সিকিমে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আটকে রাখা হচ্ছে তিস্তার ৬০ শতাংশ পানি
তিস্তার জল নিয়ে বিরোধ এবার সিকিমে গড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বার বারে সিকিমে তিস্তার উপর গড়ে ওঠা একাধিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে নিয়ে অভিযোগ করেছেন। তবে সম্প্রতি রাজ্য সরকার তিস্তার জল নিয়ে একটি রিপোর্ট ভারত সরকারের কাছে পাঠিয়েছে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, সিকিমে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য তিস্তার ৬০ শতাংশ জল আটকে রাখার ফলে তিস্তায় পানি প্রবাহ ১০০ কিউমেকে নেমে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পূর্ত দপ্তরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ইন্দরবর পান্ডের নেতৃত্বাধীন কমিটির তৈরি করা এই রিপোর্ট হাতে পেয়ে কেন্দ্রীয সরকার নড়েচড়ে বসেছে। মমতা সরকারের অভিযোগকে মান্যতা দিয়েই শক্তি মন্ত্রক সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটিকে সিকিম সফরে গিয়ে তিস্তার উপর তৈরি হওয়া বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রভাব তিস্তার উপরে কতটা পড়ছে তা খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। এজন্য আগামী ২৩ এপ্রিল সংসদীয় কমিটি সিকিম সফরে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
হাসিনার ভারত সফরের সময় তিস্তার পানি দেওয়া হবে না বলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছিলেন তা নিয়ে প্রবল আলোড়ন তৈরি হয়েছে। মমতা তিস্তার বিকল্প হিসেবে অন্য নদীর জল বাংলাদেশকে দেবার প্রস্তাব করেছেন। তবে ভারত ও বাংলাদেশ কোনও পক্ষই মমতার প্রস্তাবকে আমলে নেয় নি। তবে দিল্লি থেকে ফিরে এসেই মমতা রাজ্য সরকারের তৈরি রিপোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারের পাঠিয়ে জানিয়ে দিয়েছে তিস্তায় জল প্রবাহের বর্তমান অবস্থাটা কি পর্যায়ে রয়েছে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, তিস্তায় এপ্রিল-মে মাসের শুখা মওসুমে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সেচের জন্য তিস্তায় প্রায় ১৬০০ কিউমেক(কিউবিক মিটার পার সেকেন্ড) জল থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে বর্তমানে জল রয়েছে এর ১৬ শতাংশ কম। আর তাই এ বছরের উত্তরবঙ্গের সেচ এলাকাকে কমিয়ে ৫২ হাজার হেক্টরে নামিয়ে এনেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
তিস্তায় শুখা মওসুমে জল কম থাকার জন্য বিশেষজ্ঞরা সিকিমে তৈরি হওয়া ৮টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকেই দায়ী করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রিপোর্টে বলা হয়েছে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি প্রায় ৬০ শতাংশ জল ধরে রাখছে। আসলে জল আটতে রেখে পরে তা নদীতে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা এই সব বিদ্যুৎ প্রকল্পে থাকলেও কোন সময় তা ছাড়া হবে তা নিয়ে কোনও সমন্বয় না থাকায় মাঝে মাঝেই তিস্তা জলশূন্য হয়ে পড়ছে।
একজন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, একসঙ্গে বা প্রায় কাছাকাছি সময়ে আটটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র যদি তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনে জল সাময়িকভাবে হলেও আটকে রাখে তাহলে তিস্তায় জল প্রবাহ না থাকারই কথা। ঠিক সেটাই হওয়ার ফলে তিস্তায় জল সংকট তীব্র হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরএক শীর্ষ আধিকারিক জানিয়েছেন, এতদিনে ভারত সরকার বিষয়টিতে মনোযোগ দিয়েছেন। আর তাই দ্রুত সংসদীয় কমিটিকে পাঠানো হচ্ছে সিকিমের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি প্রত্যক্ষ করে এর প্রভাব সরজমিনে খতিয়ে দেখতে।
তিস্তা সিকিমের প্রায় ২৩ হাজার ১৫৯ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত খানচুঙ ছো হিমবাহ থেকে তৈরি লেক থেকে বেরিয়ে ১৫১ কিলোমিটার সিকিমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কালিম্পংয়ের রংপোর কাছে পশ্চিমবঙ্গের সমতলে প্রবেশ করেছে। সিকিমে অবশ্য অনেক কটি ছোট নদী এসে মিশেছে এই তিস্তায়। পশ্চিমবঙ্গে ১৪২ কিলোমিটার প্রবাহিত হবার পর বাংলাদেশে প্রবেশ করে সেটি ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে।
কিন্তু গত এক দশকে সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে ছোট বড় অসংখ্য জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এগুলির অনেক কটিই ইতিমধ্যে চালু হয়ে গিয়েছে। এছাড়া উজানে ক্যানেল কেটে জল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে সেচ প্রকল্পের জন্য।
২০১৩ সালে প্রকাশিত এশিয়া ফাউন্ডেশনের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রায় ৩০টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে। সিকিমে তৈরি হয়েছে ৮টি এই ধরণের বিদ্যুৎ প্রকল্প। এজন্য তৈরি করা হয়েছে বিশাল বিশাল বাঁধ। সেখানে জল আটকে ক্যানেলের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। পরে তা আবার নদীতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়েও তৈরি হচ্ছে দুটি বাঁধ। তবে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জল ব্যবহারে যে ৫ শতাংশ করে জল নষ্ট হয়ে যায় সে কথা বিশেষজ্ঞরাই জানিয়েছেন। তাছাড়া সাময়িকভাবে হলেও তিস্তার জল আটকে রাখার ফলে তিস্তার জলে টান পড়ছে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রিপোর্টে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা এবং বাংলাদেশের লালমনিরহাটের দোয়ানিতে যে দুটি বাঁধ তৈরি করা হয়েছে তার উদ্দেশ্যই ছিল জল ধরে রেখে সেচের জন্য ব্যবহার করা। এজন্য পশ্চিমবঙ্গের ৯.২ লাখ হেক্টর এবং বাংলাদেশে ৭.৫ হেক্টর এলাকায় কৃষিকাজে (বোরো চাষের জন্য) তিস্তার জল ব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে বা ভারতে কোথাও পরিকল্পিতভাবে জল ধরে রাখা হয় না বলে অভিযোগ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাম্প্রতিক রিপোর্টে পরিষ্কারই বলা হয়েছে , পরিকল্পিতভাবে শুখা মওসুমের কথা মাথায় রেখে জল রাখা হয় নি। ফলে তিস্তার ব্যরেজগুলি এখন প্রায় জল শূন্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গজলডোবায় যে তিস্তা প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছিল তার উদ্দেশ্য ছিল কৃষিকাজের জন্য জলের ব্যবহার করা। কিন্তু্ এজন্য প্রকল্পে বড় ধরণের কোনও জলাধার তৈরি করা হয় নি। ফলে বর্ষার সময়ের অতিরিক্ত জলকে সঞ্চয় রাখতে না পেরে তা ছেড়ে দিতে হয়। গজল ডোবা নিয়ে মূল পরিকল্পনাতেই যে ভুল ছিল সেটিই রাজ্য সরকারের রিপোর্টে স্পষ্ট করা হয়েছে। এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে কাঁটা হয়ে উঠেছে এটি।
তবে তিস্তা চুক্তি নিয়ে যতই আশার কথা বলা হোক না কেন, সমাধানে পৌঁছানো ক্রমিই দূরের বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তিস্তায় জলপ্রবাহ বাড়াতে ভারত সরকার নদী সংযোগ প্রকল্পকেই গুরুত্ব দিচ্ছে বলে কেন্দ্রীয জলসম্পদ মন্ত্রক সুত্রে জানা গেছে, মানস ও সঙ্কোষের মতো নদীগুলির সঙ্গে তিস্তার সংযুক্তিকরণের একটি প্রস্তাব বিবেচনায় রয়েছে। কিন্তু এই প্রকল্প একদিকে যেমন সময় সাপেক্ষ তেমনি এর পরিবেশগত প্রভাব ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রযেছে। পরিবেশবিদরা মনে করছেন, এই সংযুক্তিকরণের পথে সরকার এগিয়ে গেলে সার্বিক পরিবেশে বিপর্যয় ঘটবে। নদীগুলির স্বাস্থ্যহানি হবে। অববাহিকার মানুষজনের জীবন জীবিকার উপরও তা প্রতিকূল প্রভাব ফেলবে। [ছবি’র ক্যাপশনঃ ৫১০ মেগাওয়াট তিস্তা-ভি বিদ্যুৎ কেন্দ্র (সিকিম)-ড্যামঃ নির্মাণে এনএইচপিসি লিমিটেড ইন্ডিয়া।]
সূত্রঃ সাউথএশিয়ানমনিটর কলকাতা প্রতিনিধি’র রিপোর্ট