সন্দেহাতীত ভাবে হাদীসের নির্ভুলতা প্রমাণ ও সহিহ হাদীস প্রণয়নে ইমাম বোখারি (রহ) এর অবদান।
নিউইয়র্ক থেকে ড. ওমর ফারুক।। তারিখঃ ২২ ডিসেম্বর ২০১৭।।
কতিপয় প্রাচ্য পণ্ডিত ও শিক্ষিত মিশনারী হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে মুসলমানদের ভেতর বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়েছে। এসকল প্রাচ্য পণ্ডিত ও শিক্ষিত মিশনারীদের মধ্যে স্যার উইলিয়াম মুর ও গোণডজার সবচাইতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ,তারা রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এর হাদীস গুলোর সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করার কাজ তার ইন্তেকালের ৯০ বছর পর শুরু হয়েছে বলে এগুলোর ত্রুটিহীনতা ও উপযুক্তর প্রমানের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন।
এমনকি মুসলমানদের ভেতরও এ ধারণা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন যে, হাদীসও নবী চরিত সংকলন ও রচনার কাজ শুধু তাবেঈগণ শুরু করেন।
তাই অনেকে স্বাভাবিকভাবেই মনে করে থাকেন, নবী চরিত সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ তার ওফাতের একশ বছর পর শুরু হয়েছে। কিন্তু আমরা বলতে চাই- একথাগুলো ভাওতা ছাড়া আর কিছুই নয় অথবা অজ্ঞতার বশবর্তী হয়েই এ কথা প্রচার করা হয়েছে। আসলে এ কাজ নবী (সাঃ) এর জীবিতাবস্থা থেকেই শুরু হয়েছে।তার প্রমাণ হিসেবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো পেশ করছিঃ
এক. হযরত আবু হুরায়রা(রাঃ) বলেনঃ আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স(রাঃ) ব্যতীত কারও আমার চাইতে অধিক সংখ্যক হাদীস স্মরণ নেই। আমার চাইতে তার নিকট অধিক সংখ্যক সংরক্ষিত থাকার কারণ হচ্ছে এই যে, তিনি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট যা কিছু শুনতেন সব লিখে রাখতেন। কিন্তু আমি লিখে রাখতাম না।(বোখারী শরীফ)
আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বলে উল্লেখিত হয়েছে যে, কতিপয় সাহাবা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমরকে বললেন- রাসুলুল্লাহ(সাঃ) কখনও ক্রুদ্ধ অবস্থায় আবার কখনও প্রফুল্ল অবস্থায় থাকেন, অথচ তুমি সকল অবস্থায়ই সব কিছু লিখে রাখ। এ কথার পর আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) লেখা বন্ধ করলেন এবং রাসুলুল্লাহর (সাঃ) নিকট বিষয়টি বললেন। রাসুলুল্লাহ(সাঃ) নিজের মুখের দিকে ইশারা করে বললেনঃ তুমি লিখতে থাক এ স্থান থেকে যা বের হয় সত্যই হয়ে থাকে। (আবু দাউদ-দ্বিতীয় খণ্ডঃ ৭৭ পৃষ্ঠা
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) তাঁর এ সংকলনের নাম রাখেন ‘সাদেকা’। (ইবনে সায়াদ- দ্বিতীয় খণ্ড ২য় অধ্যায় পৃষ্ঠা ১২৫)। তিনি বলতেন মাত্র দু’টি জিনিসের জন্য আমি জীবিত থাকার আকাঙ্খা পোষণ করেছি। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, এই সাদেকা এবং সাদেকা এমন একটি কিতাব, যা রাসুলুল্লাহর(সাঃ) এর পবিত্র মুখ থেকে শুনে শুনে আমি লিখেছি। [দারেমীঃ ৬ পৃষ্ঠা]
মুজাদি বলেনঃ আমি আবদুল্লাহ ইবনে আমর(রাঃ) এর নিকট কিতাব রক্ষিত দেখেছি। জিজ্ঞেস করলাম এটি কি কিতাব? বললেন ‘সাদেকা’। এটি রাসুলুল্লাহ(সাঃ) এর মুখ থেকে শুনে শুনে আমি লিখেছি। এই কিতাব আমার ও রাসুলুল্লাহ(সাঃ) এর মাঝখানে আর কেউ নেই (ইবনে সায়াদঃ ২-২-১২৫)। বোখারী শরীফে উল্লেখ আছে যে, মদীনায় হিজরত করার কিছু কাল পর রাসুলুল্লাহ(সাঃ) মুসলমানদের আদমশুমারী করে তাদের নামের তালিকা প্রণয়ন করেন। উক্ত তালিকায় পনের শ নাম ছিল (বাবুল জিহাদ)। বর্তমানে বোখারি শরীফে দু পৃষ্ঠা ব্যাপী যাকাত সম্পর্কিত যে সব নির্দেশ বিভিন্ন বস্তুর ওপর দেয়া যাকাত এবং তার হার সম্পর্কে যে আলোচনা রয়েছে, তা রাসুলুল্লাহই(সাঃ) লিখিত আকারে দায়িত্বশীল কর্মচারিদের নিকট প্রেরণ করেন। হযরত আবুবকর (রাঃ) এর নিকট আবুবকর ইবনে হাযমের খান্দানে এবং আরও কিছু লোকের নিকট এ নির্দেশনামা মওজুদ ছিল (দারে কুতনী- কিতাবুজ্জাকাত – ২০৯ পৃঃ)।
সুস্পষ্টরূপে হাদীসের সাথে সম্পর্কিত কয়েকটি দস্তাবেজের নাম উল্লেখ করছি-
১। হোদায়বিয়ার সন্ধিনামা।(বোখারী প্রথম খণ্ডঃ ৩৭ পৃষ্ঠা)
২। বিভিন্ন কবিলা ও গোত্রের প্রতি বিভিন্ন সময়ে লিখিত ফরমান। (তাবাকাতে ইবনে সায়াদ, কিতাবুল আমওয়াল আবু ওবাইদ, পৃষ্ঠাঃ২১০)।
৩। বিভিন্ন দেশের বাদশাহ ও রাষ্ট্র নেতাদের নিকট লিখিত ইসলামি দাওয়াতের পত্রাবলী। (বোখারী শরীফ দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠাঃ ৬৩১)
৪। আবদুল্লাহ ইবনে হাকীম সাহাবীর নিকট রাসূলের প্রেরিত চিঠি। এ চিঠিতে মৃত জন্তু ইত্যাদি সম্পর্কিত আইন লিখিত হয়েছিল। (মু’জিমুসসগীর,তীবরাণী)।
৫। ওয়ায়েল ইবনে হাজার সাহাবীর জন্য নামাজ,মদ্যপান ও সুদ ইত্যাদি সম্পর্কে নবী করীম(সাঃ) বিধান লিখাইয়া দিয়াছিলেন। (মু’জিমুসসগীর তীবরাণী)।
এ ভাবে প্রচুর উদাহরণ তুলে ধরা যাবে, যা রাসুলুল্লাহ(সাঃ) এর আমলেই লিখিত হয়েছিল।
আর যা লিখিত ছিল না, তা হাফেজে হাদীসের কন্ঠস্থ ছিল। সে সময়কার আরবজাতির স্মরণ শক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিল। একবার শুনলে তারা তা আর কখনও ভুলে যেত না। যেমনঃ “হযরত আবু হুরায়রা(রাঃ) বিপুল সংখ্যক হাদীসের হাফেজ ছিলেন। কিন্তু উমাইয়া বংশের শাসক খলিফা মারওয়ান ইবনে হেকামের মনে এ সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক হয়। তিনি হযরত আবু হুরায়রার পরীক্ষা লওয়ার জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করেন। একদিন কিছু সংখ্যক হাদীস শুনাবার অনুরোধ করলেন। আবু হুরায়রা(রাঃ) তখন নির্দেশ মোতাবেক কিছু সংখ্যক হাদীস শুনিয়ে দিলেন। মারওয়ানের নির্দেশ মোতাবেক পর্দার অন্তরালে বসে হাদীসসমূহ লিখে নেওয়া হয়। বাৎসরিক কাল পরে একদিন ঠিক এই হাদীসসমূহ শুনাবার জন্য হযরত আবু হুরায়রা(রাঃ) কে অনুরোধ করা হলে তিনি সেই হাদীসসমূহই এমনভাবে মুখস্থ শুনিয়ে দেন যে পূর্বের শুনানো হাদীসের সাথে এর কোনই পার্থক্যই হয় নি। এ ঘটনার হতে হযরত আবু হুরায়রার স্মরণ শক্তির প্রখরতা অনস্বীকার্যভাবে প্রমাণ হয়।
বিখ্যাত হাদীস বেত্তা ইমাম বুখারী (রহ)এর নাম শোনে নি এমন মনে হয় খুব কম লোকই আছে। তিনি একজন বিখ্যাত হাদীসবেত্তা, জ্ঞানী ও সাধক মনিষী হিসেবে ইসলামি দুনিয়ায় চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। এ মহান মনিষীর জন্ম খোরাসানের বোখারাতে ১৯৪ হিজরি’র ১৩র শাওয়াল, শুক্রবার, ৮১০ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর জন্মস্থানটি বর্তমানে উজবেকিস্তানের অংশ। আরব রীতি অনুযায়ী বংশধারাসহ তাঁর পুরো নাম হল ‘মুহাম্মদ বিন ইসমাইল বিন ইব্রাহিম বিন মুহিরাহ বিন বারদিযবাহ। আমরা এত কিছু পড়ি, এসব ইসলামি দুনিয়ার মহান জ্ঞান সাধকদের নিয়ে মাঝে মাঝে আলোচনা না করলে কি আর হয়! তাঁর অমর সৃুষ্টির মধ্যে বিখ্যাত হাদীস সংকলন ‘বোখারি শরীফ’ প্রধান। মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে তাঁর এ অমর গ্রন্থটি হাদীসের মধ্যে সর্বোত্তম গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। তাঁর নাম বোখারি নয়। আসলে তাঁর জন্ম স্থান বোখারা বলে সকলেই তাঁকে বোখারি বলে। মূলতঃ যে স্থানটিতে এমন একজন মনিষীর জন্ম, সে স্থানটিকে মর্যাদার সাথে স্মরণ করতেই হয়ত এ নামে ডাকা শুরু। তাঁর পিতামহ সম্পর্কে তেমন কিছু জানার সুযোগ এখন আর নেই। কে জানত যে, একজন বালক এক সময় এত বড় মনিষী হয়ে বিশ্ব মানবের কাছে স্মরণীয় হবেন।
ইমাম বোখারির পিতা ইসমাইলও মুসলিম বিশ্বে একজন সুপরিচিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনিও ছিলেন একজন হাদীসবিদ। তিনি হাদীস শাস্ত্রবিদ আল্লামা হাম্মাদ (রহঃ) এবং হযরত ইমাম মালেক (রহঃ) এরও শিষ্য ছিলেন। ছাড়াও বিখ্যাত মনীষী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহঃ) এর শাগরিদ ছিলেন বলে জানা যায়। সমসাময়িক যুগের আরও অনেক বুজর্গ আলেমদের কাছ থেকে দ্বীনই ফায়েজের জাহেরি ও বাতেনি ইলম হাসিল করে সুযোগ্য আলেম ও বিজ্ঞ মুহাদ্দিস হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
ইমাম বুখারী (রহঃ) শিহ্মা, জ্ঞান ও যোগ্যতা শুধু পিতার দিক থেকেই পাননি বরং মাতার দিক থেকেও অর্জন করেছিলেন। ইমাম বুখারী (রহঃ) এর মাতাও ছিলেন একজন জ্ঞানী, বিদুষী ও মহীয়সী নারী। একজন ফরহেজগার নারী হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল। ইতিহাসে এ সম্পর্কে একটা ঘটনা বিধৃত আছে। বাল্যকালে ইমাম বোখারী (রহঃ) এর একবার কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। এ রোগের প্রভাবে তাঁর দু’ চোখ প্রায় অন্ধ হয়ে যায়। স্নেহময়ী মা পুত্রের চোখের আলোর পুনঃপ্রাপ্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন এবং মহান রাব্বুল আ’লামিনের দরবারে প্রার্থনা করতে থাকেন। এ পর্যায়ে এক রাত্রে স্বপ্নে তিনি হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে তার শিয়রে বসা অবস্থায় দেখতে পেলেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাকে বলেন, তোমার প্রার্থনা আল্লাহ্ পাক কবুল করেছেন। তাঁর দয়ার বরকতে তোমার পুত্র চোখের আলো ফিরে পেয়েছে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে তাঁর পুত্র ইমাম বুখারী (রহঃ) বলে উঠলেন, আম্ম! আমি সবকিছু দেখতে পাচ্ছি। আমার চোখ ভাল হয়ে গেছে। এ ঘটনাটিই প্রমাণ করে ইমাম বুখারী (রহঃ) এর জননী কত বড় মাপের বুজর্গ মহিলা ছিলেন। ইমাম বোখারী (রহঃ) শৈশবেই বাবাকে হারান, ফলে মায়ের কাছে প্রতিপালিত হন। পিতা মারা যাওয়ার সময় প্রচুর ধনসম্পদ রেখে যান। ফলে ইমাম বোখারি (রহঃ) এর কোনরূপ অর্থনৈতিক প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় নি। যে সন্তানের মা এত জ্ঞানী ও বিদুষি মহিলা। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরুর জন্য তো এটা অনেক বড়। তাই পুত্রের শিহ্মা-দীক্ষার ভার মা’ই গ্রহণ করেন। ইমাম বুখারী (রহঃ) এর বাল্যকাল থেকেই শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল। ইমাম বোখারী (রহঃ) প্রথমে কোরআন পাঠ শুরু করেন। মাত্র ৬ বছর বয়সে তিনি কুরআন মুখস্থ করেন। ১০ বছর বয়স থেকে তিনি হাদীস মুখস্থ করা শুরু করেন। ১৬ বছর বয়সেই তিনি “আবদুল্লাহ বিন মুবারক” এবং “ওয়াকীর পান্ডুলিপিসমূহ” মুখস্থ করে ফেলেন। মহান আল্লাহ্ পাক তাকে অনন্য সাধারণ জ্ঞান ও স্মরণ শক্তি দান করেছিলেন।
ষোল বছর বয়সে তিনি মা এবং বড় ভাইয়ের সাথে হজ্জে গমন করেন। হজ্জের পর তিনি মক্কাতে রয়ে গেলেন এবং হিজাযের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদদের কাছ থেকে হাদীস গ্রহণ করতে থাকলেন। এ সময় তিনি “কাজায়াস সাহাবা ওয়াত তাবীয়ীন” নামক গ্রণ্থ রচনা করেন। এরপর হাদীস অন্বেষণের জন্য তিনি ইরাক, সিরিয়া ও মিশরসহ বহু অঞ্চল সফর করেন। একদা ইমাম বোখারি (রহঃ) মুহাদ্দিস দাখেলির দরসগাহে যোগ দেন। ইমাম দাখেলি (রহঃ) একটি হাদিসের সনদ বর্ণনা করবার সময় ‘জুবাইর’ এর স্থলে ‘আবু জুবাইর’ বলেছেন। ইমাম বুখারি নম্রস্বরে বললেন- এখানে আবু জুবাইর’ এর স্থলে ‘জুবাইর’ হবে। অতঃপর ইমাম দাখেলি (রহঃ) বাড়িতে গিয়ে কিতাব দেখে তাঁর ভুল সংশোধন করেছেন। এর অব্যবহিত পরই দাখেলি (রহঃ) তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি এতদ্ভিন্ন অন্য এক দরসগাহে ও যোগ দিতেন। সেখানে অন্য ছাত্রগণ হাদিসগুলো লিখে নিতেন। তিনি তা লিখতেন না। তাঁর সহপাঠিগণ তাঁকে হাদিস না লিখে রাখার কারণ জিজ্ঞেস করলে কোন উত্তর দেন নি। অতপর সহপাঠিগণ তাঁকে হাদিস লেখার জন্য জোর তাগিদ দিলে উত্তর দিলেন এভাবেঃ “আপনাদের লেখা কপিগুলো নিয়ে আসুন।” তারা কপিগুলো নিয়ে আসলে তিনি ধারাবাহিকভাবে তাদের সামনে হাদিসগুলো পাঠ করে শোনান। সেই মজলিসে তাদের লেখা অনুসারে প্রায় পনের হাজার (১৫,০০০) হাদিস মুখস্থ পাঠ করে শোনালেন। দীর্ঘ ১৬ বছর পর তিনি হাদীস অন্বষণের ভ্রমণ শেষ করে নিজ মাতৃভূমি বোখারায় ফিরে আসেন।
ইমাম বোখারি রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টিরও বেশি। এগুলোর কিছু বিলুপ্ত হয়ে গেছে কিংবা পাণ্ডুলিপি আকারে সংরক্ষিত রয়েছে। আর কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত গ্রণ্থাবলীর মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ হল, বুখারী শরীফ। নীচে তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থের নাম দেয়া হলঃ
- কাজায়া আস-সাহাবা ওয়া আত-তাবিয়ীন (আরবীতেঃقضايا الصحبة و التابعين)
- আত-তারীখ আস-সগীর (আরবীতেঃالتاريخ الصغير)
- আল-আদাব আল-মুফরাদ (আরবীতেঃالأدب المفرد)
- কিতাব আল-জুআফা আস-সগীর (আরবীতেঃكتاب الضعفاء الصغير)
- কিতাব আল-কুনা (আরবীতেঃكتاب الكُنى)
- কিতাবু খালকি আফআলিল ইবাদ (আরবীতেঃكتاب خلق أفعال العباد)
- সহীহ আল-বুখারী (আরবীতেঃ صحيح البخاري )
- রাফওল ইয়াদাইন ফিস সালাত,
- কিরাআত খলফিল ইমাম।
- আত-তারিখুল কবির,
- আত-তারিখুল ওয়াসাত,
- খালকু আফয়ালিল ইবাদ,
- আল জামেওল কবির,
- আল মুসনাদুল কবির,
- কিতাবুল আশরিয়া,
- ওসামাস সাহাবা,
- কিতাবুল মারসুত,
- কিতাবুল বিজদান
ইমাম বোখারি’র জীবনের শ্রেষ্ঠতম কর্ম হচ্ছে এ হাদীসগ্রন্থের রচনা। তিনি স্বীয় শিক্ষক ইসহাক বিন রাহওয়াইহ থেকে এ গ্রন্থ রচনার প্রেরণা লাভ করেন বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় ।একদিন ইসহাক একটি এমন গ্রন্থের আশা প্রকাশ করেছিলেন,যাতে লিপিবদ্ধ থাকবে শুধু সহিহ হাদীস। ছাত্রদের মাঝে ইমাম বোখারি তখন এ কঠিন কাজে অগ্রসর হন। ২১৭ হিজরি সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি মক্বায় অবস্থানকালে হারাম শরীফে বসে এ গ্রন্থের সংকলন শুরু করেন। দীর্ঘ ১৬ বছর পর ২৩৩ হিজরী সনে এ দুর্লভ গন্থের সংকলনের কাজ সমাপ্ত হয়। বুখারী শরীফের সংকলনকালে তিনি সর্বদা সিয়াম পালন করতেন এবং প্রতিটি হাদীস গ্রন্থ সন্নিবেশিত করার আগে গোসল করে দু’ রাকাত নফল সলাত আদায় করে মুরাকাবা ও ধ্যানের মাধ্যমে হাদীসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন। এ গ্রন্থে তিনি সকল সহিহ হাদীস সংকলন করেন নি। বরং সহিহ হাদীসের মাঝে যেগুলো তার নির্ধারিত শর্তে উন্নীত হয়েছে,সেগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি স্বয়ং বলেন, “আমি জা’মে কিতাবে সহিহ হাদিস ব্যতীত অন্য কোন হাদিস ওল্লেখ করি নি। তবে কলেবর বড় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেক সহিহ হাদিসকে বাদ দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, আমি আমার কিতাবে প্রতিটি হাদিস লেখার পূর্বেই গোসল করেছি এবং দু রাকাআত সলাত আদায় করে নিয়েছি। অপর বর্ণনা হতে জানা যায় যে, ইমাম বুখারী (রহঃ) তাঁর স্বীয় কিতাবের শিরোনাম সমূহ রাসুলে করিম (সা) এর রওজা এবং মসজিদে নববির মধ্যস্থলে বসে লিখেছিলেন এবং প্রত্যেক শিরোনামের জন্য দু’রাকায়াত নফল নামাজ আদায় করেছেন। ইমাম বোখারির প্রায় ৬ লাখ হাদীস মুখস্থ ছিল। বোখারি শরীফের পুরো নাম হলঃ আল-জামি আল-সাহীহ আল-মুসনাদ মিন উমুরি রাসূলিল্লাহ ওয়া সুনানিহি ওয়া আইয়ামিহি। বুখারি শরীফ প্রণয়ের স্থানঃ আবুল ফজল মোহাম্মদ বিন তাহেরের বর্ণনা মতে, ইমাম বুখারী (রহঃ) তাঁর গ্রন্থখানি বোখারাতে বসে রচনার কাজ শেষ করেছেন। আবার কারও মতে মক্কা মুয়াজ্জামায় আবার কারো মতে বসরাতে। তবে উল্লেখিত সকল বর্ণনা নির্ভুল। কেননা তিনি উল্লেখিত স্থানগুলোর সকল নগরীতে অবস্থান করেছেন। স্বয়ং ইমাম বোখারি (রহঃ) বলেছেন, আমি আমার সহিহ বোখারি সঙ্গে নিয়ে বসরা শহরে ৫ বছর অবস্থান করেছি এবং আমার কিতাব প্রণয়ের কাজ শেষ করি। আর প্রতি বছরই হজ্ব পালন করি এবং মক্কা হতে বসরাতে ফিরে আসি। তিনি ৬ লাখ হাদিস হতে যাচাই বাছাই করে সর্বসাকুলে ১৬ বছর নিরলস সাধনা করে এ প্রসিদ্ধ গ্রন্থখানি প্রণয়ন করেন। এখানে মোট হাদিস আছে সাত হাজার একশত পচাত্তর খানি (৭,১৭৫)। আর পুনরুক্ত ছাড়া আছে চার হাজারের (৪,০০০) মত। আর কারও মতে, বোখারিতে পুনরুক্ত হাদিস আছে মাত্র একখানি যা রুমালের বর্ণনা।
জীবনকালের শেষদিকে একবার বুখারার তৎকালীন শাসনকর্তা “খালিদ বিন আহমাদ যুহলী” হাদীসশাস্ত্রে ইমাম বোখারির পান্ডিত্য দেখে তাকে দরবারে এসে শাসনকর্তার সন্তানদেরকে হাদীস শেখাতে বলেন। ইমাম বোখারি এটাকে হাদীসের জন্য অবমাননাকর মনে করেন। ফলে উভয়ের মাঝে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। তখন তিনি মাতৃভূমি বোখারা ত্যাগ করে সমরকন্দের খরতঙ্গে চলে যান এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ২৫৬ হিজরীর, ১লা শাওয়াল মোতাবেক ৩১শে আগস্ট, ৮৭০ খ্রিস্টাব্দের শুক্রবার দিবাগত রাতে মৃত্যুবরণ করেন পরদিন শনিবার যোহর সলাতের পর খরতঙ্গেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। দাফনের পর তাঁর কবর থেকে সুগন্ধি বিচ্ছুরিত হয়। লোক দলে দলে তাঁর কবরের মাটি নিতে থাকে। কোন ভাবে তা নিবৃত্ত করতে না পেরে কাঁটা দিয়ে ঘিরে তাঁর কবর রক্ষা করা হয়। পরে জনৈক ওলী মানুষের আকিদা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় সে ঘ্রাণ বন্ধ করার জন্য দোয়া করেন, ফলে তা আল্লাহর রহমতে বন্ধ হয়ে যায়।
তথ্যসূত্রঃ 01. S. ‘Abdul-Maujood, “The Biography of Imam Bukharee”, Maktaba Dar-us-Salam, 2005,
02. মুহাম্মাদ তাকী উসমানী (ডিসেম্বর ২০০৯)। “ইমাম বুখারীর দেশে”
03. Imam Bukhari: His and Works.