‘মি টু’ এবং তারও অনেক আগে

March 8, 2018 3:41 pm0 commentsViews: 82

দেবেশ মজুমদার।

বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। অথচ, পৃথিবীর প্রায় সব দেশে নারীর অবস্থান যেন কিছুতেই পুরুষের তুল্য হয়ে ওঠে না। আজ, ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস, বিভিন্ন ক্ষেত্রে (বিশেষ করে সামাজিক ও রাজনৈতিক) নারীদের সাফল্য উদ‌্‌যাপনের দিন। অথচ, এই দিনটিতেও লিঙ্গবৈষম্য মেটানোর আহ্বান রাখতে হয়!
কেন?
গোদা ভাবে বলতে গেলে নারীদের মাথা পিছু শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় এখনও পুরুষদের চেয়ে কম। নারীদের উপরে নির্যাতনের ঘটনা পুরুষদের উপরে অত্যাচারের তুলনায় বেশি। আর পুরুষ এবং নারীর পারিশ্রমিকে ফারাকও চোখে পড়ার মতো। ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’-এর ২০১৭ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, সারা বিশ্বে নারী এবং পুরুষের লিঙ্গবৈষম্য ঘুচতে আরও একশো বছরের বেশি সময় লাগতে পারে।
অথচ, বৈষম্য ঘোচানোর লড়াই কিন্তু শুরু হয়েছে অনেক আগে। ফরাসি বিপ্লবের সময়ে সনাতন রাজতন্ত্রের অবসান হলে, সে দেশের জনতা ‘ডিক্লারেশন অব দ্য রাইটস অব ম্যান অ্যান্ড অব দ্য সিটিজেন’ (১৭৮৯) তথা স্বাধীনতার সনদ তৈরি করে। কিন্তু তাতে নারীদের দাবিদাওয়ার কোনও উল্লেখ ছিল না। তারই পাল্টা হিসেবে ‘ডিক্লারেশন অব দ্য রাইটস অব ওম্যান অ্যান্ড ফিমেল সিটিজেন’ (১৭৯১) তৈরি করেন মহিলা সমাজকর্মী, নাট্যকার ওলাঁপ দ্য গুজ। কিন্তু তা প্রকাশ্যে আসতেই  রাষ্ট্রদোহের অভিযোগে তাঁকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়।
ওলাঁপ তাঁর লেখা শুরু করেছিলেন এ ভাবে— ‘পুরুষ, তুমি কি ন্যায় করতে পার? এক নারী জানতে চায়:  সেটুকু সুযোগ নিশ্চয় দেবে?’ (Man, are you capable of being fair? A woman is asking: at least you will allow her that right)। তাঁর অনুপ্রেরণায় ইংল্যান্ডে নারীদের দাবিদাওয়া সম্বন্ধে সচেতন মহিলাদের অন্যতম ছিলেন মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট। ‘এ ভিন্ডিকেশন অব দ্য রাইটস অব ওম্যান’ (১৭৯২)-এ মেরি বোঝাতে চেষ্টা করেন, নারী স্থাবর সম্পত্তি নয়। মানুষ। পুরুষের মতো একই মৌলিক অধিকার তারও প্রাপ্য।
সে সময়ের ইংল্যান্ডে এই দাবিদাওয়া প্রকাশ্যে আনার প্রয়োজন ছিল। কারণ, সে দেশে তখন মেয়েদের ভোটাধিকার ছিল না। তাঁরা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারতেন না। কোনও রাজনৈতিক সংগঠনে অথবা কোন রাজনৈতিক সমাবেশে যোগ দেওয়ার অধিকারও ছিল না। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করা হত না তাঁদের। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ছিল নানা বাঁধন। নারীরা সম্পত্তির অধিকারী হতে, ব্যবসায় যুক্ত থাকতে, নিজেদের নামে ঋণ নিতে পারতেন না। আইনের দৃষ্টিতে তাঁরা ছিলেন নিম্নমানের সাক্ষী। বিবাহ বিচ্ছেদ করার অধিকার তখনও তাঁরা পাননি। শিক্ষার ক্ষেত্রেও ছিল বৈষম্য।  প্রাতিষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডী পেরনো ছিল নারীর জন্য নিষিদ্ধ।
এই বি-সম পরিস্থিতিতে ইওরোপের নারীরা সমতার লক্ষ্যে তাঁদের আন্দোলন অক্লান্ত ভাবে চালিয়ে গিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তাঁদের এই আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে এবং তা ইউরোপের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। লিঙ্গসমতার অনুপ্রেরণা জোরদার ভাবে এসেছে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে যেখানে নারী ও পুরুষের অধিকার সমান ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ কর্তৃক গৃহীত  ‘Declaration of Universal Human Rights’ অর্থাৎ, বিশ্বজনীন মানবাধিকারের সনদ। এই সনদের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য সংযোজন হল ‘CEDAW’ (CONVENTION FOR THE ELIMINATION OF DISCRIMINATION AGAINST WOMEN) তথা নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত সমঝোতা।
একটু একটু করে পৃথিবীতে নারী আন্দোলন গতি পায়। রাষ্ট্রপুঞ্জ চারটি আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের আয়োজন করে। ১৯৭৫ ‘নারী বর্ষ’ এবং ১৯৭৫-১৯৮৫ সাল ‘নারীদশক’ রূপে পালিত হয়। ১৯৯৫ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ আয়োজিত চতুর্থ আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের (‌‌বেইজিং) কথা বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়। নারী সশক্তিকরণ এবং লিঙ্গবৈষম্য ঘোচানোর লক্ষ্যে সেখানে বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, যা বিশ্বের ১৮৯টি দেশ মানার অঙ্গীকার করে। অথচ, তার পরেও অন্ধকার পুরোপুরি ঘুচেছে, তা বলা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি হলিউডের এক প্রযোজকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের দৌলতে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়েছে, যৌন-হেনস্থার প্রতিবাদী আন্দোলন ‘মি টু’। প্রতিবাদীদের সামনের সারিতে রয়েছেন অনেক যশস্বী মহিলা। তাঁদের প্রতিবাদী স্বর মনে করিয়ে দিচ্ছে, লিঙ্গ-সাম্য আসতে এখনও বহু দূর যেতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল বদল না হলে এ লড়াই থামানো অর্থহীন।

লেখক শিক্ষক

নারীকে মানুষ হতে হবে, পুরুষকেও

তিলোত্তমা মজুমদার

Friendship

ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব, সে আবার কী!

মেয়ে আর মানুষ ছোটবেলাতেই এই দুটি শব্দ আমার মনে গোল পাকিয়ে ছিল। ছেলেমেয়ে মিলিয়ে আমাদের বন্ধুদের দলটি ছিল বিশাল। ছেলের দল আর মেয়ের দলে আলাদা কিছু ছিল না। একই স্কুলে পড়ি। পাশাপাশি বসে একই রকম চেঁচামেচি ও নামতা-পড়া! স্কুলের শুরুতে প্রার্থনাসঙ্গীত গাইবার সময় যতেক ফচকেমি তারও কোনও ভেদাভেদ নেই। লক্ষ্মী ছেলে এবং দুষ্টু মেয়ে সব রকমই ছিল দলে। সহপঠন আমাদের সমানানুভূতি দিয়েছিল। তারা যা খেলে, আমরাও তা-ই খেলি। মাঝে মাঝে একসঙ্গে, কখনও বা আলাদাও। ক্রিকেট খেলিনি অবশ্য। ভলিবলও না। তবে ফুটবল ও ব্যাডমিন্টন সমান তালে খেলেছি। আমার দ্বারা হয়নি, কিন্তু আমার অনেক বান্ধবীই টেবিল টেনিসে দক্ষ ছিল।

ছোটবেলার প্রথম বিচার তো খেলাতেই। আমরা সব একজোট ডাং-গুলি, পিট্টু, আত্তিকা-পাত্তিকা খেলেছি যেমন, তেমনি কাবাডি বা দাঁড়িয়াবান্ধা! ঘুড়ি ওড়ানোর মরশুমে মাঠ থেকে আমাদের ঘরে ফেরানো মুশকিল। ফ্রক পরতাম ঠিকই। মেয়েদের পোশাক। সেটুকুই। ছেলের দলের সঙ্গে আমরাও গাছে উঠেছি, গুলতি মেরে ফল পেড়েছি, বাড়ির চালে চড়ে মায়ের শিম, কুমড়ো ফুল, এঁচোড় পেড়েছি। আমাদের চা-বাগানের বাঙালি পাড়া মিশে থাকত আদিবাসী ও নেপালি বন্ধুদের সঙ্গে, রাজবংশী, রাভা, মেচদের সঙ্গে। পঞ্জাবি ও বিহারি বন্ধুও অনেক। কেউ বলেনি, এর সঙ্গে মিশিস না, তার সঙ্গে কথা বলিস না, তোরা তো মেয়ে, তোদের ওটা করতে নেই। তবে রবীন্দ্রজয়ন্তী বা পূজাপার্বণে আয়োজিত নৃত্যনাট্যে মেয়েরা বেশি, দু’-একজন ছেলেই কেবল নাচে যোগ দিত। কেবল সে ক্ষেত্রেই আমরা ‘মেয়ে’ হয়ে উঠতাম আর নাচ করা ছেলেরা হত ‘লেডিস’!

আমরা কিছু মনে করিনি! নৃত্যগীত সম্পূর্ণ মেয়েলি কর্ম হলে আমাদের আপত্তির কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু আমরা উদয়শঙ্কর থেকে বিরজু মহারাজ পর্যন্ত জ্ঞান রাখতাম।

আমাদের পাড়ায় সুগায়কের অভাব মোটেও ছিল না। আমার অপরিণত মনে ছোট ছোট কয়েকটি প্রশ্ন জেগেছিল আপনিই। যেমন করে আমাদের ঝোপে-জঙ্গলে আপনি গজাত নানাবিধ ফুল!

আরও পড়ুন: ‘সিস্টারহুড’ বনাম ‘কাজের মেয়ে’রা

প্রশ্ন ছিল, শুধু বাবা-ই কেন আপিস যায়? মা নয় কেন? কাকি-জেঠি, মা-মাসি সকলে বড় সন্ত্রস্ত! ‘তোর বাবা আসবে! তোর কাকা ফিরবে!’ যেন বাবাদের এই ফেরা এমন এক পরীক্ষার মুখে মা-কাকিমাদের ফেলে দেয়, যাতে পাশ না করলে, আমাদের মতোই এক বছর নষ্ট!

নষ্ট! এক বছর তো নয়! তবে কী নষ্ট? কেন এমন ভয়? সেই ভয়ের আঁচ আমাদের মধ্যেও ঢুকে পড়ত খানিক। কেবল পাড়ার এক জেঠিমা হাসতে হাসতে ইস্কুলে যান। হিন্দি স্কুলের শিক্ষয়িত্রী। কী আত্মবিশ্বাস চোখে-মুখে! উনি তো স্বাধীন! অন্য কাকিমারা বলাবলি করেন! ‘যা খুশি কেনার স্বাধীনতা আছে। কর্তার কাছে হাত পাততে হয় না।’

ভারী খারাপ লাগত শব্দটা! ‘কর্তা!’ তাঁদের কর্তালির রকমও যেহেতু চোখে পড়ত নানারকম, সেই প্রভুত্বপরায়ণতার সঙ্গে মনে মনে দ্বন্দ্ব ঘটে যাচ্ছিল আমার! ‘হাত পাতা’ বললে আমার ভিখিরির অনুষঙ্গ মনে পড়ত। মা-কাকিমাদের আমার লাগত মা দুর্গা একেকজন। তাঁদের সব কাজে, সব ক্ষেত্রে অমন নির্ভরশীল, ভিতু, দাস্যভাব আমায় পীড়ন করেছে! কবে, কোন শৈশবে আমি স্থির করলাম, আমি এস ডি ও হব! নয়তো ম্যাজিস্ট্রেট! মা দুর্গার স্তিমিত, হাত-পাতা রূপ আমার কখনও সহ্য হয়নি!

আরও পড়ুন: বাধার পাহাড় পেরনোর কাহিনি লিখছে চম্পারণ

তবুও তাকে আমি একজন ‘মেয়ে’ হওয়ার চেতনা বলতে পারি না! বরং তার প্রথম উদ্ভাস আমার ইউনিয়ন একাডেমি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল। শুনতাম, মেয়েরা ওখানে হেরে যায়! ছেলেরাই সব ফার্স্ট-সেকেন্ড! নীল স্কার্ট আর সাদা শার্ট পরে আমি কী রকম জেদি হয়ে উঠলাম! সেই হয়তো প্রথম, মেয়ে হয়ে নিজেকে প্রমাণ করার পদক্ষেপ!

ঘরের কাজে আমার মন লাগত না। বই ছিল পরমসঙ্গী! ‘আমার জীবন’ বলতে আমি বুঝতাম অন্য রকম কিছু। ঠিক কেমন, তা বলা শক্ত। তবে ঠাকুমা যখন আমার হা হা হাসি শুনে বললেন, ‘মাইয়া মাইনষের শব্দ কইরা হাসতে নাই। লোকে অসইভ্য কইব…’

আমি মোটেই তাকে পাত্তা দিইনি। মেয়েমানুষ হিসেবে আমার আত্মোপলব্ধি খানিক পোক্ত হল একটু। যতই সমালোচিত হই, ঠ্যাং নাচানো বন্ধ করিনি, সাইকেল চালানোর বারণ মানিনি! যাদের সঙ্গে খেলি, সেই ছেলের দল, তাদের গোঁপের রেখা উঠতেই আমিও হয়ে গেলাম পরিপূর্ণ মেয়ে, নিষেধ বাড়ল! ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব, সে আবার কী!

কী আশ্চর্য! যাদের সঙ্গে শৈশব, কৈশোর যাদের সঙ্গে খেলা, পড়া, আড্ডার নির্মল ভালবাসার সম্পর্ক, তাদের বন্ধু বলব না? বন্ধুর লিঙ্গবিচার হয় না! আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম তা বোঝেনি। আমরা, সেইসব বন্ধুরা, ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে লড়াই চালিয়ে গিয়েছি। আজও সেই বন্ধুত্ব অটুট! একসময় অভিভাবকের দল মানতে বাধ্য হয়েছেন, একটি ছেলে ও একটি মেয়ে মানেই প্রণয়লীলা নয়! এ-ও এক স্বাধীনতার যুদ্ধ। আমি ও আমার বন্ধুরা জীবন দিয়ে বুঝেছি। কৃষ্ণ দ্রৌপদীর সখা ছিলেন। লোকে মহাভারত স্মরণ করে, বার্তা নেয় কতটুকু?

একজন নারীর স্বাধীন মানুষ হয়ে ওঠার পথ অমসৃণ পাথরের। কণ্টকময়। তার মধ্যে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য যেমন, তেমনি সম্পর্কগুলি সংজ্ঞায়িত ও মর্যাদাব্যঞ্জক করে তোলাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। নারী তার লক্ষে অনেক দূর এগিয়েছে। একজন পেশাদার মহিলার সম্পর্ক শুধু সমাজ-নির্ণীত প্রাচীন সম্পর্কগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তার জীবনে পুরুষ সহকর্মী আছে, বন্ধু আছে, পেশাগত যোগাযোগ আছে, সহযাত্রী আছে, দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য যোগাযোগ আছে। সেই সবই একজন ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক। মানুষের সঙ্গে মানুষের। এই ক্ষেত্রটি সহজে তৈরি হয় না!

জীবন বড় বিচিত্র! শৈশব ও কৈশোর জুড়ে আমার যে স্বাধীনতার উপলব্ধি, তার বিপরীত প্রান্তে গিয়ে আমি উঠেছিলাম, এক ভুল ভালবাসার নৌকা চেপে। এ যেন ‘তাসের দেশ’-এর রাজপুত্রের বাণিজ্যতরী! আমাকে এমন এক সংসার সমুদ্র পাড়ে আছড়ে ফেলেছিল, যা দিয়ে, নারীজন্মের এমন সব অবমাননা, পারিবারিক অত্যাচার ও হিংসার অভিজ্ঞতা লাভ করলাম, যা, আমার মা-মাসি-কাকি-জেঠি, এমনকী ঠাকুমা-দিদিমাও ভোগ করেননি!

এর ফল হল বেশ চমকপ্রদ! এক, একটি মেয়ের মেয়েমানুষতার বেদনা কত গভীর ও নির্জন, আমি জীবন দিয়ে বুঝেছি। তাই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের লক্ষ্য, প্রতিজ্ঞা ও মর্যাদা প্রদানের যতেক আয়োজনের প্রতি আমার সমর্থন আছে। দুই, আমি পুরুষের সমান হওয়াই আমার স্বাধীনতার লক্ষ্য, মনে করি না, কারণ সমাজে পুরুষের শৃঙ্খল যথেষ্ট জটিল এবং অনেক ক্ষেত্রেই মনুষ্য মর্যাদাসঞ্জাত নয়। আমি এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছি, নারীকে যেমন মানুষ হতে হবে, পুরুষকেও তেমনি। তিন, আমার ভুল জীবনের যন্ত্রণার পাঁকে আমার কাব্য-সাহিত্যকমলিনীর জন্ম! অবমানিত নতমুখী মেয়ের শিরে সরস্বতীর আশীর্বাদ লাভ!

সাহিত্যিক পরিচয়ের আভায় নারী হিসেবে আমার সম্মান ও অবমাননা দুই-ই জোটে। এখনও আমার ‘নারী’ পরিচয়কে ব্যক্তি পরিচয়ে পৌঁছে দেবার যুদ্ধ শেষ হয়নি। কবে হবে, তার ধারণাও আমার নেই। কারণ, আমি এবং আমরা যখন চাইছে সুকৃতি ক্ষেত্রে লিঙ্গবিভাজন লুপ্ত হোক, তখন বিশ্ব জুড়ে গে রাইটার বলছেন— আমি গে। অনেক নারী আজও পদোন্নতির জন্য নারীত্ব বিক্রয় করছে। বহু পুরুষ আজও মনে করছেন— মেয়েরা ততখানি বুদ্ধি ধরে না, যতখানি তাদের লাস্য!

তবু আমরা এগোচ্ছি। প্রগতির বার্তা সমেত আমাদের নিশান নমিত হবে না কখনও। আমাদের যতই মারুক, মানবিকতার জয়গান গাইতে গাইতে বেঁচে উঠব ফের।

নারীবাদীর প্রেম কেমন, দেখা বাকি

যে সারা জীবনের সব পরিশ্রম, সব সঞ্চয় স্বচ্ছন্দে দাবি করে কিন্তু শূন্য হাতে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়ার ভয় দেখায় নিত্যদিন, সে-ও আপনজন। লিখছেন স্বাতী ভট্টাচার্য

শ্রীকান্ত সব বিষয়ে ইন্দ্রনাথের সাগরেদ। দূরত্ব টের পাওয়া গেল প্রথম যে দিন দু’জনে গিয়ে দাঁড়াল তেঁতুল-পাকুড়ের ছায়ায় অন্ধকার, ঝোপ-জঙ্গলে ঘেরা অন্নদাদিদির কুটিরে। শাহজি মুসলমান সাপুড়ে, হিন্দিতে কথা বলে। অন্নদার পরিধান মুসলমানীর, কিন্তু মাথায় মেটে সিঁদুর। স্বামী ঠগ, প্রতারক, সেই লজ্জা হাসি দিয়ে চাপা দিতে চায়। নেশার মাথায় দুর্দান্ত রাগে স্বামী লাঠি মেরে মাথা ফাটিয়ে দেয়, ইন্দ্রনাথ বহু কষ্টে তাকে কাবু করে বেঁধে ফেলে। স্ত্রী জ্ঞান ফিরে পেয়ে স্বামীর বাঁধন খুলে দিয়ে বলে, যাও ঘরে গিয়ে শোও। ইন্দ্র ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, কিন্তু অন্নদাকে নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারে শ্রীকান্ত। যে দিন অন্নদা দুশ্চরিত্র স্বামীর জন্য ঘর ছেড়েছে, সে দিন থেকে তার নিজের হাতে নিজের মুখে কালি মাখানোর দিনও শুরু হয়েছে। যন্ত্রণা ছাড়া কিছু পাওয়ার নেই, অথচ ছেড়ে গিয়েই বা কী পাবে সে। ব্রাহ্মণ বিধবার প্রেম-মাধুর্যহীন জীবন থেকে মুক্তি পেতে অন্নদা বাঁধা পড়েছিল নির্যাতনের আবর্তে। দিদি বার বার দুই ভাইকে বলে, তোমরা আর এসো না।

