বাংলাদেশে নিপতিত গণতন্ত্র ও আয়েশি নেতৃত্ব!
।। ডক্টর তাজ হাশমী।।
[Austin Peay State University, Clarksville, Tennessee]
২৬ অক্টোবর ২০১৭।।
[যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যের অস্টিন পিয়ে ইউনিভার্সিটির ন্যায়বিচার বিষয়ক প্রথিতযশা অধ্যাপক ও গ্রন্থকার ডক্টর তাজ হাশমী বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তি থেকে অদ্যাবধি অর্থাৎ ১৯৭২-২০১৭ সালের চলমান রাজনীতি নিয়ে ইংরেজিতে ‘ডিক্লাইনিং ডেমোক্রেসি অ্যান্ড রিক্লাইনিং লিডারশিপ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি সুদীর্ঘ গবেষণামূলক নিবন্ধ লিখেছেন। সেটি গত ১৯ অক্টোবর ভারতীয় গণসচেতনতামূলক ওয়েবসাইট ‘কাউন্টার কারেন্টস ডটঅর্গে’ প্রকাশ পেয়েছে। তারই চুম্বকাংশ এখানে তুলে ধরা হল।]
বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র যখন সংকটাপন্ন, ঠিক তখন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ‘ইললিবারেল ডেমোক্রেসি’ বা উদারতাহীন গণতন্ত্র পেরিয়ে ভারতীয় অভিভাবকত্বে ‘অথরিটেরিয়ান ডাইনাস্টিক ডেমোক্রেসি’ বা কর্তৃত্বপূর্ণ সাম্রাজ্যের গণতন্ত্র বলয়ে অনুপ্রবেশ করেছে। সেই রোগের উপসর্গ, যাকে ‘অরওয়েলিয়ান স্টেট’ বা অরওয়েলীয় রাষ্ট্র বলা হয়, তা লক্ষণীয়। প্রখ্যাত লেখক জর্জ অরওয়েল রচিত উপন্যাস ‘নাইনটিন এইটিফোর’-এর নাভিশ্বাস সকল সীমান্ত ঘুরে এখন বাংলাদেশের ঘাড়ে অবস্থান নিয়েছে। ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও কর্তৃত্বে দেশটি স্বাধিকার ও গণতন্ত্রকে জলাঞ্জলি দিয়ে সেবাদাসে উপনীত হয়েছে, যা একাত্তরে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দৃশ্যমান।
আমরা স্বনামধন্য নৃতত্ত্ববিদ ম্যানকুর ওলসনের ‘প্রোটো-ডেমোক্রেসি’ থেকে জেনেছি যে, সুসংঘবদ্ধ গোত্রে প্রাকৃতিক নিয়মেই গণতন্ত্রের উত্থান ঘটে; যদিও বাংলাদেশে ক্ষমতাধর রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী শ্রেণি দোদুল্যমান, নীতিবর্জিত ও সুবিধাভোগী প্রকৃতির এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ ও বিলীনোন্মুখ মধ্যবিত্ত শ্রেণি আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ, তাই নিপতিত গণতন্ত্রের সুরক্ষায় মার্কসীয় ধারণায় নেতৃত্বের জাগরণে আস্থাশীল বাইরের নেতৃত্ব অভাবনীয়ভাবে ফলোৎপাদক।
ফিলিপ কটলারে সাম্প্রতিক বই ‘ডেমোক্রেসি ইন ডিক্লাইন’ অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপে গণতন্ত্র এখন ভগ্নদশায় উপনীত। তাতে নিঃসন্দেহে নব্বইয়ে এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশ গণতন্ত্রের প্রেক্ষাপটে অতি কঠিন সময় অতিক্রম করছে। রাজনীতিতে অঢেল টাকার প্রাচুর্য এবং সরকারি গণতন্ত্র পরিচালনায় কোটিপতিদের প্রভাব প্রবাদীয় এক শতাংশ জনগোষ্ঠীর সুবিধাকে অগ্রবর্তী করেছে। আমেরিকায় এক শতাংশ জনগোষ্ঠী ৪০ শতাংশ জাতীয় সম্পদের অধিকারী। ২০১৪ সালের এক হিসাবে আমেরিকায় একজন প্রধান কর্মধ্যক্ষ (সিইও) প্রতি ঘণ্টায় যা উপার্জন করেন, সেটি সাধারণ কর্মচারীর সারা মাসের পরিশ্রমপূর্ণ উপার্জনের সমান। ভারতে তেমন জনগোষ্ঠির এক শতাংশ জাতীয় সম্পদের ৫৮ শতাংশের মালিক। সেই হিসাবে বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়; বরং দেশটি অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয় অপপ্রচারণায় নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচিত, অনির্বাচিত এবং কারচুপিপূর্ণভাবে ক্ষমতাসীন কর্তৃত্ব কর্তৃক এক শতাংশই সুবিধাভোগী।
