হাসিনা আরও কঠোর অবস্থানে। ২০০৭ সালের পুনরাবৃত্তি কী?
আরো কঠোর অবস্থানে হাসিনা, বাংলাদেশ আবার ২০০৭ সালের দিকে যেতে পারে, বিএনপি কি খেলতে পারবে?
নিজস্ব প্রাক-নির্বাচনী জরিপ প্রতিবেদনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম ভবিষ্যদ্বাণী করার প্রেক্ষাপটে এবং ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ প্রতিবাদ সামাল দিতে বিলম্ব করার ফলে যে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সরকার তাতে করে বাংলাদেশ ২০০৭ সালের মতো পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হতে পারে, যেখানে সেনাবাহিনী রাজনীতিকে ‘স্থিতিশীল’ করতে চূড়ান্ত ভূমিকা পালন করেছিল।
সামরিক বাহিনী শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতা দখল করবে, এমন কথা বলা হচ্ছে না। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে মেজর বা জেনারেলরা ট্যাঙ্ক বের করে সরকার উৎখাত করবে, এমন দিন শেষ হয়ে গেছে। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে নির্ধারিত পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে ২০০৬ সালের অক্টোবরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়া সত্ত্বেও বিখ্যাত দুই বেগম প্রচণ্ড শক্তিতে একে অপরের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার ফলে যে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তার অবসান ঘটাতে ২০০৭ সালে সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। ওই সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সহিংস রাজনৈতিক সঙ্ঘাত এড়াতে সেনাবাহিনীর প্রশ্রয়ে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। ২০০৮ সাল শেষ হওয়ার আগেই সেনাবাহিনী নিশ্চয়তা দানকারীর ভূমিকায় থাকার ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।
বর্তমানে আওয়ামী লীগ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করার জন্য পরিবেশ সৃষ্ট, রাষ্ট্রীয় ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা, দমনমূলক ব্যবস্থা বন্ধ করাসহ অন্যদের স্থান দিতে পুরোপুরি একগুঁয়েভাবে অস্বীকার করায় আবারো কি সময় এসেছে, অন্তত লীগের অংশবিশেষে, অনির্দিষ্টকালের জন্য নির্বাচন স্থগিত করা? এ ধরনের অবস্থান কি ২০০৭ সালের মতো সেনাবাহিনীকে সামনে আসতে বাধ্য করবে ও/বা অনুপ্রাণিত করবে? নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আরো কিছু প্রয়োজনীয় বিবেচনাও – ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের অবস্থান, যা নির্বাচন স্থগিত করার জন্য যৌক্তিকতা ভালোভাবেই তুলে ধরবে- পুনঃপ্রতিষ্ঠা বা ‘স্বাভাবিক অবস্থা’র জন্য দরকার পড়বে যা নির্বাচনকে সহিংসতা, ভীতি প্রদর্শন ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে।
সাউথ এশিয়ান মনিটর’র সাথে কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাই কমিশনার দেব মুখার্জি স্বীকার করেছেন যে শেখ হাসিনা সরকার ‘ভুল করেছে’ এবং এই সরকার যা করছে, ঢাকার রাজপথের বিক্ষোভ অবসানে গৃহীত পন্থা ও আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন ফটোগ্রাফার ও অ্যাক্টিভিস্ট শহীদুল আলমকে স্বেচ্ছাচারমূলকভাবে গ্রেফতার করার মাধ্যমে প্রকট হয়েছে, তা ‘খুবই ভ্রান্ত ও মূর্খতা।’ অবশ্য দেব মুখার্জি আস্থার সাথে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচন আয়োজন করবে। কারণ এই সরকার জানে যে তা করা না হলে তাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিন্দার মুখে পড়তে হবে।’ দেব মুখার্জি যদিও বলেছেন, নির্বাচন হবে, তবে তা কখন হবে সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন। তিনি বলেন, ‘আগামী দিনগুলোতে অরাজনৈতিক সেনাবাহিনী কোন ভূমিকা পালন করবে, তা অনুমান করা কঠিন।’
এই পর্যায়ে আওয়ামী লীগ কোন পথ অবলম্বন করবে তা স্পষ্ট না থাকায়, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এর অবস্থান কঠোর করতে থাকায় ও এর নির্লজ্জতা ‘তীক্ষ্ণভাবে ও প্রত্যক্ষ ও পর্যবেক্ষণ’ করা হচ্ছে বলে জানালেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। গয়েশ্বর রায় বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারছি যে আওয়ামী লীগ আমাদের পার্টির জন্য একই ধরনের কঠোর অবস্থান সৃষ্টি এবং জাতীয় আন্দোলন শুরু করার দিকে আমাদেরকে ঠেলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য তার দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ‘জোরালো অবস্থান প্রসঙ্গে বলেন, তার সহকর্মীরা ‘আওয়ামী লীগের আমাদের কোর্টে বলা ফেলতে চাওয়া সম্পর্কে অবগত রয়েছে। তিনি জানান, এটি ‘দলের নেতৃত্ব পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে।’
বাংলাদেশের একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্কের প্রাক-নির্বাচনী জরিপের ফলাফল – অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে এবং আসন সংখ্যা দুই অঙ্কের নিম্ন প্রান্তিকে নেমে যেতে পারে বলে এতে বলা হয়েছে – সম্পর্কে হাসিনা অবগত থাকায় নিরাপদ সড়কের জন্য ঢাকার শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ-পরবর্তী ঘটনাবলীতে অবরুদ্ধ দলটির ‘ব্যাখ্যাহীন’ অবস্থান রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মহা ও অব্যাহত জটিলতায় ফেলেছে। এখানে উল্লেখ করা যথাযথ হবে যে ২০১৭ সালের আগস্টে অনুষ্ঠিত এক জরিপে ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ‘সম্মিলিত ৬৬ ভাগ ‘জোরালো সমর্থন’ (৪৫ শতাংশ) বা ‘কোনোরকম সমর্থন’ (২১ শতাংশ) রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের…’। অবশ্য এই জরিপ হয়েছিল সাম্প্রতিক শিক্ষার্থী বিক্ষোভের অনেক আগে।
ঢাকাভিত্তিক একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রধানের বক্তব্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ নির্বাচনী তফসিলে অটল থাকবে নাকি অনির্দিষ্টকালের জন্য তা স্থগিত করবে, তা অক্টোবরের শুরুতেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। এটি পরিষ্কার ইঙ্গিত যে ক্ষমতাসীন দলটি তার রাজনৈতিক-নির্বাচনী কার্ডটি খেলার আগে ঈদ উৎসব শেষ হয়ে যেতে দেবে। ওই থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রধান বলেন, বিএনপি জাতীয় আন্দোলন শুরু করতে পারে। অবশ্য দলটি অবগত রয়েছে যে দীর্ঘ মেয়াদি কর্মসূচি সফল করার মতো প্রয়োজনীয় শক্তি তার নেই। এই প্রেক্ষাপটে তিনি জোরালোভাবে বলেন যে আওয়ামী লীগকে তার নিজের ও বাংলাদেশের কল্যাণের জন্য বর্তমান অচলাবস্থা নিরসনের একটি পথ বের করতে হবে।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাবেক জেনারেল, যিনি ঘরোয়া রাজনীতির আগ্রহী পর্যবেক্ষক, বলেন যে আওয়ামী লীগের অনুমিত অজনপ্রিয়তার প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন দলটি পরিস্থিতি সামাল দিতে দুটি রাস্তা অবলম্বন করতে পারে। প্রথমত, নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত করে দিতে পারে এবং আসন্ন নির্বাচনী পরাজয় এড়ানোর জন্য একটি নির্গমন পথ খুঁজে নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, ‘জাতীয় ঐক্যের সরকার’ গঠনের জন্য নির্বাচন, ধরা যাক দুই বছরের জন্য, স্থগিত করা। ওই জেনারেলের মতে, ভবিষ্যতের কোনো এক সময়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগে এটি আওয়ামী লীগকে ঝকঝকে পরিষ্কার করে দেবে।
বাংলাদেশী নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের একটি অংশের মতে, বিশেষভাবে যারা আগে সামরিক-সমর্থিত সরকারে কাজ করেছিলেন, মনে করেন, আমেরিকানরা জাতীয় ঐক্যের সরকারের পক্ষে থাকার সম্ভাবনা থাকলেও ভারতীয়রা কী করবে তা পরিষ্কার নয়। অন্য দিকে বেইজিং একটি দলের বদলে অন্য কোনো দলকে এগিয়ে নিতে সরাসরি কোনো ভূমিকা পালন করবে না। তবে তারা চাইবে, নতুন সরকার গঠিত হওয়া মাত্র তার উপস্থিতি যেন অনুভূত হয়। অবশ্য বাংলাদেশী রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, চীনাদের যেকোনো ধরনের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ভারতীয় ও আমেরিকানরা একযোগে কাজ করবে।
ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার কোনো সুযোগ না থাকলেও একমাত্র যে বিকল্প পথ আছে তা হলো ২০০৭ সালের মতো কিছু একটা। অবশ্য এবার হবে এক বছরের সংক্ষিপ্ত বিরতির মতো। এমনটা হতে পারে সম্পূর্ণ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আগে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ঘটতে পারে।
২০০৭-২০০৮ মেয়াদে হাই কমিশনারের দায়িত্ব পালনকারী পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী স্বীকার করেন যে ঢাকার রাজপথের বিক্ষোভ দমনে আওয়ামী লীগ ‘সুনির্দিষ্টভাবেই রূঢ় আচরণ’ করলেও এবং দলটির মধ্যে অন্যান্য ঘাটতি থাকলেও ভারতের কাছে ‘বিকল্প আছে সামান্যই।’ কারণ বিএনপি (দিল্লির বিবেচনায়) এখনো রয়েছে ধূসর এলাকায়।’ ভারতীয় নিরাপত্তা এস্টাবলিশমেন্টের ইতোপূর্বে খালেদা জিয়ার লন্ডনভিত্তিক ছেলে তারেক রহমানকে ‘মার্জিত’ করতে চাওয়ার কথা স্মরণ করেন। তবে বলেন, তিনি সরে গেলে বিষয়টি চরমভাবে ব্যর্থ হয়।
গত প্রায় এক যুগ ধরে ভারতীয় নিরাপত্তা এস্টাবলিশমেন্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের সাথে ‘আরো ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত’ হতে চেয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীপ্রধানের সাম্প্রতিক পাঁচ দিনের সফরকে ঢাকাভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রধান ‘শুভেচ্ছা সফর’ হিসেবে অীভহিত করলেও অন্য জ্ঞাত সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশী অতিথির সাথে ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা’ হয়েছে। বিএনপির ‘অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশ’ দেশব্যাপী বিক্ষোভের ‘কোনো ধরনের বহিরাগত মদতের’ পথ সৃষ্টি করে কিনা তা ভারতীয় নিরাপত্তা এস্টাবলিশমেন্ট আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করছে।
প্রকাশ্যভাবে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য আগে থেকেই বলা ‘সবার জন্য সমান সুযোগ প্রস্তুতের’ দাবির কথা বলা অব্যাহত রাখবে। তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, তার দলের ‘অনমনীয়ভাবে’ তাদের দাবির প্রতি অটল থাকলে এবং আওয়ামী লীগ যদি তার বর্তমান অবস্থান থেকে না নড়ে তবে আইন-শৃঙ্খলায় পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্যান্য শক্তির হস্তক্ষেপ করার ‘সম্ভাবনা’ থাকবে। তিনি বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতির প্রতি বিএনপি হয়তো বিমুখ হবে না।