লুটপাটের কারণে বন্ধ হচ্ছে বহু ব্যাংকঃ আমানত তোলার হিড়িক!
দেশের প্রায় অর্ধেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে- অর্থ ও ব্যাংকিং খাতের ভয়াবহ খবর। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত এর সমাধান দিয়েছেন দেউলিয়া ব্যাংকগুলিকে একত্র করে একটা কিছু করবেন! এ নিয়ে প্রতিদিনই বিভিন্ন পত্রিকার নানা প্রতিবেদন ছাো হচ্ছে- হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট, সিকিউটির মানি খেয়ে ফেলেছে ব্যাংক, দেউলিয়া হয়ে গেছে অর্ধেক ব্যাংক, ব্যাংক খাতে ধস নেমেছে ইত্যাদি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খবরে যতটুকু আসছে, বাস্তব অবস্থা তারও চেয়ে খারাপ- ব্যাংক খাত কলাপস করতে পারে যেকোনো সময়ে। শেয়ার মার্কেটের মত ভয়াবহ বিপর্যয় ধেয়ে আসছে, সামনে হয়ত জনগণের আমানতের টাকা ফেরত দিতে পারবে না অনেক ব্যাংক। তহবিলের অভাবে চেক বাউন্স করবে। এমনকি জনগনের মধ্যে ব্যাংক ভীতি শুরু হতে পারে- ব্যাংক থেকে ব্যাপকভাবে টাকা উত্তোলনের হিড়িক পড়তে পারে।
যেসব ব্যাংকের অবস্থা খারাপ সেগুলোকে অন্য ব্যাংকের সাথে একীভূত করে দেওয়া হবে বলে জানিয়ে দুদিন আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে খেলাপি ঋণ। খারাপ ব্যাংক গুলি বলতে দেউলিয়া ব্যাংক বুঝিয়েছেন। তবে কোন কোন ব্যাংক দেউলিয়ার খাতায় নাম লিখিয়েছে, এবং এই ব্যাংকগুলো মার্জ করলে আমানতকারীদের অর্থের কি উপায় হবে, তা অবশ্য তিনি পরিস্কার করে বলেননি।
গত ১৯ ডিসেম্বর অর্থনীতি সমিতির এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী ঘরানার বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত দেশের বর্তমান অর্থনীতি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখোমুখিতে আছে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ঠিকমতো হিসাবপত্র করলে দেশের অর্ধেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর একের পর এক দলীয় বিবেচনায় ব্যাংক অনুমোদন দেয়। এসব ব্যাংকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামীলীগের বহু নেতাকে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় যাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে অর্থ লুটপাটের বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। কেবল মাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় এইরূপ অদক্ষ, অপেশাদারি নিয়োগ ও সীমাহিন স্বজন প্রীতি ও অনিয়মের কারনে একের পর এক ব্যাংক এখন দেউলিয়া হতে চলেছে। ড. বারকাত আরও বলেন, দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক ব্যাংকের আর্থিক হিসাবে সমস্যা রয়েছে। এর আগে গত জুনে প্রাক বাজেট আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক লুটপাট চলছে। তিনি বলেন, ব্যাংক সেক্টরে বেসরকারি ব্যাংক খাতে সর্ব নিম্ন খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশ। আর সরকারি ব্যাংকের হার সর্বনিম্ন ৩০ শতাংশ। বেসিক ব্যাংকে ৬০, সোনালী ব্যাংকে ৪০, বিডিবিএল-এ ৩০ শতাংশের কাছাকাছি খেলাপি ঋণের হার। পৃথিবীর কোনে দেশে ব্যাংক সেক্টরে এরকম খেলাপি ঋণের হার নেই। অথচ আমাদের ব্যাংক থেকে টাকা লোপাট করা হচ্ছে। কথা নেই বার্তা নেই, ইচ্ছামত লোকজন বসিয়ে জনগণের টাকা লুট করা হচ্ছে। ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সরকার যদি ব্যাংকের টাকা লুট করে তাহলে আমরা যাবো কোথায়? এটা অদ্ভুত ব্যাপার যে, সরকার আমাদের টাকা মেরে দিয়ে, আবার আমাদের পকেটের টাকা থেকে ট্যাক্স নিচ্ছে। এই টাকায় ব্যাংকের ঘাটতি মেটাচ্ছে। সর্বশেষ ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়ার কারণে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির মুখে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো। এ ঘাটতি পূরণে সরকারের কাছেও নগদ অর্থ নেই। বাজেট থেকে তা পূরণ করাও কঠিন। কেননা, চলতি বাজেটে এ খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ মাত্র ৪ হাজার কোটি টাকা। এরপরও বাজেট থেকে পূরণ করা হলে সরকারকে বড় চাপের মুখে পড়তে হবে। ওই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ২ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের ২০০ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ১ হাজার ৫৩ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ২৮৬ কোটি, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) ৭৩৭ কোটি টাকা, কৃষি ব্যাংকের ৭ হাজার ৪৮৫ কোটি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৭০৫ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী রীয়াজ তার নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণে বিপর্যস্ত ব্যাংক, মোট পরিমাণ এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, হদিস নেই ৪৫ হাজার কোটি টাকার, এটা আর কখনই আদায় হবে না। ব্যাংকিং খাতের কী ভবিষ্যত কেউ জানে না। একদিকে আদায় করতে না পারায় নতুন ঋণ দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ফলে মুনাফায় ধস নেমেছে অধিকাংশ ব্যাংকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগি করায় সেখানেও খেলাপের সংখ্যা বেড়ে গেছে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে আছে নতুন প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকগুলো। অনিয়ম-জালিয়াতিতে পিছিয়ে নেই বেসরকারি ব্যাংকগুলোও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বেসরকারি খাতের প্রায় সব ব্যাংকের পরিচালকরা একে অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ঋণ দেওয়া-নেওয়া করেন। নতুন-পুরান মিলিয়ে দেশে সরকারি-বেসরকারি ৫৭টি ব্যাংক। এসব ব্যাংক পরিচালকদের হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। ১৯টি ব্যাংকের পরিচালক নিজের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বেশি। একই ভাবে ৯টি ব্যাংকের পরিচালক গ্যারান্টার বা জিম্মাদার হয়ে ঋণ দিয়েছেন আরও ২৩১ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপির চিত্রে দেখা গেছে,এক্সিম ব্যাংক ৪ হাজার ৫৬৯ কোটি, ব্যাংক এশিয়া ৩ হাজার ৯৫৪ কোটি, ঢাকা ব্যাংক ৩ হাজার ৭২২ কোটি, এবি ব্যাংক ৩ হাজার ৫৩৬ কোটি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ৩ হাজার ২৫৯ কোটি, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ৩ হাজার ১৫৫ কোটি,ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ৩ হাজার ৬৬ কোটি, যমুনা ব্যাংক ৩ হাজার ১৬ কোটি,প্রাইম ব্যাংক ২ হাজার ৯৭৬ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংক ২ হাজার ৯৩০ কোটি,পূবালী ব্যাংক ২ হাজার ৭৯৭ কোটি,ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ২ হাজার ৩৫৭ কোটি, ট্রাস্ট ব্যাংক ২ হাজার ৩০৩ কোটি, এনসিসি ব্যাংক ২ হাজার ১৩৯ কোটি,সাউথইস্ট ব্যাংক ১ হাজার ৯৯০ কোটি, ওয়ান ব্যাংক ১ হাজার ৮২৭ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংক ১ হাজার ৭৮৭ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ১ হাজার ৭৪৫ কোটি,মার্কেন্টাইল ব্যাংক ১ হাজার ৬৬৭ কোটি ও আইএফআইসি ব্যাংকের ১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। নতুন কার্যক্রমে আসা এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালককে ঋণ দিয়েছে ৫১৪ কোটি, মধুমতি ব্যাংক ৩৫২ কোটি,মিডল্যান্ড ব্যাংক ৩৪৯ কোটি, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ৩২৫ কোটি,মেঘনা ব্যাংক ৩০১ কোটি ও ফারমার্স ব্যাংক ১৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনিয়ম করে ঋণ দেওয়ার দায়ে এনআরবিসি,ফারমার্স ব্যাংকের পর্ষদ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর খেলাপিদের ঋণের একটি বড় অংশই বর্তমান ও সাবেক ব্যাংক পরিচালক,তাদের স্ত্রী-পুত্র-সন্তান বা নিকটাত্মীয়দের কাছে আটকা পড়ে আছে। এসব ঋণপ্রস্তাব,অনুমোদন ও বিতরণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ।
প্রথম আলোর রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সরকারি-বেসরকারি খাতের সাত ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি এতটাই দুর্বল হয়েছে যে মুলধন পর্যন্ত খেয়ে ফেলেছে, উপরন্তু সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতিতে পড়েছে। ব্যবসার পরিবর্তে এসব ব্যাংক এখন মূলধন জোগান নিয়েই চিন্তিত। ব্যাংক সাতটি হল সোনালী, রূপালী, বেসিক, কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন, বাংলাদেশ কমার্স ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি ছয় ব্যাংক ঋণের মান অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। মুনাফার অংশ থেকে ব্যাংকগুলোকে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকগুলো হলো সোনালী, রূপালী, বেসিক, বাংলাদেশ কমার্স, ন্যাশনাল ও প্রিমিয়ার। সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিক খান আলমগীরের ফারমার্স ব্যাংক শুধু দেউলিয়া হয় নি, তারা কর্মচারিদের বেতন দিতে পারছে না। আমানতকারীদের চেক ফেরত দিচ্ছেন।
সরকারের নীতিনির্ধারকরাও ব্যংক খাতের এ লুটপাটের কথা বিভিন্ন সময় স্বীকার করেছেন। কিন্তু প্রতিকারের উদ্যোগ নেই। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের কিছু কিছু ক্ষেত্রে লুটপাট হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও । তিনি বলেছেন, ব্যাংকিং খাতে শুধু পুকুরচুরি নয়, সাগরচুরি হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষের অনেক সহ্য শক্তি। তারা প্রায় ভুলে যেতেই বসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ৮০০ কোটি টাকার চুরির কথা, এই সরকারের আমলেই শেয়ার মার্কেট থেকে প্রায় লক্ষাধিক কোটি টাকা লুট করার কথা, ক্ষতিগ্রস্থ ৩৩ লাখ বিনিয়েগকারীর মধ্যে কয়েকজন আত্মহত্যা করেছিল, এদের মধ্যে বিরাট সংখ্যায় ছিল সশস্ত্র বাহিনার সদস্যরা, যারা শান্তিরক্ষী মিশন থেকে উপার্জিত অর্থ লগ্নি করেছিলেন ক্যাপিটেল মার্কেটে। হলমার্ক, বিসমিল্লিাহ গ্রুপ, ভুয়া এলসি কেলেঙ্কারীর কথা আর কেউ মনে করে না। বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ হয় হয় দশা। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সবগুলো দেউলিয়া ব্যাংক যদি একত্র করে ফেলে তবে আমানতকারীদের টাকার কি অবস্থা হবে? অনেক ব্যাংকে চেক দিলে টাকা দিতে পারছে না। জনগন আতঙ্কিত- চারিদিকে আমানত তোলার হিড়িক।