ভ্যালেনটাইন ডে বা ভালবাসা দিবস।

February 14, 2018 10:04 pm0 commentsViews: 245

সম্পাদনা, পরিবর্দ্ধন ও পরিমার্জনাঃ  নিউইয়র্ক থেকে ড. ‍ওমর ফারুক।। মূল লেখকঃ  শাহরিয়ার সিফাত।। 

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮  নাকি ‘ভ্যালেনটাইন ডে’ অর্থাৎ ভালবাসা দিবস । চারদিকে ভ্যালেনটাইন ডে নিয়ে এত পোষ্ট এত ষ্ট্যাটাস এত ছবি এত মেসেজ দেখে মনটা অনুসন্ধানী হয়ে উঠল । হঠাৎ কি মনে করে হিস্ট্রি অফ ভ্যালেনটাইন ডে লিখে গুগলে সার্চ দিলাম । সার্চ দেয়ার পর দুনিয়ার সব ’ভ্যালেনটাইন ডে’ এর ইতিহাস চলে এল । তারই কিছু নমুনা ছিল এই…

নমুনা একঃ রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস লক্ষ্য করলেন বিবাহিত যুবকদের তুলনায় অবিবাহিত যুবকরা যুদ্ধের কঠিনতম মুহূর্তে ধৈর্য -এর পরিচয় বেশি দেয়। অনেক সময় বিবাহিত যোদ্ধারা স্ত্রী-পুত্রের টানে যুদ্ধে যেতেও অস্বীকৃতি জানায়। তাই যুগল বন্দী তথা যে কোন পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন তিনি। কিন্তু সেন্ট ভেলেনটাইন নামের এক প্রার্দী এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং গোপনে তার গির্জায় পরিণয় প্রথা চালু করেন।  এ খবর জানাজানি হলে সম্রাট তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। এরপর থেকে নাকি ভ্যালেনটাইন ডে’র সুত্রপাত ।

নমুনা দুইঃ সেন্ট ভেলেন্টাইন খ্র্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর একজন খ্রিশ্চিয়ান ধর্ম প্রচারক ছিলেন। রোমের তৎকালীন সম্রাট ছিলেন রোমান দেব-দেবীর পূজায় বিশ্বাসী। সম্রাট খ্রিশ্চিয়ান ধর্ম প্রচারের জন্যই তাকে জেলে বন্দী করেন । জেলের ভেতরই পরিচয় ঘটে এক মেয়ের সাথে,যে মেয়ে ছিল জেলারেরই মেয়ে । সে প্রায়ই কারারুদ্ধ অবস্থায় তাকে দেখতে আসত । এভাবে ভেলেনটাইন তার প্রেমে পড়ে যায়। মৃত্যুর আগে মেয়েটিকে লেখা এক চিঠিতে সে জানায়, তার ভালবাসার কথা এবং চিঠির নিচে লিখে দেনঃ ইতি- তোমার ভ্যালেনটাইন। এরপর থেকেই নাকি ভ্যালেনটাইন ডে’র সূত্রপাত ।

নমুনা তিনঃ ইউরোপে এর প্রচলন নিয়ে একটু ভিন্ন মতবাদ রয়েছে ।এর প্রচলন ইউরোপে শুরু হয় সম্ভবত ২৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে । তখন মধ্য ফেব্রুয়ারিতে লুফারছেলিয়া নামে একটা উৎসব হত । যে উৎসব বসন্ত শুরুর সাথে সাথে শুরু হত এবং তারা নিজেকে আত্মশুদ্ধির জন্য এ সময়টাকে বিবেচনায় আনত। লুফারছেলিয়া উৎসবের প্রথম অংশে সব যুবক ছেলেরা দূরে কোন গুহায় গিয়ে একটা কুকুর এবং একটা ছাগল জবাই দিত । জবাই দেয়ার পর ছাগলের চামড়া স্লাইস করে নিয়ে এসে মেয়েদের ছুঁয়াত । দ্বিতীয় অংশে গ্রামের সকল যুবকরা সমস্ত মেয়েদের নাম চিরকুটে লিখে একটি পাত্রে জমা করত। অতঃপর ঐ পাত্র হতে লটারীর মত প্রত্যেক যুবক একটি করে চিরকুট তুলত, যে যুবক যে মেয়ের নাম তুলত, সে যুবকের সাথে ঐ মেয়ের সারা বৎসর প্রেমের সম্পর্ক থাকত। তখন তারা তাকে একটা চিঠি লিখত, যে চিঠির শিরোনামে লেখা হতঃ  ‘প্রতিমা মাতার নামে তোমার প্রতি এ পত্র প্রেরণ করছি’। তাদের মাঝে এ সম্পর্ক সারা বৎসর বিদ্যমান থাকত। বৎসর শেষে এ সম্পর্ক নবায়ন বা পরিবর্তন করা হত। এ কালচারটি তৎকালীন খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের দৃষ্টিগোচর হলে তাদেরকে এই বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে। তারা ভাবতে লাগল কিভাবে একে সমূলে উৎপাটন যায় । এক সময় তারা বুঝল যে, এটা সমূলে উৎপাটন করা অসম্ভব। তাই তারা অন্য পথ অবলম্বন করল। শুধু পত্রের শিরোনামটি পাল্টে দিয়ে একে খ্রিশ্চিয়ান ধর্মায়ন করার জন্য তারা একটা নির্দেশ জারি করল। সে নির্দেশণায় বলা হলঃ ‘ এখন থেকে এ পত্রগুলো ‘সেন্ট ভেলেনটাইন’-এর নামে প্রেরণ করতে হবে।’ কারণ, এটা খ্রিশ্চিয়ান নিদর্শন, এভাবেই তারা ধীরে ধীরে খ্রিশ্চিয়ান ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত হবে।

কার্ড নিয়ে একটা নমুনাঃ  গ্রেট ব্রিটেনে এর প্রচলন শুরু হয় প্রায় সতেরশ শতাব্দীর দিকে । সেখানে তারা একে অপরকে হাতে লেখা ছোট ছোট চিরকুট দিয়ে একে অপরের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করত । আটারশ শতাব্দীর শেষের দিকে প্রিন্টেড কার্ডের প্রচলন শুরু হল। তখন মানুষের অনুভূতি প্রকাশের জন্য রেডিমেড কার্ড-ই সবচেয়ে সহজলভ্য হয়ে ওঠে  । তাছাড়া অধিকতর সহজলভ্য পোষ্টাল ব্যবস্থা এটাকে আরো জনপ্রিয় করে তুলল । আর  আমেরিকানরা অবশ্য এর আগ থেকেই কার্ডের মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানাতে অভ্যাস্ত ছিল ।

বিশ্ব ভালবাসা দিবস আজঃ
আজ বিশ্ব ভালবাসা দিবস। ভালবাসার জন্য আলাদা একটি দিন। চোখে মায়ার কাজল মেখে দুরু দুরু বুকে ভালবাসা প্রকাশের মধুর দিন বুঝি আজ। রৌদ্রকরোজ্জ্বল শুভ্র সকাল, রূপালী দুপুর, আর মায়াবী রাত আজ কেবলই ভালবাসার ক্ষণ। করতালে সুর তুলে আজ ভালবাসার গান গাইবার দিন নাকি। ‘ভালবাসা মোরে ভিখারি করেছে তোমারে করেছে রাণী’, অথবা ‘আমি ভালবাসি যারে, সে কী কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে…’। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় যদি বলিঃ  ‘তোমরা যে বল দিবস-রজনী, ভালবাসা ভালবাসা সখী ভালবাসা কারে কয়, সে তো কেবলই যাতনা নয়’। এভাবে নানাভাবে ভালবাসার বর্ণনা দেয়া হলেও মূলতঃ ভালবাসার সর্বজনীন কোন সংজ্ঞা আজও নির্দিষ্ট হয় নি কিংবা আবিষ্কার করা যায় নি। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, পৃথিবীর আদিমতম সম্পর্কের নাম ভালবাসা। জান্নাতে হযরত আদম (আ) ও বিশ্ব মানবের প্রথম জননী ‘হাওয়া (আ)’ থেকেই এ ভালবাসা শুরু। ভালবাসা- এ প্রত্যয়টি নিয়ে পৃথিবীতে যত গল্প, কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা রচিত হয়েছে, আর কোন সম্পর্ক নিয়ে তা হয় নি। ভালবাসার জন্য কেউ সাম্রাজ্যও তো ত্যাগ করেছে, কেউ জীবন উৎসর্গও করেছে । ভালবাসার মানুষটিকে খুশি করতে ফরহাদ তো শিরি’কে খুশিতে আন্দোলিত করতে ওেো্রয়সীর   বিশাল পাহাড়ও কেটেছে। সঙ্গী বা সঙ্গীনি’র প্রতি সেই ভালবাসাকে চিরঞ্জীব ও শ্বাসত করে তুলতে মানুষেরা ইতিহাসের পাতা থেকে যে ভাবেই হোক শেষাবধি নিয়ে এসেছে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ বা ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’। বিশ্ববাসীর সঙ্গে সম্প্র্রতি বাংলাদেশেও তরুণ-তরুণীদের এক বিশাল অংশও পালন করছে এ দিবসটি। বাংলািদেশে ভালবাসা পালনে থাকে বাড়তি বসন্তের ছোঁয়া। কেননা ফাগুনের মৃদু মন্দ বাতাস বয়ে চলে এ দিনগুলোতে। নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এ দিবসটি তারা পালন করে থাকে। এ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা স্থানে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানও প্রচার করে। পত্রিকাগুলো বিশেষ সংখ্যাও বের করে এবং সে সংখ্যায় ভালবাসা দিবসটির ওপর ক্রোড়পত্র বা বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
ইতিহাস মতে, তৃতীয় শতকে রোমের যাজক ছিলেন দ্বিতীয় ক্লাডিয়াস। সে সময় তার ঘোষণা অমান্য করে প্রথম ভ্যালেন্টাইন গোপনে প্রেমিক-প্রেমিকাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। ২৭০ খ্রিস্টাব্দে বিশপ ভ্যালেন্টাইন ভালবাসার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেন। তৃতীয় ভ্যালেন্টাইন উত্তর আফ্রিকার একটি রোমান সাম্রাজ্য আত্মোত্সর্গ করেন। ক্যাথলিক এনসাইক্লোপিডিয়া অনুসারে এই তিন ভ্যালেন্টাইন ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালবাসার জন্য আত্মাহুতি দেন। সেসব ইতিহাসের পথ ধরে ৪৯৮ সালে প্রথম জেলসিয়াস ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালবাসা দিবসের ঘোষণা দেন। দিবসটি সর্বজন গ্রহণযোগ্যতা পায় প্রায় ৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর আগে প্রতিবছর রোমানরা ১৪ ফেব্রুয়ারি পালন করত ‘জুনো’ উত্সব। রোমান পুরাণে বিয়ে ও সন্তানের দেবী জুনোর নামানুসারে এর নামকরণ। এদিন অবিবাহিত তরুণরা কাগজে নাম লিখে লটারির মাধ্যমে তার নাচের সঙ্গীকে বেছে নিত। ৪০০ সালের দিকে রোমানরা যখন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে, তখন ‘জুনো’ উত্সব আর সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগের দিনটি একসুতোয় গেঁথে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ হিসেবে উদযাপন করা শুরু হয়।