যেহেতু কেউ জানে না বিশ্বে গণতন্ত্রের কী পরিণতি হবে, সেহেতু বাংলাদেশে কোনোভাবে টিকে যাওয়া ১৬ বছরের গণতন্ত্র (উদার ও উদারতাহীন), যা ১৯৯১ সালে জেনারেল এরশাদের পতনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রীত্বে স্ফূরিত এবং পুনরায় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জেনারেল মইনের ক্ষমতা গ্রহণে দূরীভূত, তা নিয়ে ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে বৈকি। তার আগে, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৭৫-৭৬ সাল পর্যন্ত গণতন্ত্রের আস্বাদন যৎসামান্য হলেও পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৮১ সালের মে অবধি বাংলাদেশ জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বহুদলীয় গণতন্ত্র দেখেছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ নির্বাচিত সরকারের অধীনে পরিচালিত, তথাপি সে নির্বাচন ত্রুটিমুক্ত গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা দেয়নি। আমরা জানি, হিটলারও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়েছিল। সে কারণে ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচিত সরকারের যথোপযুক্ততা নিয়ে বহুবিধ প্রশ্ন রয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনটি ২০০৭ সালে সামরিক ক্ষমতা করায়ত্তের মাধ্যমে ভারতের উপনিবেশ বানানোর লক্ষ্যটি পরিপূরণ করেছে। আর ২০১৪ সালের নির্বাচনটি যে কোনো জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের কাছে কেবল নির্বাচন হিসেবেই গণ্য, সেটিকে ভারতের প্রভুত্বপূর্ণ কর্তৃত্বে হওয়া ‘হাস্যকর’ নির্বাচন বলাটাও অত্যুক্তি হবে না।
একাত্তরের মার্চে পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের একচ্ছত্র আকাক্সক্ষা বা গণতান্ত্রিক সদিচ্ছাটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন। সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করলে তেমনটি ঘটতো না, অন্ততঃ ১৯৭১ সালে।
সংক্ষেপে ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী মুজিবের তত্ত্বাবধানে পিতৃতান্ত্রিক রীতিতে জবাবদিহিতাহীন অগণতান্ত্রিক স্বরূপে বাংলাদেশের পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি গড়ে ওঠে। স্বাধীনতাত্তোর পুরো জনপ্রশাসন ও সংবিধান প্রণয়ন ছিল সমস্যাসংকুল। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, স্বল্প সময়ের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধের পর পরিস্থিতি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী, তবুও পার্লামেন্ট গঠন ও সংবিধান প্রণয়নে বিতর্ক এড়াতে আওয়ামী লীগ নেতাদের আইনি নীতিমালা মেনে চলা উচিত ছিল। প্রথমত, সংবিধান প্রণয়নের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ থেকে ১৬০ সদস্যের বাংলাদেশের নতুন জাতীয় সংসদ গঠনের ক্ষেত্রে তাদের কোনো গণরায় ছিল না। কেননা ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে তারা পাকিস্তানের ন্যাশনাল এসেম্বলির সদস্য তথা ‘এমএনএ’ হিসেবে নির্বাচিত হন, যা তারা জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ইস্যুকৃত ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও)’র ভিত্তিতে লিখিতভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং ১২০ দিনের মধ্যে ইসলামী আদর্শ ও চিন্তাচেতনায় পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন। দ্বিতীয়ত, অন্য সদস্যরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক এসেম্বলির ‘এমপিএ’ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন, অথচ তারাও ‘এমএনএ’ মর্যাদায় বাংলাদেশ সংসদে যোগ দেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের কারোরই বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের এখতিয়ার ছিল না। এতে ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিতর্কহীন হয়নি; ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কারচুপি ও সংঘবদ্ধ ভোট জালিয়াতির অভিযোগ ছিল। লেখক নিজেই প্রভাষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অস্ত্রের মুখে ব্যালটবক্স ছিনতাই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন, যখন সরকারপুষ্ট ছাত্রলীগ নেতারা বিরোধী দলের কাছে পরাজয় বরণের পথে ছিলেন। ফলে ১৯৭২ সালের শুরু থেকে একইভাবে ১৯৭৫ সালের শুরু পর্যন্ত মুজিবের জনপ্রিয়তার ভিত্তিটি নড়বড়ে হয়ে পড়ে ও ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তাই তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবে সমাজতন্ত্রের নামে একদলীয় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ইতোমধ্যে পুলিশ, ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক, সেনাবাহিনী ও রক্ষীবাহিনী আওয়ামী লীগ উদ্ভূত জাসদপন্থী ও সিরাজ শিকদার নেতৃত্বাধীন সর্বহারা দলের ২০ থেকে ৩০ হাজার কর্মীকে খুন করে। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে পুলিশি হেফাজতে সিরাজ শিকদার খুন হন, যা ছিল বাংলাদেশে নির্বিচার প্রথম ‘ক্রস-ফায়ার’।
তিনি হয়তো তার ‘কোয়াসি-ডেমোক্রেসি’কে রক্ষা করতে পারতেন, কিন্তু মুজিব গণতন্ত্র পরীক্ষণের পরিবর্তে একদলীয় একনায়কত্বের জন্য ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্রের কফিনে পেরেক ঠুকেন। ওই বছরের ২৫ জানুয়ারি সংসদে দাঁড়িয়ে একজন গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে পরিচিত মুজিব নিজ ক্ষমতাবলে কোনো প্রকার আলোচনা ও বিতর্কহীন কয়েক মিনিটের মধ্যে চতুর্থ সংশোধনী পাশ করেন। মুজিব প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি হন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করে মাত্র দুটি বাংলা ও দুটি ইংরেজি দৈনিক কড়া নজরদারিতে রাখা হয়, সকল পেশার মানুষকে রাষ্ট্রীয় দলে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়, লক্ষ্য একটাই ছিল নামেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।
যার জনপ্রিয়তা ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আকাশচুম্বী ছিল, সেই মুজিব ১৯৭৫ সালের আগস্টে সামরিক অফিসারদের হাতে নিহত হলেন এবং পাঁচজন বাদে মুজিব মন্ত্রিপরিষদের সকলেই মোস্তাকের সরকারে যোগ দেন। কিন্তু ক্যু-পাল্টা ক্যু থেমে থাকেনি, অবশেষে স্বাধীনতাযুদ্ধের খেতাবে ভূষিত জিয়াউর রহমান সেনাপ্রশাসক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং পরে রাষ্ট্রপতি হন। সম্প্রতি বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা তারই প্রশংসা করেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে জেনারেল মঞ্জুরের নেতৃত্বাধীন এক সাময়িক ক্যুতে জিয়া নিহত হন। কিন্তু পরিস্থিতির প্রমাণাদি সেই ‘নিস্ফল-ক্যু’র নেপথ্যে জেনারেল এরশাদকেই সন্দেহভাজন হিসেবে দায়ী করে। ১৯৮১ সালের নভেম্বরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার ক্ষমতা গ্রহণের পর নির্বাচিত হলেও ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ ক্ষমতা কেড়ে নেন এবং নয় বছরের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন গড়ে তোলেন, যার তুলনা সোহার্তো বা মার্কোসের সঙ্গে করা চলে।
১৯৯০ সালে এরশাদের পতন হলে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। কিন্তু ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’র অভিযোগে আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা ওই নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান ও বিচারপতিকে দোষারোপ করেন এবং নির্বিঘœ সরকার পরিচালনা ও শান্তিতে একদিনও থাকতে দেবেন না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। বাস্তবে তখন থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি ‘ভারতপন্থী’ ও ‘পাকিস্তানপন্থী’ এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং শেখ হাসিনা তার প্রতিশ্রুতিটি যথার্থই পালন করেন। দেখা যায়, ১৯৯৪ সালের মার্চে মাগুরায় একটি উপনির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী বিরূপ সমালোচনায় নেমে পড়ে এবং বিএনপির সঙ্গে তাদের সংঘাত হরতালে পর্যবসিত হয়। মহিউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে সরকারি আমলারা ‘জনতার মঞ্চ’ গড়ে বিএনপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফলে ১৯৯৬ সালে তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতাসীন হন। সবই ঠিক চলছিল। এরপর ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে দ্বিতীয় দফায় বেগম খালেদা জিয়া আবারও সরকার গঠনে সক্ষম হন। এবারও শেখ হাসিনা পক্ষপাতিত্বমূলক নির্বাচনের দোষারোপটি করেন। শুরু হয় অপবাদের রাজনীতি, যা পাঁচ বছর ঘুরতেই আরেক নির্বাচনে এসে আওয়ামী লীগকে সরাসরি ক্ষমতাসীন না করলেও ২০০৭ সালের শুরুতে সামরিক সমর্থিত সরকারকে ক্ষমতাসীন করে। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেন, যাকে শেখ হাসিনা ‘আমাদের আন্দোলনের ফসল’ হিসেবে অভিহিত করেন। যদি গণতন্ত্রের স্বার্থে তার পরবর্তীতে ক্ষমতাসীন হওয়াকে মুক্তভাবে আলোচনা করা হয়, তবে দেখা যাবে ‘মইন-ফখরুদ্দীন’ পরিচালিত সরকারের কর্মকা-কে ন্যায়সঙ্গত করার প্রতিশ্রুতি শেখ হাসিনাই দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রয়াত মহাসচিব আবদুল জলিলের স্বগতোক্তিটি হচ্ছে আমরা ‘সমঝোতা’ করেই ক্ষমতায় এসেছি। এতে ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ এবং ২০০৮ সালের তথাকথিত নির্বাচন দক্ষিণ এশিয়ায় ‘বিগ ব্রাদার’ ভারতেরই ‘গ্রেট গেম’-এর অংশ হিসেবে পরিস্ফূট।
তাহলে চলুন দেখা যাক বাংলাদেশ কী করে ভারতীয় অভিভাবকত্বে ‘অথরিটেরিয়ান ডাইনাস্টিক ডেমোক্রেসি’ বা কর্তৃত্বপূর্ণ সাম্রাজ্যের গণতন্ত্র বলয়ে অনুপ্রবেশ করেছে? এতে হতবাক হতে হয় যে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ২০১১ সালের জুনে শেখ হাসিনা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তড়িঘড়ি করে ১৯৯৬ সালে গৃহীত ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ বিধানটি বিলুপ্ত করেন। অথচ স্বাধীন, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে এই বিধানটি প্রণয়নে আওয়ামী লীগের সঙ্গী হয়েছিল মতিউর রহমান নিজামীর জামায়াতে ইসলামী। তারও আগে হতবাক হতে হয় যে, ২০১১ সালের মে মাসে প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ক সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের সংক্ষিপ্ত রায়টি দেন এবং সংশোধিত পূর্ণাঙ্গ রায়টি ১৬ মাস পর ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশ করেন। এটি কেবল অনৈতিক নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সর্বতো আইন পরিপন্থী। কেননা একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শুধুই অবসরপ্রাপ্ত এবং কোনোভাবেই অবসরে গিয়ে রায় লেখার এখতিয়ার রাখেন না। দুঃখজনকভাবে এই অনৈতিক, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বেআইনি কর্তৃত্বটিই বাংলাদেশে ন্যায়সঙ্গত হয়ে অনাচারে প্রশাসনের নির্বাহী, সংসদীয় ও বিচারিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে। কার্যত দেশ নৈরাজ্যিকভাবে গণতন্ত্রকে তাড়া করে ফিরছে, যা ন্যূনতম নীতিমালার অবস্থান থেকে অবধারিত। এতে ১৯৭২ সালের পর সকল প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনে দেশ এক মস্ত চ্যালেঞ্জের মুখে নিপতিত।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে জায়েজ করতে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শয্যশায়ী অসুস্থ এরশাদকে দেখতে শেখ হাসিনার পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী ও ভারতের পরাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এলে ‘ম্যাজিকতুল্য’ কাজ হয় এবং এরশাদের প্রথম স্ত্রী রওশন এরশাদ সংসদে প্রধান বিরোধী নেতা, এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও তার কতিপয় নেতা মন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন। আর শেখ হাসিনার দলের ১৫৩ জন সংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তা না হলে এরশাদের দুর্নীতির মামলা বিচারের জন্য পুনরুজ্জীবিত থাকতো। সম্প্রতি ছুটিতে যাওয়া বিচারপতি এন কে সিনহাকে নিয়েও সরকার অস্থিরচিত্তে একেক সময় একেক কথা বলেছে, যার পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ রয়েছে ১১ অক্টোবর ডেইলি নিউ এইজে প্রকাশিত ‘জাস্টিস সিনহাজ এক্সিট পাজল’ নিবন্ধে। এক্ষেত্রে তার ‘আমি অসুস্থ নই, আমি পালিয়ে যাচ্ছি না, আমি ফিরে আসবো’ লিখিত বক্তব্যটিও প্রণিধানযোগ্য।
মোদ্দা কথায়, কিছু ধারণকৃত ভুল বা ত্রুটির কারণে কখনোই বাংলাদেশ গণতন্ত্রকে ক্ষয়িষ্ণু হতে দেবে না। কারণ দেশটির জনগোষ্ঠী তাদের অবস্থার উন্নয়নে চর্তুষ্পার্শ্বের আর্থ-সামাজিক-রাজনীতিক সমস্যা অনুধাবনে কখনোই পিছপা থাকেনি। জনগণ ও তাদের নেতৃত্ব ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান অর্জন করেছে; ১৯৪৮-১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্য লড়েছে; ১৯৫৪-১৯৬৯ সালে প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন, সমতা ও সুযোগের জন্য লড়েছে এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গ করেছে। তারা স্বাধীনতার পর বেসামরিক ও সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়েছে। তাই গণতন্ত্রের জন্য চাই নেতৃত্বের আনুগত্যপূর্ণ ধারণা। সেজন্য গণতন্ত্রের স্বার্থে জনগণের প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্বকে বেছে নেওয়া অথবা আইনের শাসন, পাল্টাপাল্টিটি নয়। এখন সময় এসেছে, আত্মনিবেদিত রাজনীতিকদের সাধারণের কাছে ছুটে যাওয়া, যাদের ভোট দেওয়ার সক্ষমতাটি রয়েছে; যেমনটি গান্ধী, ফজলুল হক, ভাসানী সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমান বাঁধ ভাঙার অতুৎজ্জ্বল শিক্ষণীয় দ্যুতিটি রেখে গেছেন।আস