সিইসিকে সরাতে ‘কাদেরীয়’ তত্ত্ব!

October 17, 2017 10:00 pm0 commentsViews: 17

১৭ অক্টোবর ২০১৭।।

কে এম নুরুল হুদা, আবদুল কাদের সিদ্দিকীগতকাল সোমবার কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রধান ‘বঙ্গবীর’ আবদুল কাদের সিদ্দিকী নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টা কথা বলে বাইরে এসে সাংবাদিকদের জানালেন, তাঁরা সংলাপ বর্জন করেছেন। সংলাপ বর্জনের কথা বলতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগার কথা নয়। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী সংলাপে অংশ নিয়ে কাদের সিদ্দিকী নির্বাচন কমিশনের কাছে ১৮ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন, যার মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ১৫ দিন আগে সেনা মোতায়েন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পদে পরপর দুবারের বেশি নির্বাচিত না হওয়ার কথা আছে। এর পক্ষে হয়তো যুক্তিও আছে। কিন্তু প্রার্থীর আয়কর রিটার্ন জমা না দেওয়া কিংবা ফৌজদারির মামলার বিবরণ না দেওয়ার দাবির পক্ষে কী যুক্তি থাকতে পারে? উচ্চ আদালতের রায়েই নির্বাচন কমিশন এই বিধান চালু করেছেন।

কাদের সিদ্দিকীর এসব দাবি দাওয়ার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা যায়নি; নেওয়ার কথাও নয়। তাঁরা সব দলের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্তে আসবেন। তাহলে কাদের সিদ্দিকী যে ঘোষণা দিলেন, তাঁরা সংলাপ বর্জন করেছেন, তার মাজেজা কী?

একই সঙ্গে জনতা লীগ–প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার পদত্যাগ দাবি করেছেন। তাঁর যুক্তি, সিইসি আগের দিন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন বলে তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। তবে সিইসি যে নারী শিক্ষা ও গণতন্ত্রের নবযাত্রায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভূমিকার প্রশংসা করেছেন, সে বিষয়ে অবশ্য বঙ্গবীর কোনো মন্তব্য করেননি।

জিয়াউর রহমান সম্পর্কে সিইসির মন্তব্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভালো না লাগলেও তারা প্রতিবাদ করেনি কিংবা কেউ সিইসির পদত্যাগ চাননি। বরং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মোহাম্মদ নাসিম বিষয়টিকে উদারভাবেই নিয়েছেন। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনার কৌশল হিসেবেও সিইসি কথাটি বলতে পারেন। আর মোহাম্মদ নাসিমের মতে, স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের প্রধান তাঁর বক্তব্য দিয়েছেন, এ নিয়ে আওয়ামী লীগ চিন্তিত নয়।

আওয়ামী লীগের অন্য নেতারাও সিইসির বক্তব্য নিয়ে উচ্চবাচ্য করার পক্ষপাতী নয়। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের রায়, বিশেষ করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পর্যবেক্ষণের বিরুদ্ধে দলটি সংসদের ভেতরে ও বাইরে কঠোর সমালোচনা করেছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রধান বিচারপতি বর্তমানে ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছেন। প্রধান বিচারপতি ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার—দুটোই সাংবিধানিক পদ।

প্রধান বিচারপতির ঘটনার পর সিইসির বক্তব্য নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হোক, এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ তা চায় না। শীর্ষ পর্যায় থেকে দলীয় নেতাদের সংযত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু আওয়ামী লীগ সিইসিকে ছাড় দিলেও জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকী ছাড় দিতে মোটেই রাজি নয়। তিনি সিইসির পদত্যাগ দাবি করেছেন। তাঁর যুক্তি হলো জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলে কেউ না কেউ সেই গণতন্ত্র হত্যা করেছিল। তাঁর এই যুক্তিটি যেমন অসার, তেমনি ঐতিহাসিক সত্যেরও অপলাপ। কোনো সামরিক শাসকই গণতন্ত্র দেন না—এ কথা যেমন সত্য, তেমনি সেই সামরিক শাসক যখন উর্দি খুলে দেশ শাসন করেন, তখন আর তিনি সামরিক শাসক থাকেন না। সামরিক শাসন প্রত্যাহারই গণতন্ত্রের পথে এক ধাপ অগ্রগতি। জিয়া বা এরশাদের গণতন্ত্র কতটা খাঁটি আর কতটা ভেজাল, সেসব নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তাই বলে গায়ে পড়ে ঝগড়ার কোনো মানে হয় না। বাংলাদেশে কোনো শাসনামলকেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ গণতান্ত্রিক বলে স্বীকার করে না।

আর যুক্তির খাতিরে যদি মেনে নিই সিইসির বক্তব্য সঠিক নয়, তাহলেই তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে? সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানের পদটি কি এতই ঠুনকো যে একটি কথা বলার জন্যই তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে? সামনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ আছে। সেই সংলাপে সিইসি কী বলেন, সে পর্যন্ত কাদের সিদ্দিকী অপেক্ষা করতে পারতেন। একেই বলে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। যে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভাবেন, সেই আওয়ামী লীগ যখন বিষয়টি নিয়ে উচ্চবাচ্য করছে না, তখন কাদের সিদ্দিকী পদত্যাগের শোরগোল তুলে কী ফায়দা নিতে চাইছেন?

কাদের সিদ্দিকীর নিশ্চয়ই জানা আছে যে কাউকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলার অর্থ এই নয় যে অন্যকে হেয় করা বা গণতন্ত্র হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা। তাঁর যুক্তি ধরেই বলব বাকশাল যদি জাতীয় দল হয়ে থাকে এবং বঙ্গবন্ধু দেশ গড়ার জন্য দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি নিয়ে থাকেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট তাঁকে হত্যার মাধ্যমে ঘাতকেরা সেই ব্যবস্থাটিকেও হত্যা করেছে। সেই ঘাতকেরা আওয়ামী লীগ নেতা খোন্দকার মোশতাককেই রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়েছিল এবং সামরিক শাসন জারি করেছিল। আর জিয়াউর রহমান ইচ্ছেয় হোক অনিচ্ছায় হোক সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে বহুদলীয় ব্যবস্থার পথ সুগম করেছেন।

জিয়াউর রহমান যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালুই না করবেন, তাহলে দ্বিতীয় জেনারেলকে কেন সেই সংবিধান স্থগিত করে সামরিক শাসন জারি করতে হলো? দেশান্তরী থাকার কারণেই কাদের সিদ্দিকীর হয়তো জানা নেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সম্মিলিতভাবে আন্দোলন করেই এরশাদকে হটিয়ে নব্বইয়ে গণতন্ত্রের দ্বিতীয় যাত্রার সূচনা ঘটিয়েছিল।

অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগকে খুশি করতেও ‘বঙ্গবীর’ সিইসির পদত্যাগ দাবি করে থাকতে পারেন। কেননা টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে সিদ্দিকী সাম্রাজ্য এখন অবলুপ্ত প্রায়। আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাসিত। স্থানীয় নেতাদের বিরোধিতার কারণে ছোট ভাই মুরাদ সিদ্দিকী অনেক চেষ্টা তদবির করেও আওয়ামী লীগে ঢুকতে পারছেন না।

এ অবস্থায় আওয়ামী লীগে ফিরে যাওয়ার বাসনায় কাদের সিদ্দিকী সিইসির পদত্যাগের নতুন তত্ত্ব সামনে নিয়ে এলেন কি না সেই প্রশ্নের জবাব ভবিষ্যৎ দেবে।

সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।  sohrabhassan55@gmail.com

উৎসঃ   prothom-alo

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 400E Mosholu Parkway South Apt # A23,The Bronx, New York 10458, USA

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com