজি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলো নির্মিত হয়েছিল। যাদের নিরাপত্তামূলক আটকাবস্থায় বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল তাদের এসব কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে রাখা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ৪টি ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল তাদের স্পান্দো কারাগারে রাখা হয়। এই কারাগারে মাত্র ৭ জন বন্দিকে বিচার শেষে রাখা হয় ১৮ জুলাই ১৯৪৭ থেকে। এই ৭ জন বন্দির মধ্যে পুরো দণ্ড ভোগ করার পর ৩ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। তিনজনকে স্বাস্থ্যগত কারণে আগাম মুক্তি দেয়া হয়। বাকি রইল মাত্র রুডলফ্ হেস। তার একমাত্র সঙ্গী ছিল ওয়ার্ডেন ইউজিন কে বার্ড। এই ব্যক্তিটি হেসের বন্দি জীবন সম্পর্কে একটি বই লেখেন। বইটির নাম ছিল The Loneliest Man in the World অর্থাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ মানুষ।
স্পান্দো কারাগারটি ছিল ৪টি ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন দুটি কারাগারের ১টি। কারাগার দুটি মিত্রপক্ষ নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল ভেঙে যাওয়ার পরও ৪টি ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে। এই ৪টি ক্ষমতাধর রাষ্ট্র বার্লিনে মাসিকভিত্তিতে আলাদাভাবে কারাগারটি নিয়ন্ত্রিত করত। ফলে প্রতিটি ক্ষমতাধর রাষ্ট্র বছরে মোট তিন মাস কারাগারটির ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখত। যখন যে দেশের নিয়ন্ত্রণ চালু থাকত, তখন সে দেশের পতাকা উড্ডয়ন করা হতো কারাগারটির ওপর। ১৯৬৬ সালের পর এই কারাগারে একক বন্দি হিসেবে ছিল রুডলফ্ হেস। তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। ১৯৮৭ সালের ১৭ আগস্ট কারাগারেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর।
মিত্র শক্তিগুলো ১৯৪৬ সালের নভেম্বরে কারাগারটি হুকুম দখল করে। তারা ভেবেছিল এই কারাগারে ১০০ কিংবা ততোধিক যুদ্ধাপরাধীদের রাখা হবে। প্রতি মুহূর্তে কারাগারের ভেতরে ও বাইরে ৬০ জনের মতো সৈনিক পাহারা দিত। ৪টি দেশের পেশাদার বেসামরিক ওয়ার্ডেনরাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। এতে ছিল ৪ জন কারাপরিদর্শক এবং তাদের সহকারী। আরও ছিল ৪ জন সেনা মেডিকেল অফিসার, পাচক, অনুবাদকারী, পরিবেশক, কুলি ও অন্যরা। খুবই অল্পসংখ্যক বন্দির জন্য এত বিশালসংখ্যক পাহারাদার, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পদের অপব্যবহার বলে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। পশ্চিম বার্লিন সরকার এই অপব্যয় খুবই অপছন্দ করত। কারণ তাদেরই এই ব্যয় বহন করতে হতো। অন্যদিকে তাদের কারাব্যবস্থার বহন ক্ষমতা সাধারণ বন্দিদের রাখার জন্য অপ্রতুল ছিল। মাত্র ৭ জন ব্যক্তিকে আটক রাখার জন্য এত বড় একটি কারাগার তার বিশাল কর্মী বাহিনীসহ বজায় রাখা ছিল আর্থিক সক্ষমতার ওপর বিরাট চাপ। ৭ জন বন্দির সংখ্যা যখন দিনে দিনে কমতে শুরু করল, ব্যয়ের বোঝা বহন ছিল অসহনীয়। ১৯৬৬ সাল থেকে একমাত্র বন্দি ছিল রুডলফ্ হেস।
এই কারাগারে বন্দিদের ভোর ৬টায় শয্যা ত্যাগ করে সেলগুলো এবং এগুলোর বারান্দা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হতো। তারপর প্রাতঃরাশ সেরে মধ্যাহ্নভোজ পর্যন্ত বাগানের কাজ করতে হতো। মধ্যাহ্নভোজের পর বন্দিরা নিজ নিজ সেলে কিছুক্ষণের জন্য মধ্যাহ্নভোজ পরবর্তী বিশ্রামের সুযোগ পেত এবং তারপরই বাগানের কাজে যেতে হতো। বিকাল ৫টায় রাতের খাবার খেতে হতো এবং তারপর নিজ নিজ সেলে ফিরতে হতো। রাত ১০টায় বাতি নিভিয়ে দেয়া হতো। প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতি সোম, বুধ ও শুক্রবার দাড়ি শেভ করা ও চুল কাটানোর সুযোগ পেত বন্দিরা। কাপড় কাচার জন্য নির্ধারিত ছিল সোমবার। বছরের পর বছর কারাগারের রুটিন প্রায় অপরিবর্তনীয়ভাবে আবর্তিত হতো। তবে নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রগুলো নিজ নিজ কারা বিধির ব্যাখ্যা দান করত। সব বন্দি সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণের মাসগুলোকে খুবই ভয়ের চোখে দেখত। রুশরা কারাবিধি বাস্তবায়নে খুব কড়াকড়ি করত। তাদের দেয়া খাবারও ছিল নিম্নমানের। প্রতিটি ক্ষমতাধর রাষ্ট্র নিজ নিজ পাচক নিয়ে আসত। মার্কিন, ফরাসি এবং ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত সময়ে কারাবন্দিরা উন্নত মানের খাবার পেত। সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণের সময় বন্দিদের কফি, রুটি, স্যুপ এবং গোল আলু পরিবেশন করা হতো। সোভিয়েত কারাপরিদর্শক বিরামহীনভাবে এই কঠোর নিয়মাবলী প্রয়োগ করত। এটি রুশ ও পাশ্চাত্যের কারারক্ষীরা খুবই অপছন্দ করত। ১৯৬০ সালে রুশ কারাপরিদর্শক পরিবর্তনের পর পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে এবং খাবারসহ অন্যান্য ব্যাপারে উন্নতি ঘটে।
স্পান্দো কারাগার ছিল পৃথিবীর নিকৃষ্টতম অত্যাচারী যুদ্ধাপরাধীদের জন্য নির্ধারিত। সুতরাং স্পান্দো কারাগারের নিয়মাবলী কঠোর হবে বলে আমরা ধরে নিতে পারি। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দুর্নীতির অভিযোগে নিু আদালত কর্তৃক ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। দণ্ডপ্রাপ্তির পরপরই তাকে ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়। তিনি এখন এই কারাগারেই বন্দি রয়েছেন। এই কারাগারটির সঙ্গে আমারও পরিচয় আছে। ১৯৭০ ও ৭১-এ জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনকালে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাকে এই কারাগারে বন্দিজীবন কাটাতে হয়। সুতরাং এই কারাগারের অবকাঠামো এবং সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় আছে। এই কারাগারটি ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল। দু-একটি সেল ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর পাকিস্তান আমলে নির্মিত হয়। এই কারাগারে আমাদের জাতীয় এবং অন্যান্য পর্যায়ের নেতারা বন্দিজীবন কাটিয়েছেন। এই কারাগারের সঙ্গে আমাদের জাতীয় ইতিহাস সম্পৃক্ত হয়ে আছে। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হওয়ার ফলে এই কারাগারের ভবনগুলো জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। সঙ্গত কারণেই এগুলো স্যাঁতসেঁতে এবং অস্বাস্থ্যকর। এই কারাগারটির চারদিকে রয়েছে ১৮ ফুট উঁচু পুরু দেয়াল। ঔপনিবেশিক শাসনামলে নির্মিত হওয়ার ফলে অধিকাংশ সেলের শৌচাগার অতি নিম্নমানের। আমি যে সময় এই কারাগারে রাজবন্দি হিসেবে ছিলাম, তখন এর ধারণ ক্ষমতা ছিল এক হাজার নয়শ’ আটত্রিশ। কিন্তু বাস্তবে ৩০০০-এরও অধিক বন্দিকে এই কারাগারে রাখা হতো। সশ্রম কারাদণ্ডভোগীরা রান্নাবান্না, পানি সরবরাহ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, ফুলের বাগানের পরিচর্যা করা, শাকসবজি উৎপাদন করা এবং কারাগারের হাঁটাপথ নির্মাণের জন্য সুড়কি ভাঙা ও বন্দিদের জন্য খাদ্য বিতরণের কাজ করত। কড়া শৃঙ্খলায় কারাগার পরিচালিত হতো, রাতের বেলায় একাধিকবার বন্দির সংখ্যা গোনা হতো। সন্ধ্যা হলেই লকাপে প্রবেশ করতে হতো। আরও অনেক রকম কাজকর্ম হতো এই কারাগারে। কম্বল ফ্যাক্টরিতে কম্বল বোনা হতো। কারাদণ্ডপ্রাপ্ত তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদিদের ডোরা কাটা মোটা কাপড়ের ফতুয়া ও পাজামা কিংবা হাফ পাজামা পরতে হতো।
বছরখানেকেরও বেশি সময় আগে এই কারাগারটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। কেরানীগঞ্জে একটি নতুন কারাগার তৈরি করা হয়। সেখানে এই কারাগারের অনেক বন্দিকেই স্থানান্তরিত করা হয়। কেরানীগঞ্জের জেলখানাটি সুপরিকল্পিত না হওয়ার অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তারও আগে কাশিমপুরের আধুনিক কারাগারটি নির্মাণ করা হয়।
বাংলাদেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পরিত্যক্ত পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছে। এই কারাগারে আর কোনো বন্দি আছে বলে জানা নেই। আমার অভিজ্ঞতা থেকে যতদূর বুঝতে পারি তাকে পরিত্যক্ত এই কারাগারের জেলগেটে অবস্থিত প্রশাসনিক ভবনের কোনো একটি কক্ষে রাখা হয়েছে। কারাগারে অবস্থানের অন্তত প্রথম দুই কী তিন দিন তাকে ডিভিশন মর্যাদা দেয়া হয়নি। ১১ ফেব্রুয়ারির টিভি সংবাদ থেকে জানা গেল তাকে ডিভিশনের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। তবে এটি বাস্তবায়িত হয়েছে কিনা নিঃসন্দেহে বলা যায় না। কারণ ডিভিশন দেয়ার নির্দেশনা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জন্য সময়মতো পৌঁছেছে কিনা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না।
এ ব্যাপারে জনমনে যেসব প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে সে সম্পর্কে জনগণকে নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বয়োবৃদ্ধ নারী যেটুকু মর্যাদা পাওয়ার হকদার, সেটা সুনিশ্চিত করাই সরকারের দায়িত্ব। তাকে একটি পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ পুরনো কারা ভবনে একেবারে একলা বন্দি রাখা চরম মানসিক নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে। হয়তো সমগ্র বিশ্বে তিনি একমাত্র নিঃসঙ্গতম বন্দি বর্তমানে। তিনি কি নাজি যুদ্ধাপরাধী রুডলফ্ হেস ও অন্যদের মতো জঘন্যতম অপরাধ করেছেন? তার কথিত অপরাধ নিঃসন্দেহে ওই পর্যায়ে পড়ে না। সবকিছু দেখেশুনে বোদ্ধা মহলের কেউ কেউ বলেছেন, আমরা কী করে এমন অমানবিক হয়ে গেলাম? সহিংস না হয়েও কী করে মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হয় তা মার্টিন লুথার কিং দেখিয়ে গেছেন। অনেক সময় অহিংসার শক্তি হিংসার নৃশংসতার তুলনায় বহুগুণ শক্তিশালী হতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন ধৈর্য, নিষ্ঠা, সাহসিকতা এবং চাবুকের মুখে পিঠ উদোম করে দেয়া।
অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহঃ কলামিস্ট, লেখক ও অর্থনীতিবিদ।