লীগকে ক্ষমতায় আনা ঃ ৫ জানুয়ারির আগে এসেছিলেন সুজাতা, এবার খোদ মোদিই আসছেন!
1
এবার আর সুজাতা নয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নিজেই স্বয়ং আসছেন বাংলাদেশে। মূলতঃ আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মত জনসমর্থনহীন এ সরকারকে ক্ষমতায় বসানো নিশ্চিত করতেই তার এ সম্ভাব্য আগমন। এমনটিই ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। এর আগে বিগত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানো ব্যাপারটি ঢাকা সফরে এসে নিশ্চিত করেছিলেন তৎকালীন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুজাতা সিং। এদিকে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখলে আগামী ৮ এপ্রিল দু’দিনের সফরে ঢাকায় আসতে পারেন। এছাড়া রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সোলার সামিটে যোগ দিতে পাঁচ দিনের সফরে ভারতে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল শিগগিরই ভারত সফরে যাচ্ছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের প্রতিনিধি দলও ভারত সফরে যেতে পারে। তার মানে বিশ্বের অন্য কোন দেশ নয়, শুধুই ভারত সফর। আবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলকেও সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভারত।
সূত্র বলছেঃ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের দুই মেয়াদে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১০৮ চুক্তি সই হলেও বহুল প্রত্যাশিত তিস্তা চুক্তি সই হয় নি। শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অঙ্গীকার করেছিলেন, তার আমলেই তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই হবে। অভিজ্ঞমহল বলছে, ভারত সব নিয়ে নেবে, এ বলে সে বলে, কিন্তু দেবে না অবশেষে কিছুই। শুধু ছেলে ভুলানোর আষাঢ়ে গল্প শুনিয়েই পার করবে। দক্ষিণ ব্লকের সাথে সম্পর্ক রাখেন, একজন আওয়ামী বুদ্ধিজীবী আমাদের এ প্রতিনিধিকে জানান, ভারত আসলেই তিস্তা চুক্তি কেরতে চায় না। তিস্তা চুক্তি নিয়ে মমতা যেমন গোঁ ধরে তার ভোট ব্যাংক বাড়িয়েছে। তেমনি বিজেপিও তাই করতে প্রয়াসী। যদিও পথটি মমতাই দেখিয়েছে। কিন্তু এখন সেটি জনপ্রিয়তার বাড়তি কমতির হিসেবে চলে যাচ্ছে। তাছাড়া বাম দুর্গ হিসেবে পরিচিত
ভারতের দ্য ইকোনমিক টাইমস পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, আগামী মাসগুলোতে মোদি ভুটান, বাংলাদেশ ও নেপাল সফর করতে পারেন। এ সময় ভুটান ও বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হবে। দুই নির্বাচনের গুরুত্ব অনুধাবন করে মোদি সফরসূচি নির্ধারণ করছেন বলে খবরে বলা হয়।
ভূটান ইতোমধ্যে ভারতের করদরাজ্য হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশও সেই পথে আছে। আগামী নির্বাচনে ভারতের একচেটিয়া আনুগত্যকারী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এটিও করদরাজ্যে পরিণত হওয়া নিশ্চিত হবে।
নির্বাচনের মধ্যস্থতায় ভারতঃ বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে ভারতই দাতা দেশগুলোর পক্ষ থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। বিদেশি দূতাবাসগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এব্যাপারে সমঝোতার দায়িত্ব ভারতের উপরই ন্যস্ত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অবাধ, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রধান দুই দলের মধ্যে সমঝোতার আবহ তৈরি করতে ভারতকে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব করেছে। ফলে, আগামী নির্বাচনে ভারতের অবস্থানই সকল দাতা দেশের অবস্থান হবে। একাধিক কূটনীতিক সূত্র এ খবর নিশ্চিত করেছে।
নানা কারণেই বাংলাদেশ মার্কিন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে এসেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ‘ঐতিহাসিক মানবিক’ অবস্থানের পর, নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে চাপে ফেলতে চায় না কোনো দেশই। অন্যদিকে, ভারতের উপর বাংলাদেশের রাজনীতির নির্ভরতা বেড়েছে। পাশের বড় দেশ এবং সাম্প্রতিক সময়ে দুদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত নির্ভরতা বেড়েছে। বিশেষ করে ২০১৪’র নির্বাচনে ভারতের একতরফা সমর্থন, শেষ পর্যন্ত বর্তমান সরকারকে পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় রেখেছে। ভারত তার নিজের দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই বাংলাদেশের একটি স্থিতিশীল সরকার চায়। ভারত চায় এমন একটি দলকে ক্ষমতায় রাখতে যারা জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি গ্রহণ করবে। আবার কংগ্রেসের মতো মোদীর বিজেপি সরকার আওয়ামী লীগকে অন্ধভাবে সমর্থনও দিতে চায় না। বিজেপি সরকার বাংলাদেশের ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়‘। চায় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এজন্যই কূটনৈতিক আলোচনায়, বাংলাদেশে এরকম একটি নির্বাচনের মধ্যস্থতায় ভারতই উপযুক্ত এরকম মনোভাব উঠে এসেছে। বিশেষ করে
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় মোটেই আগ্রহী নয়। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক মার্কিন প্রতিনিধি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চেয়ে পায়নি। যারা সময় পেয়ছেন, তাদেরও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ‘নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হবে’ এই বলে বিদায় দিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিজ্ঞতাও একই। সেদিক থেকে ভারত অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বলে কূটনৈতিক মহল মনে করে। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অনেক অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। ভারতও নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের প্রভাব বজায় বলয় বাড়াতে চায়। গত তিনমাসে ভারতের কূটনীতিকদের সঙ্গে বিএনপিরও যোগাযোগ বেড়েছে। একটি সূত্র দাবি করেছে, বিএনপিও এখন বুঝতে পেরেছে, ভারত বিরোধীতা করে ক্ষমতায় আসা অলীক কল্পনা। ভারতের পরামর্শ এবং অনুরোধেই বিএনপি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিচ্ছে। ভারত হয়তো শেষ পর্যন্ত, বিএনপিকে নির্বাচনের পথেও নিয়ে যাবে। তবে ভারত কাউকে জিতিয়ে আনার কৌশল নেবে না। বরং জনগণ যেন তাঁর মতামত নির্ভয়ে দিতে পারে সেজন্য প্রধান দুই দলকে ঐক্যমতে আনবে ।
অন্যান্য দাতা দেশগুলোর চাওয়া এটাই। তবে ভারত স্পষ্ট করেই বলেছে, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তারা সমর্থন করে না। বর্তমান সরকারের অধীনেই একটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে ভারতই দুই প্রধান দলের মধ্যে মধ্যস্থতা করছে, এমন খবর বেশ জোরেসোরেই শোনা যাচ্ছে । নির্বাচনের আগে একাধিক সফর সেই খবরকে আরও শক্ত ভিত্তি দিচ্ছে। মার্চেই প্রধান দুই দলের সাধারণ সম্পাদক ও মহাসচিব ভারত সফরে যাচ্ছেন । তিস্তার পানি চুক্তি এবং আরও কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ আসবেন এপ্রিল মে মাসে। এই সফরেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হবে। এই সফরটা বাংলাদেশে অনুষ্ঠেয় অগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হবে তা নিশ্চত করেছে কূটনৈতিক মহল
ফারাক্কা বাঁধঃ ভারতে পানি থৈ থৈ বাংলাদেশে মরুভূমি
ভারত-বাংলাদেশ ৩০ বছরমেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়েছে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর। গত ২১ বছর ধরে নদী পাড়ের মানুষ দেখছেন, চুক্তি অনুযায়ী পদ্মায় পানি আসছে না। ভারতীয় অংশে গঙ্গা পানিতে ভরপুর। ভাটির বাংলাদেশ অংশে পদ্মায় মাইলের পর মাইল ধুধু বালুচর। উজানে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করায় প্রমত্তা পদ্মা এখন মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। পদ্মা ও এর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। অথচ চুক্তিটি আজ পর্যন্ত রিভিউ করা হয়নি।
১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌরা নতুন দিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন সংক্রান্ত ৩০ বছরমেয়াদি চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন। ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চুক্তি কার্যকর হয়েছে। চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে, শুষ্ক সময়ে বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে। কিন্তু বাংলাদেশ কোনো বছরই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পানি পাচ্ছে না। চুক্তিতে বলা হয়েছে, এই চুক্তি পাঁচ বছর পরপর উভয় সরকার রিভিউ করবে। যদি প্রয়োজন হয় অন্তর্বর্তীকালীন রিভিউ করা যাবে। চুক্তিতে আরো বলা হয়েছে, আগামী দুই বছর পর যদি কোনো পক্ষ চুক্তিটি রিভিউ করতে চায় তা করা হবে। সমঝোতার ব্যত্যয় ঘটলে বা সমন্বয়ের অভাব দেখা দিলে এই রিভিউ হবে। কিন্তু ২১ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তিটি রিভিউ করা হয়নি।
ভাটির বাংলাদেশ অংশে পদ্মার প্রশস্ততা ও পানির স্তর ক্রমাগত কমে আসছে। চুক্তি মতে ফারাক্কায় যে পানি জমে তাই ভাগ করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু গঙ্গার পুরো পানির ভাগাভাগির প্রসঙ্গ চুক্তিতে উল্লেখ নেই। তাই চুক্তির পানি দিয়ে বাংলাদেশের চাহিদার অর্ধেকও পূরণ হচ্ছে না। শুষ্ক মওসুমে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উজান ও ভাটিতে পানির স্তর কমে যাওয়ায় পদ্মা ও এর শাখা-প্রশাখা নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে চুক্তি রিভিউ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
পদ্মা অববাহিকার অন্যতম প্রধান শাখা গড়াইয়ে পানিপ্রবাহ নেই। এ নদীর উৎসমুখে পলি ও বালু পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। কুষ্টিয়া সদর উপজেলা, হরিপুর ও মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়া এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা থেকে গড়াই নদীর উৎস মুখ শুরু হয়েছে। এ নদীতে পানিপ্রবাহ না থাকায় খুলনা, যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় নদী অববাহিকায় নোনাপানি বেড়েছে। গড়াই নদী মাগুরা, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, যশোর ও খুলনা হয়ে সুন্দরবনে মিশেছে। এ নদী সুন্দরবন ছাড়াও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় নোনা পানির আগ্রাসন রুখতে বড় ভূমিকা রাখে। পরিবেশবিদদের মতে, খুলনা বিভাগের মধ্যে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার দিক থেকে পদ্মার প্রধান শাখা নদী গড়াইকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। বিশেষ করে সুন্দরবনের জন্য গড়াইয়ের মিঠা পানি অপরিহার্য।
১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকার কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্প হাতে নেয়। ১৯৬৯ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। এই প্রকল্পের ১২টি ছোট পাম্প ও তিনটি বড় পাম্প চালু রাখতে নদীর পানির স্তর ন্যূনতম ১৫ ফুট প্রয়োজন। জিকে প্রকল্পের মোট সাড়ে ৩ লাখ একর জমি সেচসুবিধার আওতায় আনা হলেও পদ্মায় পানি সঙ্কটের কারণে এক লাখ একরের বেশি জমিতে সেচসুবিধা সম্প্রসারণ করা হয়নি।
সমুদ্রতল থেকে ৪২ ফুট উঁচুতে অবস্থিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্ট থেকে ভারত সীমান্ত ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ১৮ কিলোমিটার উজানে ফারাক্কা বাঁধ অবস্থিত। ভারতের গোমুখিতে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশের মেঘনা সঙ্গম স্থান পর্যন্ত এক হাজার ৬৮০ মাইলব্যাপী প্রবাহিত। মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে গঙ্গার মূল অংশ চলে আসে বাংলাদেশে। গঙ্গার নি¤œস্রোত ধারার নাম পদ্মা। পদ্মা রাজশাহী চারঘাটে প্রবেশ করে পাবনার বেড়া উপজেলার নতিবপুরের কাছে বারকোদালিয়া নামক স্থানে যমুনার সাথে মিশেছে। পদ্মা ও যমুনার মিলিত প্রবাহ পদ্মা নামে অভিহিত। অবশ্য গঙ্গা বাংলাদেশে আসার পর থেকেই পদ্মা নামে পরিচিত। এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মার বুকে এখন অসংখ্য চর।
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর মহকুমার কাছে গঙ্গা বিভক্ত হয়ে ভাগিরথী ও পদ্মা হয়েছে। জলঙ্গি হয়ে নদীয়ার মধুগাড়ি পর্যন্ত আসে। এই এলাকার দৈর্ঘ্য ১২০ মিটার। এরপর বাংলাদেশে ঢোকে। পশ্চিম বাংলায় পদ্মার কোনো উপনদী নেই। শাখা নদীর মধ্যে ভাগিরথী, ভৈরব ও জলঙ্গি। সেখানে কোনো জোয়ার-ভাটার প্রভাব নেই। পদ্মায় বছরে পলিপ্রবাহ ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন টন। পাবনার পাকশী থেকে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পর্যন্ত প্রতি কিলোমিটারে এ নদীর ঢাল প্রায় পাঁচ সেন্টিমিটার। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উজানে রয়েছে পদ্মার পানিপ্রবাহ মাপার মিটার গেইজ। এখানে বাংলাদেশ ও ভারতের পানি বিভাগের কর্মকর্তারা পানি মাপেন ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত। এখানে ছাড়াও গোয়ালন্দের বারুলিয়া এবং মাওয়ার ভাগ্যকূলে পদ্মার পানিপ্রবাহ পরিমাপ করা হয়।
চুক্তি অনুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত গঙ্গার সর্বাপেক্ষা কম প্রবাহকালে ১০ দিনের পালাক্রমে উভয় দেশের মধ্যে পানির ভাগ হয়ে থাকে। ১০ দিনের যেকোনো পালায় পানিপ্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেকের নিচে নেমে গেলে দুই দেশের সরকার জরুরি ভিত্তিতে আলোচনা করে পানি বণ্টনে সামঞ্জস্য বিধান করে। ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহ ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি হলে বা তার কম হলে উভয় দেশ সমান সমান ভাগে পানি পায়। কিন্তু গঙ্গার পানির পুরো ভাগ দেয়া হচ্ছে না।
অন্যান্য মাসে সমস্যা না হলেও মে মাসে পানিসমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে। ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে গঙ্গার প্রবাহ ছিল ৩৫ হাজার কিউসেক। তখন পাবনার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির উচ্চতা ছিল ৬.৩৬ মিটার। ১৯৯৬ সালের মার্চে তা কমে দাঁড়ায় ৩৪ হাজার ৮৩৮ কিউসেক এবং পানির উচ্চতা ছিল ৩.৯৬ মিটার। এ অবস্থার অবনতি হয়েছে। গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির পর থেকে পাবনা হাইড্রোলজি বিভাগ পদ্মায় পানিপ্রবাহ সংক্রান্ত কোনো তথ্য সাংবাদিকদের দিচ্ছে না।
পদ্মা পাড়ের মানুষ দেখছেন গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী পদ্মায় পানি আসছে না। এ অঞ্চলের নদনদী শুকিয়ে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। পদ্মায় পর্যাপ্ত পানিপ্রবাহ না থাকায় এর প্রধান শাখা বড়াল, আত্রাই ও গড়াই নদী প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। কুষ্টিয়ার-রাজবাড়ী মহাসড়কের লাহিনী এলাকায় কয়ায় গড়াই নদীর ওপর নির্মিত গড়াই রেলসেতু ও রুমী ব্রিজের নিচে গর্তে কিছু পানি জমে আছে। আর উৎসমুখ তালবাড়িয়া থেকে শুরু করে লাহিনী এলাকা পর্যন্ত নদীতে বিপুল পরিমাণ পলি ও বালু জমেছে।
কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, সাতক্ষীরা ও ফরিদপুরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ২৫টি নদীর উৎসমুখ পদ্মা। মধুমতি, নবগঙ্গা, কাজলা, মাথাভাঙ্গা, গড়াই, হিনসা, কুমার, সাগরখালী, কপোতাক্ষ, চন্দনাসহ অসংখ্য শাখা-প্রশাখা নদী প্রায় শুকিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো স্থানে বালু স্থায়ী মৃত্তিকায় রূপ নেয়ায় ফসল আবাদ করেছেন অনেকেই। বর্তমানে পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ ব্রিজের নিচে খাস জমিতে কৃষক চিনাবাদাম, বাঙি, তরমুজ, টমেটো, আখসহ নানা রকম রবিশস্য আবাদ করেছেন।
ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ করে ভাগিরথী দিয়ে গঙ্গার (পদ্মা) পানিপ্রবাহ ঘুরিয়ে নিয়েছে ভারত। ফারাক্কার উজানে পানি থই থই করছে। ভাটির বাংলাদেশ পানি সঙ্কটে পড়েছে। এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৩ থেকে ৭ মিটার নিচে নেমে গেছে। শুষ্ক মওসুমে ফারাক্কার উজান থেকে হাজার হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত। ফলে ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। পদ্মা সংযুক্ত উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত মহানন্দা, আত্রাই, বারনই, শিব, রানী ও ছোট যমুনাসহ ১২টি নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। এসব নদী পলি ও বালু জমে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে এ অঞ্চলের কৃষি সেচব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। পদ্মার পানি দিয়ে শুকনো মওসুমে রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় সেচকাজ চালানো হয়।
শুধু ফারাক্কার প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প-কারখানা ও পরিবেশসহ সবকিছুতেই মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। মিঠাপানি ছাড়া কৃষি তথা কোনো ধরনের শিল্প-কারখানা চলতে পারে না। ফারাক্কার কারণে যশোর-খুলনা অঞ্চলে মিঠা পানির প্রবাহ কমে গেছে। পদ্মার তলদেশ ওপরে উঠে এসেছে। শুষ্ক মওসুমে এখন পদ্মায় তেমন ইলিশ মাছ পাওয়া যায় না। মাছ আসার জন্য পানিতে যে পরিমাণ প্রবাহ থাকার কথা সেটি না থাকায় এখন আর পদ্মায় ইলিশ আসে না। অন্যান্য প্রজাতির মাছ আগের মতো পাওয়া যায় না। পদ্মায় পানিস্বল্পতার কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ, ভৈরব, মাথাভাঙ্গা, কুমার, কপোতাক্ষ, পশুর নদী পদ্মার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নদীবিশেষজ্ঞ কামরুন নেছা জানান, বাংলাদেশের পদ্মার যে বিপুল আয়তন তাতে স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলে প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টির কথা উঠত না। কিন্তু ভারত নেপালের কোশি থেকে শুরু করে ফারাক্কা পর্যন্ত দীর্ঘ পথে পানি প্রত্যাহারের যে একতরফা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
আওয়ামীলীগকে বিজয়ী ঘোষনা করে দিলেই পারে ইসিঃ রিজভী
অংশগ্রহণের জন্য নতুন কোনো উদ্যোগ নেয়া হবে না বলে সিইসির দেয়া বক্তব্যের সমালোচনা করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ বলেছেন, তাহলে কী কমিশন একতরফা নির্বাচনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে? যদি তাই হয়, নির্বাচন নির্বাচন জিকিরের তো দরকার নেই। শিডিউল ঘোষণা করে পরের দিনেই ক্ষমতাসীন দলকে বিজয়ী ঘোষণা করলেই পারেন। গতকাল দুপুরে দলের নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন।
রিজভী বলেন, নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দল যে অনাচার শুরু করেছে সে বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিশ্চুপ। প্রধানমন্ত্রী সরকারি খরচে হেলিকপ্টারে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নৌকা মার্কায় ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন, আর কমিশন দেখেও না দেখার ভান করছে। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনে সব দলকে সমান সুযোগ ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু সিইসির বক্তব্য ও আচরণে মনে হচ্ছে না তিনি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন করতে আগ্রহী। তিনি মালিক পক্ষের অনুগত থেকে স্বার্থরক্ষা করতেই যেন উঠেপড়ে লেগেছেন। রিজভী বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তি ও নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি পূরণ হলেই নির্বাচনের মাঠ সমতল হবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন ও সরকার সেদিকে কোনো দৃষ্টি দিচ্ছে না। এখন সিইসি যদি শেখ হাসিনার দুর্বিনীত দুঃশাসনকে প্রলম্বিত করতে ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে গেলে দেশে চরম অরাজকতা তৈরি হবে। আর এজন্য দায়ী থাকবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচির অনুমতি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে তাকে ‘বেসামাল মিথ্যাবাদী’ আখ্যায়িত করেছেন বিএনপির মুখপাত্র। রিজভী বলেন, তিনি (কাদের) বলেছেনÑ বিএনপি বেআইনিভাবে সমাবেশ করেছে। এত বড় টাটকা মিথ্যা কথা তিনি কীভাবে বললেন? তাকে বেসামাল মিথ্যাবাদী ছাড়া আর কী বা বলতে পারি? একজন রাজনীতিবিদ যদি এভাবে অবলীলায় মিথ্যা কথা বলেন, তাহলে দেশের জনগণ ও ও শিক্ষার্থীরা কী জানবে যে রাজনীতিবিদরা অনর্গল মিথ্যা কথা বলেন, সত্যের অপলাপ ঘটান। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনে আমাদের অনুমতি দিয়েছিল পুলিশ। আমরা যে কর্মসূচির অনুমতি চেয়ে পুলিশকে চিঠি দিয়েছি, তার রিসিভড কপি আমাদের কাছে আছে। পুলিশ কমিশনার আমাদের মহাসচিবকে মৌখিকভাবে অনুমতির কথা বলেছেন। আমরা তো অবস্থান কর্মসূচি আমাদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে করতে চেয়েছিলাম। পুলিশই জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে করতে বলেছে। আমরা তাদের কথা অনুযায়ী প্রেস ক্লাবের সামনে করেছি।
রিজভী বলেন, খালেদা জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করে দেড় মাসে সারা দেশে প্রায় ছয় হাজারের মতো নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বলেন, বিরোধী নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে নেতা-কর্মীদের না পেলে স্ত্রী-সন্তান, পিতা-মাতা-ভাই-বোনকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। থানায় নিয়ে গিয়ে তাদের উপর চালানো হচ্ছে নির্যাতন। বিএনপির আটক নেতাকর্মীদের জামিন পাওয়ার যে অধিকার সেটিও সরকার নিম্ন আদালতকে কব্জা করে বন্ধ করে রেখেছে। আদালতের দুয়ার যেন বিএনপি ও বিরোধী দল ও মতের মানুষদের জন্য বন্ধ। জেলখানাগুলো এখন নাৎসিদের গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়েছে। বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি থেকে টেনেহিঁচড়ে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ সময় বৃহস্পতিবারের অবস্থান কর্মসূচি থেকে ‘নির্মমভাবে টেনে-হেঁচড়ে’ গ্রেপ্তার করা ছাত্রদল নেতা মিজানুর রহমান রাজকে রিমান্ডে নেয়ার নিন্দাও জানান তিনি। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আতাউর রহমান ঢালী, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ উপস্থিত ছিলেন।
কূটনৈতিক ব্যার্থতায় কোনঠাসা ভারত
Related Articles
কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় কোণঠাসা হয়ে পড়ছে ভারত। আমাদের কিছু মানুষের নতজানু মানসিকতা ও সেবাদাস মনোবৃত্তির জন্য একমাত্র বাংলাদেশের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে দেশটি। ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোতে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার বদলে সুবিধাবাদী ব্যক্তি, কিছু রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিসেবীকে সেবাদাস হিসেবে গড়ে তোলে। তাদেরকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে।
গেøাবালাইজেশনের এই যুগে ভারত আদিম যুগের পররাষ্ট্রনীতি ধরে রাখার কারণেই প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপের মতো ছোট দেশেও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক না গড়ে, তিস্তার পানিসহ অভিন্ন ৫৪ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না দিয়ে কিছু দল, কিছু ব্যক্তির পেছনে খরচাপাতি করছে দেশটি। ভারত নিজেদের স্বার্থে যাকে যেভাবে সম্ভব বাংলাদেশের রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী বিভিন্ন গ্রæপকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। দিল্লির কাছে কিছু পেয়ে ‘প্রতিদান’ দিতে আমাদের দেশের ওইসব লোক নিজ দেশ ও জনগণের স্বার্থ বাদ দিয়ে দিল্লির স্বার্থকে সবসময় প্রাধান্য দিচ্ছেন; প্রচারণা চালাচ্ছেন। এমনকি কিছু মিডিয়া দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, জনগণের চিন্তা চেতনা-প্রত্যাশা প্রাপ্তির বদলে দিল্লির তাঁবেদারিতে হয়ে পড়েছে বেশি মনোযোগী।
দিল্লির সাউথ ব্লক অখুশি হতে পারে সে আশঙ্কায় এখন আর তিস্তার পানি, সীমান্ত হত্যা, টিপাইমূখে বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ট্রানজিটের বিরোধিতা, বাণিজ্য বৈষম্য কমানোর দাবিতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় না। ভারত অভিন্ন নদীগুলোতে আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নেয়ায় বাংলাদেশের কৃষকদের পানির জন্য হাহাকার। নদীগুলোতে নাব্যতার অভাবে জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এমনকি কোথাও কোথাও পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। সেদিকে কারো ভ্রæক্ষেপ নেই। গোলামি আর কারে কয়! অথচ নেপালের মতো দেশের জনগণ, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক দলগুলো ভারতকে দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে দেশপ্রেম দেখাতে হয়।
’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের সহায়তা-সহযোগিতা করেছিল, প্রায় এক কোটি লোককে ৯ মাস আশ্রয় দিয়েছিল; এ জন্য দেশটির প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু ভারতের অখন্ডতা রক্ষায় বাংলাদেশের ভ‚মিকা কী কম? বাংলাদেশ দিল্লির শাসকদের সহায়তা করছে বলেই তো দেশটির সেভেন সিস্টারর্স খ্যাত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্য এখনো ভারতের সঙ্গে রয়েছে। ওই রাজ্যগুলোতে স্বাধীনতার দাবিতে যেভাবে আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, বাংলাদেশ যদি দিল্লির প্রতি সহানুভ‚তিশীল না হতো, তাহলে ভারত এতদিনে ভেঙে খান খান হয়ে যেত। আমরা ভারতকে সহায়তা করেছি বলেই আসামের স্বাধীনতাকর্মী নেতা অনুপ চেটিয়াসহ কয়েকজনকে বাংলাদেশে এক দশকের বেশি সময় কারাগারে কাটাতে হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এই মহতি অবদানকে কি ভারত কৃতজ্ঞতা চিত্রে মনে করছে? মনে করে থাকলে তা প্রকাশ করছে না কেন?
প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক অপরিহার্য। প্রশ্ন হলো, ভারত কী প্রতিবেশী কোনো দেশের নির্ভরযোগ্য বন্ধু হতে পেরেছে! প্রতিবেশী কোন দেশের সঙ্গে ভারত সুসম্পর্ক রেখেছে? পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। আফগানিস্তান, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ কার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী দেশটির সম্পর্ক ভালো? বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে দীর্ঘ ৪৬ বছর ধরে বাংলাদেশ শুধু ভারতকে দিয়েই যাচ্ছে; বিনিময়ে কি পেয়েছে? ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ এবং এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন আমাদের অহঙ্কার। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করে আমাদের মতো নতুন দেশের অভ্যুদয় পৃথিবীতে খুব কম নজির আছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো জাতি আমরা। মুক্তিযুদ্ধে যে বিদেশিরা অবদান রেখেছেন, তাদের ডেকে এনে সম্মান জানাচ্ছি। অথচ মুক্তিযুদ্ধের এতদিন পর ভারতের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকরের ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য ‘ভারত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে’ কি প্রমাণ দেয়? এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করতে না পারার রহস্য কি? মনোহর পারিকরের এ বক্তব্যের পরও দেশের রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবীরা মুখে কুলুপ এঁটে আছেন কেন?
ক্ষমতায় থাকার জন্য, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এবং ব্যক্তিগতভাবে কিছু অর্থকড়ির জন্য আমরা যতই ভারতকে নিয়ে লাফালাফি করি না কেন, দক্ষিণ এশিয়ায় দেশটির অবস্থান কোন পর্যায়ে? বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়া নেপাল, পাকিস্তান, ভুটান, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান কোথায় ভারতের কী সম্মানজনক অবস্থান আছে? এসব দেশে ইতোমধ্যেই চীন অর্থনৈতিক ভিত মজবুত করে ফেলেছে। শি জিনপিংয়ের জাদুকরি নেতৃত্বের জন্যই সেটা সম্ভব হয়েছে।
দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের দিকে তাকালে কী দেখি? মোহাম্মদ নাশিদকে ক্ষমতায় বসিয়ে আধিপত্যবাদের বিস্তার ঘটাতে চেয়েছিল ভারত। দিল্লির পুতুল হিসেবে গণতন্ত্রের লেবাসে নাশিদ জনগণের বদলে দিল্লির মনোরঞ্জনে বেশি ব্যস্ত ছিল। মালদ্বীপের সাধারণ জনগণ সেটা মেনে নেয়নি। পরিণতিতে যা হওয়ার তাই হয়েছে। নাশিদ ক্ষমতা হারিয়ে দেশছাড়া; প্রেসিডেন্ট হয়েছেন আবদুল্লাহ ইয়ামিন। তিনি ক্ষমতায় এসেই জনগণের প্রত্যাশার কথা বিবেচনায় নিয়ে মালদ্বীপের বন্ধু দেশের সংজ্ঞা বদলে ফেলেছেন। ভারতের বদলে এখন চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছেন। ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে এখন চীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা ব্যাপকভাবে প্রসারিতই হচ্ছে। মালদ্বীপ ও চীন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কয়েক বছর ধরে মালদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলের দ্বীপ গাদহতে চীনের সহায়তায় একটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৪ সালে মালদ্বীপ সফর করেন। তখন জাদুকরি নেতৃত্বের কারণেই তিনি মালদ্বীপের জনগণের মনে রেখাপাত করেন। ওই সময় দু’দেশের মধ্যে বিমানবন্দর উন্নয়নের চুক্তি করা হয়। অথচ মালদ্বীপের বিমানবন্দর উন্নয়ন চুক্তি হয়েছিল ভারতের সঙ্গে। চীনের সঙ্গে চুক্তির আগে ভারতের সঙ্গে বিমানবন্দর উন্নয়নের সেই চুক্তি বাতিল করে দেয়া হয়। ওই সময় ৬০০ মিলিয়ন আরএমবির (চায়নিজ মুদ্রা) অবকাঠামো উন্নয়ন, ২০ মিলিয়ন আরএমবির সামরিক সহযোগিতা ও অন্যান্য সহযোগিতার আওতায় বিভিন্ন সেবা খাতে বিনিয়োগের জন্য আরো ২০ মিলিয়ন আরএমবির চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। মালদ্বীপের রাজধানী মালের কাছে একটি দ্বীপ অবকাশ যাপন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ৫০ বছরের লিজ নেয় চীন। এসব অর্থনৈতিক উদ্যোগ বহুল আলোচিত চীনের ‘মেরিটাইম সিল্ক রোড’ ডকট্রিনের অংশ। দু’দেশের সম্পর্ক এমন পর্যায়ে গেছে যে, ২০১৭ সালে তিন লাখ চীনা পর্যটক মালদ্বীপ ভ্রমণ করেন।
আর ভুটান! ভুটানে ছিল ভারতের মিনি ক্যান্টনমেন্ট। অর্থনৈতিক, সামরিক দিক দিয়ে ভুটান চীনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারপরও ভুটানকে কাছে টানতে চাইছে চীন। ভৌগলিকভাবেই সাত লাখ মানুষের দেশ ভুটানের তিন দিকেই ভারত। আগ্রাসী নীতির কারণেই দেশটির জনগণ ভারতকে পছন্দ করছে না। রাজতন্ত্র থেকে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকারে আসা দেশটিতে ভারতের বিনিয়োগ থাকলেও জনগণ ভারতের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে। ভুটান-ভারতের সিকিমের কাছে চিনের সীমান্তের দোকলাম মালভ‚মিতে চীন রাস্তা তৈরির ইস্যুতে যখন ভারত-চীন মুখোমুখি; তখন দেশটির জনগণ চীনের দিকেই ঝুঁকে পড়ে। ষেখানে চীন ইতোমধ্যেই সড়ক নির্মাণ ও তিনটি হ্যালিপ্যাড নির্মাণ করেছে।
আফগানিস্তানে ভারতের বিনিয়োগ ও প্রভাব দুই-ই ছিল। মার্কিন-ইসরাইল-রাশিয়ার সহযোগিতায় আফগানিস্তানে জায়গা করে নেয় ভারত। এখন ভারতের সেই অবস্থান আগের পর্যায়ে নেই। কারণ আফগানিস্তানে যখন যে ক্ষমতায়, তখন তার সঙ্গে সম্পর্ক করে টিকে থাকার চেষ্টা করেছে দিল্লি। আফগান জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার কোনো চেষ্টা করেনি। পাহাড়-পর্বতের ওই দেশের জনগণ ভারতের এই নীতি পছন্দ করেনি। এখন আফগানিস্তান থেকে ভারতের পালায়নপর অবস্থা। অন্যদিকে সেখানে চীনের বাণিজ্য হু হু করে বাড়ছে। আফগানিস্তানে চীনের কেবল বিনিয়োগই বাড়ছে তা নয়; পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সমঝোতা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। সেই উদ্যোগ আফগানিস্তানে চীনের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চিত্রেই বোঝা যায়।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের ভ‚মিকা ন্যক্কারজনক। বাংলাদেশ সবসময় ভারতের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে; সহায়তা করেছে। দিল্লি যখন যা চেয়েছে, ঢাকা অকাতরে দিয়ে দিয়েছে। অথচ যখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ গোটা বিশ্ব বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে; তখন মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে ভারত। রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘে ভারত ভোট দেয়নি বাংলাদেশের পক্ষে। যখন রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাড়িঘর আগুন দেয়া হয়; হাজার হাজার রোহিঙ্গা আত্মরক্ষায় পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়; তখন নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে খুশি করতে নেপোদি সফরে যান। তিনি মিয়ানমারের শাসক ও নোবেল জয়ী সু চি’র পাশে থাকার অঙ্গিকার করেন। সারাবিশ্বের কাছে মিয়ানমার যখন ঘৃণিত দেশ, মিয়ানমারের মিলিটারিরা যখন ধিকৃত হচ্ছেন; জাতিসংঘ তাদের নিষিদ্ধ করে বিচারের চিন্তাভাবনা করছে; বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জেনারেলদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে; তখন গেরুয়া পোশাকের নরেন্দ্র মোদি তাদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন; পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন। বিনিময়ে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। মিয়ানমারেও চীনের আধিপত্য এখন ব্যাপক। মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দর পরিচালনা করছে চীন। ওই দেশে চীনের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। রাখাইনের তেল, গ্যাস ও বন্দর উন্নয়ন কর্মকান্ডে বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে চীনের। শুধু তাই নয় চীনের অস্ত্র কিনছে মিয়ানমার।
ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে যুগের পর যুগ ধরে নেপাল নির্ভরশীল ছিল ভারতের ওপর। সেই নেপাল হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র থেকে সংবিধান সংশোধন করে ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রে রুপান্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার পর দিল্লিকে থোড়াই কেয়ার করছে। নেপালের রাজা বিরেন্দ্র পরিবারকে হত্যার পেছনে এখনো ভারতকে দায়ী করা হয়। এ ছাড়াও নেপালি কংগ্রেস এবং কিছু নেতাকে আর্থিক সহায়তা, উলঙ্গভাবে সমর্থন করায় ওই সব ব্যক্তি দেশের জনগণের বদলে দিল্লির স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এ জন্য নেপালিরা ওই নেতাদের চিহ্নিত করেছেন; ভারতকে অপছন্দ করছেন। তার প্রমাণ মিলেছে ভারত সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার পরও নেপালের জনগণের দিল্লির কাছে মাথা নত না করার ঘটনা। হিমালয়ের পাদদেশের দেশটি পর্যটনের উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে দাবিয়ে রেখেছিল ভারত। সেই নেপাল এখন ঝুঁকে পড়ছে চীনের দিকে। দেশটি নতুন অর্থনৈতিক মিত্র হিসেবে পেয়েছে চীনকে। ইতোমধ্যেই নেপাল ও চীন একাধিক বাণিজ্যিক চুক্তি করেছে। নেপালের সর্বত্রই ক্রমবর্ধমান চীনা উপস্থিতি এখন দৃশ্যমান। ৩৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে কাঠমান্ডুর নতুন পুলিশ একাডেমি নির্মাণ হয়েছে; যার পুরোটাই চীন উপহার হিসেবে দিয়েছে। নেপালে এখন চীন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নিজের জীবন কাহিনী তুলে ধরে বলেছিলেন, আমি কৃষকের সন্তান। আমজনতা থেকে উঠে এসেছি। নেপালের সাধারণ মানুষের বেশির ভাগই কৃষকের সন্তান। তারা শি জিন-এর ওই ভাষণ নেপালিরা দারুণভাবে গ্রহণ করেছে। চীনা প্রেসিডেন্টের ইমেজ অন্যরকম ইমেজ তৈরি হয় নেপালে। তা ছাড়া বাণিজ্যের আড়ালে চীনারা কখনোই কোনো দেশের রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা না করায় চীনকে আরো নেপালের কাছাকাছি নিয়ে গেছে। গত নির্বাচনে নেপালে কমিউনিস্টদের বিজয়ের বড় কারণ দেশটির জনগণের ভারত বিরোধী অবস্থান। নেপালের সংবিধান সংশোধন ইস্যুতে ভারতের সীমান্তের আরোপিত অবরোধে নেপাল ওধুষ, জ্বালানি সঙ্কটে পড়ে। তখন চীন নেপালের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। এখন বলা যায়, প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের ওপর নেপালের নির্ভরশীলতা কমে গেছে।
শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সময় ভারত তামিল নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণকে গোপনে সহায়তা করত। তামিলরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় এটা করে শ্রীলঙ্কাকে অস্থিতিশীল করে রাখার চেষ্টা করে চানক্য নীতির দেশ ভারত। এখন যে শ্রীলঙ্কায় দাঙ্গা চলছে তার নেপথ্যে রয়েছে ভারতেই হাত। শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের চীনের সহায়তা নিয়েই তামিলদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন দমন করেছেন। সেই শ্রীলঙ্কায় বিমানবন্দরের অধিকার পাওয়ার লড়াইয়ে দক্ষিণ জমে উঠেছিল ভারত-চীনের ক‚টনৈতিক লড়াই। শ্রীলঙ্কা ভারত মহাসাগরে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর ৯৯ বছরের ইজারায় চীনের কাছে হস্তান্তর করেছে। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের ভাষায়, হাম্বানটোটা ভারত মহাসাগরের প্রধান একটি বন্দরে পরিণত হচ্ছে।
চীনের প্রভাবে ইতোমধ্যেই নেপালে ভারতীয় পণ্য ধাক্কা খেয়েছে; এখন শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপে একই অবস্থা। মালদ্বীপ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত এবং চীনের সঙ্গে ‘অবাধ বাণিজ্য চুক্তি’ করেছে। মালদ্বীপের বাজারের প্রতি এতদিন চীন মনোযোগী ছিল না; এখন চীন মালদ্বীপে পণ্য পাঠাতে শুরু করেছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশ চীন দীর্ঘদিন থেকে ভারত মহাসাগরে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে এসেছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চীন একের পর এক বিনিয়োগ করছে। তার উদাহরণ শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর। এই বন্দরে চীনের বিনিয়োগ দেশটির বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। চীনের এই বিনিয়োগ ভৌগলিক-রাজনৈতিক কারণে তাৎপর্যপূণ বটে। চীন বারবার বলে আসছে সমুদ্র বন্দরগুলোকে সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করার কোনো পরিকল্পনা নেই। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে কলম্বোতে চীন তার শক্তি প্রদর্শনের যে চেষ্টা করবে না সেটা উড়িয়ে দেয়া যায়? ভারতকে বাদ দিয়েই চীন যে মেরিটাইম সিল্ক রোড নির্মাণ করছে; এই রোডের উদ্দেশ্যই হলো- বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সামরিক উদ্দেশ্য হচ্ছে- বাণিজ্যিক স্বার্থের আড়ালে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতকে ঘিরে ফেলা। এ জন্যই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চীনের উপস্থিতি বেড়েই চলেছে।
পাকিস্তান শুরু থেকেই চীনের মিত্র। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা, নেপাল এখন অনেকটা ভারতের প্রভাবের বাইরে চলে গেছে। আফগানিস্তানে, মিয়ানমারে চীনের বিনিয়োগ বাড়ছে। এখন যদি মালদ্বীপেও বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে আড়ালে চীনের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়, তবে ভারতকে আরো শক্তভাবে ঘিরে ফেলা চীনের জন্য কঠিন হবে না।
দিল্লি মুখাপেক্ষী রাজনৈতিক দল, কিছু নেতা, বুদ্ধিজীবী ও সুশীলের নতজানু মানসিকতার কারণে ভারতের আধিপত্য বাংলাদেশে এখনো বিদ্যমান। বন্ধু দেশের জনগণ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ কী চায় প্রতিবেশী দেশ হিসেবে দিল্লির শাসকরা সেটা বোঝার চেষ্টা করেনি। বরং যখন যে দল বাংলাদেশের সরকারে এসেছে, সে দলকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বা বর্তমান সরকারের অবস্থা নিয়ে ভারতের ভ‚মিকা সবার জানা। বিএনপির শাসনামলেও জাতীয়তাবাদী পুরো দলটিকে ব্যবহার করতে না পারলেও বিএনপির কিছু নেতাকে পকেটস্থ করতে পেরেছিল দিল্লির সাউথ বøক। জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্ব না করা দিল্লির ভুল ক‚টনীতির কারণেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী অবস্থান সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভারতের নাম শুনলেই মানুষ খিস্তিখেউড় করেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, নেপাল, শ্রীলঙ্কায় ভারতের অবস্থান গৌণ হয়ে গেছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে জনগণের মধ্যে মার্কিন হটাও, ভারত হটাও আওয়াজ উঠেছে। সার্বিক পরিস্থিতির আলোকে বলা যায়, আগ্রাসী নীতি ও ভুল ক‚টনীতির কারণে ধীরে ধীরে দক্ষিণ এশিয়ায় বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে ভারত। একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া কোথাও তারা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। যদিও বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। চীন বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হচ্ছে। গত বছর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের সময় প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি এবং দেশের অবকাঠামোগত খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ হয়েছে। চীন থেকে সাবমেরিন ক্রয় করেছে বাংলাদেশ। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশ চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার আড়ালে ভারতীয় বলয় থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। আর বাংলাদেশের জনগণ? দিল্লির আগ্রাসী নীতির কারণে এ দেশের সাধারণ মানুষ ভারতকে পছন্দ করে না। ব্যবসা ও সংস্কৃতির নামে ভারত এ দেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। এ জন্য তারা এ দেশে এজেন্ট তৈরি করেছে। অথচ চীন হলো বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী দেশ। দীর্ঘদিন থেকে চীন বাংলাদেশে বাণিজ্য করছে এবং বড় বড় প্রকল্প নির্মাণ করছে। অথচ বাণিজ্যের আড়ালে কখনো বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেনি। এ জন্য দেশের সাধারণ মানুষ চীনের প্রতি সহানুভ‚তিশীল। অবশ্য বিষয়টি দেশের রাজনীতিকরা বোঝেন না, সেটা মনে করার কারণ নেই।