রাখাইনের পরে কি আসাম?

March 25, 2018 10:07 pm0 commentsViews: 13

আমীন আল রশীদ

মিয়ানমারের রাখাইনে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের মতোই ভারতের আসাম রাজ্যের মুসলমানরাও বড় ধরনের সংকটে পড়তে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ করে দেশটির সেনাপ্রধানের একটি বক্তব্যের জেরে এই উদ্বেগ আরো বেড়েছে। যদি তাই হয়, তাহলে রোহিঙ্গার মতো আসামের মুসলিমদের এই সংকটেরও প্রধান ভিকটিম হবে বাংলাদেশ।

সম্প্রতি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে এক সেমিনারে সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত বলেছেন, ভারতের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসেবে পাকিস্তান পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ থেকে পূর্ব ভারতের রাজ্য আসামে মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে। আর পাকিস্তানকে এই কাজে সহায়তা করছে চীন।

অবশ্য সেনাপ্রধানের এই বক্তব্যের অনেক আগে থেকেই কথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের অভিযোগ নিয়ে উত্তপ্ত আসামের রাজনৈতিক অঙ্গন। কথিত অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে সেখানে সম্প্রতি একটি জরিপও করেছে সরকার। এতে যুক্ত হওয়ার জন্য তিন কোটি ২৯ লাখ মানুষের আবেদন জমা পড়েছিল। গত ৩১ ডিসেম্বর যে খসড়া প্রকাশিত হয়, তাতে এক কোটি ৯০ লাখ আবেদনকারীর নাম ওঠে। কিন্তু বাদ পড়েন এক কোটি ৩৯ লাখ মানুষ। যে তালিকা এখন যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

আশঙ্কার বিষয় হলো, আসামের এই নাগরিক নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় লাখ লাখ মানুষ ‘রাষ্ট্রহীন’ হিসেবে চিহ্নিত হলে দেশটির সবচেয়ে স্পর্শকাতর এই রাজ্যে রোহিঙ্গাদের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই নিবন্ধন প্রক্রিয়ার কারণ সেখানে অ-আসামীয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী জাতিগত দাঙ্গার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। কেননা, তালিকায় বাদপড়াদের মধ্যে সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রীসহ কয়েকজন পরিচিত মুসলিম নেতাও রয়েছেন। শুধু তাই নয়, কয়েকজন হিন্দু নেতাও তালিকাভুক্ত হতে পারেননি। বাদ পড়াদের মধ্যে বেশিরভাগই বাংলা ভাষাভাষী।

এ রকম বাস্তবতায় গত নভেম্বরে এক অনুষ্ঠানে আসামের সংগঠন জমিয়তে উলামা হিন্দ-এর নেতা মাওলানা আরশাদ মাদানি মন্তব্য করেছিলেন, আসাম হতে যাচ্ছে ভারতের রাখাইন। সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াতের মন্তব্যের পর সেই আশঙ্কা আরো তীব্র হলো মনে করে হচ্ছে।

সেনাপ্রধানের বক্তব্য নিয়ে দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফোরাম (এআইইউডিএফ) নেতা মাওলানা বদরউদ্দিন আজমলও বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের উত্থান-পতন নিরীক্ষণের দায়িত্ব সেনাপ্রধানকে দেওয়া হয়নি। তিনি সংবিধানে নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করেছেন।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৪ সালের লোকসভা ও ২০১৬ সালের রাজ্যসভা নির্বাচনের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসামে বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘অবৈধ নাগরিকদের প্রত্যাবাসন করা হবে না। তাদের নিজেদের ব্যাগ গুছিয়ে চলে যেতে হবে।’ তবে কোথায় যেতে হবে, তা পরিষ্কার করেননি তিনি। বলা হয়, ভোটের বৈতরণী পার হতে হিন্দুত্ববাদী অনুভূতি ও কট্টরপন্থী আসামি নাগরিকদের প্রতিরোধকে বাংলাদেশি অভিবাসনের বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছিলেন মোদি।

আশার সংবাদ হলো, মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা নিধনে যেমন পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রই তৎপর এবং সেখানে কোনো রাজনৈতিক দলের তরফে এই জাতিগত নির্মূল অভিযানের বিরোধিতা নেই, ভারতের ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্য রকম। যেমন আসাম থেকে কথিত অনুপ্রবেশকারী মুসলিমদের বিতাড়নের এই উদ্যোগের সমালোচনা এসেছে খোদ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর তরফেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরির জন্য ঘৃণ্য রাজনৈতিক চাল হিসেবে কেন্দ্রীয় ক্ষমতাসীন দল বিজেপি এসব করাচ্ছে। শুধু তাই নয়, মানবিক দিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করার জন্য ভারত সরকারের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছিলেন মমতা।

তবে ভারত ও মিয়ানমারের এই সংকটে একটি বিষয়ে অভিন্নতা লক্ষণীয়। তা হলো, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বিতাড়নের মূল ভূমিকাটি যেমন সে দেশের সেনাবাহিনী করছে এবং এই পুরো প্রক্রিয়ায় ইন্ধন দিয়েছেন খোদ দেশটির সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াং, তেমনি আসামের প্রসঙ্গেও যিনি বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন, তিনিও ভারতের সেনাপ্রধান। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল বিপিন রাওয়াত সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর এ নিয়ে দেশটিতে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। কংগ্রেস ও বাম দলগুলোর দাবি, দুজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে টপকে সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদে রাওয়াতকে বসানো হয়েছে।

মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের আরেকটি অমিলের জায়গা হলো, কার্যত সেনাশাসিত মিয়ানমারের গণমাধ্যম তাদের সেনাপ্রধানের উগ্রবাদী বক্তব্যের সমালোচনা করার সাহস না রাখলেও ভারতের সেনাপ্রধানের বক্তব্যের সমালোচনা করে সম্পাদকীয় ছেপেছে দেশটির প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলো। ‘দ্য হিন্দু’ লিখেছে, রাজনৈতিক ইস্যুতে সেনাপ্রধানের সতর্কভাবে কথা বলা উচিত। যেখানে আরো বলা হয়, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি যেসব দেশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ভারত তার সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে সফল হয়েছে। তাই সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত যে মন্তব্য করেছেন, তা যেকোনো বিচারেই অস্বাভাবিক।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত ‘পাকিস্তান মডেলের’ দিকে এগোচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছে আনন্দবাজার পত্রিকা। তারা লিখেছে, ‘যে সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতার ওপর নির্দ্বিধায় ভরসা করা চলে না, সেই বাহিনী দেশের পক্ষে অতি বিপজ্জনক।’ টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘একজন দায়িত্বরত সেনাপ্রধান হিসেবে জনসমক্ষে যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক মন্তব্য করা থেকে দূরে থাকা রাওয়াতের কর্তব্য। রাওয়াতের শব্দচয়ন এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে, যেন এআইইউডিএফ চীন-পাকিস্তানের প্রক্সি হিসেবে কাজ করছে।’

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তাদের সম্পাদকীয়র শিরোনাম দিয়েছে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’। এতে বলা হয়েছে, সেনাপ্রধানের মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ এবং বিরক্তিকর। স্বাধীন ভারতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অঙ্গন ও কর্তব্যরত সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি সীমারেখা আছে এবং একে শ্রদ্ধা করা হয়। পৃথককরণের এই ঐতিহ্য ভারতের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক হয়ে আছে।

ভারত যে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ, এ রকম কিছু ঘটনায় সেটি প্রমাণিত হয়। একটি ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের ক্ষমতাবান সেনাপ্রধানের বক্তব্য চ্যালেঞ্জ করে সম্পাদকীয় ছাপতে পারার অর্থ হলো, সে দেশের গণমাধ্যম যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করছে। তাই এই স্বাধীন গণমাধ্যমই আসামের মুসলামানদের ‘রোহিঙ্গা’ হওয়ার হাত থেকে বাঁচাবে, এমন প্রত্যাশা করাই যায়।

লেখক : সাংবাদিক।

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 400E Mosholu Parkway South Apt # A23,The Bronx, New York 10458, USA

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com