হে মোর দুর্ভাগা দেশ।।
।।নূরে আলম সিদ্দিকী।।
সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ আজ মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত। আপাতদৃষ্টিতে ছিমছাম, রাজনৈতিক দুর্যোগবিবর্জিত, হরতাল-অবরোধমুক্ত একটা নির্ঝঞ্ঝাট রাজনৈতিক অবস্থা দৃশ্যমান থাকলেও কেমন যেন একটা গুমোট থমথমে ভাব। সবচেয়ে পরিতাপ ও বেদনার বিষয়, মানুষ নিখোঁজ হওয়া এবং কিছুদিন পর কোনো নদীতে, খালে-বিলে তার পচা দুর্গন্ধময় বস্তাবন্দী লাশ ভেসে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে লাশগুলো শনাক্ত করাই দুঃসাধ্য হয় বিধায় বেওয়ারিশ ঘোষণা করে পুলিশ নিজেই দাফন করে ফেলে। ক্ষেত্রবিশেষে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে লাশ হস্তান্তর করে। বিষয়টি কদাচিৎ ঘটে, তা নয়। এরকম ঘটনার খবর হামেশাই সংবাদমাধ্যমে দেখা যায়। অজানা কারণে প্রাণ হারানো অসহায় ব্যক্তিদের অনেক সময় সাদা পোশাক পরিহিত ব্যক্তিরা, র্যাব ও পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার নামে তাদের বাড়ি থেকে সদর্পে উঠিয়ে নিয়ে আসে। কখনো কখনো আত্মীয়স্বজনকে নিকটস্থ থানায় যোগাযোগ করার সদাশয় পরামর্শ প্রদান করা হয়। তবু এরা সৌভাগ্যবান। লেনদেন ও দেনা-পাওনায় সঠিক সমঝোতায় পৌঁছতে পারলে নির্যাতিত ও নিগৃহীত হলেও কোনোরকমে প্রাণটা নিয়ে তো ফিরে আসতে পারেন। ব্যতিক্রমভাবে বেঁচে ফেরা এই মানুষগুলো সত্যিই সৌভাগ্যের বরপুত্র। ভিটেমাটি, জমিজিরাত, গরুছাগল, গয়নাগাটি বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ এবং গ্রেফতার করা কর্তাদের সঙ্গে আপস ও সমঝোতা করে যারা বেরিয়ে আসতে পারেন, তারা ধন্য হয়ে যান। সর্বস্ব খুইয়ে অবমুক্ত হওয়া মানুষগুলোর মুচলেকাও দিতে হয়। কেউ কেউ আবার তাদের এজেন্টেও পরিণত হন। সাধারণত সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী ও আদালতে ওয়ান সিক্সটি ফোরে অপরাধের স্বীকারোক্তি প্রদানকারী আসামিগুলোই ক্ষেত্রবিশেষে পুলিশের সোর্সে পরিণত হয়। আজকাল শোনা যায়, এই সোর্সরাই রাতারাতি বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে যায়। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই সোর্সরা সম্মানী ও হোমরা-চোমরা বিত্তবান সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের টেলিফোনে ধমক দেন, একটা বিরাট অঙ্কের অর্থ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্বেচ্ছায় পৌঁছে না দিলে সন্ত্রাসী বা মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। অন্যদিকে সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীদের গডফাদাররা শুধু এই উেকাচের বিনিময়ে নির্বিঘ্নে সমাজের বিভিন্ন স্তরে অবাধে বিচরণ করে।
জনান্তিকে জানিয়ে রাখা কর্তব্য, সন্ত্রাস ও মাদক ব্যবসায়ী গডফাদারদের হাত এতটাই প্রসারিত যে, প্রশাসনের সর্বস্তরে তো বটেই, সরকার ব্যবস্থাকেও অনেকটাই বশীভূত করে ফেলেন। হায়রে, কী দুর্ভাগা এই দেশ! কী সৌভাগ্যবান এ দেশের দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজরা! লাখ লাখ মানুষের বুক নিঃসৃত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশের মাটিতে আজকে গাছের চেয়ে আগাছাই জন্ম নিচ্ছে বেশি। দুর্নীতি ও এই নিরাপত্তাহীনতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে প্রান্তিক জনতার নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা দেওয়া তো যাবেই না, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বও প্রচণ্ডভাবে বিপন্ন হয়ে পড়বে। দুঃখজনক হলেও বাস্তবে এই বিপন্নতার করুণ দৃশ্য সমাজে আজ ক্রমেই নিদারুণভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দুর্নীতিবাজরা আজ আদৌ কুণ্ঠিত বা লজ্জিত নয়। বরং অসহ্য ও অসহনীয় দর্পে ক্রমে তারা রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে অধিকার বিস্তার করেই চলেছে। পরিস্থিতিটা আজ এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, কে যে আজ দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের পরিমণ্ডলের বাইরে তা শনাক্ত করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনোরকম রাজনৈতিক চেতনা, আদর্শ, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের যারা ধারই ধারেন না, সরকারি দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনে তারাই আজ দোর্দণ্ড প্রতাপে বিচরণ করছে। এটা যে জাতির জন্য কত বড় অশনি সংকেত, স্বাধীনতার জন্য কত বড় হুমকি তা হৃদয়ের মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলেও বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই। শুধু সবিনয়ে অকুতোভয়ে বলতে চাই, সবাইকে আপন আপন আঙ্গিক থেকে এই সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে সরব হতে হবে, প্রতিবাদী হতে হবে।
কাউকে কটাক্ষ করার জন্য নয়, কারও বিরুদ্ধে বিদ্বেষ, আক্রোশ বা ক্ষোভ প্রকাশের নিমিত্ত নয়, রাজনৈতিক মহল ছাড়াও এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে যাদের সবচেয়ে সগৌরবে, অকুতোভয়ে এগিয়ে আসা উচিত ছিল, সেই সাংবাদিক মহল কেন জানি না আজকে এতটা নিষ্প্রভ! এমনকি দুর্নীতির অতল গহ্বরে তাদের অনেকেই আজ নিমজ্জিত। তদুপরি সাংবাদিকতার গোটা মহলটি আজকে সরকার ও বিরোধী দলের বশ্যতা স্বীকার করে বসে আছেন। আনুগত্যের মুচলেকা প্রদানকারী আত্মসম্মানবিবর্জিত সাংবাদিক মহলটি আজকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত তাদের পূর্বসূরি ছিলেন মানিক মিয়া, শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন, আসফ উদ্দৌলা রেজা, রণেশ দাশগুপ্তের মতো কালজয়ী ব্যক্তিবর্গ। আমরা যৌবনে দেখেছি, সাংবাদিকতার পরিমণ্ডলে মানিক ভাই, সিরাজ ভাই, রেজা ভাই, রণেশদার মতো অকুতোভয় ব্যক্তিত্বকে তাদের বিবেকনিঃসৃত জনস্বার্থের লেখনীকে অর্থ বা অন্য যে কোনো ধরনের উেকাচ ও সুবিধা প্রদান করে স্তব্ধ করা যেত না। কোনো নির্যাতন নিগ্রহ এমনকি প্রাণনাশের হুমকি তাদের নির্ভীক যাত্রাপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারত না। ১৯৬৬ সালে ছয় দফার পক্ষে কলম ধরার কারণে ইত্তেফাকের প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। মানিক ভাইসহ ইত্তেফাকের অনেক সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়। তবু তাদের বিবেককে অবদমিত করা যায়নি, লেখনীকে বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। শুধু তাই নয়, তখনকার সমগ্র সাংবাদিক মহলটি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাদের হৃদয়ের অর্ঘ প্রদান করেছিল। এই দুর্দমনীয় সাহস নিয়ে নিগ্রহ নির্যাতনকে সানন্দে বরণ করার যে অকুতোভয় মানসিকতা ও নিষ্কলুষ পরিভাষা তাদের লেখনীতে নৈমিত্তিক ফুটে উঠত, আজকের চিত্রটি অনেকটাই তার বিপরীত। সমাজের অধিকারবঞ্চিত মানুষের কথা তুলে ধরার পরিবর্তে যাদের উদ্ধত পদাঘাতে পদানত হলো মৌলিক অধিকার, তাদের বন্দনাই আজকের অনেক সাংবাদিকের দিগ্দর্শনে পরিণত হয়েছে।
শুধু সাংবাদিকদেরই যে এই নৈতিক স্খলন, তা নয়। রাষ্ট্র ও সমাজের সব ক্ষেত্রে এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য প্রতিভাত। বিশেষ করে মানবতার সেবায় জীবনকে উৎসর্গ করার শপথবাক্য উচ্চারণ করে যারা অধ্যয়ন শুরু করেন তাদের নৈতিক স্খলন আজকের সমাজে ভয়ঙ্কর ও ভয়াবহ আকারে ফুটে উঠেছে; তারা হচ্ছেন দেশের চিকিৎসকবৃন্দ। চিকিৎসকদের একটা বিরাট অংশ আজকে জীবন বাঁচানোর মহতী সাধনা থেকে দূরে সরে এসে তাদের নিজেদের জীবনটাকে নিষ্ঠুর ও নির্লজ্জ অর্থ উপার্জনের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তারা আইন-কানুনেরও পরোয়া করেন না। অন্যদিকে দেশের প্রচলিত আইন তাদের ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারে না। তাদের একটি রোমও স্পর্শ করতে পারে না। চিকিৎসকদের কাছে আইন ও আদালতকে বড়ই অসহায় মনে হয়। চিকিৎসা সঠিক হলো না ভুল হলো, তার চিকিৎসায় রোগী বাঁচল কি মরল তা বিবেচনা করা যেন আইন ও আদালতেরও অসাধ্য। ওই যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নিয়ে বের হয়েছেন, সেটিই তাদের আদি ও অন্তিম সম্পদ। চিকিৎসা ক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্ভাবন, আবিষ্কার, যে নিত্যনতুন বিবর্তন— এসবের তারা ধারই ধারেন না। কোনোরকমের ডিগ্রির একটা তকমা থাকলে তারা এমনই দুর্দমনীয় হয়ে ওঠেন যে, তাদের ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা গেলে সমাজের কাছে কৈফিয়ত বা রোগীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া দূরে থাক, তারা সম্পূর্ণরূপে বেপরোয়া। অনেক নার্সিং হোমে রোগী মারা যাওয়ার পরও বাড়তি অর্থ উপার্জনের পৈশাচিক লালসায় লাইফ সাপোর্টে কয়েক দিন রেখে দেওয়া হয়। ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে অর্থ ও উপঢৌকনের বিনিময়ে প্রেসক্রিপশনে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লেখা, বিনা প্রয়োজনে বিভিন্ন টেস্ট করতে বাধ্য করা, সন্তান জন্মের সময় সিজারের প্রয়োজন না থাকলেও সিজার করতে বাধ্য করানোর ঘটনাগুলো তো সর্বজনবিদিত।
অথচ এজন্য তাদের বিচারের আওতায় আনা দূরে থাক, বিন্দুমাত্র প্রতিবাদও হয় না। ভুল চিকিৎসার জন্য একজন চিকিৎসকের বিচার হওয়া দূরে থাক, চিকিৎসকদের অভ্যন্তরীণ সংগঠন থেকে অভিযুক্ত ডাক্তারকে তলব করে বিন্দুমাত্র ভর্ত্সনা করা হয়েছে বা তার ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, এমন একটি উদাহরণও বাংলাদেশে নেই।
অথচ পাশের ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি গ্রহণের পরও চিকিৎসারত অবস্থায় নিয়মিত পড়াশোনা করতে হয়। এটা ঐচ্ছিক নয়, বাধ্যতামূলক। আমাদের দেশে সনদ নবায়নের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে বার্ষিক পরীক্ষা প্রদানের কোনো নিয়মই নেই। বাংলাদেশের মতো চিকিৎসা ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতার এই অবাধ সুযোগ পৃথিবীর আর কোথাও পরিলক্ষিত হবে না, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
চিকিৎসকদের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে চিকিৎসাকে মানবতার সেবার আবর্তে না এনে ব্যবসায়িক মানসিকতায় গ্রহণ করার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সময় বয়ে যাচ্ছে। এর জন্য সামাজিক প্রতিরোধ তো বটেই, বিশেষ আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে। তাদের সুনিশ্চিত গাফিলতিতে রোগী মারা গেলে আত্মীয়স্বজনের হৃদয় ভেঙে যায়, অনুভূতি কুঁকড়ে কেঁদে ওঠে। ফলে ডাক্তারদের সঙ্গে তর্কবিতর্ক ও বচসা বেধে যায়। এ নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রায়শই রক্তারক্তি পর্যন্ত গড়ায়। ফলে সমস্ত চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়, এমনকি ইমারজেন্সি রোগী দেখারও কোনো তাগিদ তারা বোধ করেন না। সম্প্রতি চট্টগ্রামের কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে র্যাবের অভিযানের প্রতিবাদে বৃহত্তর চট্টগ্রামের সমস্ত বেসরকারি হাসপাতালে অনির্দিষ্টকালের চিকিৎসাসেবা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন মালিকরা। একই দিনে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে তার দ্বিগুণ বয়সী জনৈক মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করে বের করে দিয়েছেন চিকিৎসক নামধারী এক ব্যক্তি। একটি ভিডিওচিত্রে সেই দৃশ্য দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে।
