মোহরানা বৃত্তান্ত
সভ্যতা এগুতে থাকে বিকাশের অনিবার্যতায়। এরপরেও নারীকে প্রাক্তন বৃত্তাবদ্ধ দশায় দেখতে থাকে পুরষতন্ত্র। আর এসব কন্ডুয়ন থেকে নারী জাগরণের আশ্বাস আর মুক্তির বার্তা নিয়ে আসে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। সমাজ বিকাশের এ ধারায় আদি শৃঙ্খল, সনাতন শাস্ত্র আচারের অন্তর্জলী যাত্রায় সামিল হওয়ার স্বপ্ন দেখে মানব সমাজ। তারপরও নারী মুক্ত হয় না। তাকে নানান ঘেরাটোপে ফেলে নিংড়ে নেয় পুরুষশাসিত সমাজ।
ভারতবর্ষেই শুধু নয়, আধুনিক এবং উন্নত বলে পরিচিত রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাতাবরনেও নানা রকমের বাজারি অভ্যাসের বলীতে পরিণত হতে হয় নারীকে। যৌতুক,শুল্ক,পণ নামক সংস্কার নারীকে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে তার সমস্ত রক্ত প্রবাহকেই বন্ধ করে দেয়।
আর মোহরানা বা দেনমোহর প্রথা নারীর প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য প্রণীত হয়েছে বলা হলেও দেনমোহর নীতি পালিত হয় না। আর প্রতিপালিত যদি হয়ও তারপরও প্রচলিত ধর্মচর্চা নারীকে মুক্তি দেয় না। সে কারণে দেনমোহর সংস্কারও একজন মুসলিম নারীকে প্রকৃতপক্ষে শোষণমুক্ত হতে সাহায্য করে না। আদি সনাতন শাস্ত্রাচারের ঘেরাটোপে সে বৃত্তাবদ্ধ থাকে।
নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বে এ সন্ধান মেলে যে পশুপালন,ধাতুর কাজ ,বয়ন শিল্প এবং সর্বশেষ কৃষিকাজ চালু হওয়ার আগে নারীরা ছিল সহজলভ্য । কিন্তু এগুলো চালু হওয়ার পর নারীদের মূল্য দিয়ে কিনে (কন্যা শুল্ক) নিতে হতো। যৌথ পরিবারের অধিকাংশ অথবা সমস্ত নারীই একটি মাত্র গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত থাকত আর পুরুষরা আসত নানান গোষ্ঠী থেকে । এ বৈশিষ্ট ছিল নারীর প্রাধান্যের বাস্তব ভিত্তি। আদিমযুগে নারীর প্রাধান্যই ছিল রীতিসম্মত।
আদিযুগের মানব পরিবারের ক্রম বিকাশের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, প্রথমে অবাধ যৌন সংসর্গের যুগে গোটা উপজাতি জুড়েই ছিল পরিবার। তারপর সেই পরিবারের পরিধি ক্রমশ সঙকুচিত হয়ে আসে।
যৌন সম্পর্কের আওতা থেকে প্রথমে নিকট সম্পর্ক জ্ঞাতিদের, তারপর দূর সম্পর্কের আত্মীয় স্বজনদের, তারপর ক্রমশ বিবাহসূত্রে সম্পর্কিত লোকজনদেরও বাদ দিতে থাকার ফলে শেষ পর্যন্ত দলগত বিবাহপ্রথা (গ্রুপ ম্যারিজ্) প্রকৃত পক্ষে লোপ পেয়ে যায়।
অবশেষে মাত্র একজোড়া নর-নারীর মধ্যে পরিবারের সীমা বাঁধা পড়ে। দুজন সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তির মধ্যে বিয়ে ঠিক করা হয়। তারা শুধু বিবাহের সময়েই জানতে পারে যে তদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের আগে পাত্র তার পাত্রীর (মাতৃকুলের, পিতৃ কুলের নয়) আত্মীয় স্বজনদের পাত্রীর বিনিময় মূল্য হিসাবে অনেক উপঢৌকন দেয়।
জননী বিধির (মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা) উচ্ছেদের পর যখন জনক বিধির(পুরুষ তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা) উদ্ভব হয় তখন নারী জাতির বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয় ঘটে। পুরুষ শুধু বাইরে নয় গৃহেও কর্তৃত্ব করতে শুরু করে। নারীকে অবনমিত অবদমিত করা হয়। নারী পুরুষের কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার ক্রীতদাসী আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রে পরিনত হয়।
দার্শনিক ফ্রেডরিক এঙ্গেলস তার পরিবার, ব্যক্তি মালিকানা ও রাষ্ট্রের উদ্ভব গ্রন্থে বলেন, ‘নারীর এ হীন অবস্থা বীর যুগের গ্রীকদের মধ্যে ও মহাকাব্যের যুগের গ্রীকদের মধ্যে দেখা যায়। তার উপর ক্রমশ নরম সুরের প্রলেপ দিয়ে ও উপর উপর চাকচিক্য দিযে নারীকে এই হীন অবস্থাকে ঢাকতে চেষ্টা করা হয়েছে বটে কিন্তু কোন ভাবেই সে অবস্থার বিলোপ হয় নাই।’
এ গ্রন্থেই তিনি আমাদেরকে জানান,‘বর্বর যুগের মধ্যস্তর থেকে উচ্চ স্তরে পরিবর্তনের সময় একবিবাহের প্রবর্তন হয়। একবিবাহ প্রথায় বিবাহের ভিত্তি জোড় বিবাহের প্রথার চেযে মজবুত। এ প্রথায় সন্তানেরা খুব সহজে পিতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হতে পারত। এ প্রথায় খুব সহজে ইচ্ছে করলে স্বামী স্ত্রী বিয়ের সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারত।
দাম্পত্য জীবনে পুরুষদের ব্যভিচারের অধিকার “কোড নেপোলিয়ন” দেয়া হল। “এক বিবাহ প্রথার মধ্য দিযে নারী ও পুরুষের যে শ্রেণী বিরোধ দেখা দেয় , সেই হল ইতিহাসে প্রথম শ্রেণী বিরোধ। আর প্রথম শ্রেণী শোষণ পুরুষ দ্বারা নারীর নিগ্রহ থেকে । এক বিবাহ প্রথা একটি বড় রকমের ঐতিহাসিক অগ্রগতিও বটে। কিন্তু এই প্রথা একই সময়ে দাসত্ব ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির সঙ্গে সঙ্গে এমন একটা যুগের সূচনা সৃষ্টি করে যে যুগ আজও পর্যন্ত চলছে। সভ্য সমাজের এ প্রাথমিক স্তরে এমন সব বিরোধ দেখা দেয় যা কিনা পরবর্তী যুগে পুরোপুরি বিকাশ লাভ করে।’
ভারতবর্ষে বৈদিক আর্য সমাজেও সম্পত্তির মালিকানার উপর ভিত্তি করে অসাম্যের সূচনা ঘটে। ক্রীতদাস ক্রীতদাসীর সৃষ্টি হয়। আর এসময়ে কন্যা শুল্ক বা কন্যা পনেরও প্রচলন ঘটে।
মধ্যযুগের দুনিয়ায় কন্যা সম্পদকে বিনিময়ের একটি প্রধান রুপ ছিল বিয়ে। ইতিহাস বলে , এ সময় উচ্চ নীচ সব বর্ণের মধ্যেই বিয়ে চুক্তির অন্যতম প্রণিধান ছিল বরের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা। এই ক্ষতি পূরণের রুপ ছিল বিভিন্নতর। এই ক্ষতি পূরণের একটি মূর্তমান প্রপঞ্চ হিসেবেও মহরানার উদ্ভব ঘটে বলে সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণা।
বস্তুত মহরানা শুধুমাত্র রয়েছে ইসলামে। এটি কন্যা পণও নয় বা বর পণও নয়। ইসলামী শাস্ত্রে এটিকে নারীর প্রতি সন্মান ও শ্রদ্ধা স্বরুপ অবশ্য প্রদেয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নারীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও তাকে একতরফা, যথন তখন তালাকের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য মুসলিম বিবাহে এ নিয়ম চালু করা হয়।
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বেও আরব সমাজে কন্যাপণের কায়া নিয়ে মোহর বা মহরানা প্রদানের রীতি ছিল। বিয়ে চুক্তির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে মহরানা বিবেচিত হত। তবে স্ত্রীর কল্যানের জন্য এ মোহরানা প্রদানের নিয়ম থাকলেও কোন কোন ক্ষেত্রে স্ত্রীর এই প্রাপ্য টাকা তাঁর পিতৃকূলের লোকজন গ্রহন করত। স্বামী এ মহরানার টাকা দিয়ে স্ত্রীকে তার অবিভাবকদের কাছ থেকে কিনে নিত।
ইসলামিক আইন শাস্ত্র বিষয়ক মুসলিম পন্ডিতদের মতে প্রাক ইসলামী যুগের মোহর প্রথাকে স্ত্রীর নিরঙ্কুশ অধিকার ও সম্পত্তি হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে ইসলাম সৌন্দর্য দান করেছে।
ইসলাম আবির্ভাবের অনেক আগে আরব বিশ্ব ,ভারতবর্ষ সহ আমেরিকা বা অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসী, জনজাতি, উপজাতিদের মধ্যে কন্যাপণ বিবাহ অনুষ্ঠানের প্রধান বৈশিষ্ট ছিল। বর পক্ষ থেকে কন্যা পক্ষকে বিশেষত কন্যার পিতাকে নানা রকমের উপহার দান সামগ্রী সহ বিভিন্ন শ্রেণীর মূল্য দিতে হত। এ মূল্যের মধ্যে এমনকি কন্যার পিতাকে বেগার শ্রম দানের রীতিও ছিল।
মহরানা পাওয়ার অধিকার নারীর নিরঙ্কুশ ও একচ্ছত্র। স্বামীর কোন অধিকার নেই এটি পাওয়া থেকে স্ত্রীকে কোনভাবে কোন যুক্তিতে বঞ্চিত করার।
কিন্তু বাংলাদেশে প্রচুর উদাহরন রয়েছে স্ত্রীকে তার মহরানার অধিকার থেকে ঠকিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সরল স্বার্থ হাসিলের। সামাজিক বিভিন্ন রকমের বাধা-প্রতিবন্ধকতা, মানসিক এমনকি শারীরিক নিগ্রহের ভয়ে জড়োসড়ো তৃতীয় বিশ্বের প্রমীলাকূল তাই মহরানার দাবিতে উচ্চকিত হতে পারে না।
মুসলিম বিয়েতে দেনমোহর হচ্ছে স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীর একটি বিশেষ অধিকার। আর এই দেনমোহর সাধারণত বর ও কনের সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। দেনমোহর হিসাবে যে কোনো পরিমাণ অর্থ নির্ধারণ করা যায়। কিন্তু কোনো অবস্থায়ই স্বামী ন্যূনতম দশ দিরহাম বা সম পরিমাণ অর্থ অপেক্ষা কম নির্ধারিত করতে পারবে না।
