যুক্তফ্রন্ট বা ঐক্য প্রক্রিয়া, মতলব কী?
18 Sep, 2018
নির্বাচন যখন ঘনিয়ে আসে, তখন সব দেশেই নানা ধরনের নতুন নতুন রাজনৈতিক কর্মকা- মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই সময়টায় দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো কাউকে চটাতে চায় না। কে জানে কার হাতে কি ভোট আছে। নির্বাচনে জিততে যেহেতু ভোটেরই দরকার সবচেয়ে বেশি, তাই সবাইকে হাতে রাখতে চায়। আর এ সুযোগটাই নেয় ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো।
এ কথা অস্বীকার করার জো নেই, দেশে আসলে বড় রাজনৈতিক দল মাত্র দুটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এর পরই রয়েছে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান। জাতীয় পার্টিকে এখন অবশ্য আর সেভাবে বিরোধী দল বলা যাবে না, এরা আওয়ামী লীগের ‘অনুগত বিরোধী দল’-এ পরিণত হয়েছে। নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ যেভাবে যা চাইবে, জাতীয় পার্টি সেভাবেই কাজ করবে।
আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে থাকা এহেন জাতীয় পার্টিরও কিন্তু কিছু জনসমর্থন রয়েছে, কিছু ভোট রয়েছে। আর ভোট আছে জামায়াতে ইসলামীর। এ দলটির সমস্যা হচ্ছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এই দলের শীর্ষস্থানীয় অধিকাংশ নেতার ফাঁসি হয়েছে। দেশজুড়ে খুবই একটা প্রতিকূল অবস্থায় রয়েছে দলের নেতা-কর্মীরা। দল হিসাবে এদেরকে নিষিদ্ধ করা না হলেও প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করতে পারে না। তারও চেয়ে বড় কথা এদের নিবন্ধন নেই নির্বাচন কমিশনে। তাই এরা দলীয় পরিচয়ে কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে না।
যত বেকায়দাতেই থাকুক না কেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে ভোটের বিচারে ধর্তব্যের মধ্যে থাকা রাজনৈতিক দল কিন্তু এই দুটিই, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী। বাকি যা কিছু আছে, সেগুলো নামকা ওয়াস্তে। সেগুলোতে বড় বড় কিছু ব্যক্তির নাম হয়তো আছে, কিন্তু জনভিত্তি বলতে কিছু নেই। কিন্তু নির্বাচনের আগে এই ক্ষুদ্র দলগুলোই নানা বাগাড়ম্বরে নিজেদের অবস্থানকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখাতে চেষ্টা করে। নির্বাচনের আগে আগে আবার এই খুচরা দলের খুচরা নেতাদের গুরুত্ব কিছুটা বেড়ে যায়। দেখা যায়, নিজেদের তেমন কোনো ভোট না থাকা সত্ত্বেও রব, মঞ্জু, দিলীপ বড়ুয়া, মেনন বা ইনুদের মতো ব্যক্তিরাও কেবল জোটের সমীকরণে মন্ত্রী হয়ে যান। মন্ত্রী হয়েই দ্রুত পাল্টাতে থাকেন নিজেদের চেহারা, অবয়ব।
হয়তো সেই উদাহরণই উৎসাহ জুগিয়ে থাকবে বর্তমানের নবগঠিত দুই জোটকে। আসলে জোটের সংখ্যা নিয়েও একটা বিভ্রান্তি রয়েছে। প্রথমে দেখা গেল ডা. বি. চৌধুরীর বিকল্পধারা, আ স ম আবদুর রবের জেএসডি এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য মিলে একটা জোট হলো, নাম দেয়া হলো যুক্তফ্রন্ট। এর গঠন প্রক্রিয়া যখন চলছিল, অনেকে মনে করেছিলেন ড. কামাল হোসেনের গণফোরামও বুঝি এর সঙ্গে থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর থাকেনি। অথচ এরপর আবার দেখা গেল ওই তিনদলের সঙ্গে ড. কামালদের একাধিক বৈঠক হচ্ছে। সেখানে জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে। এদের সঙ্গে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকীর নামও শোনা গেল কয়েকবার।
এই যে যুক্তফ্রন্ট বা জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া এদের রাজনৈতিক আদর্শটি কি? অথবা নির্বাচনের এই আগমুহূর্তে এদের প্রধান চাহিদাটি কি? এসব প্রশ্ন বিভিন্নজনই করছেন। আবার নানা জন আর নিজেদের মতো করে জবাবও দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে এক কথায় যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে তা হচ্ছে বর্তমান সরকারের কর্মকা-ে তারা অতিষ্ঠ, তাই এর পতনের জন্য যা কিছু করা দরকার তারা করবে। সরকারকে ফেলে দিতে হলে সবচেয়ে বড় বিরোধীদলকে লাগবে, তাই তারা বিএনপির সঙ্গেও জোটবদ্ধ হতে চায়। এ ক্ষেত্রে বিএনপির দিক থেকে সমস্যা হচ্ছে, তাদের পুরনো মিত্র জামায়াতের তাহলে কি হবে? জামায়াতও কি থাকবে এই জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে? যুক্তফ্রন্ট কিংবা জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া আরও আগেই বলে দিয়েছে, তারা জামায়াতের সঙ্গে নেই। বিএনপি যদি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আসে, তাহলে তারা বিএনপির সঙ্গেও নেই। তাহলে বিএনপি এখন কি করবে? জামায়াতকে ছাড়বে কি করে? কারণ প্রায় ৫ থেকে ৬ শতাংশ ভোট তো জামায়াতের রয়েছে। সে তুলনায় যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া অনেক ছোট গোষ্ঠী। এদের সবার ভোট যোগ করলেও এক শতাংশ হবে না। আবার বিপরীত দিকে ৫ শতাংশ ভোট নিয়েও জামায়াত কিন্তু প্রকাশ্য রাজনীতিতে ইতিবাচক কোনো অবস্থানে নেই। প্রশাসন তো বটেই, এমনকি মিডিয়া পর্যন্ত তাদেরকে কোনো সমর্থন দেয় না। তারা ঘরোয়াভাবে কোনো মিটিং পর্যন্ত করতে পারে না। তাদের একটা মন্দ ইমেজ তৈরি হয়ে আছে, সেই ইমেজটিকে নানাভাবে টিকিয়ে রাখাও হচ্ছে। বিপরীত দিকে নতুন ওই দুই জোটের ভোট না থাকলেও তারা প্রকাশ্যে নানা রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করতে পারছে, মিডিয়াগুলোতে কভারেজ পাচ্ছে। এমন ত্রিশঙ্কু অবস্থায় কি করবে বিএনপি? তারা জামায়াতকে হারাতে চায় না ভোটের হিসাবের কারণে। আবার জামায়াতের নেতিবাচক ইমেজটিকেও নিজেদের গায়ে প্রকাশ্যে লাগাতে চাচ্ছে না। বিপরীত দিকে মিডিয়া কভারেজ পেতে নতুন দুই জোটের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রবল একটা আকাক্সক্ষা তারা এরই মধ্যে প্রকাশও করেছে।
এমন জটিল পরিস্থিতিতে বিএনপির জন্য সমাধানের পথ যেন বাতলে দিয়েছেন যুক্তফ্রন্টের মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলছেন, জামায়াত ফ্রন্ট বা জোটবদ্ধ হয়ে না থাকলেও যুগপৎ আন্দোলনে থাকতে পারে। বিষয়টির ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। যেমন বিএনপি ও যুক্তফ্রন্ট হয়তো কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দিল। জামায়াত এদের সঙ্গে নেই। কিন্তু আলাদা থেকে জামায়াতও কিন্তু সেই একই কর্মসূচি দিতে পারে। তাহলে এক সঙ্গে থাকা যেমন হলো না, তেমনি জামায়াতের সাংগঠনিক শক্তিটিকেও নিজেদের আন্দোলনের কাজে লাগানো গেল। সন্দেহ নেই, অসাধারণ বুদ্ধি!
বুদ্ধির এখানেই শেষ নয়, আরও কিছু কথা বলেছেন সাবেক এই বামপন্থি নেতা। কদিন আগে তিনি বলেছেন, তারা দুই বছরের জন্য ক্ষমতায় যেতে চান! এ বিষয়টা কি? জানতে চাইলে তিনি বললেন, এটা যুক্তফ্রন্টের নয়, তার একান্ত নিজের প্রস্তাব। যুক্তি হিসাবে বলছেন যারাই ক্ষমতায় যায়, গিয়ে স্বৈরাচারী আচরণ করা শুরু করে। এই মানসিকতার পরিবর্তনের জন্যই তার এই নতুন প্রস্তাব। তাহলে অর্থটা কি দাঁড়ালো? দুই বছরের জন্য উনি ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধানের এমন পরিবর্তন আনবেন, যাতে পরবর্তী সময়ে যারাই ক্ষমতায় যাবে, তাদের আর স্বৈরাচারী হওয়ার সুযোগ থাকবে না? উদ্দেশ্য মন্দ নয়। আর তারপর? তারপর ওই দুই বছর শেষে একটা নির্বাচন দেবেন, যেটি হবে অনেকটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্টাইলে, যা নিয়ে কেউই আপত্তি তুলবে না। তাহলে কি মান্না সাহেবরা নতুন নামের একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দিচ্ছেন, যাতে ওনারা থাকবেন? ইচ্ছা মন্দ নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- ওনাদের বিশ্বাসযোগ্যতার নিশ্চয়তা কে দেবে?
আসলে এসব কেবল কথার মারপ্যাঁচ। মূল লক্ষ্য হলো যেকোনো উপায়ে কেবল ক্ষমতার একটু স্বাদ লাভ করা। এর উদাহরণ তো আছে এই দেশে। দিলীপ বড়ুয়া মন্ত্রী হননি? দলে দশজন লোক নেই, কিন্তু মন্ত্রী হয়ে গেছেন। তাহলে মান্নাই বা নয় কেন? আর কিছু না হোক, তিনি তো দিলীপ বড়ুয়ার চেয়ে ভালো বক্তৃতা দিতে পারেন। বি. চৌধুরী কিংবা আ স ম রবের মতলবও এর চেয়ে খুব একটা ভিন্ন বলে মনে হয় না।
তবে ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে এই জোটকে কিন্তু সরকার তেমন একটা প্রতিরোধ করছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদেরকে নিয়ে প্রকাশ্যেই কিছুটা রসিকতা করেছেন, কিন্তু বিরোধিতা করেননি। বরং জোট গঠনকে উৎসাহই দিয়েছেন। সেটা কেন? এটা আসলে আর এক রাজনীতি। তা নিয়ে বরং আগামীতেই আলোচনা করা যাবে।
মাসুদ কামাল: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক