রহস্য বাড়ছে ফয়জুরকে ঘিরে
র্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশ এবং দেশের বাইরের আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য যে অ্যাপস ব্যবহরা করে সে অ্যাপসে অ্যাকাউন্ট খুঁজে পেয়েছে র্যাব। ‘টেলিগ্রাম’ নামের ওই অ্যাপসটি দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা ব্যবহার করে থাকে। এর বাইরে নানা বেনামি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে ফয়জুর জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে বলেও জানতে পেরেছে র্যাব। তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর বিভিন্ন লিঙ্কের শেয়ারও পাওয়া গেছে। এছাড়া দেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) বা আনসার আল ইসলামের বিভিন্ন পোস্ট ও লেখাও তার ফেসবুকে পাওয়া গেছে। এ থেকে গোয়েন্দারা ধারণা করছেন, ফয়জুর একজন ‘রিমোট কন্ট্রোল জিহাদি’। এ ধরনের জিহাদিরা অনলাইনের মাধ্যমে নির্দেশিত হয়ে নাশকতায় অংশ নেন। এদের সঙ্গে সরাসরি কোনো জঙ্গি গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা নেই। কিন্তু বিভিন্ন জঙ্গি গ্রুপ অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমেই এক বা একাধিক তরুণের সমন্বয়ে বিভিন্ন অপারেশন প্ল্যান করে। গত বছরের ১৫ আগস্ট পান্থপথের ‘ওলিও ইন্টারন্যাশনালে’র হামলায় জড়িত যুবকও ফয়জুরের মতই রিমোট কন্ট্রোল জিহাদি ছিল বলে জানান সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। সে আনসার আল ইসলামের মতাদর্শে বিশ্বাসী বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ড. জাফর ইকবালকে হত্যার পরিকল্পনা-সম্পর্কিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বেশ কিছু গোপন তথ্য প্রকাশ করে। ব্লগার রাজীব হত্যায় সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি রেদোয়ানুল আজাদ রানাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নানা পরিকল্পনার তথ্য বেরিয়ে আসে বলে জানায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সূত্র। ওই একই সূত্রের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ খবর আসে যে, মালয়েশিয়ায় বসে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল জঙ্গিরা। ওই পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) দুই জঙ্গি রেদোয়ানুল আজাদ রানা ও মোস্তাক। এ ব্যাপারে মালয়েশিয়ায় তারা মোবাইল ফোনে বিশেষ অ্যাপসের মাধ্যমে এসএমএস আদান-প্রদান করে। রানার মোবাইল সেট পরীক্ষা করতে গিয়ে জাফর ইকবালকে হত্যার পরিকল্পনা-সংক্রান্ত ওই এসএমএস পাওয়া যায়। ফয়জুরের ফেসবুকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বিভিন্ন লেখা ও পোস্ট পাওয়ার পর, এ হামলার পেছনে আনসারুল্লা বাংলা টিম জড়িত কি না, ফয়জুর এ গ্রুপের সদস্য কি না- সে ব্যাপারেও প্রশ্ন উঠেছে। যদিও ফয়জুর এখনো বলছে, সে একাই হামলা চালিয়েছে, তার সঙ্গে কেউ যুক্ত নয়। এটা তার গ্রুপের অন্যদের বাঁচিয়ে দেওয়ার কৌশল হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, ফয়জুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, একজন জঙ্গির আচরণ যেমন হয় সেভাবেই আচরণ করছে ফয়জুর। জিজ্ঞাসাবাদের সময় অনেক কিছুই সতর্কতার সঙ্গে সে এড়িয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দারা বলছেন, জাফর ইকবালকে হামলার আগে তোলা অনুষ্ঠানের প্রায় ছবিতেই ফয়জুরের চেহারা রয়েছে। হামলার আগে সে কয়েকবার ওই এলাকা রেকি করেছিল। অনুষ্ঠানের সময় জাফর ইকবালের পেছনে ফয়জুর একা নয়, তার সঙ্গে আরও দুজন দাঁড়িয়ে ছিল, যারা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয়। অনুষ্ঠানে অন্য শিক্ষার্থীদের মতই ফয়জুর কালো টি শার্ট পরে এসেছিল। ওই দিনের উৎসবে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের সবারই গায়ে ছিল কালো রঙের টি শার্ট। চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সিলেটের লিডিং, নর্থ ইস্ট ও মেট্রোপলিটান ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরাও অংশ নিয়েছিলেন ‘রোবো কমব্যাট’ উৎসবে। ফলে তাকে সন্দেহ কারার জো ছিল না।
হামলার সময় ফয়জুর যে একা ছিল না, সে ব্যাপারে অনেকেই একমত। এমনকি তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কেউ সহযোগিতা করেছে সে বিষয়টিও অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ ফয়জুর গোয়েন্দাদের কাছে স্বীকার করেছে এক বছর ধরে সে সুযোগ খুঁজছিল জাফর ইকবালকে হত্যা করার। ফলে জাফর ইকবালের গতিবিধির ওপর তার এবং তার দলের অন্য কারও গভীর নজর ছিল। এক্ষেত্রে ক্যাম্পাসের কেউ তার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। অনেকে বলেছেন, জাফর ইকবালের ওপর হামলার সময় তারা একজনকে মোটরসাইকেলে পালিয়ে যেতে দেখেছেন। গোয়েন্দারা বলছেন, তার পকেটে সাইকেলের চাবি পাওয়া গেছে। সিসিটিভি ফুটেজেও দেখা যাচ্ছে সে সাইকেলে করে ঘটনাস্থলে এসেছিল। কিন্তু পরে সে সাইকেলটি আর পাওয়া যাচ্ছে না। জাফর ইকবালকে হামলায় জড়িত আরও একজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও সে ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
এদিকে ফয়জুরের বাবা আতিকুর রহমান ও মা মিনারা বেগম আত্মসমর্পণ করলেও তার ভাইবোনদের কোনো হদিস মেলেনি। স্থানীয়দের বরাত দিয়ে পুলিশের একটি সূত্র বলছে, ফয়জুর ধর্মের কোন মাজহাবে বিশ্বাসী ছিল না। ‘লা মাজহাবি’ হিসেবে সে ধর্ম পালন করত। পরিবারের অন্যরাও একই মতাদর্শী বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে, সামান্য একটা ছুরি নিয়ে কেন ফয়জুর হামলা চালিয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, যারা সাধারণত ক্ষুদ্রাস্ত্র ব্যবহার না করে ছুরি-চাপাতির মতো অস্ত্র ব্যবহার করে জঙ্গি হামলায় অংশ নেয়, তাদের বলা হয় ‘কোল্ড আর্মস ব্যবহারী জিহাদি’। এদের আরেক নাম ‘ফুট সোলজার’। এটার অর্থ, এ ধরনের জঙ্গিরা সাধারণত টার্গেট করা ব্যক্তির কাছে হেঁটে যাবে। ধরা পড়ার আশঙ্কা থাকায় এরা অস্ত্র বহন এবং কেনা থেকে বিরত থাকে। এরা পরিবারের সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন না থেকেই চরম উগ্রপন্থি হয়ে ওঠে। একসময় নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করেই হামলার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়। ফয়জুর ঠিক সে ধরনের উগ্রপন্থি বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্যান্য সময় জঙ্গিবাদী হামলার পরপরই দায় স্বীকার করে বিভিন্ন সংগঠন বিবৃতি দিলেও জাফর ইকবালের ক্ষেত্রে কেউ দায় স্বীকার করেনি। সূত্র বলছে, জঙ্গি গ্রুপগুলো এখন আর দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয় না। কারণ দায় স্বীকার করে যারা বিবৃতি দেওয়ার কাজটি করত তাদের অধিকাংশই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। কেউ কেউ কড়া নজরবন্দিতে আছে। আবার এমনো হতে পারে, দায় স্বীকারের কৌশল থেকে সরে এসেছে জঙ্গিরা।