তবে বসন্তের সঙ্গে একাকার হয়ে বাংলাদেশে আজ পালন করল উৎসবমুখর এ দিবসটি। ভালবাসা দিবসকে এখন বাংলাদেশের সেই গ্রুপটি সংস্কৃতিতে নতুন সংযোজন করে নেয়। সে গ্রুপের তরুণ-তরুণীদের কাছে এ যেন এক মহোৎসব। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ছাড়াও বিদেশি দূতাবাসগুলো ভালবাসা দিবকে বিভিন্ন ভাবে সমর্থন যুগিয়ে যেতে অতি আগ্রহ ভরে ভূমিকা পালন করে।
এদিবসে কী হয়! ফুল দোকানে থরে থরে সাজানো থাকে মল্লিকা, জুঁই, গাঁদা। সেসব ফুলগুলো উঠে আসে এদিন ললনাদের খোঁপায়। প্রিয়তমার খোঁপায় গাঁদার হলুদ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাবে প্রিয়’র পাঞ্জাবি-ফতুয়া। মুহুর্মুহু বেজে উঠে মোবাইল ফোন। বিনিময় হয় ভালবাসার বার্তা। হাতে রেখে হাত যুগলবন্দি নারী-পুরুষ ভালবাসার জানান দেয় নিজের মত করে, নারী পুরুষ মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। সে একাকার হতে গিয়ে নানান অঘটনও বাংলাদেশে বেশিই ঘটে। কেননা যে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত নেই। ধর্ষণ সাংস্কৃতি যে দেশে সরকারি দলেরপেৃষ্ঠপোষকতায় হয়, এখানে নারী ও পুরুষের ওপর সমান তালে চলে যৌন সহিংসতা।তবে ভালবাসা দিবসটি কেবল প্রিয়তম আর প্রিয়তমেষুর জন্য নয়। এ দিবসের তাৎপর্য নাকি আরও বিশাল ও সার্বজনীন। সন্তানের প্রতি পিতামাতার অপত্য স্নেহ এবং পিতামতার প্রতি সন্তানের আন্তরিক সংবেদন সব মিলিয়েই ভালবাসার এই দিন। আদরের ছেলেমেয়ের জন্য বাবা-মার থাকবে আশীর্বাদ ও প্রার্থনা। ছেলেমেয়েও শ্রদ্ধা-ভালবাসায় সিক্ত করে দেবে বাবা-মাকে।

‘ভালবাসা দিবসটিকে কেন্দ্র করে সারা পৃথিবী দিন দিন উন্মাতাল হয়ে উঠছে, সে নিয়েও এখন ভীষণ শঙ্কা কাজ করে, বললেন নিউইয়র্কে বসবাসকারী একজন নেটিভ আমেরিকান। বাজার ছেয়ে যাচ্ছে নানাবিধ হাল ফ্যাশনের উপহারে। পার্কগুলোতে চলছে ধোয়ামোছা। রেস্তরাঁগুলো সাজছে নতুন সাজে। পৃথিবীর প্রায় সব বড় শহরেই ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’-কে ঘিরে সাজ সাজ রব। পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি প্রাচ্যের দেশগুলোতেও এখন ঐ সংস্কৃতির মাতাল ঢেউ লেগেছে। হৈ চৈ, উন্মাদনা, রাঙায় মোড়া ঝলমলে উপহার সামগ্রী, নামি রেস্তরাঁয় ‘ক্যান্ডেল লাইট ডিনার’কে ঘিরে প্রেমিক যুগলের চোখেমুখে এখন বিরাট উত্তেজনা। হিংসা-হানাহানির যুগে ভালবাসার জন্য ধার্য মাত্র এই একটি দিন! প্রেমিক যুগল তাই উপেক্ষা করে সব চোখ রাঙানি। বছরের এ দিনটিকে তারা বেছে নিয়েছে হৃদয়ের কথকতার কলি ফোটাতে।

ভালবাসা দিবসের এ দিবসটিতে প্রেমের নামে বেলেল্লাপনার অভিযোগও কম নয়। বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম এ দিবসটিকে ভালবাসার দিবস বলতে একদমই নারাজ। হাল জমানায় এ দিবসটিকে কেন্দ্র করে যা ঘটে, তা ইসলামি সমাজে মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। এটিকে হারাম দিবসও ঘোষণা করছেন আল্লাহভীরু মাখলুকাত মানুষেরা।  বছরে মাত্র একটি দিন ও রাত প্রেম সরোবরে ডুব দেয়া, সাঁতার কাটা,  নৈতিক চরিত্রের চরম অবক্ষয়ের দিবসটির নামই হল ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’। এদিন প্রেমিক প্রেমিকারা সব ছেড়ে ছুড়ে জীবনের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়। বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কের  সলিল সমাধিতে হারিয়ে যাওয়ার দিবস হচ্ছে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ বা ‘ভালবাসা দিবস’। সারাবিশ্বে ভ্যালেন্টাইন ডে পালিত হয় প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারী।

ইতিহাসে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ সম্পর্কে আরও বর্ণণাঃ

‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’র ইতিহাস প্রাচীন। এর উৎস হচ্ছে ১৭শ’ বছর আগের পৌত্তলিক রোমকদের মাঝে প্রচলিত ‘আধ্যাত্মিক ভালবাসা’র উৎসব। এ পৌত্তলিক উৎসবের সাথে কিছু কল্পকাহিনী জড়িত ছিল, যা পরবর্তীতে রোমীয় খৃষ্টানদের মাঝেও প্রচলিত হয়। এ সমস্ত কল্প-কাহিনীর অন্যতম হচ্ছে, এ দিনে পৌত্তলিক (অগ্নি উপাসক) রোমের পৌরাণিক কাহিনীতে বর্ণিত রোমিউলাস নামক জনৈক ব্যক্তি একদা নেকড়ের দুধ পান করায় অসীম শক্তি ও জ্ঞানের অধিকারী হয়ে প্রাচীন রোমের প্রতিষ্ঠা করেন। রোমানরা এ পৌরাণিক কাহিনীকে কেন্দ্র করে ১৫ ফেব্রুয়ারী উৎসব পালন করত। এ দিনে পালিত বিচিত্র অনুষ্ঠানাদির মধ্যে একটি হচ্ছে, দু’জন শক্তিশালী পেশীবহুল যুবক গায়ে কুকুর ও ভেড়ার রক্ত মাখত। অতঃপর দুধ দিয়ে তা ধুয়ে ফেলার পর এ দু’জনকে সামনে নিয়ে বের করা হ’ত দীর্ঘ পদযাত্রা। এ দু’যুবকের হাতে চাবুক থাকত, যা দিয়ে তারা পদযাত্রার সামনে দিয়ে অতিক্রমকারীকে আঘাত করত। রোমক রমণীদের মাঝে কুসংস্কার ছিল যে, তারা যদি এ চাবুকের আঘাত গ্রহণ করে, তবে তারা বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তি পাবে। এ উদ্দেশ্যে তারা এ মিছিলের সামনে দিয়ে যাতায়াত করত। রোমকরা খৃষ্টধর্ম গ্রহণের পরও এ উৎসব উদ্যাপনকে অব্যাহত রাখে। কিন্তু এর পৌত্তলিক খোলস পাল্টে ফেলে খৃষ্টীয় খোলস পরানোর জন্য তারা এ উৎসবকে ভিন্ন এক ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট করে। সেটা হচ্ছে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক জনৈক খৃষ্টান সন্ন্যাসীর জীবনোৎসর্গ করার ঘটনা। ইতিহাসে এরূপ দু’জন সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের কাহিনী পাওয়া যায়। এদের একজন সম্পর্কে দাবী করা হয় যে, তিনি শান্তি ও প্রেমের বাণী প্রচারের ব্রত নিয়ে জীবন দিয়েছিলেন। তার স্মরণেই রোমক খৃষ্টানরা এ উৎসব পালন অব্যাহত রাখে। কালক্রমে ‘আধ্যাত্মিক ভালবাসা’র উৎসব রূপান্তরিত হয় জৈবিক কামনা ও যৌনতার উৎসবে। পরবর্তীতে রোমানরা খৃষ্টানদের অধীনে আসলে তাদের অনেকেই খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করে। খৃষ্টান ধর্মের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ধর্মবিরোধী, সমাজ বিধ্বংসী ও ব্যভিচার বিস্তারকারী এ প্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন। এমনকি খৃষ্টধর্মের প্রাণকেন্দ্র ইতালীতে এ প্রথা অবশেষে বিলুপ্ত করা হয়। কিন্তু আঠারো ও ঊনিশ শতকে তা পুনরায় চালু হয়।

ক্যাথলিক বিশ্বকোষে ভ্যালেনটাইন ডে সম্পর্কে তিনটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু বিভিন্ন বইয়ে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা উদ্ধৃত হয়েছে। তন্মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকটি ঘটনা নিম্নরূপ :

১ম বর্ণনা : রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস-এর আমলের ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেনটাইন ছিলেন শিশুপ্রেমিক, সামাজিক ও সদালাপী এবং খৃষ্টধর্ম প্রচারক। আর রোম সম্রাট ছিলেন দেব-দেবীর পূজায় বিশ্বাসী। সম্রাটের তরফ থেকে তাকে দেব-দেবীর পূজা করতে বলা হ’লে ভ্যালেন্টাইন তা অস্বীকার করেন। ফলে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। রোম সম্রাটের বারবার খৃষ্টধর্ম ত্যাগের আহবান প্রত্যাখ্যান করলে ২৭০ খৃস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রীয় আদেশ লঙ্ঘনের অভিযোগে সম্রাট ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন।

২য় বর্ণনা : খৃষ্টীয় ইতিহাস অনুযায়ী এ দিবসের সূত্রপাত হয় ২৬৯ খৃষ্টাব্দে। সাম্রাজ্যবাদী, রক্তলোলুপ রোমান সম্রাট ক্লডিয়াসের দরকার ছিল এক বিশাল সৈন্যবাহিনীর। এক সময় তার সেনাবাহিনীতে সেনা সংকট দেখা দেয়। কিন্তু কেউ তার সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে রাযী নয়। সম্রাট লক্ষ্য করলেন যে, অবিবাহিত যুবকরা যুদ্ধের কঠিন মুহূর্তে অত্যধিক ধৈর্যশীল। ফলে তিনি যুবকদের বিবাহ কিংবা যুগলবন্দী হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। যাতে তারা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অনীহা প্রকাশ না করে। তার এ ঘোষণায় দেশের তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীরা ক্ষেপে যায়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামের এক ধর্মযাজকও সম্রাটের এ নিষেধাজ্ঞা মেনে নিতে পারেননি। প্রথমে তিনি ভালবেসে সেন্ট মারিয়াসকে বিয়ের মাধ্যমে রাজার আদেশকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং তার গীর্জায় গোপনে বিয়ে পড়ানোর কাজ চালাতে থাকেন। একটি রুমে বর-বধূ বসিয়ে মোমবাতির স্বল্প আলোয় ভ্যালেন্টাইন ফিস ফিস করে বিয়ের মন্ত্র পড়াতেন। কিন্তু এ বিষয়টি এক সময়ে সম্রাট ক্লডিয়াস জেনে যান। তিনি সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। ২৭০ খৃষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারী সৈন্যরা ভ্যালেন্টাইনকে হাত-পা বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে সম্রাটের সামনে হাযির করলে তিনি তাকে হত্যার আদেশ দেন। ঐ দিনের শোক গাঁথায় আজকের ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’।

অন্য বর্ণনা মতে, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন কারারুদ্ধ হওয়ার পর প্রেমাসক্ত যুবক-যুবতীদের অনেকেই প্রতিদিন তাকে কারাগারে দেখতে আসত এবং ফুল উপহার দিত। তারা বিভিন্ন উদ্দীপনামূলক কথা বলে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে উদ্দীপ্ত রাখত। জনৈক কারারক্ষীর এক অন্ধ মেয়েও ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে যেত। অনেকক্ষণ ধরে তারা দু’জন প্রাণ খুলে কথা বলত। এক সময় ভ্যালেন্টাইন তার প্রেমে পড়ে যায়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক চিকিৎসায় অন্ধ মেয়েটি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। ভ্যালেন্টাইনের ভালবাসা ও তার প্রতি দেশের যুবক-যুবতীদের ভালবাসার কথা সম্রাটের কানে যায়। এতে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে মৃত্যুদন্ড দেন। তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল ২৬৯ খৃষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারী।

৩য় বর্ণনা : গোটা ইউরোপে যখন খৃষ্টান ধর্মের জয়জয়কার, তখনও ঘটা করে পালিত হ’ত রোমীয় একটি রীতি। মধ্য ফেব্রুয়ারীতে গ্রামের সকল যুবকরা সমস্ত মেয়েদের নাম চিরকুটে লিখে একটি জারে বা বাক্সে জমা করত। অতঃপর ঐ বাক্স হ’তে প্রত্যেক যুবক একটি করে চিরকুট তুলত, যার হাতে যে মেয়ের নাম উঠত, সে পূর্ণবৎসর ঐ মেয়ের প্রেমে মগ্ন থাকত। আর তাকে চিঠি লিখত, এ বলে ‘প্রতিমা মাতার নামে তোমার প্রতি এ পত্র প্রেরণ করছি।’ বৎসর শেষে এ সম্পর্ক নবায়ন বা পরিবর্তন করা হ’ত। এ রীতিটি কতক পাদ্রীর গোচরীভূত হ’লে তারা একে সমূলে উৎপাটন করা অসম্ভব ভেবে শুধু নাম পাল্টে দিয়ে একে খৃষ্টান ধর্মায়ন করে দেয় এবং ঘোষণা করে এখন থেকে এ পত্রগুলো ‘সেন্ট ভ্যালেনটাইন’-এর নামে প্রেরণ করতে হবে। কারণ এটা খৃষ্টান নিদর্শন, যাতে এটা কালক্রমে খৃষ্টান ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়।

৪র্থ বর্ণনা : প্রাচীন রোমে দেবতাদের রাণী জুনো (ঔঁহড়)’র সম্মানে ১৪ ফেব্রুয়ারী ছুটি পালন করা হ’ত। রোমানরা বিশ্বাস করত যে, জুনোর ইশারা-ইঙ্গিত ছাড়া কোন বিয়ে সফল হয় না। ছুটির পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারী লুপারকালিয়া ভোজ উৎসবে হাযারো তরুণের মেলায় র‌্যাফেল ড্র’র মাধ্যমে সঙ্গী বাছাই প্রক্রিয়া চলত। এ উৎসবে উপস্থিত তরুণীরা তাদের নামাংকিত কাগজের সি­প জনসম্মুখে রাখা একটি বড় পাত্রে (জারে) ফেলত। সেখান থেকে যুবকের তোলা সি­পের তরুণীকে কাছে ডেকে নিত। কখনও এ জুটি সারা বছরের জন্য স্থায়ী হ’ত এবং ভালবাসার সিঁড়ি বেয়ে বিয়েতে পরিণতি ঘটত।

৫ম বর্ণনা : রোমানদের বিশ্বাসে ব্যবসা, সাহিত্য, পরিকল্পনা ও দস্যুদের প্রভু ‘আতারিত’ এবং রোমানদের সবচেয়ে বড় প্রভু ‘জুয়াইবেতার’ সম্পর্কে ভ্যালেনটাইনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। সে উত্তরে বলে, এগুলো সব মানব রচিত প্রভু, প্রকৃত প্রভু হচ্ছে, ‘ঈসা মসীহ’। এ কারণে তাকে ১৪ ফেব্রুয়ারীতে হত্যা করা হয়।

৬ষ্ঠ বর্ণনা : কথিত আছে যে, খৃষ্টধর্মের প্রথম দিকে রোমের কোন এক গীর্জার ভ্যালেন্টাইন নামক দু’জন সেন্ট (পাদ্রী)-এর মস্তক কর্তন করা হয় নৈতিক চরিত্র বিনষ্টের অপরাধে। তাদের মস্তক কর্তনের তারিখ ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারী। ভক্তেরা তাদের ‘শহীদ’ (!) আখ্যা দেয়। রোমান ইতিহাসে শহীদের তালিকায় এ দু’জন সেন্টের নাম রয়েছে। একজনকে রোমে এবং অন্যজনকে রোম থেকে ৬০ মাইল (প্রায় ৯৭ কি.মি.) দূরবর্তী ইন্টারামনায় (বর্তমান নাম ঞবৎহর) ‘শহীদ’ করা হয়। ইতিহাসবিদ কর্তৃক এ ঘটনা স্বীকৃত না হ’লেও দাবী করা হয় যে, ২৬৯ খৃষ্টাব্দে ‘ক্লাউডিয়াস দ্যা গথ’-এর আমলে নির্যাতনে তাদের মৃত্যু ঘটে। ৩৫০ খৃষ্টাব্দে রোমে তাদের সম্মানে এক রাজপ্রাসাদ (ইধংরষরপধ) নির্মাণ করা হয়। ভূগর্ভস্থ সমাধিতে একজনের মৃতদেহ আছে বলে অনেকের ধারণা।

অন্য এক তথ্যে জানা যায়, রোমে শহীদ ইন্টারামনা গীর্জার বিশপকে ইন্টারামনা ও রোমে একই দিনে স্মরণ করা হয়ে থাকে। রোমান সম্রাট ২য় ক্লাউডিয়াস ২০০ খৃষ্টাব্দে ফরমান জারী করেন যে, তরুণরা বিয়ে করতে পারবে না। কারণ অবিবাহিত তরুণরাই দক্ষ সৈনিক হ’তে পারে এবং দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। ভ্যালেন্টাইন নামের এক তরুণ সম্রাটের আইন অমান্য করে গোপনে বিয়ে করে। কেউ কেউ বলেন, রাজকুমার এ আইন লংঘন করেন।

৭ম বর্ণনা : ৮২৭ খৃষ্টাব্দে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামের এক ব্যক্তি রোমের পোপ নির্বাচিত হয়েছিল। তিনি তাঁর চারিত্রিক মাধুর্য এবং সুন্দর ব্যবহার দিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই রোমবাসীর মন জয় করে নিয়েছিলেন। কিন্তু মাত্র ৪০ দিন দায়িত্ব পালনের পরই তাঁর জীবনাবসান ঘটে। প্রিয় পোপের মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে ১৪ ফেব্রুয়ারী রোমবাসী এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। অনেকের মতে এভাবেই ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র সূচনা হয়।

প্রাচীনকালে রোমানরা নেকড়ে বাঘের উপদ্রব থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে লুপারকালিয়া নামে ভোজানুষ্ঠান করত প্রতি বছর ১৫ ফেব্রুয়ারী। এ ভোজানুষ্ঠানের দিন তরুণরা গরুর চামড়া দিয়ে একে অন্যকে আঘাত করত। মেয়েরাও উৎসবে মেতে উঠত। ভ্যালেন্টাইন নামের কোন বিশিষ্ট বিশপ প্রথমে এর উদ্বোধন করেন। সেই থেকে এর নাম হয়েছে ভ্যালেন্টাইন, তা থেকে দিবস। রোমানরা ৪৩ খৃষ্টাব্দে ব্রিটেন জয় করে। এ কারণে ব্রিটিশরা অনেক রোমান অনুষ্ঠান গ্রহণ করে নেয়। অনেক গবেষক এবং ঐতিহাসিক খঁঢ়বৎপধষরধ অনুষ্ঠানের সঙ্গে ভ্যালেন্টাইন অনুষ্ঠানের একটা যোগসূত্র আছে বলে মনে করেন। কেননা এতে তারিখের অভিন্নতা ও দু’টি অনুষ্ঠানের মধ্যে চরিত্রগত সাযুজ্য রয়েছে।

ভালবাসা দিবস উদ্যাপনের সূচনা

‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’র ইতিহাস থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে, ১৪ ফেব্রুয়ারীতে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন প্রেমের পূজারী সিদ্ধপুরুষরূপে ভালবাসার বাণী বিনিময়ের মূর্তপ্রতীক হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। ভ্যালেন্টাইন ডে’র প্রচলনের এটাই হ’ল আদি ইতিহাস। এ দিবসের ইতিহাসে বর্ণিতে লটারীর বিষয়টি পরবর্তীতে পোপ গেলাসিয়াস কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং এ দিবসকে খৃষ্টীয় ফ্লেভার দিতে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ নামের মোড়ক দিয়ে আবৃত করেন। মজার কথা হ’ল ১৪ শতকের আগেও ভ্যালেন্টাইন দিবসের সাথে ভালবাসার কোন সম্পর্ক ছিল না। বিখ্যাত ইংরেজ লেখক জেওফ্রে চসার (Geoffery Chaucer) তার ‘ÔThe Parliament of FowlsÕ ’ কবিতায় পাখিকে প্রেমিক-প্রেমিকা হিসাবে কল্পনা করেছেন। মধ্যযুগে ফ্রান্সে এবং ইংল্যান্ডে বিশ্বাস করা হ’ত যে, ফেব্রুয়ারী মাস হ’ল পাখির প্রজনন কাল। চসার তার কবিতায় লিখেছেন, ‘ÔFor this was on St. valentineÕs day, when every fowl cometh there to choose his mate..’ বস্ত্ততঃ চসারের এ কবিতার মাধ্যমেই ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’র মধ্যে ভালবাসা জিনিসটি ঢুকে যায় এবং আস্তে আস্তে ব্যাপকতা লাভ করে। লেখক ঐবহৎু অহংমধৎ কবষষু তার ‘and cult of Saint Valentine’ বইতে এ ব্যাপারটি ভালভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। মূলতঃ আজকের ভালবাসা দিবসের উৎপত্তি ভালবাসা দিবস হিসাবে হয়নি।

৫ম শতাব্দী (৪৯৬ খৃ.) থেকেই দিনটিতে কবিতা, ফুল, উপহার সামগ্রী পাঠিয়ে প্রিয়জনকে বিশেষ স্মরণের রেওয়াজ শুরু হয়। ইংল্যান্ডের মানুষ ১৪শ’ শতাব্দীর শুরু থেকে ভ্যালেন্টাইন দিবস উদ্যাপন শুরু করেছে। ঐতিহাসিকদের অভিমত, ভ্যালেন্টাইন দিবসে ইংল্যান্ডে প্রিয়জনের কাছে কবিতার চরণ প্রেরণের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালনের রেওয়াজ শুরু হয়। ফরাসি বংশোদ্ভূত অর্লিন্স (Orleans)-এর ডিউক চার্লসকে ১৪১৫ সালে অজিনকোর্টের যুদ্ধে ইংরেজরা গ্রেফতার করে এবং ইংল্যান্ডে এনে কারাবন্দি করে। ১৪ ফেব্রুয়ারী ভ্যালেন্টাইন দিবসে এ ডিউক তার স্ত্রীর কাছে ছন্দময় ভাষায় লন্ডন টাওয়ারের কারাগার থেকে পত্র লেখেন। ইংল্যান্ডে সেই থেকে ভ্যালেন্টাইনস দিবস উদ্যাপন শুরু।

মধ্য ইংল্যান্ডের ডারবিশায়ার কাউন্টির তরুণীরা ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’র মধ্য রাতে দল বেধে ৩ থেকে ১২ বার চার্চ প্রদক্ষিণ করত এবং এ চরণগুলো সুর দিয়ে আবৃত্তি করত প্রদক্ষিণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত :

  1. I sow hempseed
  2. Hempseed I sow,
  3. He that love me best,
  4. Come after me now.

তারা মনে করত এ কথাগুলো বারবার আবৃত্তি করলে রাত্রিতে প্রেমিকজন অবশ্যই ধরা দেবে।

এ দিবসে যা যা করা হয়

পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে এ দিনে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, এমনকি পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও উপহার বিনিময় হয়। উপহার সামগ্রীর মধ্যে আছে পত্র বিনিময়, খাদ্যদ্রব্য, ফুল, বই, ছবি, ÔBe my valentineÕ’ (আমার ভ্যালেন্টাইন হও), প্রেমের কবিতা, গান, শ্লোক লেখা কার্ড প্রভৃতি। গ্রীটিং কার্ডে, উৎসব স্থলে অথবা অন্য স্থানে প্রেমদেব (Cupid)-এর ছবি বা মূর্তি স্থাপিত হয়। সেটা হ’ল একটি ডানাওয়ালা শিশু, তার হাতে ধনুক এবং সে প্রেমিকার হৃদয়ের প্রতি তীর নিশান লাগিয়ে আছে। এ দিন স্কুলের ছাত্ররা তাদের ক্লাসরুম সাজায় অনুষ্ঠান করে।

১৮শ’ শতাব্দী থেকেই শুরু হয়েছে ছাপানো কার্ড প্রেরণ। এ সব কার্ডে ভাল-মন্দ কথা, ভয়-ভীতি আর হতাশার কথাও থাকত। ১৮শ’ শতাব্দীর মধ্য ভাগ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যে সব কার্ড ভ্যালেন্টাইন ডে’তে বিনিময় হ’ত তাতে অপমানজনক কবিতাও থাকত।

সবচেয়ে যে জঘন্য কাজ এ দিনে করা হয়, তা হ’ল ১৪ ফেব্রুয়ারী মিলনাকাঙ্ক্ষী অসংখ্য যুগল সবচেয়ে বেশী সময় চুম্বনাবদ্ধ হয়ে থাকার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া। আবার কোথাও কোথাও চুম্বনাবদ্ধ হয়ে ৫ মিনিট অতিবাহিত করে ঐ দিনের অন্যান্য প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করে।

বাংলাদেশে ভ্যালেন্টাইন ডে :

বাংলাদেশের পত্রিকা যায়যায় দিনের সাবেক সম্পাদক শফিক রেহমান বাংলাদেশের ভালোবাসা দিবসের জনক। ভালবাসায় মাতোয়ারা থাকে ভালবাসা দিবসে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলো। পার্ক, রেস্তোরাঁ, ভার্সিটির করিডোর, টিএসসি, ওয়াটার ফ্রন্ট, ঢাবির চারুকলার বকুলতলা, আশুলিয়া- সর্বত্র থাকে প্রেমিক-প্রেমিকাদের তুমুল ভিড়। ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে’ উপলক্ষে অনেক তরুণ দম্পতিও হাযির হয় প্রেমকুঞ্জগুলোতে।

ঢাকার প্যান প্যাসেফিক সোনারগাঁও হোটেলের আয়োজনে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ উদ্যাপন উপলক্ষে হোটেলের বলরুমে বসে তারুণ্যের মিলন মেলা। ‘ভালবাসা দিবস’-কে স্বাগত জানাতে হোটেল কর্তৃপক্ষ বলরুমকে সাজান বর্ণাঢ্য সাজে। নানা রঙের বেলুন আর অসংখ্য ফুলে স্বপ্নিল করা হয় বলরুমের অভ্যন্তর। জম্পেশ অনুষ্ঠানের সূচিতে থাকে লাইভ ব্যান্ড কনসার্ট, ডেলিশাস ডিনার এবং উদ্দাম নাচ। আগতদের সিংহভাগই অংশ নেয় সে নাচে। ঘড়ির কাটা যখন গিয়ে ঠেকে রাত দু’টার ঘরে তখন শেষ হয় প্যান প্যাসেফিক সোনারগাঁও হোটেলের ‘ভালবাসা দিবস’ বরণের অনুষ্ঠান।

রাজধানীর পাঁচতারা হোটেলগুলোতে এ দিবস উদ্যাপনের অনুকরণে দেশের মেট্রোপলিটন শহরগুলোর বড় বড় হোটেলগুলোও এ দিবস উদ্যাপন শুরু করেছে প্রায় একই ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।

ঢাবির টিএসসি এলাকায় প্রতি বছর এ দিবসে বিকেল বেলা অনুষ্ঠিত হয় ভালবাসা র‌্যালি। এতে বেশ কিছু খ্যাতিমান দম্পতির সাথে প্রচুর সংখ্যক তরুণ-তরুণী, প্রেমিক-প্রেমিকা যোগ দেয়। প্রেমের কবিতা আবৃত্তি, প্রথম প্রেম, দাম্পত্য এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়াদির স্মৃতি চারণে অংশ নেয় তারা।

আমাদের দেশের এক শ্রেণীর তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী এমনকি বুড়া-বুড়িরা পর্যন্ত নাচতে শুরু করে! তারা পাঁচতারা হোটেলে, পার্কে, উদ্যানে, লেকপাড়ে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসে ভালবাসা বিলাতে, অথচ তাদের নিজেদের ঘর-সংসারে ভালবাসা নেই! আমাদের বাংলাদেশী ভ্যালেন্টাইনরা যাদের অনুকরণে এ দিবস পালন করে, তাদের ভালবাসা জীবনজ্বালা আর জীবন জটিলতার নাম; মা-বাবা, ভাই-বোন হারাবার নাম; নৈতিকতার বন্ধন মুক্ত হওয়ার নাম। তাদের ভালবাসার পরিণতি ‘ধর ছাড়’ আর ‘ছাড় ধর’ নতুন নতুন সঙ্গী। তাদের এ ধরা-ছাড়ার বেলেল্লাপনা চলতে থাকে জীবনব্যাপী।

উপসংহার

ভালবাসা তো ভালবাসাই । বাচ্চার জন্য মা বাবার ভালবাসা, বাবা মার জন্য বাচ্চার ,প্রেমিকের জন্য প্রেমিকার,প্রেমিকার প্রেমিকের, ভাইয়ের জন্য বোনের,বোনের জন্য ভাইয়ের ভালবাসা, স্ত্রীর জন্য স্বামীর, স্বামীর জন্য স্ত্রীর , বন্ধুর জন্য বন্ধুর ভালবাসা – এই ভালবাসার জন্য কোন উপলক্ষ্যের প্রয়োজন আছে কিনা সেটা জানিনা । তবে এটা জানি এই ভালবাসার সমম্বয়ে ই আমরা বেঁচে থাকি,এই ভালবাসাই আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয় ” জীবনটা আসলেই সুন্দর “।

সবাইকে বসন্তের বাসন্তী শুভেচ্ছা ।

[ইন্টারনেট ও বিভিন্ন ব্লগ থেকে কিছু তথ্য ও তত্ব সংগৃহিত।]

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 400E Mosholu Parkway South Apt # A23,The Bronx, New York 10458, USA

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com