রাজনীতিতে বিষধর কালো সাপ ফণা তুলছে
পীর হাবিবুর রহমান
অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না। সম্প্রতি বেপরোয়া বাসচালকদের হত্যাকাণ্ডে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব ও মিমের নির্মম মৃত্যুর প্রতিবাদে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যে উত্তাল আন্দোলনে দেশ কাঁপিয়ে দিয়েছে তা এক বিস্ময়কর আকাশছোঁয়া অর্জন।
পরিবহন সেক্টরে অনিয়ম-নৈরাজ্যের খবর সবার জানা ছিল। চালকরা বেপরোয়া গাড়ি চালান, লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি নিয়ে ঊর্ধ্বগতিতে ছোটেন, মালিকরা ফিটনেসবিহীন গাড়ি মুনাফার লোভে রাস্তায় নামান, লাইসেন্সহীন চালকদের হাতে তুলে দেন, ট্রাফিক পুলিশ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। পথে পথে লেনদেন চলে। বিআরটিএতে অনিয়ম-ঘুষ বাণিজ্য চলে। সহজে মেলে লাইসেন্স। কখনো ভুয়া লাইসেন্স। যানবাহন চলাচলে আইন লঙ্ঘনের খবরসহ সব অনিয়ম মানুষের জানা ছিল। কিন্তু দুই শিক্ষার্থীর সড়ক হত্যায় অকালমৃত্যুতে দ্রোহের আগুনে প্রতিবাদী স্লোগান তুলে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে দীর্ঘদিনের জমানো অনিয়মের যে চিত্রপট জাতির সামনে তুলে ধরেছে তার চেহারা যেমন বীভৎস, তেমন সবার জন্য গ্লানি, লজ্জা ও বেদনার। রীতিমতো অনিয়মের পাহাড় তুলে প্রকাশ্যে এনেছে তারা। তারা লাইসেন্স চেক করেছে, গাড়ির কাগজপত্র দেখেছে, সুশৃঙ্খলভাবে কীভাবে যানবাহন সড়কে চলাচল করতে হয়, তা শিখিয়ে দিয়েছে। এই শিক্ষা কেবল ট্রাফিক পুলিশের জন্য নয়, গোটা দেশের মানুষের জন্যও টনক নাড়িয়ে দেওয়ার মতো।
সড়কে নিয়মবহির্ভূতভাবে দায়িত্বশীলরা উল্টো পথে গাড়ি নিয়ে ছোটেন। কর্তব্যপরায়ণরা লাইসেন্সবিহীন গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করেন। ক্ষমতাধর ও সরকারি চালকদের লাইসেন্স থাকে না। এমনকি আইনের রক্ষকরাও না রাখেন গাড়ির লাইসেন্স, না রাখেন নিজেদের ড্রাইভিং লাইসেন্স। মোট কথা নিয়ম না মানার ঔদ্ধত্য সংস্কৃতির চরম রুগ্ন চিত্রপট তারা রাস্তায় নেমে হাতেনাতে ধরিয়ে দিয়েছে।
সমাজের মুখোশ উন্মোচনকালে এই আন্দোলনে দেখা গেছে শুধু অশিক্ষিত গাড়িচালকরাই লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামেন না, উচ্চশিক্ষিত দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও লাইসেন্সহীন, চালক ও গাড়ি নিয়ে রাস্তা দাবড়ে বেড়ান। গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রবল জোরে ঝাঁকুনি দিয়েছে যে কিশোর-কিশোরীরা তারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়। তারা কাউকে ক্ষমতা থেকে নামাতে বা কাউকে ক্ষমতায় বসাতেও রাজপথে নামেনি। তারা স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ মুখরিত করেছে, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। হাতে লেখা হৃদয়কাড়া পোস্টারে স্লোগান তুলেছে, ‘রাস্তা বন্ধ, রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে’। তাদের স্লোগান ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়েছে, উদাসীন রাষ্ট্রকে সজাগ করেছে, নির্বিকার প্রশাসনকে কাঁপিয়ে দিয়েছে, আইন প্রণেতাদের কর্মতৎপর করেছে। মোট কথা নাগরিক, পরিবার, সমাজ ও প্রশাসনযন্ত্রকে সবার ব্যর্থতার তীরে বিদ্ধ করেছে। সবার বিবেকের দরজায় সজোরে কড়া নেড়েছে। এই আঘাত সরকারকেই নয়, সব রাজনৈতিক শক্তি, প্রশাসন থেকে নাগরিকসমাজকেও করেছে। বলেছে, আইন লঙ্ঘনের দিন শেষ। অনেক হয়েছে আর সহ্য করবে না দেশ। আমরাই বাংলাদেশ।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে উত্থাপিত দাবিগুলোকে সরকার যৌক্তিক বলে মেনেই নেয়নি, খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে উদ্যোগী হয়ে নিহতদের পরিবারকে ডেকে সমবেদনা ও আর্থিক অনুদান দিয়েছেন, কলেজকে দিয়েছেন পাঁচটি বাস, সড়ক পরিবহন আইন অনুমোদন দিয়েছেন মন্ত্রিসভায়, ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিষিদ্ধ করেছেন, স্কুল-কলেজের সামনে স্পিডব্রেকার, জেব্রা ক্রসিং ও আন্ডারপাস নির্মাণের ঘোষণাই দেননি, আইন ও নিয়মনীতি তৈরি করেছেন। অনুমোদিত আইন পাস হলে সড়ক দুর্ঘটনা তদন্তে হত্যা প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হবে।
আমরা জানতাম, আমাদের সন্তানরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকায়, ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না হওয়ায় দেশ ও সমাজ নিয়ে ভাবে না। স্মার্টফোন, ফাস্টফুড আর পশ্চিমা সংগীতের প্রতি অনুরক্ত। কিন্তু নেতৃত্বহীন, স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে উত্তাল বালক-বালিকারা রাজপথে সমুদ্রের গর্জন তুলে, ট্রাফিকব্যবস্থাকে হাতে তুলে নিয়ে পরিবহনে চরম অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, নৈরাজ্যের চিত্র তুলে এনে জানিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে জড়িত সব শক্তি, সমাজপতি, সিভিল সোসাইটি এমনকি গণমাধ্যমও ঘুমিয়ে ছিল। আর তারা ছিল সজাগ-সতর্ক। নিজস্ব মেধা, মনন ও সৃজনশীলতায় আন্দোলনের মহাপ্লাবন ঘটিয়ে সরকার ও দেশের জনগণের সমর্থনই আদায় করেনি, সবাইকে জবাবদিহির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। অনিয়মের চিত্রপট তুলে ধরে জানিয়ে দিয়েছে, এ দেশ এভাবে চলতে পারে না। আইন ও বিধি-বিধান অনুযায়ী সংবিধানের আলোকে সবাইকে শ্রদ্ধাশীল হয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে বাস করতে হবে। কাজ করতে হবে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে কীভাবে সমাজে শৃঙ্খলাবোধ ফিরিয়ে আনা যায়, তা রাস্তায় নেমে তারা দেখিয়ে দিয়েছে।
পরনে স্কুল ইউনিফর্ম, পিঠে ব্যাগ, একটাই ছিল তাদের পরিচয়, তারা শিক্ষার্থী। কী নির্মোহ এক সামাজিক আন্দোলনের ঢেউ তুলেছে তারা, যে ঢেউ বহির্বিশ্বের গণমাধ্যমও অস্বীকার করতে পারেনি। যে ঢেউ সংহতি জানাতে পশ্চিমবঙ্গের স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের রাজপথে নামিয়েছে। তাদের মধ্যে গভীর দেশপ্রেম ছাড়া কোনো মতলব ছিল না। আর তাই তারা অকপটে স্লোগান তুলেছে, ‘যদি তুমি ভয় পাও, তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবেই তুমি বাংলাদেশ’। তারা প্রমাণ করেছে, ইতিহাসের সঙ্গে তাদের আত্মার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তারা আমাদের গৌরবময় ভাষা আন্দোলনের শহীদ সালামের উত্তরাধিকার। তারা ঊনসত্তরের আসাদের রক্তেভেজা শার্ট। তারাই জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অমিত সাহস ও দেশপ্রেমের উত্তরাধিকার। তারাই সম্ভাবনাময় সোনার বাংলাদেশ।
শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে বাংলা মিডিয়াম থেকে ইংলিশ মিডিয়াম সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছেলেমেয়েরা দাবানলের মতো অগ্নস্ফুিলিঙ্গ জ্বালিয়েছে। এরাই আমাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের উত্তরাধিকারিত্ব নিয়ে জানান দিয়েছে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির দোরগোড়ায় আমরাই এই প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা। তাদের আন্দোলনের শেষলগ্নে রাজনীতির অশুভ গ্রহণ লেগেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে মতলববাজরা গুজবের পর গুজব ছড়িয়েছে। গুজব ছড়িয়ে এই শান্তিপূর্ণ, নির্মোহ আন্দোলনকে সহিংসতার পথে ঠেলে দিতে বা কেউ কেউ সরকার পতন বা সরকারবিরোধী আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিতেও নিষ্ঠুর খেলা খেলেছেন। অনেকে রসিকতা করে বলেছেন, কিছু ঘটলেই বিরোধী দল মনে করে সরকার পরিবর্তন আন্দোলন শুরু হলো। আর বামপন্থিরা মনে করেন বিপ্লব শুরু হয়েছে। কিন্তু এটি ছিল গোটা দেশকে কাঁপিয়ে দেওয়ার বিপ্লব। জাগিয়ে দেওয়ার বিপ্লব।
