ধর্মবিশ্বাস নিয়ে জাফর ইকবালের যত গাঁজাখুরি বচন।
প্রথমেই আমি জাফর ইকবালের লেখা একটি সায়েন্স ফিকশানের দিকে আলোকপাত করতে চাই। তার লেখা “ঈশ্বর” নামক গল্পটিতে ধর্মের (বিশেষ করে ইসলাম) ব্যাপারে তার চিন্তাধারার স্বরূপ অনেকটাই উন্মোচিত হয়েছে। যারা গল্পটি পড়েন নি কিংবা যাদের স্মরণে নেই তাদেরকে গল্পটি একবার পড়ে দেখতে অনুরোধ করি। কেননা ইনফরমেশন সবই আপনার আমার জানা থাকা উচিত। তাহলেই তো বুঝবেন, দেশে কিছু বুদ্ধিজীবী তকমা লাগানো মানুষগুলো ইসলাম ধর্ম নিয়ে কী নিখুঁত ভাবে ষড়য্ন্ত্র পাকায়। উক্ত সায়েন্স ফিকশনে গল্পের ছলে জাফর ইকবাল তার চিন্তা-চেতনার অনেক কিছুই প্রকাশ করেছেন। ধর্ম সম্পর্কে জাফর ইকবালের যে দৃষ্টিভঙ্গি এখানে পাওয়া যায়, সংক্ষেপে তা হলঃ
১। ঈশ্বরের অস্তিত্ব কেবল মানুষের মনে, বাস্তবে এর কোন অস্তিত্ব নেই।
২। ঈশ্বরে বিশ্বাসের পেছনে কোন যুক্তি নেই, এটি একটি যুক্তিহীন বিশ্বাস।
৩। গল্পের নায়ক চরিত্রটির মতে- “মানুষ ঈশ্বর নামে একজনকে বিশ্বাস করে কারন যখন তার আর অন্যকিছু করার থাকে না তখন সে ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পন করে দিতে পারে”।
৪। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলে কেবল মানুষের মনোবল একটু বৃদ্ধি পায়- এছাড়া আর কোন উপকার নাই।
৫। ঈশ্বরের প্রার্থনা করে মানুষ তার প্রচুর মূল্যবান সময় অপচয় করে, ফলে তাদের পক্ষে দৈনন্দিন কাজগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না, সে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে।
৬। ঈশ্বরে বিশ্বাস সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করছে, ধর্মবিশ্বাস পৃথিবীকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে।
৭। ঈশ্বরে বিশ্বাস মানব জাতির জন্য কখনো কোন কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসতে পারেনি, বরং জগতের সকল হানাহানি ও ধ্বংসের পেছনে ধর্মবিশ্বাসীরা দায়ী।
৮। বোকা রবোটরা প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ পড়ে এক ধরনের জিহাদ (ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে লড়াই) শুরু করলে গল্পের নায়ক তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন- “তোমার ঈশ্বরের আমি নিকুচি করছি”।
গল্পের সারমর্ম অনেকটা এরকম। এবার আমি কিছু জিনিস ব্যাখ্যা করতে চাই। এখানে গল্পের নায়ক হলেন একজন বুদ্ধিমান নাস্তিক। গল্পে যেসব রবোট দেখা যায় প্রথমে তাদের মধ্যে শান্তি বিরাজ করলেও একসময় প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ পড়ে তারা প্রভাবিত হয়ে যায় এবং তাদের ব্রেইন ওয়াশ হয়ে যায়! এক পর্যায়ে রবোটদের মধ্যে দু’টি ভিন্ন মতবাদের উদ্ভব হয় এবং তারা একে অপরের সাথে ধর্মযুদ্ধে লিপ্ত হয়। তারা সহিংস আচরন শুরু করে।
প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ পড়ে বিভ্রান্ত হয়ে যাওয়া রবোটরা ঈশ্বরের আদেশমত যুদ্ধ ও নৃসংশতা চালিয়ে এক পর্যায়ে পুরো মহাকাশযানটাই ধ্বংস করে দেয়। (বি.দ্র. এখানে ব্রেইন ওয়াশড রবোটদের দ্বারা মূলত মুসলিম জাতিকে বুঝানো হয়েছে। ধর্মে বিশ্বাসী রবোটদের দুই গ্রুপের দ্বন্ধ দ্বারা মূলত শিয়া ও সুন্নীদের বিরোধকে তুলে ধরা হয়েছে। লেখক রূপক অর্থে আমাদেরকে যে বার্তা দিতে চেয়েছেন তা হল- ব্রেইন ওয়াশড মুসলিমদের দ্বারা এভাবেই একদিন সমগ্র পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।)
এবার গল্প থেকে একটু বাস্তবে আসা যাক- জাফর ইকবাল তার “একটি ছোট প্রশ্ন” নামক কলামে লিখেছেন-
জীবনের প্রশ্নের একটি মাত্র সঠিক উত্তর নেই, অনেক সঠিক উত্তর হতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস নিয়ে একসঙ্গে অনেকে সঠিক হতে পারে। অর্থ্যাৎ সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট জন্য কেবল একটা নির্দিষ্ট ধর্ম মানতে হবে, অন্য কোন ধর্ম মানলে সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌছানো যাবে না- এটা একেবারে ভুল ধারনা। আমরা কেন মনে করি- কেবল আমরা নিজেরাই সঠিক, আর বাদবাকি সবাই ভুল? কেন আমরা ব্যাপারটা এভাবে চিন্তা করি না যে, আমারটা যেমন সঠিক, তারটাও তো তেমনি সঠিক হতে পারে? নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাই সঠিক হতে পারে।
কথাগুলো সুন্দর- এতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করলে কথাগুলোকে আর সুন্দর মনে হবে না। এই কলাম দ্বারা স্যার যেটা বুঝাতে চেয়েছেন তা হল- মুসলমানদের কালেমা যেমন সঠিক, হিন্দুদের মূর্তিপূজাও তেমনি সঠিক। কেবল কুরআন-হাদিস সঠিক আর অন্য ধর্মগ্রন্থগুলো ভুল এমনটা ভাবলে চলবেনা। আমাদেরকে এভাবে ভাবতে হবে- কুরআন যেমন সঠিক, তেমনি খ্রিস্টানদের বাইবেল, বৌদ্ধদের ত্রিপিটক এগুলোও সঠিক। সব ধর্মই সত্য। সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য যে কোন একটা ধর্ম ঠিকমত অনুসরন করলেই চলবে। একটা অংক যেমন বিভিন্ন পদ্ধতিতে সমাধান করা যায়- তেমনি যে কোন একটা ধর্ম মানলেই সৃষ্টিকর্তা খুশি হবেন।
নামাজ-রোজা করে যেমন জান্নাত পাওয়া যাবে, তেমনি গণেশ পূজা, শিবলিঙ্গ পূজা, দূর্গার পূজা করেও ঈশ্বরের সন্তুষ্টি অর্জন করা যেতে পারে। একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাওয়ার জন্য কেবল একটা রাস্তাই অবলম্বন করতে হবে এমন কোন কথা নেই, ঠিক তেমনি সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়ার জন্য কোন একটি বিশেষ ধর্ম অবলম্বন করতে হবে এমন ধারনা ভুল । কেবল একটি ধর্মই সত্য আর বাকি সব ধর্ম মিথ্যা এমনটা ভাবা যাবে না।অর্থাৎ একই সাথে সবগুলো ধর্ম সঠিক হতে পারে।নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রত্যেকেই সঠিক হতে পারে।
অথচ কুরআনে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন- “নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম। [৩:১৯] “যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিণকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্ত।” [৩:৮৫]
স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে- জাফর ইকবাল আর যাই হোন না কেন, মুসলিম নন। কারন তিনি ইসলামের মূলনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তার মত একজন জ্ঞানদ্রষ্টা অধ্যাপক ইসলামের মূলনীতি সম্পর্কে কোন ধারনাই রাখে না (!)- এমনটা জাস্ট হতেই পারে না। অবশ্যই তিনি সবকিছু বুঝে শুনেই এধরনের কলাম লিখেছেন। তিনি ভাল করেই জানেন- ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্ম একসাথে যায় না, যেতে পারে না। ইসলামের মূলনীতিই হল- অন্যান্য সকল ধর্ম বাতিল এবং কেবলমাত্র ইসলামই সৃষ্টিকর্তা মনোনীত ধর্ম। এটা অস্বীকার করার মানে- হয় আপনি ইসলাম বুঝেন না আর নয়তো ইসলাম মানেন না।
সবকিছু বিবেচনা করে আমার পর্যবেক্ষণ হল- জাফর ইকবাল একজন নাস্তিক অথবা সর্বাস্তিক (অর্থাৎ যারা একসাথে সবগুলো ধর্মে বিশ্বাস করতে চায়)। যদিও কারও পক্ষেই এক সাথে সবগুলো ধর্ম বিশ্বাস করা সম্ভব না। যারা এমনটা দাবি করে, তারা আসলে নিজের সাথেই প্রতারণা করে, তারা মূলত কোন ধর্মেই পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। সেক্ষেত্রে বলতে হয়- জাফর ইকবাল অনেক বিষয়ের উপর পন্ডিত হতে পারেন, একজন লেখক হতে পারেন, কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে তিনি একেবারেই অন্তঃসারশূণ্য। ধর্মীয় কোন বিষয়ে তার কাছ থেকে কোন উপদেশ গ্রহণ করা আর একটা অন্ধকে পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করা একই কথা।