আশ্চর্যান্বিত ও বিস্ময়াভিভূত হতে হয় তাদের বিবেকবিবর্জিত, কাণ্ডজ্ঞানহীন, মানবতাবিরোধী কার্যক্রম দেখে। তারা তখন এতটাই মারমুখী ও সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠেন যে, মুমূর্ষু রোগীর কথা ভাববারও প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না। তারা নিজেরা তো কারও না কারও সন্তান, স্বামী বা পিতা। তাদের রক্তের নিবিড় সম্পর্কের কেউ ওই সময় হাসপাতালে ভর্তি থাকলে তারা কি এতখানি নির্মম, নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন ও অমানবিক হতে পারবেন? নাকি সে ক্ষেত্রেও তারা নিষ্ঠুরতার উন্মত্ততায় বুঁদ হয়ে থাকবেন? অপচিকিৎসায় মৃত রোগীর অসহায় আত্মীয়স্বজন শুধু নির্যাতিত ও নিগৃহীতই হন না, সরকারি হাসপাতাল এমনকি ব্যক্তিমালিকানাধীন নার্সিং হোমে আসুরিক তাণ্ডবলীলা চলে। এটা সমাজের, মানবতার, জীবনের কোনো সংজ্ঞায়ই পড়ে না।
কিছু কিছু কিন্ডারগার্টেন ও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লে-গ্রুপ থেকে শুরু করে এ লেভেল ও লেভেল পর্যন্ত শিক্ষা প্রদান করে। তারা অনেক ক্ষেত্রে প্রদেয় কর তো দেয়ই না, কর আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের (এনবিআর) কর্মকর্তারা মরিয়া হয়ে পড়ে থাকেন তাদের সন্তানসন্ততির বা স্বজনদের ভর্তিসুবিধা পাওয়ার ব্যাপারে। আমার শিল্পপতি বন্ধুদের অনেককেই আক্ষেপ করতে শুনেছি, এত বড় শিল্পকারখানা না বানিয়ে ওই ধরনের একটা ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করলেই ভালো হতো। আমরাও ভাগ্যের বরপুত্র হতে পারতাম। সেখানে ভর্তি ফি ও মাসিক বেতনের কথা শুনলে অনেকের পিলে চমকে উঠবে।
আজকাল প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি নিয়মিত ও স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি চক্ষু লজ্জার মাথা খেয়ে নির্বোধের মতো অবলীলাক্রমে উত্তর দেন, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, ভবিষ্যতে আর প্রশ্ন ফাঁস হবে না। কিন্তু বাস্তবটা হলো, যথা পূর্বং তথা পরং। অভিভাবকদের দুঃখবেদনা সবকিছুই যেন ‘পুরোহিতে মন্ত্র পড়ে আরা পাঠায় লেজ নাড়ে’— এমন বিশ্রী অবস্থা। এর শেষও নেই, প্রতিকারও নেই। এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের পেছনেও কোটি কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন কাজ করে। কোমলমতি শিশুদের ভাগ্যবিড়ম্বনা তো বটেই, এটি শিক্ষাব্যবস্থায় বীভৎস ধস নামার অশনিসংকেত।
পাঠক অবহিত, আমি স্বাধীনতাযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। ছাত্রজীবনে দীর্ঘদিন কারাগারের অন্তরালে নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণার মধ্যে কাটিয়েছি। কারারুদ্ধ অবস্থায় মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের জন্য দুই দিনের প্যারোলও পাইনি, মুমূর্ষু অবস্থায় তার মুখে এক ফোঁটা পানি তুলে দিতে পারিনি, তার জানাজা পড়তে পারিনি, তার দাফন করতে পারিনি। এ শুধু আমার জীবনের করুণ কাহিনী নয়। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকেরই জীবন এমন করুণ আলেখ্যে ভরা। জীবনসায়াহ্নে এসে মূল্যবোধের এমন অবক্ষয়, দুর্নীতির এমন অপ্রতিরোধ্য বিস্তার, মৌলিক অধিকার বিবর্জিত এমন স্বৈরাচারী শাসন দেখে মনটা ক্ষোভ, ক্লেদ ও প্রান্তিক মানুষের বঞ্চনার বেদনায় কেবল ভরেই ওঠে না, হৃদয়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত বিবেকের জাগ্রত দেবতা প্রশ্ন করে— ভাষা আন্দোলন থেকে স্বায়ত্তশাসন, স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনের দীর্ঘ পথপরিক্রমণে কোথাও কি কোনো ব্যত্যয় ছিল? না হলে আজ সব প্রত্যাশা দূরাশায় পরিণত হচ্ছে কেন? এই লেখার উপসংহারে বিধাতার কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই—
‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভাল?’
লেখকঃ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন