সব শর্ত পূরণ করেও বৈষম্যের শিকার মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা
মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম (এসএসসি ও এইচএসসি) পাস করা শিক্ষাথীর্রা একশ’ নম্বরের বাংলা ও ইংরেজি পড়ে এ অজুহাতে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানবিক ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগে তাদের ভালো কোন বিষয় দেয়া হত না। তবে গত দুই বছর ধরে দাখিল ও আলিম দুটি শ্রেণিতেই বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে দুইশ’ নম্বরের পরীক্ষা হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় সে বাধা তুলে নিয়েছে। যদিও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এ ব্যাপারে আগের অবস্থানেই রয়েছে। ফলে শতর্ পূরণ করেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে শিক্ষাথীর্রা।
জানা গেছে, গত কয়েক বছর থেকে মাদ্রাসা থেকে পাস করা শিক্ষাথীর্রাও সাধারণ স্কুল কলেজের শিক্ষাথীের্দর মতোই দুইশ’ নম্বরের বাংলা ও ইংরেজি পড়ে আসছে। ফলে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় যারা আগে একশ’ নম্বরের বাংলা ও ইংরেজির কারণে মানবিক ও সমাজবিজ্ঞানের ভালো বিষয় মাদ্রাসা শিক্ষাথীের্দর দিত না তারা এখন সেসব বিষয় দিচ্ছে। এতে করে দীঘির্দনের বৈষম্যও দূর হয়েছে। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গত বছরের ভতির্ পরীক্ষাতেও মাদ্রাসা শিক্ষাথীের্দর নানা কারণ দেখিয়ে ভালো বিষয় দেয় নি। এবারও দেবে কিনা তা নিশ্চিত করেনি। এতে করে মাদ্রাসা শিক্ষাথীর্রা মনে করছে তাদের সঙ্গে এবারও একই রকমের বৈষম্যমূলক আচরণ করবে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণ শিক্ষা বোডর্ থেকে পাস করে আসা শিক্ষাথীের্দর কলা ও মানবিক অনুষদে ভতির্র ক্ষেত্রে ‘বিজ্ঞান’, ‘মানবিক’, ‘অন্যান্য’ (ব্যবসায় শিক্ষা) নামে তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। কিন্তু মাদরাসা শিক্ষা বোডের্র অধীনে এইচএসসি পাস করে আসা বিজ্ঞান বিভাগ ও মানবিক বিভাগের শিক্ষাথীের্দর ‘বিজ্ঞান’ ও ‘মানবিকে’ অন্তভুর্ক্ত না করে তাদের ‘অন্যান্য’ ক্যাটাগরির মধ্যে অন্তভুর্ক্ত করা হয়। ওই ‘অন্যান্য’ ক্যাটাগরির মধ্যে কারিগরি শিক্ষা বোডের্র শিক্ষার্থীর এবং ইংরেজি মাধ্যম (ও-লেভেল এবং এ-লেভেল)-এর শিক্ষাথীর্রাও রয়েছে। আর এ ‘অন্যান্য’ ক্যাটাগরিতে ভতির্ ইচ্ছুক শিক্ষাথীর্র সংখ্যা বাকি দুই বিভাগ থেকে কয়েক গুণ বেশি হলেও সিট সংখ্যা অন্য দুই ক্যাটাগরি থেকে বিভাগ ভেদে দুই থেকে তিন গুণ কম।
এ বিষয়ে গত বছর ওয়েটিং লিস্টে থাকা ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থী ইয়াসিন আরাফাত বলেন, ‘মাদরাসা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আটর্স হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এখানে ‘অন্যান্য’ হিসেবে ধরায় আমাদের ন্যায্য প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রটা সংকীণর্ হয়ে পড়ে। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবষের্ জাবির কলা অনুষদে কলেজের শিক্ষাথীর্রা মানবিক শাখা থেকে দুইশ’র পরে সিরিয়াল হয়েও চান্স পেলেও আমি ৮৫তম হয়েও সাবজেক্ট পাই নি। কারণ আমাকে মানবিক না হিসেবে ধরে ‘অন্যান্য’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।’
এমন আরও অভিযোগ করেন কলা অনুষদে যথাক্রমে ৮৮তম ও ১২৭তম হওয়া আরিফুর ও আরাফাত রহমান নামক দুই শিক্ষাথীর্।
জানা যায়, মাদরাসা শিক্ষাবোডর্ ২০১৩-১৪ শিক্ষাবষর্ দাখিল এবং ২০১৫-১৬ শিক্ষাবষের্র আলিমে বাংলা ও ইংরেজিতে যথাক্রমে ২০০ নম্বর অন্তভুর্ক্ত করে। এ ছাড়াও অন্যান্য মৌলিক বিষয়গুলো কলেজ-মাদরাসার একই সিলেবাসের অন্তভুর্ক্ত করা হয়েছে। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় মাদ্রাসা শিক্ষাথীের্দর কলেজের সাথে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে আর বাধা নেই। গত সেশন থেকে ঢাবিসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্যতা অনুসারে সমান বিষয় পেয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষাথীর্রাও। কিন্তু জাবিতে ভিন্ন আঙ্গিকে বৈষম্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ।
কেন এমন বৈষম্য করা হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোজাম্মেল বলেন, ‘আমরা প্রতœতত্ত¡ বিভাগে এমন সব বিষয় পড়াই যা মাদ্রাসা শিক্ষাথীের্দর সঙ্গে প্রযোজ্য নয়। এছাড়া মাদরাসার শিক্ষাথীের্দর ইংরেজিতে দক্ষতা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মাদ্রাসা থেকে সহজেই ভালো ফলাফল করা যায় বলেও আমরা বিভিন্ন সময়ে শুনেছি।’
তবে মাদ্রাসা শিক্ষাথীর্রা বলছেন, যেখানে তারা একই প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করে আসছেন সেখানে এ ধরনের চিন্তা সমতার নীতির সঙ্গে সাংঘষির্ক।
বিশ্ববিদ্যালয়টির সাংবাদিক ও মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগেও মাদরাসা শিক্ষাথীর্র আসন দেয়ার ক্ষেত্রে নানা প্রতিক‚লতা তৈরি করে রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগীয় সভাপতি সহকারী অধ্যাপক উজ্জ্বল কুমার মণ্ডল বলেন, ‘মাদরাসা শিক্ষাথীর্রা ২০০ নম্বরে বাংলা ও ইংরেজি পড়েও বিভাগে কোন মাধ্যমের কতজন ভতির্ হবে, তা বিভাগ ঠিক করবে। এখানে এককভাবে আমি কিছু বলতে চাই না।’
ভতির্র ক্ষেত্রে এমন বৈষম্যের আইনগত ভিত্তি আছে কিনা, এমন প্রশ্নে কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বিভাগগুলো সিট সংখ্যা নিধার্রণ করে দেয়, তাই আমার তেমন কিছু করার থাকে না। তবে তিনি বলেন, ‘মাদ্রাসা শিক্ষথীর্রা যদি ২০০ নম্বরের বাংলা ও ইংরেজি পড়ে থাকে এবং মাদরাসার শিক্ষাথীের্দর ওপর কোন বৈষম্য হয়ে থাকে তাহলে আমরা যাচাই-বাছাই করে এবারের ভর্তি পরীক্ষা থেকে বৈষম্য নিরসন করব।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রোভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক নুরুল আল আলম বলেন, ‘বৈমষ্য থাকলেও আমি বিষয়টা জানি না। কারণ এগুলো আমার দায়িত্ব গ্রহণের আগ থেকে চলে আসছে। এ ব্যাপারে নতুন কোনো আলোচনাও হয়নি। হবে কিনা তাও ঠিক হয় নি। তবে যদি কোনো অসঙ্গতি থাকে তা ভিসির সাথে আলোচনা করে অনুষদ ডিন ও বিভাগগুলো ঠিক করতে পারবে।’
এদিকে বৈষম্য নিরসনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অনুষদকে আবার অনুষদ বিভাগকে দায়ী করছে। ফলে কয়েক বছর ধরে বৈষম্যের সুরাহা হচ্ছে না।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান যায়যায়দিনকে বলেন, ‘মাদ্রাসাকে পিছিয়ে রাখা অন্যায়। আদালতও এমন প্রক্রিয়াকে আগেই নিষিদ্ধ করেছে। আমাদেরও নীতি হলো মাদ্রাসাকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে আসা। পিছিয়ে রাখা নয়।’
উল্লেখ্য, ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষ থেকে জাবির ৯ বিভাগ ভতির্র জন্য বাংলা-ইংরেজি ২০০ নম্বরের শতর্ জুড়ে দেয়। এর ফলে মাদরাসা শিক্ষাথীর্ ভর্তির যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। সে সময় তিনজন ভতির্ ইচ্ছুক মাদ্রাসা শিক্ষাথীর্র করা রিটের রায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোটর্। পরে ২০১২-১৩ শিক্ষাবষর্ থেকে নানা শতের্র জালে নতুন আঙ্গিকে মাদ্রাসা শিক্ষাথীের্দর সঙ্গে বৈষম্য শুরু হয় বলে দাবি করেছে এখানকার অনেক শিক্ষাথীর্।