খালেদাকে ছাড়া নির্বাচনী হিসাব কী কষছে বিএনপি!
রাজনৈতিক বোদ্ধারাও মনে করেন, রাজনীতিতে ‘শেষকথা’ বলতে কিছু নেই। খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া নির্বাচনে যাবে না, এখন বিএনপি এটি বললেও বোদ্ধাদের ধারণা, এটিই দলটির শেষকথা নয়। আবার এমনও হতে পারে যে, উদ্ভূত পরিস্থিতি দলটিকে নির্বাচন বর্জনের পথে ঠেলে দিতে পারে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে বর্জন করবে বিএনপি, নির্বাচনের মাসতিনেক আগেও কেউ এমনটি বলতে পারেননি বা ভাবেননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দীন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, নির্বাচনের আরও কয়েক মাস বাকি। এর মধ্যে হয়তো বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতারা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে ইতিবাচক সিদ্ধান্তে আসতে পারেন। তবে এও স্মরণ করিয়ে দেন যে, রাজনীতিতে শেষকথা বলতে কিছু নেই।
তিনি বলেন, তরুণ নেতাদের প্রায় সবাই খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে যাওয়ার বিপক্ষে। নির্বাচনের আগে অনেক ঘটনাই ঘটতে পারে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সেসব ঘটনাও বিবেচ্য হতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের জন্য বিএনপির যে দাবি, তা মানছে না সরকার। তবে পরিস্থিতি বদলাতেও পারে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিই বলে দেবে, কী হবে।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, নির্বাচনে যাওয়ার সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের তত্ত্বাবধানে প্রতিটি আসনে দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে জরিপও হয়েছে। তিনি একটি প্রার্থী তালিকাও তৈরি করছেন। সেখানে প্রত্যেক আসনের বিপরীতে অন্তত তিনজন প্রার্থীর নাম রাখা হয়েছে; যাতে অসুস্থতা, মৃত্যু কিংবা মামলার কারণে দ-িত হয়ে কেউ নির্বাচন করতে না পারলে বিকল্প প্রার্থী বাছাই করা সহজ হয়। দলের গুলশান কার্যালয় থেকে কয়েকটি জরিপ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের এক নেতা বলেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে আটকে রাখা হবে ধরে নিয়েই নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত দলের হাইকমান্ডের যে মনোভাব তাতে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আছে। তবে প্রস্তুতি এখন পর্যন্ত অপ্রতুল।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শুক্রবার আমাদের সময়কে বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে তাদের মনোভাব ইতিবাচক। নির্বাচন বলতে যা বুঝায় সেই নির্বাচন হলে দলীয় চেয়ারপারসনের নেতৃত্বে অবশ্যই যাবেন।
এ ক্ষেত্রে কিছু শর্ত তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ভিত্তিহীন মামলায় খালেদা জিয়াকে কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে। তার মুক্তি দিতে হবে। নির্বাচনের আগে আলোচনা সাপেক্ষে নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সংসদ ভেঙে দিতে হবে। ভোটে সেনাবাহিনী মোতায়েনসহ সব রাজনৈতিক দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকতে হবে।
নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে আনুষ্ঠানিকভাবে বেশকিছু শর্ত তুলে ধরা হবে বিএনপির পক্ষ থেকে। এখন দলটির নেতারা এসব শর্তের কথা বলছেন তাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে। এর কারণ, শর্তাদি নিয়ে যেন দরকষাকষি করা যায় এবং সর্বোচ্চ যতটুকু সম্ভব দাবি আদায় করা যেন নির্বাচনকালে সরকারি দলের সমান সুযোগ পাওয়া যায়।
তবে বিএনপির একটি অংশের কাছে সরকারকে দেওয়া শর্তাদি, নির্বাচনকালীন পরিবেশ, পরিস্থিতি ইত্যাদি কিছুই বিবেচ্য নয়। তারা খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে যাওয়ার বিপক্ষে। দলের শীর্ষনেত্রী কারান্তরীণ হওয়ার আগেও এই অংশটি পরিবেশ-পরিস্থিতি যেমনই হোক, নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে ছিল।
জানা গেছে, গত শুক্রবার বিএনপির যৌথসভায় নেতারা মত দিয়েছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল শনিবার বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, যে নির্বাচনে খালেদা জিয়া অথবা তারেক রহমান অংশ নিতে পারবেন না অথবা করবেন না; একই সঙ্গে শেখ হাসিনার অধীনে হবেÑ সে নির্বাচনে আমি অংশ নেব না। আমার বিশ্বাস দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরও এমনই মত। যদি শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনে যাব, তা হলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে কেন গেলাম না? প্রশ্ন রাখেন তিনি।
গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বিএনপিকে উদ্দেশ করে বলেন, কাউকে জোর করে ভোটে আনব না। পরদিন জাতীয় প্রেসক্লাবের এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল এ বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, আলোচনায় বসুন। সংকট সমাধান করুন। সব দাবি মানতে হবে এমন নয়। তবে আগে আলোচনায় বসুন। নইলে যা হওয়ার তা-ই হবে। এভাবে তো এবার নির্বাচন হবে না। জেলে পুরে, হত্যা-গুম করেও লাভ হবে না; একতরফা নির্বাচন মানা হবে না।
এদিকে বিএনপির এতদিনের অন্যতম জোটশরিক জামায়াতের সূত্রে বলছে, নির্বাচনের ব্যাপারে দলটি তাদের সিদ্ধান্ত খালেদা জিয়াকে জানিয়ে দিয়েছে। ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার আগেই আলোচনার সময় জামায়াত তাকে জানিয়ে দিয়েছে, বিএনপি চেয়ারপারসনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান আমাদের সময়কে বলেন, শুধু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা খালেদা জিয়া আজ কারাবন্দি। গণতন্ত্রের এই নেত্রীকে ছাড়া আমি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারি না।
অবশ্য সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশই মনে করেন, যে কোনো পরিস্থিতিতেই বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া উচিত। তারা নির্বাচন বর্জনের বিপক্ষে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরেন তারাÑ মিয়ানমারে অং সান সু চির ওপর দেশটির জান্তা সরকার গৃহবন্দিত্বসহ নানারকম নির্যাতন করেছে। তবু তার দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ দেশের কূটনীতিকরাও চাইছেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করুক।
কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, প্রভাবশালী একটি দেশ খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে ‘বাদ’ দিয়ে বিএনপিকে নির্বাচনে চায়। বিষয়টি নিয়ে সিনিয়র একাধিক নেতার সঙ্গে সে দেশের প্রতিনিধি বৈঠকও করেছেন। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে এমন শর্তে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি।
অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে চাইছে না, এমন দেশ নেই। তবে বিএনপি নেতাদের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে যে, বাংলাদেশে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আগামী নির্বাচন প্রশ্নে ভারত যেন নিরপেক্ষ ভূমিকা নেয়, সে জন্য দলটির দায়িত্বশীল নেতারা কাজ করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় একাদশ নির্বাচনের আগে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দলের ভারত সফরেরও পরিকল্পনা রয়েছে।