সব বলে দিলেন প্রণব মুখার্জি!
05 Nov, 2017
ভারতের সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি (৮২) তার দি কোয়ালিশন ইয়ার্স, ১৯৯৬-২০১২ গ্রন্থে, এটি তার দ্বাদশ গ্রন্থ, তার সক্রিয় রাজনীতির শেষ ১৬ বছরের অভিজ্ঞতার কাহিনী তুলে ধরেছেন। এতে ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ার সময় তথা ২০১২ সাল পর্যন্ত ঘটনাবলী স্থান পেয়েছে। তিনি ৪৩ বছর ধরে (১৯৬৯-২০১২) রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি এমপি, লোকসভা ও রাজ্যসভার নেতা, পরিকল্পনা কমিশনের উপ-প্রধান, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, ও অর্থমন্ত্রী ছিলেন। কংগ্রেস সভাপতি সনিয়া গান্ধী মনমোহন সিংকে নির্বাচন করায় তার প্রধানমন্ত্রী হওয়া হয়নি।
আমি এখনো তার এ বইটি দেখিনি। তবে মিডিয়ায় এই বই থেকে যেসব উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, এতে বাংলাদেশ সম্পর্কিত খুবই গোপন ও প্রাসঙ্গিক তথ্য রয়েছে। এই লেখাটি উদ্ধৃতির আলোকে, আমার বিবেচনায় বাংলাদেশী দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই আলোড়ন সৃষ্টিকারী। বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে ছোট অনুচ্ছেদটি আমাদের অনেক কিছু বলছে। বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্যবাদী পরিকল্পনা এবং ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর ব্যাপারে ভারতের দাদাগিরি মনোভাব সম্পর্কে জানে, এমন লোকজনকে আমি চিনি। এখানে আমার উদ্ধৃতি দেখে তাদের কাছে ‘তুমি আমাকে বলছ’ ধরনের বিস্ময় সৃষ্টি করবে।
আমি জানি, তারা জানে, বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত খুবই উন্নাসিক, বিভ্রান্তিকর, উদ্ধত্যপূর্ণ এবং মর্যাদাহানিকর ধারণা পোষণ করে। আর ভারত যে উপনিবেশ-পরবর্তী বিশ্বে নিজেকে শ্রেষ্ঠ, নব্য-উপনিবেশ শক্তি মনে করে বলে আমাদের যে ধারণা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেটাই সম্ভবত অবচেতনভাবে প্রণব নতুন করে নিশ্চিত করলেন। শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের সদস্য এবং বাংলাদেশের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাথে তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে প্রণব মুখার্জির খোলামেলা বক্তব্য সাধারণভাবে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক মানুষজনের কাছে খুবই অস্বস্তিকর। অবশ্য যারা চায় ভারতের অনুগ্রহভাজন হয়ে থাকুক বাংলাদেশ, তারা বাংলাদেশের ২০০৮ সালের নির্বাচনে তার হস্তক্ষেপমূলক ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞ হয়েই থাকবে।
আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ডে তিনি এমন একটি ঘটনার কথা বলেছেন, যা কার্যত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সামিল। মুখার্জি লিখেছেন: ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে (তিনি তখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী) বাংলাদেশের সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ ছয় দিনের সফরে ভারত এলেন। তিনি আমার সাথেও সাক্ষাত করলেন। অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় আমি তাকে রাজবন্দিদের মুক্তি দেওয়ার গুরুত্ব বোঝালাম।
তারপর প্রণব উল্লেখ করেছেন, হাসিনা সরকারের আমলে জেনারেলের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে তার উদ্বেগও দূর করলেন এই বলে: ‘আমি ব্যক্তিগত দায়দায়িত্ব গ্রহণ করলাম, জেনারেলকে হাসিনার ক্ষমতায় ফেরার পরও তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার আশ্বাস দিলাম।… জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এম কে নারায়নকে দিয়ে আমার হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সব রাজবন্দির মুক্তি এবং দেশটির স্থিতিশীলতা প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করলাম।’ বাংলাদেশের সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাথে ভারতের সম্পৃক্ততা অব্যাহত থাকার বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেছেন।
আত্মজীবনটিতে আরো বড় ধরনের গোপন তথ্য প্রকাশ করে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় আসার পর হাসিনা আশ্বাস দেন, মঈনই থাকবেন দায়িত্বে। এছাড়া হাসিনার দুঃসময়ে তাকে ত্যাগকারী আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রণব তিরস্কার করেছিলেন বলেও তিনি তার বইতে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন: ‘হাসিনা যখন জেলে ছিলেন, তখন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা তাকে ত্যাগ করে। আমি তাদেরকে ধমক দিয়ে বলেছিলাম, খারাপ সময়ে কাউকে ছেড়ে যাওয়া অনৈতিক কাজ।’ এত খোলামেলা আর সততার জন্য প্রণব ধন্যবাদও পেতে পারেন! তবে কিছুটা সমস্যাও আছে! তিনি আমাদের জানাচ্ছেন, তিনি নিজে ভারতীয় রাজনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেন, ভারতীয় স্বার্থের দিকে বাংলাদেশের রাজনীতিকে পরিচালিত করতেন।
এখান পর্যন্ত ভালোই! আমরা জানি, ভারত সবসময়ই বড় ভাইসুলভ অনধিকারচর্চা করে থাকে, দেশটি বাংলাদেশের জন্য এক মারাত্মক প্রতিবেশী। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাবেক মুখ্যসচিব ড. কামাল সিদ্দিকী একটি ব্যক্তিগত পত্রে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের শীর্ষপর্যায়ের কিছু নেতার কর্তৃত্বপরায়ণতার বিষয়টি বেশ ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই লেখককে তিনি পত্রটি লিখেছিলেন ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর। তিনি ২০০৬ সালে নয়া দিল্লিতে শীর্ষ পর্যায়ের একটি বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাথে কী ধরনের আচরণ করেছিলেন, তার প্রত্যক্ষ অকপট বর্ণনা দিয়েছেন:
“এটি ছিল ২০০৬ সালের মার্চে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক বৈঠক। আমাদের পক্ষে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোর্শেদ খান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমান, মুখ্যসচিব হিসেবে আমি, পররাষ্ট্রসচিব শমশের মুবিন চৌধুরী। বৈঠক শুরু হওয়ামাত্র আমি দেখলাম, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সীমা ভয়াবহ মাত্রায় অতিক্রম করে ভারতের সাথে ‘খারাপ ব্যবহার’ নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে কামান দাগছেন। আমরা উলফাকে সমর্থন করছি বলেও অভিযোগ করলেন। অভিযোগটা ছিল ডাহা মিথ্যা। তিনি কথা বলার সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দিকে অত্যন্ত অমার্জিত ভঙ্গিতে আঙুল তুলছিলেন। বোঝা গেল তিনি ভদ্রলোক নন। তার ব্যবহৃত ভাষা ছিল পশ্চিমবঙ্গের কেরানিদের ব্যবহার করা বাবু ইংরেজি।”
কামাল সিদ্দিকীর ভাষ্যে বাবু প্রণব মুখার্জির পরিচয় জানা যায়। তিনি একসময় ছিলেন উচ্চমান কেরানি। তিনি সাম্প্রতিক অতীতে তার কৌশল এবং বাংলাদেশী রাজনীতিবিদদের অবমূল্যায়ন করা নিয়ে লিখেছেন। ভারতীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে এমন কাজ তিনি একমাত্র লোক হিসেবে করেছেন, এমনটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি অনেক সময় সিনিয়র ভারতীয় সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তারা পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশাী ও ক্ষমতাধর নেতাদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাধর দেখা যায়। আমরা ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের কথা জানি। তিনি রাজনীতিবিদ ছিলেন না, ছিলেন স্রেফ সরকারি কর্মচারী। তিনি পর্যন্ত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি তথাকথিত পার্লামেন্টারি নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন।
তিনি ঢাকা এসেছিলেন আক্ষরিকভাবেই এরশাদকে চাপ দিয়ে বশে আনার জন্য। ঢাকায় সুজাতা সিংয়ের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পূর্ব পর্যন্ত তিনি হাস্যকর নির্বাচনটিতে অংশ নিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। বৈঠকের পর তিনি তার মন পরিবর্তন করেন। তিনি ভোটারবিহীন নির্বাচনে অংশ নেন এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হন। ভারতের ইচ্ছানুযায়ী এরশাদ আরো পাঁচ বছরের জন্য হাসিনাকে ক্ষমতায় থাকার বৈধতা দিয়েছিলেন।
উপরের ভাষ্য অনুযায়ী, ভারতীয় রাজনীতিবিদেরা সাধারণভাবে এবং বিশেষ করে কংগ্রেসর রাজনীতিবিদেরা তাদের নিজস্ব লোকদের বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন করার জন্য করার কোনো কিছুই বাদ রাখেননি। তাদের সবচেয়ে পছন্দের বাংলাদেশী রাজনীতিবিদদের বেশির ভাগই আছেন আওয়ামী লীগ এবং জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টির সাথে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত জাতীয় পার্টিতে।
সম্ভবত মোরারজি দেশাই, ভি পি সিং, আই কে গুজরালকে বাদ দিলে ১৯৭১ সালের পর সব ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীই বাংলাদেশের ব্যাপারে ছিলেন অনধিকারচর্চামূলক ও আধিপত্যবাদী। প্রণব মুখার্জির সর্বশেষ গ্রন্থ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশের সফররত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাথে তার অসৌজন্যমূলক আচরণ থেকে যেটুকু পাচ্ছি তা আসলে ‘ভারতের বাংলাদেশ নীতি’র দৃশ্যমান অতি সামান্য অংশবিশেষ। ভারত আসলে বাংলাদেশের সাথে তার ওপর নির্ভরশীল দেশের মতো আচরণ করে, সার্বভৌম দেশ বিবেচনা করে না।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রণব মুখার্জির দৃশ্যমান হস্তক্ষেপমূলক মানসিকতা অস্বস্তিদায়ক। জেনারেল মইনের সাথে তিনি কেমন আচরণ করেছেন তা প্রকাশ্যে জোরালোভাবে প্রকাশ করাটা এবং ২০০৭-২০০৮ সালে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বাধীন ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের আমলে কারাগারে থাকার সময় শেখ হাসিনাকে পরিত্যাগকারী নেতাদের তার তিরস্কার করার ঘটনাও একই ধরনের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রণব মুখার্জিকে এ ব্যাপারে ব্যক্তিক্রম হিসেবে গ্রহণ করা বাংলাদেশের জন্য উচিত হবে না। নরেন্দ্র মোদি, সুষমা স্বরাজ এবং মোদি সরকারের অন্য সদস্যদের কোনো ধরনের ইচ্ছা নেই বা তাদের কোনো হস্তক্ষেপমূলক নীতি নেই, এমনটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
বাংলাদেশে সম্প্রতি সফরের সময় সুষমা স্বরাজ কী করেছেন দেখুন। তিনি তথাকথিত বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের সাথে সাক্ষাত করেননি। এর বদলে তিনি খালেদা জিয়ার (হাসিনার অপছন্দ সত্ত্বেও) সাথে সাক্ষাত করেছেন। নয়া দিল্লির অগোপন বাংলাদেশবিরোধী অ্যাজেন্ডার ব্যাপারে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত নয়।
ভারতের বাংলাদেশ নীতি প্রসঙ্গে মনমোহনের চেয়ে মোদিকে অনেক ভালো বিকল্প বিবেচনা করা এবং প্রণব মুখার্জির চেয়ে সুষমাকে ভালো মানুষ বিবেচনা করার চেয়ে হিতে বিপরীত এবং বিপর্যয়কর আর কিছু হতে পারে না।
উল্লেখ্য, গণতন্ত্রের জন্য অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদীয় নির্বাচন ভালো নয়- এমন উপদেশ বাংলাদেশকে দেওয়ার সুষমা স্বরাজ কে?
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের অস্টিন পেই স্টেট ইউনিভার্সিটির সিকিউরটি স্টাডিজের শিক্ষক। তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থের প্রণেতা। তার সর্বশেষ গ্রন্থ: Global Jihad and America: The Hundred-Year War Beyond Iraq and Afghanistan (Sage, 2014).
(লেখকের অনুমতি নিয়ে প্রকাশিত)