স্বর্গের ঠিকানা খুঁজে পেতে বারী সিদ্দিকীও অবশেষে চলে গেলেন।
কিংবা
”আমি একটা জিন্দা লাশ/ কাটিস না রে জংলার বাঁশ/ আমার লাইগা সাড়ে তিন হাত ঘর কুঁড়িস না।” এ সব গান এখন আর বারী সিদ্দিকী স্বশরীরে গাইতে আসবে না। কোন লাইভ ইভেন্টে অগনিত দর্শকদের মধ্য থেকে তাঁর অসংখ্য ভক্তরা ‘ওয়ান মোর” বা “আরেকটি গান” এ রকম সমস্বরে চিৎকার করে অনুরোধ করবে না। গানে তিনি নিজেই বলেছিলেন, জংলার বাঁশ না কাটতে। মরনের পর তাঁকে সেই জংলার বাঁশ কেটেই কবরস্থ করতে হয়েছে।
আসলে পৃথিবীর এ নশ্বর জীবনে কেউই স্থায়ী বসবাসের কোন সুযোগ পায় না। তবুও এ ধরনীর আমরা এই মানুষগুলো যে কত বোকা, আমরা যত্রতত্র স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে এ ধরনীর বুকে কোন ঠিকানা অনায়াসে লিখে যাই। আসলে সবই তো অস্থায়ী ঠিকানা। স্থায়ী ঠিকানা তো কবর। আর এসবই কেবল চিন্তাশীল মানুষের মনেই শুধু চিন্তার উদ্রেক করে। ভোগ বিলাসে মত্ত মানুষের মননে কোন প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করতে পারে না।
শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মরদেহ বহন করা গাড়িটি শহরের সাতপাই এলাকায় পৌঁছায়। তবে মৃত্যুর খবর পৌঁছানোর পর থেকেই শোকের ছায়া নেমেছে নেত্রকোনায়। সে সময় শিল্প সংস্কৃতি অঙ্গনের লোকজনসহ নানা স্তরের মানুষ তাদের প্রিয় এ প্রথিতযশা সংগীতশিল্পীকে দেখতে ছুটে আসেন। জীবদ্দশায়ও তিনি যেমন পেয়েছেন অসংখ্য মানুষের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা এবং মৃত্যুর পরও তিনি অসংখ্য ভক্তকে কাাঁদালেন। তিনি পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিলেও গানই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে শতাব্দীর পর শতাব্দী, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে পৌঁছে যাবে তাঁর গানগুলোর আবেদন।
গত ১৭ নভেম্বর শুক্রবার দিবাগত রাত ১টার দিকে বারী সিদ্দিকী হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এর আধা ঘণ্টার মধ্যে তাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় তিনি অচেতন ছিলেন। এরপরই তাকে দ্রুত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে লাইফ সাপোর্ট দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লাইফ সাপোর্টে ছিলেন জনপ্রিয় এ শিল্পী। সেখান থেকে আর স্বাভাবিক জীবনে ফেরা হল না তার। এছাড়াও তার দুটি কিডনিই অকার্যকর ছিল, বহুমূত্র রোগেও ভুগছিলেন তিনি। ২০১৬ সাল থেকেই সপ্তাহে তিন দিন তাকে কিডনি ডায়ালাইসিস করানো হচ্ছিল।
বারী সিদ্দিকী ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের নেত্রকোনার সদর উপজেলার মৌগাতি ইউনিয়নের ফচিকা গ্রামের এক সংগীত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১২ বছর বয়সেই নেত্রকোনার শিল্পী ওস্তাদ গোপাল দত্তের অধীনে তার আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। তিনি ওস্তাদ আমিনুর রহমান, দবির খান, পান্নালাল ঘোষসহ অসংখ্য গুণী শিল্পীর সরাসরি সান্নিধ্য লাভ করেন। সত্তরের দশকে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত হন বারী সিদ্দিকী। ওস্তাদ গোপাল দত্তের পরামর্শে ক্লাসিক্যাল মিউজিকের উপর পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে বাঁশির বাজানোর প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন, ফলে বাঁশির ওপর উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন এ শিল্পী। নব্বইয়ের দশকে ভারতের পুনে গিয়ে পণ্ডিত ভিজি কার্নাডের কাছে তালিম নেন। দেশে ফিরে এসে লোকগীতির সাথে ক্লাসিক মিউজিকের সম্মিলনে গান গাওয়া শুরু করেন। ১৯৯৯ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বিশ্ব বাঁশি সম্মেলনে এই উপমহাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নেন তিনি।
১৯৯৫ সালে বারী সিদ্দিকী প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘রঙের বাড়ই’ নামের একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে জনসমক্ষে প্রথম সংগীত পরিবেশন করেন। এরপর ১৯৯৯ সালে হুমায়ূন আহমেদের রচনা ও পরিচালনায় নির্মিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে ৭টি গানে কণ্ঠ দেন। এর মধ্যে ‘শুয়া চান পাখি’ গানটির জন্য তিনি অতিদ্রুত ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এছাড়া রূপকথার গল্প, নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ, ও আমার দেশের মাটিসহ আরও কয়েকটি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকে গেয়েছেন এই শিল্পী।
বারী সিদ্দিকীর বাবা প্রয়াত মহরম আলী ও মা প্রয়াত জহুর-উন-নিসা। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাশেম ছিলেন একজন যাত্রাভিনেতা, তার মা ছিলেন গীত সংগীতের জন্য এলাকায় বেশ পরিচিত। বারী সিদ্দিকী ১৯৮৬ সালে বিয়ে করেন। তার স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন। অপরদিকে তার নানা শেখ সাবির সরদ বাজাতেন। তারা ছিলেন দুই ভাই। নানার একটা সংগীতের দলও ছিল।
বারী সিদ্দিকী পড়াশোনা করেছেন নেত্রকোনায় আঞ্জুমান সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ও নেত্রকোনা সরকারি কলেজে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ১৯৭৯ সালে নাট্য সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি ছাত্র জীবনে রাজনৈতিকভাবে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক করেছেন এ গুণী শিল্পী। এরপর পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন সংগীতের সঙ্গে। বংশীবাদক হিসেবে তখন তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। বারী সিদ্দিকী প্রায় ১৬০টি গান গেয়েছেন। মৃত্যুর আগে তিনি একটি অ্যালবামের কাজ করছিলেন, সেখানে ১০টি গানের কথা লিখেছেন দেলোয়ার আরজুদা শরফ, সুর ও সংগীত পরিচালনার পাশাপাশি গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি।