হাসিনার বিরুদ্ধে সেই আলোচিত দুর্নীতির মামলাগুলো।।
শামসুল আলম ।।
১ টাকাও খরচ হলে না, অথচ দুর্নীতিবাজ বানানো হল তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে! জনগণ কি এটা মেনে নেবে? এই রায় আদালতের নয়, বরং শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত। আরো আগে থেকেই তিনি বলে আসছেন এতিমের টাকা চুরির দায়ে শাস্তি দেবেন, তার মন্ত্রীরা সাজা ঘোষণা করেছেন বারবার। আর সেটা করার জন্যই দু’জন প্রধান বিচারপতিকে পদচ্যুত করে তিনি অধঃস্তন আদালতের বিচারকের দখল নিজের হাতে নিয়েছেন। চাইলেই যে কাউকে ইচ্ছামত সাজা শাস্তি দেয়াতে পারেন যে কোন আদালত দিয়ে। তাই দেশের জনগণ মনে করে, বিচার ব্যবস্থাকে কব্জা করে শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চারিচার্থ করেছেন। তাই ঢাকায় রায় প্রকাশের সাথে সাথেই বরিশালে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আক্রোশ ও আস্ফালন দেখেছে জনগণ, পিতারই ভাষায়- “কোথায় আজ খালেদা জিয়া?” এক সময় তাঁর পিতাও বলেছিলেন- “এখন কোথায় সিরাজ সিকদার?” এরপরে কে কোথায় গেছে, তা দেশবাসীর জানা আছে।
বেগম জিয়া এবং বিএনপির দিকে তাকিয়ে আজ যারা ভ্রুকুটি করছেন, তাদের মনে রাখা দরকার- ১৯৬০ সালে দুর্নীতি মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানও দু’বছর কারাদণ্ড ভোগ করেছিলেন, এমনকি ডাকাতি মামলায়ও তিনি জেলে ছিলেন! দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলাও জেলে ছিলেন ২৭ বছর। সাম্প্রতিককালে মইন-ফখরের আমলে রাজনৈতিক কারণে এক বছর করে জেলে ছিলেন বেগম জিয়া এবং শেখ হাসিনা দু’জনেই। আসলে বাংলাদেশের সমস্যা জেল বা আদালত নয়, সমস্যা হল নষ্ট রাজনীতি।
দীর্ঘদিন ধরে চলা রাজনৈতিক অনাসৃষ্টির পরে বাংলাদেশের মানুষ আশা করেছিল রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে শান্তি আসবে। তবে গতকালের এই হুকুমি রায়ে পরে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে- অবৈধ সরকার আদালতের ঘাড়ে করে দেশ চালাচ্ছে, ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিকে কারাগারে পাঠিয়েছে। মারামারি কাটাকাটি হবে আবার। শাস্তি স্বস্তি আর এলো না। একটা দেশ উপরে উঠতে গেলে রাজনৈতিক ঐক্য এবং সংহতির দরকার হয়। দক্ষিণ অফ্রিকায় দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পরে শান্তি চুক্তি করে নিজেদের মধ্যে বিবাদ মিটিয়ে নেয় কৃষ্ণাঙ্গ শেতাঙ্গরা।
৯০এর গণআন্দোলনের পরে গণতন্ত্রের যে বিজয় সূচিত হয়েছিল, তা ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেন ঝড়ে মুখ থুবরে পড়ে। নির্বাচন গণতন্ত্রের স্থান দখল করে নেয় হাসিনার ভোটবিহীন সরকার ব্যবস্থা। ২০০৮ সালে তৈরী করা ফলাফলের নির্বাচনে সরকার গঠন শেখ হাসিনা, এরপরে ২০১৪ সালে বিনাভোটের নির্বাচনে মাস্টাররোল করে এমপি ও সরকার প্রতিষ্ঠা করে গুম খুন দুর্নীতির ভূস্বর্গে পরিণত করেছে! যেহেতু ক্ষমতার জন্য ভোট দরকার নাই, তাই জনগণের কাছে জবাবদিহিতাও নাই, ফলে রাষ্ট্রীয় বাজেট থেকে ৫/১০ গুণ খরচে উন্নয়নের বিলবোর্ড ডেমোনেস্ট্রেশন হচ্ছে। বাস্তবে রাস্তাঘাট নষ্ট, যোগাযোগ ব্যবস্খা দুমড়ে মুচড়ে দেশের অবস্থা জবুথবু, অথচ রাষ্ট্রীয় বাজেটের প্রায় অর্ধেকটা মহাদুর্নীতি করে পাচার করছে বিদেশে। কার্যকর কোন বিরোধী দল না থাকায় অবৈধ ক্ষমতাসীনরা খুন লুটপাটের রাজনীতি চালু করেছে। মানুষ আশা করেছিল শীঘ্রই দেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং গণতন্ত্র ফিরে আসবে।
কিন্তু ক্ষমতার মূল প্রতিদ্বন্দ্বি বেগম খালেদা জিয়াকে গতকাল বানোয়াট দুর্নীতির মামলায় জেলে নেয়া হল, যেখানে কোন অর্থই খরচ হয় নি। একটি বানোয়টি মামলায় মিথ্যা সাক্ষী ও ঘষামাজা কাগজ দিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠিয়ে মূলতঃ গণতন্ত্রকে জেলে পাঠালেন শেখ হাসিনা।
বশংবদ জজের রায়ে সরকারি দল আস্ফালন করে অথচ, তখন জনগণ দেখতে পায় অবৈধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কেবিনেট, দলবল, ও স্বজনদের লক্ষ কোটি টাকার মহাদুর্নীতির কোন বিচার হয় না, কোনো আদালতে অভিযোগ দায়ের করে না দুদক! এরূপ কয়েকটি খাতঃ
১) ২০১০-১১ সালে শেয়ার মার্কেট থেকে ১ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা লুট করে ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীকে পথে বসানো হয়েছে। এসব লুটপাটকারীদের বিচার তো হয়ই নি, বরং কাউকে কাউকে মন্ত্রী বানিয়ে পুরস্কৃত করেছেন হাসিনা!
২) বেসিক ব্যাংক থেকে ৩০০০ কোটি টাকা লোপট করে দিয়েছে শেখ হাসিনার আত্মীয় বাচ্চু শেখ! কিন্তু কোন বিচার হচ্ছে না। বরং মোলায়েমভাবে অনুসন্ধান নাটক চলছে।
৩) সরকারী দলের স্তাবক আবুল বারাকাত জনতা ব্যাংক থেকে ৫৪০০ কোটি টাকা সরিয়েছে! অর্থমন্ত্রীর স্বীকারেক্তি।
৪) হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে জড়িত শেখ হাসিনার উপদেষ্টা মোদাচ্ছের ৪০০০ কোটি টাকা লুট করার পরে অর্থমন্ত্রী বলেন- এটা এমন কোন টাকাই না!
৫) ফার্মার্স ব্যাংক খেয়ে ফেলেছে মখা আলমগীর এবং মুনতাছির মামুনরা, যার মধ্যে পাবিলিকের টাকা তো আছেই রাষ্ট্রীয় জলবায়ু খাতের ৫০৮ কোটি টাকাও নাই!
৬) ডেসটিনি খাতে লুট ৫০০০ কোটি টাকা, যার সাথে জড়িত শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা!
৭) বিসমিল্লাহ গ্রুপ জালিয়াতি করে ১২০০ কোটি টাকা লোপাটের সাথে সরকারি দলের লোকেরা জড়িত!
৮) বাংলাদেশ ব্যাংকের ৭’শ কোটি টাকা রিজার্ভ চুরির সাথে জড়িত খোদ প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের লোকজন জড়িত, তাই দু’বছরে কোন মামলা হয় না, কেউ জেলে যায় না।
৯) এমনভাবে লুটপাট করেছে যে দেশের অর্ধেক ব্যাংক এখন দেউলিয়া করে ফেলেছে- সরকারি দলের অর্থনীতিবিদের ভাষ্য।
এসকল দুর্নীতি ও লুটপাটের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত সরকারি দলের নেতা মন্ত্রীরা, এমনকি প্রধান মন্ত্রীর পুত্র নিজেও বেনিফিশিয়ারী। যার কারণে কোন একটি ঘটনার বিচার হয় নি।
বাংক ছাড়াও রাষ্ট্রীয় খাতে দেশী বিভিন্ন প্রকল্পের মুল্য পাঁচ-দশগুণ বাড়িয়ে লুটপাট করা হচ্ছে। অস্বাভাবিক প্রাক্কলন বৃদ্ধি করে রাষ্ট্রীয় খাত থেকে টাকা সরানো হয়।
১০) দোহাজারী-গুনদুম রেলপথ নির্মাণে ১,৮৫২ কোটি টাকার প্রাক্কালন বর্তমানে ১৮ হাজার ৩০৪ কোটি টাকায়। অর্থাৎ প্রায় ১০ গুণ।
১১) ভারত ও চীনে যেখানে মহাসড়ক নির্মানে খরচ কিলোমিটার সাড়ে ১০ কোটি টাকা, ইউরোপে সর্বোচ্চে ২৯ কোটি টাকা, সেখানে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ছয়টি প্রকল্পের কিলোমিটার প্রতি খরচ কছে ৫৪ কোটি টাকা। এখাতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট।
১২) ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়কের নির্মাণ ব্যয় কিলোমিটারপ্রতি ঠেকেছে ১২২ কোটি ৭৭ লাখ টাকায়। তার মানে ইউরোপেরও ৫ গুণ।
১৩) বিএনপির রেখে যাওয়া ৭৮৮ কোটি টাকার গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারটি আ’লীগ নির্মাণে ব্যয় করেছে ২৪০০ কোটি টাকায়, কিলোমিটার প্রতি ব্যয় প্রায় ২১১ কোটি টাকা, যা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল!
১৪) প্রধান মন্ত্রীর ছোটবোনের ইচ্ছায় বৃটেনের ভুয়া কোম্পানী ডিপি রেলকে ৬০ হাজার কোটি টাকার ঢাকা-পায়রা রেলপথ নির্মানের কাজ দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৫০ হাজার কোটি টাকাই চুরি হবে বলে ধারনা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
১৫) যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৩০ হাজার কোটি টাকায় করা সম্ভব, তা করা হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকায়।
১৬) পত্র পত্রিকা জুড়ে প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের ৯৭ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও অর্থপাচারের খবর বের হয়েছে যেখানে কেবল
বিদ্যুৎ এবং জ্বালানী খাতের দুর্নীতির পরিমান ৭৬,০০০ কোটি টাকা।
১৭) ভিওআইপি খাত থেকে ৯৫০০ কোটি টাকার লুটপাটের খবর
১৮) আইজিডব্লিউ লাইসেন্স দেয়া থেকে কমিশন নিয়েছে ৫৩০০ কোটি টাকা
১৯) আইসিএক্স লাইসেন্স দেয়া বাবদ হাতিয়ে নিয়েছে ২৩৮০ কোটি টাকা।
২০) এটুআই প্রজেক্ট থেকে দুর্নীতি ১১,৫৬০ কোটি টাকা।
২১) পদ্মা সেতুর খরচ তিন গুণ বেড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ জানে না।
২২) এভাবে বড় বড় প্রকল্পের খরচ বাড়ানো হয়েছে ৩/৫/১০ গুণ খরচ বাড়িয়ে উন্নয়নের গল্প শোনানো হচ্ছে।
জিএফআই’র প্রতিবেদন অনুসারে, গত ১০ বছরে বিদেশে পাচার হয়েছে ৫ লাখ ৩৩ হাজার কোটি। রিপোর্ট বলা হচ্ছে, ২০১৩ সালে পাচারের পরিমান ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ২০১২ সালে ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার, ২০১১ সালে পাচার হয় ৫৯২ কোটি ১০ লাখ ডলার, ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এসব দুর্নীতি লুটপাটের কোন মামলা নাই, বিচার হয় না। বোন এবং পুত্রের ২০-২৫ ভাগ কমিশন নেয়ার কাহিনী লন্ডন আমেরিকায় মুখে মুখে।
২৩) ২০০৮ সালের নির্বাচন অবধি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা হয়েছিলো। এর মধ্যে ১৩ টি মামলায় মোট ১৪ হাজার ৮৬৩ কোটি ৯০ লাখ ৫১ হাজার ১৮৮ টাকার দুর্নীতি/ অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়। এ ছাড়া একটি ছিল খুনের মামলা, আরেকটি সেনানিবাসে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টার অভিযোগে মামলা। এর মধ্যে ৪টি মামলায় ১৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ টাকার ঘুষ গ্রহণ ও চাঁদাবাজির অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় তিনি ছিলেন প্যারোলে। তবে কোনো মামলায় তাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি!! প্রধানমন্ত্রী পদের ক্ষমতা ব্যবহার করে খুব দ্রুতই তিনি সবগুলো মামলা তুলে নিয়েছেন। ১৫টি মামলার ৬টি রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। আর হাইকোর্টের মাধ্যমে বাতিল করিয়ে নেয়া হয় ৯টি মামলা। ২০১০ সালের ৩ মার্চ থেকে শুরু করে ৩০ মে পর্যন্ত মাত্র তিন মাসেই ৯টি দুর্নীতি মামলা বাতিল করে হাইকোটের দুটি বেঞ্চ। ঐ দুটি বেঞ্চের বিচারপতি ছিলেন মো. শামসুল হুদা, আবু বকর সিদ্দিকী, এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, বোরহান উদ্দিন। হাসিনার বিরুদ্ধে যে সমস্ত দূর্নীতির মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হয় তার মধ্যে একটি চলো নাইকো দুর্নীতি মামলা, যাতে হাসিনার নামে ১৩ হাজার ৬৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতি/দুর্নীতির অভিযোগের মামলা তুলে নেয় হয়, অথচ একই অভিযোগে খালেদা জিয়ার নামে মামলা এখন বিচারাধীন!
২৪) বেপজায় পরামর্শক নিয়োগে ২ কোটি ১০ লাখ ১ হাজার ৬৮৮ টাকার দুর্নীতি মামলাটি ২০০২ সালের ২ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিনজনকে অভিযুক্ত করে চার্জশীট দাখিল করা হয়। পরে ৩০ মে ২০১০ মামলাটি বাতিল করে শেখ হাসিনার সরকার।
২৫) শেখ হাসিনার নামে কোরিয়ান পুরাতন ফ্রিগেট ক্রয় করে ৪৪৭কোটি টাকা দুর্নীতির মামলাটি ১৮ মে ২০১০ বাতিল করে।
২৬) মেঘনা ঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র অবৈধভাবে কাজ দিয়ে রাষ্ট্রের ১৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ক্ষতি করার অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী রফিকুল ইসলাম ও সৈয়দ আবুল হোসেন সহ অন্যান্যদের নামে ২০০১ সালের ১১ ডিসেম্বর মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন ব্যুরো। ২২ এপ্রিল ২০১০ শেখ হাসিনার আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলাটি বাতিল করে।
২৭) খুলনায় ভাসমান বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মোনের অনুমতি দিয়ে ৩ কোটি টাকা ঘুস নেয়ার মামলাটি ১৩ এপ্রিল ২০১০ বাতিল করে। সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় দরদাতাকে কাজ দিয়ে তার কাছ থেকে তিন কোটি টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুদক। ৮টি চেক/পে অর্ডারের মাধ্যমে সামিট গ্রুপের মোহাম্মদ আজিজ খান শেখ হাসিনাকে ৩ কোটি টাকা প্রদান করে, যার দ্বারা ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাষ্টের জন্য সাড়ে ছয় কোটি টাকায় দোতলা বাড়ি সহ ১৯.১১ কাঠা জমি কেনা হয়। ২০০৮ সালের ১৮ মে অভিযোগ গঠনের পরে বিশেষ জজ আদালতে মামলার সাক্ষগ্রহণ শুরু হয়। পরবর্তীতে দেশে নির্বাচনের আবহ উঠলে সেনা সমর্থিত সরকার আপোষরফা করে মামলার গতি শ্লথ হয়ে যায়। ওবায়দুল কাদের দাবী করেন, “জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের তুলনা করা ঠিক না। কারণ বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট গঠিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যাদের নিজস্ব উদ্যোগে। এটা কারো দান বা অনুদান নয়!”
২৮) ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় করে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা দুর্নীতির মামলাটি ৯ মার্চ ২০১০ বাতিল করে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এবং বিচারপতি বোরহান উদ্দিন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ। ২০ আগষ্ট ২০০৮ শেখ হাসিনাসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারের সময়ে নূর আলী স্বীকার করেছিলেন, এই মিগ কেনা বাবদ তিনি ১২ মিলিয়ন ডলার কমিশন লাভ করেন, যা শেখ হাসিনা সহ অন্যরা ভোগ করে। এই মামলাটি হাইকোর্ট দিয়ে কোয়াশ করা হয়, যদিও এর আগে আপিলেট ডিভিশন এই মামলার কোয়শমেন্ট পিটিশন নাকচ করে নিম্ন আদালতে চলার বৈধতা দেয়। হাইকোর্টের কোনো বেঞ্চ কি আর পরে ঐ মামলাটি কোয়াশ করার এখতিয়ার রাখে?
২৯) ৪ মার্চ ২০১০ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা তিনটি মামলা অবৈধ ঘোষণা করে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এবং বিচারপতি বোরহানউদ্দিনের হাইকোর্ট বেঞ্চ। এরমধ্যে একটি বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার নির্মাণে ৫২ কোটি টাকা দুর্নীতি মামলা।
৩০) নূর আলীর নিকট থেকে ৫ কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ মামলাটি ১৩ জুন ২০০৭ দায়ের করা হয়। ৮ জুন ১৯৯৭ থেকে ২০ মে ১৯৯৯ তারিখের মধ্যে ১২টি চেকের মাধ্যমে নুর আলী ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা দেন হাসিনাকে, যাতে শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদের আইটি অফিসের জন্য পান্থপথের ইউটিসি বিল্ডিংয়ে ৫৩৮৮ বর্গফুটের একটি ফ্লোরের অর্ধেক উপঢৌকন দেন।
৩১) কাজী তাজুল ইসলামের নিকট থেকে ৩ কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ মামলাটি বাতিল করা হয় ৪ জানুয়ারী ২০০৯। ১০ এপ্রিল ২০০৭ দায়ের করা এই মামলায় বলা হয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মানের জন্য ওয়েস্টমন্ট পাওয়ার কোম্পানীর চুক্তি বাতিল করার হুমকি দিয়ে শেখ হাসিনা নগদ ৩ কোটি টাকার ঘুস নেন নগদ। ৮ আগষ্ট ১৯৯৮ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবনে গিয়ে দু’টি সুটকেসে ভরে ৫০০ টাকা নোটের ৬০০ বান্ডেলে ৩ কোটি টাকা শেখ হাসিনাকে হস্তান্তর করেন তাজুল। ২০০৯ সালে কেবল মামলাটি বাতিল করা হয়নি, বরং বছর দু’য়েক আগে তাজুল ইসলাম রহস্যজনক গাড়িচাপায় মারা যান।
৩২) টুঙ্গিপাড়ায় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ দূর্নীতি ৪১.৮৪ কোটি টাকার দুর্নীতির মামলাটি ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে প্রত্যাহার করার জন্য দুদককে সরকার চিঠি দেয়।
৩৩) আজম জে চৌধুরীর নিকট থেকে ৮টি চেকে ৩ কোটি টাকা ঘুস নেয়ার অভিযোগে এই মামলাটি শেখ হাসিনার দুর্নীতির সবচেয়ে বড় দালিলিক প্রমান। অথচ এটি ১৭ মে ২০০৯ প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। শেখ হাসিনা, শেখ সেলিম, ও শেখ রেহানার বিরুদ্ধে ১৩ জুন ২০০৭ তারিখে ইস্ট কোস্ট ট্রেডিং লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আজম জে চৌধুরী মামলা দায়ের করেন। ২৫ অক্টোবর ২০০৭ অভিযোগ গঠন হয় এবং শেখ রেহানাকে পলাতক ঘোষণা করে তার সকল সম্পত্তি এটাচ করা হয়। ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর “আমাদের সময়” পত্রিকা সংবাদ পরিবেশন করে, “৮টি চেকে ফেঁসে যাচ্ছেন হাসিনা, রেহানা ও সেলিম: সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে ১৪ বছর।” ২০০৭-২০০৮ সালে এ মামলাটির বিচার চলে বিশেষ জজ আদালতে, সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে মামলাটি রায় ঘোষনার কাছাকাছি পৌছে যায়। ইতোমধ্যে ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আগে সরকারের সাথে গোপন সমঝোতার ফলে রহস্যজনক কারনে হঠাৎ মামলাটির বিচার কার্য বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩৮৪, ৩৮৫ ও ৩৪ ধারায় এ অপরাধের জন্য শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ সাজা হওয়ার কথা ১৪ বছর সশ্রম কারাদন্ড। এক পর্যায়ে বাদী আজম জে চৌধুরীকে চাপ দিয়ে মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়। এ বিষয়ে শেখ সেলিম ১৬৪ ধারায় কোর্টে জবানবন্দি দিয়েছেন। শেখ সেলিমের স্বীকৃতির কথাবার্তা ইউটিউবে পাওয়া যায়। এই মামলায় হাসিনা ও সেলিমের জেল হবে টুডে অর টুমরো।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সৎ হবেন, সেটাই সকল বাংলাদেশীর কামনা। কিন্তু সরাসরি ঘুস নেয়ার মামলা প্রধানমন্ত্রীর নামে; তাও আবার চেকের মাধ্যমে নেওয়া; যদি রাষ্ট্রীয় প্রভাব বিস্তার করে প্রত্যাহার করা হয়, তাহলে দেশে আইনের শাসন আর থাকে কিভাবে? দলের জেলা সভাপতিকে হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগ করে তারই কোর্টে ২ মাসের কম সময়ে ৫টি মামলা প্রত্যাহার করা কি নৈতিকতা সমর্থন করে? এর পরে যদি দলের বড় বড় নেতারা সাফাই গান আর চিৎকার করেন, আদালতের মাধ্যমে নিস্পত্তি হয়েছে মামলা, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নয়!
নিজেদের এতগুলি দুর্নীতির খাত থাকতে, এবং এতগুলি দুর্নীতির মামলা বেআইনীভাবে প্রত্যাহার করার পরে ‘সৎ’ সেজে শেখ হাসিনা যখন বিকট চিৎকার করে- “কোথায় এখন খালেদা জিয়া?” তার ছেলে বাণী দেয়, “জেলখানাই তাদের ঠিকানা”, তখন অনেকের প্রশ্ন- শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায় দেয়ার মত কি কোনো বিচারক নাই? শোনা যাচ্ছে, কালকের পরে অনেক আখতারুজ্জামান রেডি হয়ে আছে।
একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। অষ্টম শতকে আফগানিস্তানের উত্তরে বলখ রাজ্যের বাদশাহ ছিলেন সুফি ইব্রাহিম আদম। তার বাসার এক গৃহ পরিচারিকা বিছানা পরিস্কারের সময় মনে হলো, এত নরম বিছানায় বাদশাহ নিশ্চয় খুব আরামে থাকেন। একটু দেখি কেমন আরাম- বুঝতে পরিচারিকা এক মিনিটের জন্য বিছানায় শুয়ে পড়লেন। বিছানা গুছিয়ে চলে যান। রাতে ঘুমাতে এসে বাদশাহ দেখেন বিছানায় একটি নারী কেশ পড়ে আছে। রাজা ক্ষেপে গিয়ে সবাইকে ডাকলেন। অবশেষ জেরার মুখে ঐ নারী পরিচারিকা স্বীকার করেন বিছানায় শোয়ার কাহিনী। বাদশাহ তাকে জেলে পুরলেন, অনেক প্রহার করার পরে ঐ পরিচারিকা এক বার কাঁদে, তো আবার হাসে। তা দেখে বাদশা প্রহার বন্ধ করতে বলেন। তিনি জানতে চান, তুমি হাসছ কেনো? পরিচারিকা কি বলে- বাদশা নামদার, ভাবছি, আমি এক মিনিট আপনার এ বিছানায় শোয়ার কারনে যে শাস্তি ভোগ করছি, আপনি সারা জীবন এই বিছানায় শোয়ার জন্য কত শাস্তি পাবেন। বাদশার বোধোদয় হলো। পরিচারিকার শাস্তি বন্ধ করলেন। আরও অনেক ঘটনার পরে বাদশা ইব্রাহিম আদম রাজত্ব ছেড়ে আধ্যাধিক সাধক হয়ে যান।
….এক টাকাও দুর্নীতি না করে খালেদা জিয়াকে যদি জেলে যেতে হয়, তবে লাখ লাখ কোটি দুর্নীতি এবং এত মামলায় শেখ হাসিনার কপালে কি আছে? সূত্রঃ বিডিটুডে