সরকারি দল বলে আসছে, বিএনপি কোটা আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে এদের ওপর ভর করেছে। ছাত্রদল-শিবির যুক্ত হয়েছে। বিএনপি নেতাদের টেলিফোন সংলাপও জনসমক্ষে এসেছে। গুজব ছড়ানোদের কেউ কেউ আটক হয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতাধর আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও তাদের দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে যে হামলা পরিচালিত হয়েছে তার জন্য দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শিক্ষার্থী নয়, দুর্বৃত্তদের দায়ী করেছেন। এই দুর্বৃত্তদের গ্রেফতারের দায়িত্ব সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর, তেমনি শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের পাশে হাঁটা দেশীয় অস্ত্রসহ যারা হামলা চালিয়েছে, হেলমেট পরে যারা কর্তব্যরত সাংবাদিকদের নির্মমভাবে রক্তাক্ত করেছে তাদের ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এই অপরাধীদের, এই সন্ত্রাসীদের, এই হামলাকারীদের, এই গুন্ডাদের উন্মত্ততা দেশ দেখেছে।। এক পক্ষ বলছে, এরা বিএনপি ও ছাত্রশিবিরের কর্মী। আরেক পক্ষ বলছে, সরকারি দলের কর্মী। আমাদের কাছে এরা কেবলই হামলাকারী। এদের গ্রেফতার করে বিচার নিশ্চিত করা সময়ের দাবি।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলমের বাসভবনে হামলা হয়েছে। ঢাকাস্থ বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের গাড়িতে রাতের অন্ধকারে হামলা চালানো হয়েছে। এসব ঘটনা দেশের মানুষকেই উদ্বিগ্ন করেনি, আতঙ্কগ্রস্ত করেনি, বাইরের দুনিয়ায় দেশের ভাবমূর্তিকেও ক্ষুণ্ন করেছে। সবার নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সরকারপক্ষ বিরোধীদের, বিরোধী দল সরকারি দলের দিকে ইঙ্গিত করেছে। কিন্তু প্রশ্ন সরকার কেন চাইবে পরিস্থিতি অশান্ত করতে? বিরোধী দল কেন এটা করবে? শক্তিই বা কোথায়? তাহলে কারা শেখ হাসিনার দলীয় অফিসে, বার্নিকাটের গাড়িতে, বদিউল আলমের বাসবভনে হামলা করেছে? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তৃতীয় পক্ষ ঢুকে পড়েছে। রাজনীতিতে ‘তৃতীয় পক্ষ’ যুগে যুগে অশনিসংকেত। অশুভ বার্তা। এদের গ্রেফতার করা হোক। তদন্ত হোক। বিচার হোক। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরাও রাজপথে নেমে যাওয়ায় রবিবার ও সোমবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। উদ্বিগ্ন মানুষের চোখেমুখে প্রশ্ন— কোন পথে হাঁটছে প্রিয় স্বদেশ? জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে কালো বিষধর সাপ নিয়ে কারা খেলতে নেমেছে? এই সংঘাত-সংঘর্ষের শেষ কোথায়? স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশি হামলা কারও কাম্য নয়। সন্ত্রাসী, অপরাধী যারা শিক্ষার্থীর পোশাক পরে চাপাতি, লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ অ্যাকশনে যাক। নৈরাজ্য, সহিংসতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে দেওয়া যায় না।
সরকারের অনেকেই দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুবাদে এক ধরনের উন্নাসিক আচরণ, দাম্ভিক, দায়িত্বহীন বক্তব্যে মানুষকে দিনের পর দিন ব্যথিত করছেন, ক্ষুব্ধ করছেন। সরকারি দলের ছায়ায় অনেকে অবাধ লুটপাট করছেন। সরকারের ছায়ায় থাকা সব পেশার একদল সুবিধাভোগীও নিজেদের আখেরই গোছায়নি, ডেমকেয়ার ভাব নিয়ে মানুষের মনে ক্ষোভ ও অসন্তোষ জন্ম দিয়েছে। আন্দোলনে এরা বিচলিত হয়। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে নিরাপদে যায়। প্রধানমন্ত্র্রীকে সামাল দিতে হয় সব।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কেবল সড়ক হত্যাকাণ্ডের শিকার দুই ছাত্রছাত্রীর নিহত হওয়ার অগ্নিরোষই নয়, দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। বুকের ভিতর জমে থাকা গণঅসন্তোষের আছড়ে পড়া ঢেউ। এ ক্ষোভ শুধু বর্তমান সরকারের আমলেই পুঞ্জীভূত হয়নি, বিগত দিনেও যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, প্রশাসনযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারাও এ দায় এড়াতে পারেন না। দিনে দিনে বাড়িয়াছে দেনা। সেই দেনা-পাওনার হিসাব চলছে মানুষের মনে। সরকার ও বিরোধী দলসহ রাজনৈতিক, সামাজিক সব শক্তিকে মানুষের মন ও মুখের ভাষা শোনার সময় এখন চূড়ান্তলগ্নে। এ দায় একা কারও নয়। কোনো দলের একক দায় নয়। সব রাজনৈতিক দলের। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের। এমনকি গণমাধ্যমেরও। কারণ পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে, সরকার, বিরোধী দল ও গণমাধ্যম কারও কথাই মানুষ বিশ্বাস করছে না।
সামরিক শাসনের দীর্ঘ জাঁতাকলে গণতন্ত্রের আকুতি নিয়ে, হাহাকার নিয়ে মানুষ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। সামরিক শাসনের কবল থেকে রক্ত দিয়ে অর্জিত গণতন্ত্রের রূপ ও চেহারা দিনে দিনে ধূসর ও বর্ণহীন হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভঙ্গুর রূপ নিয়েছে। দেশের মানুষ ও প্রকৃত ব্যবসায়ীরা নানামুখী হয়রানির শিকার হন। স্বল্প টাকার কৃষিঋণের জন্য কৃষকের কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে নেওয়া হয়। অন্যদিকে প্রকৃত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা বিরাট জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেন। দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখেন। অন্যদিকে আরেক দল যখন যারা ক্ষমতায় আসেন তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে শেয়ারবাজার ও ব্যাংকের টাকা লুট করে নিয়ে যান। তাদের হাতে হাতকড়া পরানো হয় না। বিচারের মুখোমুখি হয়ে জেল খাটা দূরে থাক, উল্টো লুটের টাকার মধ্যে বিলাসী জীবনে গা ভাসান। বিদেশে টাকা পাচার করেন, সম্পদ গড়েন, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ছত্রচ্ছায়ায় অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ যেমন জমতে জমতে পাহাড়, তেমন মানুষের বুকের ভিতরে ক্ষোভের বারুদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়, সোনা কমে যায়, কয়লা-পাথর তামাদি হয়ে যায়, নির্বাক মানুষ কেবল দেখে যায়। সব ক্ষেত্রে আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। একজন পুলিশ কনস্টেবল থেকে সরকারি অফিসের পিয়নের চাকরি নিতে গেলেও ঘুষ-বাণিজ্যের রমরমা হাটে গরিবের সন্তানদের টাকা দিয়ে চাকরি নিতে হয়। অনেক জনপ্রতিনিধি এলাকায় নিজেদের সিন্ডিকেট গঠন করে শত বিতর্কের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। সরকার আসে সরকার যায়, এই সিন্ডিকেটের সর্দার পরিবর্তন হয়, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও লুটপাটের অবসান হয় না। মানুষের মধ্যে যুগের পর যুগ অসন্তোষ বিরাজ করে। আমলাতন্ত্রের লাল ফিতা যেমন সহজে খোলে না, তেমন অনেক জায়গায় ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না। রাজনীতি, প্রশাসন, পরিবহন খাতসহ সব পেশার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ উত্তম। সংখ্যালঘু একটি গোষ্ঠী আইন লঙ্ঘন, দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার দম্ভে উন্মত্ত থাকে। এরাই গোটা সমাজকে কলুষিত করছে। এদের দেখলে মনে হয়, বঙ্গবন্ধু এত সংগ্রাম করে এত আত্মত্যাগ করে জনগণের এত রক্তে দেশ স্বাধীন করেছিলেন এই সুবিধাবাদী নির্লজ্জ লুটেরা নীতিহীনদের দৌরাত্ম্য দেখার জন্য।
পরিবহন খাতের অনিয়ম-নৈরাজ্য নিয়ে প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়েছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। এখনো তারা ভোটারই হয়নি, কিন্তু গোটা দেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, সেখানেই তার নিদ্রা ভাঙিয়ে জানতে চেয়েছে ওখানে অনিয়ম চলছে সমাধান হবে কিনা? একটি খাতের ঝাঁকুনিতে শুধু এ খাতই সংস্কার হলে হবে না, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সব খাতে সংস্কার আজ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। দেশের শিক্ষা খাত, স্বাস্থ্য খাত, অর্থনৈতিক খাত, প্রশাসনিক খাতসহ সব খাতেই এ ঝাঁকুনি লেগেছে। সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী ফেসবুক বন্ধ করার কথা অতীতেও বলেছেন, বর্তমানেও বলছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যত সাফল্য ও অর্জন তার অন্যতম একটি দেশে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব ঘটিয়ে দেওয়া এবং তৃণমূল মানুষকে ইন্টারনেট ও মোবাইল সুবিধা ভোগ করতে দেওয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য সহিংসতা ঘটানোর জন্য, কারও চরিত্রহননের জন্য তৎপরতা চালাচ্ছে তাদের সংখ্যা হাতে গোনা, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে দম বন্ধ করতে যাবেন না। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে ফেসবুক বন্ধ করে দিতে বলেছেন। এবার স্বয়ং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী বলছেন, এটা করবেন না। গণতন্ত্র নিয়ে আইনস্টাইন বলেছিলেন, সব জানালা খুলে দাও। কারণ সব জানালা-দরজা বন্ধ করে দিলে মানুষই দমবন্ধ হয়ে উঠে বাঁচার জন্য শেষ চেষ্টাই করে না, তখন মুখে মুখে গুজব ভয়ঙ্কর শক্তি নিয়ে ছড়িয়ে যায়। আর সত্য সুন্দর হারিয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চারিত্রিক গুণাবলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তিনি মিডিয়াবান্ধব। তার স্বভাবসুলভ চরিত্রের বড় দিক তিনি কোনো রাগ-অভিমান পুষে রাখেন না। বলে ফেলেন। এ দেশে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে তার হাত ধরেই। এ সরকারের আমলে লাইসেন্স পাওয়া ইলেকট্রনিক মিডিয়া শেখ হাসিনাকে ছেড়ে যায়নি। তবু কোনো কোনো অতিউৎসাহী ক্ষমতার উগ্র মূর্তি নিয়ে শেখ হাসিনার দুর্দিনে যারা পাশে থাকেন তাদের পরিচালিত টেলিভিশনে চিঠি পাঠান। তারা চান ভ্রান্ত পথে হাঁটতে। এ দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ সামরিক শাসন জাতিকে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিয়েছে, সেনাশাসনের চেয়ে ভঙ্গুর গণতন্ত্র অনেক উত্তম। সেনাসমর্থিত সুশীলের মানুষ অপমান করার ওয়ান-ইলেভেন সরকার জানিয়ে দিয়েছে এই জনবিচ্ছিন্ন সুশীলের চেয়ে রাজনীতিবিদরাই মানুষের প্রকৃত বন্ধু। তাদের সময় দেশ পিছিয়েছে। তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ। আর তাদের বিদায়ের মধ্য দিয়ে গণরায়ে ক্ষমতায় আসা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে একুশ শতকের বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে। দেশে উন্নয়নের মহাকর্মযজ্ঞ সৃষ্টি হয়েছে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ এমনকি ধর্ম নিয়ে মানুষের আবেগ-অনুভূতিতে আঘাত করা নাস্তিকদের ব্যাপারেও শেখ হাসিনার সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গণমানুষের প্রত্যাশা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। যে নির্বাচনে মানুষ স্বাধীনভাবে বুক ফুলিয়ে ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’ এই আকুতি নিয়ে তার ভোট প্রয়োগ করতে পারে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দল চায় নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, স্বাধীন, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন ও দলনিরপেক্ষ প্রশাসনের ভূমিকা। এক কথায় শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন থেকে দেশের সকল শ্রেণি-পেশার অভিভাবকত্বের জায়গায় যারা রয়েছেন, তারা সংবিধান ও আইন, বিধি-বিধানের সঙ্গে, ইমানের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন এই শিক্ষাই আলো ছড়িয়েছে। রাজনৈতিক শক্তি, প্রশাসনিক শক্তি, গণমাধ্যম, সিভিল সোসাইটি এবং সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে সংবিধান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সৎ থাকার তাগিদ দিয়েছে। এ আন্দোলন ঘিরে দেশকে সংঘাত, সহিংসতা ও রক্তপাতের দিকে ঠেলে দেওয়া যায় না। নির্বাচন সামনে রেখে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যে আলো ছড়িয়েছে গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সেখান থেকে রাষ্ট্র মেরামতের কাজে সকল শ্রেণি-পেশার দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও নাগরিককে শুভবুদ্ধির উদয় ঘটিয়ে সচেতনভাবে ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসতে হবে।
আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যে কোনো সমস্যার তাত্ক্ষণিক সমাধান দিতে হবে। সমস্যার সমাধান না করে পথ হাঁটলে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। এবং একসময় তার গণবিস্ফোরণ ঘটে। ঈশান কোণে মেঘ জমছে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার সময় আরেকটি রাজনৈতিক ঝড়ের পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন এটাই মানুষের প্রত্যাশা। কিন্তু আয়নায় বিবেকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেদের চেহারা দেখে ভুলভ্রান্তি থেকে নিজেদের আত্মসমালোচনার মাধ্যমে সংশোধন করে সমাজজীবনে ভূমিকাই রাখবেন না, মানুষের সামনে গণমুখী চরিত্র নিয়ে মূল্যবোধ ও আদর্শিক চেতনা থেকে নতুন প্রজন্মের সামনে আইডল হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবেন, এটাই আন্দোলনের বড় শিক্ষা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে পর্দার অন্তরাল থেকে রাজনীতির কালো সাপ নিয়ে যারা খেলছেন তাদের মনে রাখা দরকার সেই সাপের বিষাক্ত দংশনে দংশিত হয় দেশ। রাজনীতিতে যে বিষধর কালো সাপ ফণা তুলছে আগে তাকে নিবৃত্ত করতে নির্বাচন সামনে রেখে সমঝোতা ও ভোট উৎসবের পথে অগ্রসর হওয়াই সবার জন্য উত্তম। আগুন নিয়ে খেলার পরিণতি ইতিহাসের কোনো বাঁকেই যেমন স্বস্তি বয়ে আনেনি, তেমন এও সত্য ক্ষমতা কারও জন্যই চিরস্থায়ী হয়ে থাকেনি। যখনই সরকার একগুঁয়ে, ভ্রান্ত নীতি নেয়, বিরোধী দল উগ্রপন্থা অবলম্বন করে, জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয় তখনই যুগে যুগে বিদেশি শক্তির নিয়ন্ত্রণে এই বিষধর কালো সাপ ছোবল মারে। বিষাক্ত হয়ে যায় গণতন্ত্র, দেশ ও মানুষ। আমরা চাই, উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় দেশ এগিয়ে যাক, সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে গণরায়ের প্রতিফলন ঘটুক। ব্যালটবিপ্লবে অভিষিক্ত হোক কার্যকর প্রাণবন্ত সংসদ। সব ইস্যুতে সেই সংসদ তুমুল বিতর্ক আর আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্র হয়ে উঠুক। সংবিধান, আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হোক। সংবিধান ও আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়, এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হোক। সব অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার, বিরোধী দলসহ সব রাজনৈতিক শক্তি ভূমিকা রাখুক। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিয়মিত হোক। সব নাগরিকের সমঅধিকার নিশ্চিত হোক। জনগণ ক্ষমতার মালিক এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হোক। সুমহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমাদের স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত বাংলাদেশ উন্নত-আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হোক। তাই ভোটের আগে কালো বিষধর সাপের ফণা তোলার আগেই সবাইকে একটি সমঝোতায় আসা সময়ের দাবি।
সবশেষে সবিনয় নিবেদন, গণমাধ্যমের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। আমরাও অনেকে দলবাজিতে ডুবেছি ফায়দা নিতে। মতলবে। কিন্তু যে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের সামনে হামলা হয়েছে তার পরিণতি ভালো নয়। এখনই দায়ীদের ধরুন, বিচার করুন।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন