উইঘুর মুসলিমদের শৃঙ্খলিত জীবন
যুবায়ের আহমাদ।। ২১ জুলাই, ২০১৭।।
ধারণা করা হয়, হিজরি প্রথম শতকে সাহাবায়ে কেরামের সোনালি যুগেই চীনে রোপণ করা হয় ইসলামের বীজ। দশম শতাব্দীতে ব্যাপক হারে এ অঞ্চলের মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে। অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে মুসলমানদের পরিমাণ। বর্তমান চীনে দুই কোটি ৩০ লাখেরও বেশি মুসলিম বাস করে। সেখানে বসবাসরত মুসলমানরা দুই ধরনের। ‘হুই’ মুসলমান ও ‘উইঘুর’ মুসলমান। ‘হুই’দের পূর্বপুরুষরা মূলত পারস্য, সিরিয়া, ইরাক ও আনাতোলিয়া থেকে চীনে এসেছিল কাজ করতে। চীনে এসে চীনা ‘হান’ মেয়েদের বিয়ে করে এখানেই থেকে যায়। তাদের সন্তানরাই ‘হুই’ বলে প্রসিদ্ধ। আর ‘উইঘুর’রা মূলতই জিংজিয়াং বা কাশগর এলাকায় হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসছে। তারাই এ এলাকার মূল অধিবাসী। জিংজিয়াং চীনের অধিকারে ছিল না, তা ছিল মুসলমানদের স্বাধীন ভূমি। মুসলমানদের শাসনে থাকাকালে এ এলাকার নাম ছিল উইঘুরিস্তান বা পূর্ব তুর্কিস্তান। ১৬৬৪ সালে বর্তমান চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মাঞ্চু শাসকরা কিং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলে অন্যান্য এলাকার সঙ্গে মুসলমানদের স্বাধীন এ এলাকাও দখল করে নেয়। স্বাধীনচেতা মুসলমানরা অব্যাহত স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে ১৮৬৪ সালে ২০০ বছর পর কিং শাসকদের বিতাড়িত করে কাশগরকেন্দ্রিক আবার স্বাধীনতার পতাকা ওড়ায়। স্বাধীনতাকামী এ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আবারও আক্রমণ করে চীন। সমাজতন্ত্রের বিষাক্ত ছোবলে আক্রান্ত হয়ে আবারও স্বাধীনতা হারায় উইঘুরিস্তান। ১৮৭৬ সালে চীন আবারও উইঘুর সাম্রাজ্য দখল করে এর নাম দেয় জিনজিয়াং। জিনজিয়াং অর্থ নতুন ভূখণ্ড। সেই থেকেই পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ হয় উইঘুর মুসলিমরা। আরাকানের মুসলমানদের মতো তারাও হাজার বছরের ভিটায় পরবাসী হয়ে যায়। কেড়ে নেওয়া হয় তাদের মৌলিক নাগরিক অধিকার। আর্থ-সামাজিকভাবে চরম বৈষম্যের শিকার হয় তারা। সরকারি চাকরিতে তাদের নিয়োগ একেবারেই কম। তা-ও যেসব মুসলিম চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন, তারাও বেতনের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। একই চাকরিতে একই পদে একজন ‘হান’ যা বেতন পাচ্ছেন, একজন মুসলিম তা পাচ্ছেন না। মুসলমান হওয়াই অপরাধ! দীর্ঘদিন তারা চীনা সরকারের কাছ থেকে অধিকারগুলো পাওয়ার আশা করেছে। ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার লাভের সম্ভাবনার সূর্য অস্তমিত হয়ে যাওয়ার পর স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগরিত হয়েছে। তারা ভেবে দেখল, তাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা ছাড়া অধিকার ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। তারা জিনজিয়াং প্রদেশে এক স্বাধীন ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠা করবে, যেখানে তারা ধর্মীয় ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। স্বপ্নের সেই স্বাধীন ভূখণ্ডের নাম উইঘুরিস্তান।
চীনের এ প্রদেশটি প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলে পূর্ণ হওয়ায় চীনা সরকার কিছুতেই তা হাতছাড়া করতে নারাজ। কিন্তু এ অঞ্চলে হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসা মুসলমানদের মৌলিক অধিকার পূরণ করতেও তারা রাজি নয়। এমনকি তেল-গ্যাসে সমৃদ্ধ ভূমিটুকুর নিরঙ্কুশ মালিকানা মজবুত করে রাখতে হাজার বছর ধরে এ এলাকায় বসবাস করে আসা উইঘুর মুসলিমদের বিভিন্ন কৌশলে তাদের বাপ-দাদার ভিটা থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে চীনা ‘হান’দের প্রতিষ্ঠিত করছে। যেখানে ১৯৪৯ সালেও জিংজিয়াংয়ের মোট জনসংখ্যার মাত্র পাঁচ শতাংশ ছিল ‘হান’ আর ৯৫ শতাংশই ছিল উইঘুর মুসলিম, সেখানে চীন কর্তৃক উইঘুর দখলের পর অন্যান্য স্থান থেকে ‘হান’দের এখানে এনে থাকতে দেওয়ায় এবং উইঘুর মুসলিমদের বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য করায় সেখানে বর্তমানে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে ‘হান’দের সংখ্যা।
উইঘুরদের ওপর কঠোর দমন-পীড়নের পথই বেছে নিয়েছে চীনা সরকার। যেহেতু উইঘুরদের ধর্মই তাদের স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদনের স্বপ্ন দেখায়, নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শেখায়, তাই সে ধর্মীয় স্বাধীনতায় নির্লজ্জ ও নগ্ন হস্তক্ষেপই তাদের প্রথম পদক্ষেপ। সেখানে ১৮ বছরের নিচের কোনো উইঘুর বালক মসজিদে যেতে পারবে না। ৫০ বছরের কম বয়সী কেউ প্রকাশ্যে নামাজ পড়তে পারে না। নামাজ পড়ার কারণে অনেক মুসলিমের চাকরি চলে গেছে। রোজা রাখা নিষিদ্ধ। কেউ রোজা রাখলে তাকে রোজা ভাঙতে বাধ্য করা হয়। সীমিত কিছু ক্ষেত্র ছাড়া সব ক্ষেত্রেই কোরআন শরিফ তেলাওয়াত নিষিদ্ধ। কোরআন শরিফ শেখা বা শেখানোর সুযোগও বন্ধ। নারীদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ। কোনো হিজাব পরা নারীকে ট্যাক্সিতে উঠালে চালককে করা হয় মোটা অঙ্কের জরিমানা। হিজাব পরা নারীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান ডাক্তারদের জন্য নিষিদ্ধ। মুসলিম সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টুপি থেকে শুরু করে সব ধরনের ইসলামী ঐতিহ্যের পোশাক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। চীনের কোনো নাগরিক যদি ফ্যাশনের জন্য দাড়ি রাখেন, তাতে কোনো সমস্যা নেই। তিনি স্বাধীনভাবেই চলাফেরা করতে পারেন; কিন্তু কোনো উইঘুর মুসলিম যদি দাড়ি রাখেন, তাহলে তাঁকে ধর্মীয় উগ্রপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জিংজিয়াংয়ে দুই হাজার মসজিদ ছিল। এর সংখ্যা কমছে দিন দিন। মসজিদগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে স্থাপন করা হচ্ছে পর্যটনকেন্দ্র। সম্প্রতি কাশগার বা জিংজিয়াংয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের প্রবেশপথে বসানো হয় মেটাল ডিটেক্টর। মসজিদে ঢুকতে হলে মুখোমুখি হতে হয় পুলিশি তল্লাশির।
অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা মানবতা আর মানবাধিকারের স্লোগানে পৃথিবীর রাজপথ কাঁপিয়ে তুললেও উইঘুর মুসলিমদের ন্যায়সংগত অধিকারের পক্ষে কেউ তেমন কথা বলেনি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও স্বাধীনতাকামী এ জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার চেতনাকে নানা কারণেই ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে না। স্বাধীনতাকামীদের ওপর চলমান নির্যাতন দেখেও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। পূর্ব তিমুরের যোদ্ধাদের যারা উপস্থাপন করেছে স্বাধীনতাকামী হিসেবে, তারাই আরাকান, কাশ্মীর কিংবা উইঘুর স্বাধীনতাকামী নির্যাতিতদের নামের সঙ্গে প্রায়ই জুড়ে দিচ্ছে ‘জঙ্গি’ অথবা ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ শব্দ। মনে হয় যেন মানবতা, মানবাধিকার সবই আছে; কিন্তু তা মুসলমানদের জন্য নয়। আফসোসের বিষয়, পৃথিবীর বেশির ভাগ মুসলিম রাষ্ট্রও উইঘুরদের কান্নার আওয়াজ শুনেও না শোনার ভান করে আছে। উম্মাহর কোটি কোটি সদস্যকে নিপীড়িত রেখেও আমরা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছি। নেই কোনো মাথাব্যথা।
উইঘুর সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে ব্যর্থ হলে চীনা সরকারকে এর মাসুল দিতে হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। চীন সরকারের সামনে দুটি পথ খোলা। প্রথমত, উইঘুর মুসলিমদের শত্রু না ভেবে তাদের ধর্মীয় ও সংস্কৃতির স্বাধীনতা দেওয়া। দ্বিতীয়ত, উইঘুরদের মৌলিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হতে পারলে তাদের আলাদা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা দেওয়া। এ দুইয়ের কোনো একটি না করে যদি তাদের ওপর দমন-পীড়ননীতি অব্যাহত রাখা হয়, তাহলে উইঘুর স্বাধীনতা আন্দোলন ক্রমেই শক্তিশালী হবে। হাজার বছর পরে হলেও স্বাধীন হয়ে যাবে ‘উইঘুরিস্তান’—এমন প্রত্যাশাই বিশ্বাসী মানুষের সান্ত্বনা।
লেখক : জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কারি ও খতিব
বাইতুশ শফীক মসজিদ, গাজীপুর