অন্নদা একটা প্রোটোটাইপ। তাদের মতো মেয়েদের মার খেতে দেখে যাঁরা বাঁচাতে যান, তাঁদের শুনতে হয়, ওটা আমাদের ব্যাপার, আপনার কী। আহত হয়ে তাঁরা সরে আসেন, অনুভব করেন যে নির্যাতনের অনেকটাই চলে সম্মতিতে। মেয়েরা মার খেতে চায়, এমন নয়। কিন্তু মারের হাতকে সে ভেঙে দিতেও চায় না। যা আদরের, সোহাগের হাত, তা-ই চড়থাপ্পড় মারার হাত।

নির্যাতনকারীর সঙ্গে নির্যাতিতের এই যে ঘনিষ্ঠ, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, যেখানে সব সময়ে প্রেম আর বিদ্বেষের একটা দোলাচল চলে, এই হল নারী নির্যাতনের অনন্য মাত্রা। কথাগুলো সম্প্রতি বলছিলেন শেফালি মৈত্র। দর্শনের অধ্যাপক, নারীবাদী লেখক তিনি। জাতীয় শিক্ষা পরিষদে একটি স্মারক ভাষণে বলছিলেন, ধারাবাহিক নির্যাতন তো শুধু মেয়েদের উপরেই হয় না। দলিত- জনজাতির উপর উচ্চবর্ণ, কালোর উপর সাদা, দরিদ্রের উপর ধনী, স্বল্পশিক্ষিতের উপর উচ্চশিক্ষিত দীর্ঘ দিন ধরে নির্যাতন চালিয়ে আসছে। সে নির্যাতনে চন্ডত্ব বা ভায়োলেন্স (মারধর, ঠ্যাঙানো) যেমন আছে, তেমনই হয়রানি, অতিষ্ঠ করা, পেছনে লাগা, এমন মানসিক হয়রানিও আছে। আবার শোষণ, বঞ্চনার মতো আর্থ-সামাজিক নির্যাতনও রয়েছে। কিন্তু প্রেম-অপ্রেম এ দুইয়ের দ্বান্দ্বিকতা কেবল মেয়ে-পুরুষ সম্পর্কেই রয়েছে। প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কে তা মেলে না। যে নির্যাতন করছে, সে-ই যে ভালবাসার মানুষ। আর ভাল না বাসতে পারলে জীবনে রইল কী! তাই যে মারধর করে, বা ঠেস দিয়ে কথা বলে, অতিষ্ঠ করে, সবার সামনে অপমান করে, যে সারা জীবনের সব পরিশ্রম, সব সঞ্চয় স্বচ্ছন্দে দাবি করে কিন্তু শূন্য হাতে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়ার ভয় দেখায় নিত্যদিন, সে-ও আপনজন। তার থেকে সরে আসার কথা ভাবতে গেলে নিজেকে আর খুঁজে পায় না মেয়েরা। এখানেই নারী নির্যাতন অন্য সকল নির্যাতনের থেকে পৃথক। ‘পিড়নকারীর সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েরা বলতে পারে না, শিকল ছাড়া আমার হারাবার কিছু নেই,’ বললেন শেফালি মৈত্র।

অলঙ্করণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

শিকল কি একটা? বরের সঙ্গে রয়েছে ঘর। নিজের হাতে সাজানো ঘর-গেরস্তালি ছেড়ে আসার চেয়ে হৃদপিণ্ডটা উপড়ে আনা সোজা। চালের বাতায় গোঁজা তালপাতার পাখা, ঘরের কোণে গুটোনো মাদুরটা পর্যন্ত গ্রামের মেয়েটির কাছে মহার্ঘ্য। নিজের হাতে সাজানো কালার-কোঅর্ডিনেটেড ড্রয়িং-ডাইনিং ছেড়ে চলে যাওয়ার চাইতে সর্বসমক্ষে দুটো কথা শোনা শহুরে মেয়েদের কাছে সোজা মনে হয়। ‘সারাদিন বাড়িতে থাকো, অমুকটাও করতে পারো না’ গোছের কথা হজম করার জন্য মেয়েরা এ ওকে বলে, ‘উফ আজ আমার বর আমাকে যা বকল।’ এ কেবল ন্যাকামো নয়, এ একটা কোপিং মেকানিজম – সহ্য করা, সইয়ে নেওয়ার কৌশল। এক ধরনের নীরব বোঝাপড়া, যা মেয়েদের প্রকাশ্য অসম্মানকে সহনীয়, এমনকী প্রার্থনীয় করে তোলে।

যে মেয়ে এই খেলায় যোগ দেয় না, বরং সম্পর্কে সাম্য বজায় রাখাকে অস্পষ্ট ধারণা থেকে দৈনন্দিন প্র্যাকটিসে আনতে চায়, সে ‘বহিরাগত।’ তাদের প্রতি অন্য মেয়েরা নির্মম হয়ে ওঠে। তাঁর টিফিন তাঁর বর তৈরি করে দেয়, এক তরুণী অধ্যাপিকা এ কথা বলতে কলেজের স্টাফ রুমে ঝড় বয়ে গিয়েছিল। ‘কী ভাল বর পেয়েছিস’ গোছের মিষ্টি কথার আড়ালে নিন্দা-অপবাদের ঝাঁঝ। এক সহকর্মী পড়াশোনার জন্য কিছু দিন বিদেশে ছিলেন। তাঁর ছেলেকে স্কুল-বন্ধুদের মায়েরা নিত্য শুনিয়েছেন, ‘তোর মা তো তোদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। তোকে ভালবাসে না।’

নারীর মর্যাদারক্ষায় আপসহীন হতে গেলে যেন প্রেম-সোহাগ, ঘর-গেরস্থালির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হয়। এটাই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটা মস্ত সঙ্কট। শিক্ষিত, রোজগেরে মেয়েরাও যে চট করে নারীবাদের দিকে ঝোঁকে না, তার কারণ তারা আন্দাজ করতে পারে, প্রচলিত প্রেম-ভালবাসা, ঘর-সংসারের সঙ্গে মেয়েদের অধিকার-স্বাতন্ত্র্যের কোথাও একটা সংঘাত রয়েছে। যে প্রেম মেয়েদের সমান অধিকার, সমান মর্যাদার জমিতে শিকড় গেড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, সে প্রেমের চেহারাটা কেমন, তা একবিংশের সদ্য-তরুণীর কাছেও স্পষ্ট নয়। বাংলা সিনেমা-সিরিয়াল-সাহিত্য, কোথায় তেমন রোম্যান্টিক প্রেম দেখেছে সে? একা মেয়ের লড়াই অনেক দেখেছে, তারা কেউ কেউ পুরুষদের পিটিয়ে পাট করে দিয়েছে। মেয়েদের যৌনতা, যৌন-ইচ্ছা, বিয়ের বাইরে স্বেচ্ছায় যৌন-সম্পর্ক, সে সব মেয়েরা পড়েছে, দেখেছে। মেয়েদের অসম্মতির অধিকার আছে, সে-ও তারা বিশ্বাস করে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে মোমবাতি মিছিল করে, কলম-ক্যামেরা ধরে মিলেনিয়ামের মেয়েরা। কিন্তু প্রেম?

যেটাকে বলে ফ্লার্ট করা, বাংলায় ছেনালিপনা, তা ছেলে-মেয়ে দুজনেই আজ অবাধে করে। কিন্তু যখনই তা একটা সম্পর্কের দিকে যায়, নতুন বাড়ির দেওয়ালে প্রাচীন বটের চারা মাথা চাড়া দেওয়ার মতো মেয়েদের স্বেচ্ছা-অধীনতা কোথা থেকে উঠে আসে। দু’লক্ষ টাকা, নিদেন একটা মোটরবাইক, আসবাবপত্র তো দিতেই হবে, তার বয়ফ্রেন্ড কি ফেলনা। এমনই হয়, এটাই নিয়ম। ভালবাসে বলেই না চাইছে। না দিতে পারলে মার তো খেতেই হবে। যদি মাথায় ডান্ডা মেরে, গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে ফেলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মিতা দাসের মতো, মরে যেতে হবে। নইলে ওই তো পড়ে আছে নারী অধিকারের শ্মশানভূমি, সেখানে প্রেমের শব নিয়ে শক্তির সাধনা করো।

নারীবাদীর লড়াই কেমন, অনেক দেখা আছে। নারীবাদীর প্রেম কেমন, দেখা বাকি। এ বার তার খোঁজ করতে হবে।

 

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 400E Mosholu Parkway South Apt # A23,The Bronx, New York 10458, USA

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com