দেনমোহর বিয়ের সময় নির্ধারণ করা না হলে বিয়ের পরও তা নির্ধারণ করা যায়। তবে সেক্ষেত্রে ন্যায্য দেনমোহর নির্ধারনের সময় সামাজিক মর্যাদা ও বাবার পরিবারের অন্যান্য নারী সদস্যের দেনমোহরের পরিমান বিবেচনা করাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তাছাড়া প্রয়োজনে আদালতের মাধ্যমে দেনমোহর নির্ধারন করা যায়। কিংবা স্বামী কর্তৃক দেনমোহরের পরিমাণ বাড়ানো যায়। তবে দেনমোহর প্রদান ছাড়া বিয়ে অবৈধ হয় না। শর্ত হচ্ছে , বিয়ের পর অবশ্যই স্ত্রীকে উপযুক্ত দেনমোহর প্রদান করতে হবে।
দেনমোহর নিয়ে আমাদের দেশে অনেক আইন অসমর্থিত অনেক ভ্রান্তি ও কুহক রয়েছে। বলা হয় স্ত্রী যদি স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায় বা স্বেচ্ছায় স্বপ্রনোদিত হয়ে তালাক দেয় তবে স্ত্রীকে দেনমোহরের টাকা দিতে হবে না। প্রকৃত পক্ষে স্বামী বা স্ত্রী যেই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটান না কেন স্বামীকে অবশ্যই দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হবে। দেনমোহরের টাকা মাফ করা যায়। তবে তা কিছু শর্ত ও বিধি মান্য করে। এক্ষেত্রে স্ত্রীর পূর্ন সমর্থন থাকতে হবে। স্ত্রী দেনমোহর মাফ করবে অন্য কারো প্ররোচনা, প্রভাবনা ছাড়াই সরল বিশ্বাস ও প্রতিজ্ঞা থেকে।
দেনমোহর হচ্ছে স্বামীর ঋণ। আমাদের দেশ কালের প্রচল সূত্রায়নে দেনমোহর দাবির পর স্বামী তা পরিশোধ না করলে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে দূরে এবং পৃথক বসবাস করতে পারবে। এ সময় স্ত্রীর ভরণপোষণ করতে হবে স্বামীকে। দেনমোহর অনাদায় সংক্রান্তে স্ত্রী আদালতের শরণাপন্ন হতে পারবে।
স্ত্রীকে মর্যাদা প্রর্দশনের ও অর্থনৈতিক , সামাজিক নিরাপত্তার দেয়ার লক্ষ্যেই মুসলিম বিবাহের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসাবে মহরানার বিধান স্বীকৃত। মুসলিম সম্প্রদায়ের দেনমোহরের শর্তের বিবরণ অবশ্যই কাবিন নামায় উল্লেখ থাকতে হবে।
দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর জামানতবিহীন ঋণ। স্ত্রীর প্রাপ্য দেনমোহর পরিশোধ করা একজন স্বামীর নৈতিক ও আইনী দায়িত্ব। যেটি থেকে অব্যাহতি লাভের কোন সুযোগ একজন স্বামীর নেই, যদি না স্ত্রী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে , পুরোপুরি প্রভাবহীন অবস্থায় তা মাফ করে দেন। দেনমোহর পরিশোধের দায় থেকে অব্যাহতি লাভের কোনো সুযোগ না থাকলেও দ্রুত পরিশোধের দায় থেকে মুক্তির অধিকার কিন্তু স্বামীর থাকে, যদি ওই মহরানা বা মোহরের প্রকৃতি ‘বিলম্বিত’ প্রকৃতির হয়।
আইন অনুযায়ী কেবলমাত্র দুইটি পরিস্থিতিতে বিলম্বিত মোহরানা স্ত্রী দাবি করতে পারেন। একটি হচ্ছে যদি স্বামীর মৃত্যু হয় অথবা তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙ্গ যায়। অপরটি হচ্ছে, যদি স্বামী সালিসি পরিষদ অথবা স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেন। দেনমোহর কেনো স্ত্রীর ভরনপোষণ নয়। এটি বিয়ের পর স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদত্ত কোন উপহারও নয়। বরং বিয়ের সময় স্বামীর কাবিননামায় প্রতিশ্রুত অর্থ। যা স্বামী কোন ভাবেই উপেক্ষা করতে পারেন না।
“আর তোমরা নারীদেরকে তাদের দেন মোহর খুশিমনে দিয়ে দাও। যদি তারা খুশি মনে তার কিছু ছেড়ে দেয় তোমরা তা স্বচ্ছন্দে ভোগ কর”……….সুরা নিসা।
বেঈলী, ভলিউম ১, ৯১ পৃষ্ঠায় এ মাহ্র, মহর, মোহর, মেহ্র, মহরানা, দায়ন মহর, দেনমোহর, ডাওয়ারের সংজ্ঞার বাংলা তর্জমা এরকমঃ দেনমোহর হল কিছু টাকা অথবা অপর কোন সম্পত্তি যা স্ত্রী স্বামীর নিকট থেকে বিয়ের মূল্য স্বরূপ পাওয়ার অধিকারী হয়।
বিভিন্ন আইনবেত্তাগণ বাখ্যায় বলেন, মূল্য শব্দটি ঠিক চুক্তি আইনে ব্যবহৃত শব্দের অর্থে ব্যবহৃত হয় না। মুসলিম আইনে দেনমোহর স্ত্রীর প্রতি সন্মান প্রদর্শন হিসেবে স্বামীর উপর আরোপিত একটি দায়িত্বমাত্র।
কোরানে উল্লেখ করা হয়েছে,“স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে মহরানা পরিশোধ করা হয় প্রধানত দুইটি কারণে একটি হচ্ছে,ধর্মীয় অধিকার লাভের জন্য এবং অপরটি হচ্ছে, স্ত্রীর প্রতি একটি দায় বা কর্তব্য সম্পাদনের জন্য।” আর এ জন্যই সাধারনের বোধগম্য ভাষায় এটাকে বলা হয় ,‘হক-ই-মহর’। কোরান শরীফে স্ত্রীকে তার প্রতি শ্রদ্ধার অর্ঘ্য হিসেবে দেনমোহর বা মোহরানা পরিশোধের জন্য বার বার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এমনকি স্ত্রী যদি ক্রীতদাসীও হয়, তবুও মহরানা তার হক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, হযরত আলী (রা.)যখন মুহাম্মদ(স.) কন্যা ফাতিমা(র.)কে বিয়ে করেন। তখন মহরানা দেয়ার মত আলীর কোন নগদ অর্থ সম্পদ ছিল না। বিয়ের সময় তার মালিকানায় ছিল কেবলমাত্র উট, তরবারি আর বর্ম। উট তরবারি তার জীবন যাপনের জন্য অতি আবশ্যক ও জরুরী বলে নবীজী আলীকে উট তরবারি বাদ দিয়ে বিয়েতে তার বর্ম মহরানা হিসাবে দেয়ার জন্য পরামর্শ দেন । পরামর্শ যথারীতি পালন করেন আলী।
নবী মুসা(আ.) (মোজেস) যখন মিশর থেকে মদিনায় এসে সাফুরাকে বিয়ে করেন তখন তার মোহর দেওয়ার মত কোন যোগ্যতাই ছিল না। সে কারণে সাফুরার পিতাকে তিনি কোন প্রকার মজুরি ছাড়াই দশ বছর সাফুরার বাবার গবাদি পশু চারণ ও পালন করে প্রতিদান হিসেবে তার শ্রম উপহার দেন।
ইতিহাস ও মহাগ্রন্থ বলে যে, একজন উদার ও ন্যায়পর স্ত্রী স্বামীর আর্থিক ও বাস্তব প্রতিকূলতা বুঝে ইচ্ছে করলে তার মোহরের দাবি ত্যাগও করতে পারেন। কিন্তু একবার যদি মোহর নির্ধারিত হয়ে যায় বিশেষত লিখিত আকারে, তবে সে মোহর স্বামীকে অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। কোন স্ত্রীকে তার স্বামী বা অন্য কেউ মোহরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কোন প্রভাব খাটাতে বা চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না। একটি উল্লেখযোগ্য হাদিসের বিবরণে পাওয়া যায় যে, “সেই সবচাইতে ভাল পত্নী, যার মোহর পরিশোধ করা যায় সবচাইতে সহজ উপায়ে ”(আল- হাতামি, কিতাব আন-নিকাহ ৪ঃ২৮১)
মুসলিম বিবাহ চুক্তিতে মোহর অবশ্যিক একটি উপাদান। কোরান শরীফে মোহর বা মহরানাকে সাদাক , আজুর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যার অর্থ কনেকে এমন একটি উপহার যেখানে কোন ক্ষতি নেই , বরং লাভ রয়েছে, । যেটি বাধ্যতামূলকও বটে। কোরানে বলা হয়েছে, আল্লাহ এই উপহার স্বাধীন ও মুক্তভাবে দান করতে বলেছেন।(৪ঃ৪)
অর্থ, সম্পত্তি বা কোন কিছুর দখল মোহর হিসাবে স্বামী তার স্ত্রীকে দান করবেন। স্ত্রী যার মালিক হবেন নিরঙ্কুশভাবে। বিয়ের আগে স্ত্রী যদি একদম কপর্দক শূন্যও থাকেন মোহরের অর্থ বা সম্পত্তির মাধ্যমে তিনি দ্রুত সেই অবস্থান ঘুচিয়ে ফেলতে পারবেন।
হযরত মুহাম্মদ(স.) তার প্রত্যেক স্ত্রীকে মোহর বা মহরানা প্রদান করেন এবং তাদেরকে দাস বৃত্তি থেকে স্বাধীন করে দেন। তিনি তাঁর অন্যতম স্ত্রী উম্মে হাবিবাকে ৪ হাজার দিরহাম মোহর দিয়েছিলেন।এই মোহর নাকি নির্ধারণ করেছিলেন তৎকালীন আবিসিনিয়ার সম্রাট নাযাশি (আবু দাউদ , ‘কিতাব এন নিকাহ’২ঃ২৩৫)।মোহরের সর্বোচ্চ পরিমাণ কত হবে , তা কখনই নির্ধারিত করা হয় নি।স্বামীর অর্থনৈতিক যোগ্যতা, অবস্থা ভেদে এটি নির্ধারিত হত। এ বিষয়ে একটি দৃষ্টান্ত মূলক ঘটনার নজীর রয়েছে। দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাতাব (উল্লেখ্য খলিফা ওমরকে ইসলামের সকল মাহজাবের অনুসারীরা এক রকম ভাবে গ্রহণ করেন না) তার ভক্ত সমাবেশে ঘোষণা দেন, নসিহত করেন যে, ‘কেউ খুব ভারী ও বিপুল রকমের মোহর নির্ধারণ করবেন না। কারণ নবীজী মুহাম্মদ চার’শ দিরহামের বেশি পরিমাণ মোহর কাউকে দিতে বারণ করেছেন।’ তৎক্ষণাৎ এ কথার প্রতিবাদ জানান ওই সমাবেশে আগত এক নারী। তিনি কোরানের ৪ঃ২০ সুরা ও আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরে বলেন,“ তুমি যদি একজনের পরিবর্তে অন্য একজনকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ কর এবং যদি প্রথম স্ত্রীকে মোহরানা হিসেবে কয়েক রাশি স্বর্নমুদ্রাও দাও, তাহলে তার একতিল পরিমাণও তুমি সাবেক স্ত্রীর কাছ থেকে ফেরত নিতে পারবে না। খলিফা ওমর সঙ্গে সঙ্গে নিজের কথাটি প্রত্যাহার করে ওই নারীর বক্তব্যটিকে সঠিক বলে মন্তব্য করেন ‘যিনি যে পরিমাণ মোহর দিতে চান তিনি সে পরিমাণই দিতে পারবেন’(ইবনে হযর আল-আথকালানি,ফাত আল-বারী, ৯ঃ১৬৭”)।
ইসলাম পূর্ব আরবে স্ত্রীকে উপহার দেয়া হত সাদাক, আর স্ত্রীর পিতাকে দেয়া হত মোহর বা মহরানা। যেটি সনাক্ত করা হত একপ্রকার কন্যা বিক্রির মূল্য হিসাবে। কিন্তু ইসলামের আবির্ভাবের পর মোহর দেয়া হত সরাসরি স্ত্রীকে, স্ত্রীর বাবাকে নয়। আর এটা কোন বিক্রয় মূল্য হিসেবেও সনাক্ত করা হত না বলে ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসলামের ইতিহাসে পাওয়া যায়,“মহর ই ফাতিমা”Ñচারশ মিতকাল (সরঃযয়ধধষ) নির্ধারণ করা হত মোহরানার পরিমাণ। নবী মুহম্মদের সময় এটির চর্চা ছিল আরবে। মিতকাল ছিল স্বর্ণমুদ্রা। যার ওজন ছিল ৪.৫ মাশা(সধংযধ)এক মাসা ছিল ৮ রতির সমান।
শরীয়া আইন (কোরানিক আইন) সৃষ্টির পূর্বে আরবে মোহর ছিল অনেকটাই কন্যাপণের মত। ভারত বর্ষে আর্য বিবাহের রীতি ছিল কন্যাকে জয় করা কন্যার পিতাকে নানা শ্রেণির উপহার দিয়ে সন্তুষ্ট করা। হামবুরাবী কোড থেকে জানা যায়, প্রাচীন গ্রীস, মেসোপটেমিয়া, ও ইহুদীদের মধ্যেও মহরানা প্রচলিত ছিল। তবে তার রুপ ছিল অন্য রকমের।
বাংলাদেশের প্রয়াত আইনবিদ গাজী শামসুর রহমানের অনুবাদ করা এৗতিহাসিক স্যার আবদুর রহীমের “ মোহামেডান জুরিসপ্রুডেন্স ”গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়, মুসলিম আইনের প্রাথমিক উৎস হিসাবে কোরান, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস আর দ্বিতীয় উৎস হিসাবে যা নাকি স্থানিক উৎস হিসাবে বিবেচনা করেন তা হচ্ছে, ইসতিহান, ইসতিসলাহ্, ইসতিদ্লাল, ইসতিহাদ্ এবং তকলিদ কে। মুসলমানদের উত্তরাধিকার, বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, দেনমোহর সবকিছুই আইনের উৎস সমূহে টীকা ভাষ্যে ব্যাখ্যায় নানা ভাবে ও বিস্তারে সন্নিবেশিত রয়েছে।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব যিনি বাদশাহ আলমগীর নামে সমধিক পরিচিত, তার তত্ত্বাবধানে সংকলিত ‘ফতোয়ায়ে আলমগীরী’ গ্রন্থে’ কি কি জিনিস দেনমোহর হতে পারে, কি কি জিনিস দেনমোহর হতে পারে না, দেনমোহরের পরিমাণ কত হবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে,“মোহরের পরিমান দশ দিরহাম, চাই ইহা মোহরযুক্ত মুদ্রা হোক অথবা না হোক যেমন দশ দিরহাম ওজনের শুধু রৌপ্যের উপরে মোহর জায়েজ হয়। যদিও ওই পরিমান চান্দির মূল্য দশ দিরহামের তুলনায় কম হয়।”
এ পুস্তকে বলা হয়,“ আর দিরহাম ছাড়া যে সব জিনিস যেমন কাপড়, কড়া বা কোন ওজনি বস্তুর উপর যদি বিবাহ করা হয় ,তবে আকদের সময় এর মূল্য দশ দিরহাম হলে বিবাহ জায়েজ হয়। যদিও ইহা হস্তগত করার দিন মূল্য দশ দিরহাম হতে কিছুটা কমে যায়। তাতে মহিলার বিয়ে প্রত্যাখানের কোন এখতিয়ার থাকে না।”
এ গ্রন্থেই বলা হয়, প্রত্যেকটি মূল্যবান বস্তুই দেনমাহর বা মহরানা হতে পারে। এমনকি কোন কিছু দিয়ে উপকার করা বা কোন বিষয়ে কোন ফায়দা বা সুবিধা দানও মোহর হতে পারে।এ ক্ষেত্রে দাস দাসী ,স্বাধীন পুরুষ স্বাধীন নারীদের মোহরানার বিষয়ে বিভিন্ন বাখ্যা রয়েছে। তাছাড়া আরব দেশে কাপড় চোপড়, আসবাবপত্র -চৌপায়া, খেজুর, ঘোড়া, উট, বকরী (ছাগল), গোলাপফুল এসবও মোহরানার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত থাকত। সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর সামাজিক মর্যাদা ও অবস্থান অনুযায়ী বিনিময় মূল্য হিসেবে এ জিনিস মোহরানা হিসাবে দেয়া হত।
তখনকার দিনে মোহরানার বিষয়, জিনিস অনেক সময় অপ্রকাশ্য থাকত। কি জিনিস মোহরানা হিসেবে দেয়া হবে বা দেয়া হল তা অনেক সময় বর পক্ষ গোপন রাখতো। এমনও হত যে গোপনে এ মোহর একভাবে আর প্রকাশ্যে মানুষদের শুনাবার জন্য অন্য রকম ভাবে ধার্য করা হল। এ রকম বিষয় অবৈধ বলে ফতোয়া ই আলমগীরীতে উল্লেখ করা হয়।
স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদেয় মোহরের ন্যূনতম মূল্য কত হবে তা নিয়ে প্রচুর বিতণ্ডা দেখা যায়। আদি ইরাকী মতবাদে এর পরিমাণ খেয়াল খুশীমত সাব্যস্ত হয়। হানাফী মতবাদীর আবু হানিফার শিষ্যগণ বলেন, তুচ্ছ মূল্যে নারীদেহ ভোগ বৈধ নয়। আবু হানিফার শিষ্য গোত্রীয় ইব্রাহীম নাখাই ১০ দিরহামের কম পরিমাণ মোহর হওয়া উচিৎ নয় বলে মত দিলেও পরে বলেছিলেন, মোহর ৪০ দিরহামের কম হবে না। আবু হানিফার অপর একজন শিষ্য শাইবানী বলেন,স্ত্রীর একটি অঙ্গ ভোগ করতে হলে তাকে অন্তত ১০ দিরহাম মূল্য দেয়া উচিৎ। এ নীতি আলীর হাদিস বলে কথিত।তবে মালিকী মতবাদীর মালিকী নিজে ও তার শিষ্য বর্গ স্ত্রীর মোহরানা বাবদ নূন্যতম তিন দিরহাম ধার্য করেছেন ।ইরাকীগন এই হাদিস মেনে নেন নি। এ ব্যাপরে তাাঁরা হাদিসের উপর নির্ভর করেন নি (ইসলামী আইনতত্ত্বের উৎস, পৃষ্ঠা ৮৭,গাজী শামসুর রহমান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)।
প্রাচীন কালের হানাফী মতবাদ অনুযায়ী মোহর হবে ১০ দিরহাম, মালিকী মতবাদে নির্ধারন করা হয়েছে ৩ দিরহাম, শাফি, হাম্বেলী এবং শিয়া মতবাদে মহরের কোন পরিমান নির্দিষ্ট করা ছিল না। দিরহাম যা গ্রীক সংস্কৃতি ও ভাষা থেকে উদ্ভূত সেটি হলো এমন রৌপ্য মুদ্রা যার ওজন ২.৯৭ গ্রাম।
এসব ছিল প্রাচীন আমলের মোহরানার চিত্র। বর্তমানকালে নগদ অর্থের পরিমান বিয়ের কাবিনে উল্লেখ করার জন্য ঘর রয়েছে।
আইনবিদ ডি এফ মুল্লা (দিন্ শ ফারদুন্জী মুল্লা, ভারতের বড়লাট পরিষদের আইন সদস্য এবং বোম্বাই হাইকোর্টের বিচারপতি) উড়বিৎ বা মোহর সম্পর্কে বলেন, মহর বলতে বোঝায় বিশেষ অর্থ বা সম্পদ, যা একজন মুসলমান নারী বিবাহ সম্পাদনের উদ্দেশ্যেই তার স্বামীর কাছ থেকে প্রাপ্তির অধিকার অর্জন করেন। মহরানা সম্পর্কে মুল্লার এ বক্তব্য সম্পর্কে সম্প্রতিক সময়ের ভারতীয় কয়েকজন ইতিহাস ও আইন গবেষক মনে করেন যে মুল্লার এই বক্তব্যের কারণে মুসলিম নারীদের সঙ্গে ভারতবর্ষের অন্য সম্প্রদায়ভূক্ত নারীদের অবস্থার একটা পার্থক্য স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। আইনতত্ববিদ পরশ দীওয়ান তার রচিত উড়ৎিু ধহফ ঢ়ৎড়ঃবপঃড়রহ ড়ভ সধৎৎরবফ ড়িসবহ(হবি ফবষযর, ১৯৮৭) বলেন,বিষযটি তা নয়।তাঁর মতে এটি বর পণও নয়, কন্যাপণও নয়। প্রীতি দান রুপে বর এটি কনেকে দিয়ে থাকেন। (“ডাওয়ারি এ্যন্ড প্রোটকশন অফ ম্যারেড উইম্যান”Ñদীওয়ান পরশ, নিউ দিল্লী, ১৯৮৭)
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের ১০ ধারায় মহরানা পরিশোধের পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, কাবিনে পরিশোাধ সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ না থাকলে স্ত্রী তলবমাত্র সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে হবে। স্ত্রীকে খুব সহজে যাতে করে স্বামী তালাক দিতে না পারে সে কারনে দেনমোহর প্রায়শই বেশি করে নির্ধারন করা হয়। কারণ তালাক দেয়ার আগে স্বামীকে মহরানা সম্পূর্ণ পরিশোধ করে নিতে হয়। প্রতিশ্রুত অর্থ যতই পরিমাণে বেশি হোক না কেন কিম্বা স্বামীর ক্ষমতার বাইরে হোক না কেন স্ত্রীর দাবির বিরুদ্ধে তা উপযুক্ত জবাব নয়।
১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের (ঋধসরষু ঈড়ঁৎঃং ঙৎফরহধহপব,১৯৮৫) ৪ ধারায় পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠা ও গঠনের কথা বলা হয়েছে। এ ধারায় একজন সহকারী জজ (সহকারী জজকে আগে বলা হতো মুন্সেফ )হবেন পারিবারিক আদালতের বিচারক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ অধ্যাদেশের ৫ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুসারে পারিবারিক আদালত বিবাহ বিচ্ছেদ, দাম্পত্য স্বত্ত্ব পুনরুদ্ধার, দেনমোহর, ভরনপোষণ এবং অভিভাবকত্ব ও সন্তানের হিজানত বা হেফাজতের বিচারের নিরঙ্কুশ এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছে। মহরানা আদায়ের মোকদ্দমা যে স্থানে স্ত্রী বাস করেন সেই স্থানে দায়ের করতে হয় বলে সংশ্লিষ্ট এ আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।
উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে,দেনমোহর বা মহরানা স্ত্রীর কাছে স্বামীর একটি ঋণ। এজন্য ঋণ পরিশোধের নীতিমালাও মোহরানা আদায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। চুক্তিতে অন্যরুপ কিছু লেখা না থাকলে ঋণ গ্রহীতা দাতাকে খুঁজে বের করবেন এবং দাতা যেখানে বাস করেন, সেখানেই তার ঋণ পরিশোধ করবেন।
বিভিন্ন রীতিনীতিতে মোহরানাঃ
আস সুন্নাতের নীতিঃ
যৌতুক ও মোহরানার পার্থক্য: মোহরানা হলো বিয়ের মূল্য, যা কেবল কনের অবশ্য প্রাপ্য। এটি কখনও বরের বা অন্য কারো প্রাপ্য হয় না। আর যৌতুক হলো মোহরানা বাদে বিয়ের পণ,যা সাধারণত অসামঞ্জস্য বিয়ের সমতা আনার অজুহাতে, বিয়ের এক পক্ষে অন্য পক্ষকে বা অন্য পক্ষের কাকেও টাকা পয়সা বা সম্পত্তি, সামগ্রী প্রদানের মাধ্যমে, দেয় বা দিতে বাধ্য হয়।
তাৎক্ষনিক (প্রম্ট)ও বিলম্বিত (ডেফারড) দেনমোহর। দেনমোহর বাবদ দেয় অর্থ দুইভাগে বিভক্ত। তাৎক্ষণিক দেনমোহর হচ্ছে যে মোহর চাওয়ামাত্র পরিশোধযোগ্য। আর বিলম্বিত মোহর হচ্ছে,যা মৃত্যু, বিবাহ বিচ্ছেদ অর্থাৎ তালাকের ফলে পরিশোধযোগ্য।
বিবাহকালে দেনমোহর তাৎক্ষনিক কি বিলম্বিত হবে তা স্থির করা না থাকলে শিয়া আইন অনুসারে সমস্ত দেনমোহরই তাৎক্ষণিক দেনমোহর হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু সুন্নি আইন অনুসারে উহার কিছু অংশকে তাৎক্ষণিক বা বিলম্বিত দেনমোহর হিসাবে গণ্য করা হয় এবং প্রত্যেক প্রকার অংশটি প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী পরিমিত হয়ে থাকে। প্রথার অবর্তমানে সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের পদমর্যাদা ও পূর্বে ধার্যকৃত দেনমোহরের পরিমাণ দ্বারই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।
হেদায়া, ৪৫; বেঈলী ৯২ এ উল্লেখ করা হয়েছে, দেনমোহরের পরিমাণ যদি নির্দিষ্ট করা না হয়ে থাকে, স্ত্রী কোন দেনমোহরের দাবি করবে না Ñএরকম সুস্পষ্ট শর্তে বিবাহ চুক্তি সম্পাদিত হয়ে থাকলেও স্ত্রী ন্যায্য দেনমোহর পাওয়ার অধিকারী হবেন। এ প্রকারের ন্যায্য দেনমোহরকে ‘মোহর-ই-মিছিল’ নামে অভিহিত করা হয়। ন্যায্য এ দেনমোহরটি কত হবে তা নির্ণয় করার সময় স্ত্রীর পিতার পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্যের ক্ষেত্রে যেমন, তার পিতার ভগিনীর ক্ষেত্রে, দেন মোহরের পরিমাণ কত ছিল, তা বিবেচনা করতে হবে। বেঈলী ৯৬ এ বলা হয়েছে, দেনমোহর নিশ্চিত হয়ে যায় দাম্পত্য মিলনের মাধ্যমে; অথবা বৈধ অবসরের মাধ্যমে (খালাওয়াত- ই ছাহিহ্); অথবা স্বামী অথবা স্ত্রীর মৃত্যুর ফলে। বেঈলী ২,৭৩ এ বলা হয়েছে, আইনে দাম্পত্য মিলন অথবা পক্ষদ্বয়ের যে কোন একজনের মৃত্যুর ফলে দেনমোহরের অধিকারটি প্রতিষ্ঠিত হয় বৈধ অবসর দ্বারা নয়।
বাংলাদেশে দেনমোহরের আলোচিত মামলাঃ
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী, অভিনেত্রী, বিজ্ঞাপন শিল্পীদের দায়ের করা অর্ধ ডজন মোহর আদায়ের মামলার উদাহরণ রয়েছে । তবে এর মধ্যে শমী কায়সার আর রিঙ্গোর মামলা বেশ আলোচিত।
২০০২ সালের ২১ জুলাই মঞ্চ এবং টেলিভিশন অভিনেত্রী শমী কায়সার তার ঢাকার চতুর্থ সহকারী জজ আদালতে কোলকাতা থেকে ঢাকায় বিজ্ঞাপনী সংস্থা ব্যবসায়ী অর্নব ব্যানার্জী রিঙ্গো ওরফে রিদোয়ান রশিদের বিরুদ্ধে ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ভরন পোষণ ও দেনমোহর আদায়ের মামলা করেন। মামলাটিতে রিঙ্গো প্রতিদ্বন্ধিতা না করায় এক তরফা রায় দেয়া হয় শমী কায়সারের পক্ষে।
মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব সাহিত্যে মোহরানাঃ
তুমি মহাজন, আমি তোমার খাতক। তুমি আমার সম্রাট ,আমি তৈরি হলেও ধর্মীয় মহাপুরুষেরা নিজেদের বিয়ের সময় দেনমোহর হিসেবে ধার্য করেছেন যৎসামান্য অর্থ। আর স্ত্রীর কাছ থেকে তা মাফ করিয়ে নিয়েছেন। শাসক তোমার বাঁদী।
নারীর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ও নারীর অধিকার সংরক্ষণের জন্য দেনমোহরের প্রথা ও মোল্লা সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগন বিয়ের মজলিসে দেন মোহর হিসেবে ধার্য করতে সম্মত হয়েছে মোটা অঙ্কের মুদ্রা। কিন্তু তা করেছে কেবল সামাজিক ইজ্জত বাড়ানোর জন্য। নতুন বিবির প্রতি অনুরাগবশতঃ নয়। বরং বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে যাবার পরপরই সে তৎপর হয়ে ওঠে ওই রীতির জাল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য।
আমাদের দেশে ৫০ দশকের সাহিত্য ‘আনোয়ারা’, ‘সালেহা ’, ‘গরীবের মেয়ে’, প্রতিটি উপন্যাসে দেনমোহর প্রসঙ্গটি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে এবং নিষ্পত্তির মাধ্যমে পথনির্দেশ করা হয়েছে। এ সব সাহিত্যে নতুন বধূ দেনমোহরের দাবি হাসিমুখে ত্যাগ করেছে । পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধিত্বকারী এ সাহিত্য সমুদয় স্বামী ধনের ভালোবাসার মোহমুদগরে আটকে থাকা স্ত্রীদের প্রত্যেককেই দেনমোহরের দাবি হাসিমুখে ত্যাগ করিয়েছেন। কেননা পতিদেবতার কাছ থেকে তাদের চাওয়ার আর কিছুই নেই। পতির জন্য সে জীবন উৎসর্গ করতেও রাজী, দেনমোহরের দাবি ত্যাগ তো সামান্য ব্যপার। আনোয়ারাকে যখন নূরুল এসলাম বিয়ে করেন তখন ভলোবাসার অজুহাতে দেনমোহরের পরিমান খাটো করে ফেলেন ।
‘সালেহা’ র লখক তার নায়িকা জোহরাকে দিয়ে দেখিয়েছেন যে দেন মোহরের দাবি ত্যাগ করা অতি জরুরী।
গরীবের মেয়ে উপাখ্যানের নূর মোহাম্মদও নানা উছিলা খুঁজতে থাকেন দ্বিতীয়া স্ত্রী নূরীর কাছ থেকে দেনমোহরের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য।
এসব উপন্যাসে চেতনে অথবা অবচেতনে লেখকগণ দেখিয়েছেন শুধু দেন মোহরের দায় থেকে স্বামীকে মুক্তি দেয়া প্রকৃত পতিব্রতার কাজ নয় ,সকল ধন সম্পত্তিই স্বামীকে অর্পন করা পতিব্রতার কাজ।
অথচ ইতিহাস আমাদের জানায় যে অনেক ধর্মীয় মহামানবই দেনমোহরের দাবি থেকে পিছিয়ে আসতে নারীকে বারণ করেছেন।
আমাদের ঢাকায় নবাব পরিবারে দেন মোহরঃ
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ঢাকার নবাব পরিবারে দেন মোহরের ছোট একটি প্রমাণ এরুপ যে, ১৯১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি খাজা মওদুদ তার দিন লিপি (ডায়েরিতে ) লিখেন যে,“খাজা হামিদুল্লাহর সঙ্গে দশ হাজার টাকা দেনমোহরের বিনিময়ে নওয়াব সলিমুল্লাহর মেয়ে আকতার বানুর আকদ হয় আহসান মঞ্জিলে।প্রত্যেককে একটি করে রুমাল দেয়া হয়। ৮ টার সময় বরাত্রীরা ফেরত আসে। (“নওয়াব পরিবারের ডয়েরিতে ঢাকার সমাজ ও সংস্কৃতি”, অনুপম হায়াৎ, বাংলাদেশ কো অপারেটিভ বুক সোসাইটি)।
প্রাচীন আরব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মোহর বা মোহরানার চিত্রঃ
প্রাচীন ইস্রায়েলে স্ত্রী পাবার অন্যতম উপায় ছিল কন্যাপণ , যাকে বলা হত মোহর বা মাহ্র। প্রাচীন আরবীয়দের মধ্যে বরের পক্ষ থেকে একটা উপহার দেওয়া হতো কনেকে যার নাম সাদাক বা মাহ্র। তিনি প্যালেষ্টাইন ও মরোক্কো অঞ্চলের মোহর সম্পর্কে অভিজ্ঞতা বর্ননা করেন এভাবে যে ,যদিও কোরানিক আইনে মার্হ (মহরানা ) হল কনের নিজস্ব সম্পত্তি, কিন্তু বাস্তবে এই নীতি প্রায়ই অনুসৃত হয় না। তিনি জানান, প্যালেষ্টাইনের গ্রামে বিয়ের চুক্তি স্বীকৃত হয় কন্যামূল্যের মাধ্যমে।যেখানে বলা হয়, এই মূল্য কন্যার নিজস্ব সম্পত্তি। কিন্তু বাস্তবে এর সিংহভাগই হস্তগত করেন কনের বাবা। আর মরোক্কোতে বেশ কয়েকটি জায়গায় এই সাদাকের পুরো অংশই ব্যয় করা হয় কনের জামা কাপড়, গয়নাগাটির জন্য। কনেকে আর্থিক নিরাপত্তা দেয়ার জন্য এটি একটি পদ্ধতি হলেও কনের পিতা এ অর্থ নিয়ে নিত। ”(বিবাহের ইতিহাস,এডওয়ার্ড ওয়েস্টারমার্ক, ভাষান্তর , কাজল রায় ত্রিবেদী, প্রকাশক দীপায়ন, ২০কেশব সেন স্ট্রিট, কলকাতা । পৃষ্ঠা-১২৮, ১২৯।)
প্রত্যক্ষদর্শী, বিভিন্ন নামী সংবাদ মাধ্যমের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি বর্তমানে আরব দেশে দেন মোহরের বিষযটি নিয়ে কারও কোন মাথা ব্যাথা নেই। দেন মোহর সংস্কৃতি এখানে প্রায় অনুচ্চারিত। বরং তার থেকে সামনে চলে আসে কন্যা পণের বিষয়। খোদ সৌদী আরবে বিয়ের আচার বিচারে সংস্কৃতিতে রয়েছে মধ্য যুগীয় অন্ধকার । সৌদি আরব সহ সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর ও অন্যান্য রাষ্ট্রে কণের বাবাকে বিপুল পরিমাণ পণ দিয়ে বরপক্ষ কিনে নেন। “‘এর ফলে বিবাহোপযুক্ত ছেলে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণেই ধনী রাষ্ট্রের অপেক্ষাকৃত গরীব পরিবারগুলোকে পাশ্ববর্তী গরীব আরব রাষ্ট্রে গমণ করতে দেখা যায় এবং নাম মাত্র নগদ পণের অর্থের বিনিময়ে বিদেশিনী কন্যাকে পরিবারের বধূ হিসাবে গ্রহণ করে থাকে। মিশরের আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে এরূপ দু চারটি নব বধূকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে প্রতিদিন দেখা যায় (সমাজ ব্যবস্থাপনায় আরব বিশ্ব ও বাংলাদেশÑ ডা. মো. সিরাজুল ইসলাম)”।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের দেনমোহর নিয়ে কোন তথ্য না পাওয়া গেলেও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে বিয়েতে পণ প্রথার। এ দেশের ফেডারেল ন্যাশনাল কাউন্সিল ( এফএনসি) সদস্য আল-কিতাবি এএফপিকে বলেন, বর্তমানে ৩০ বছরের বেশি প্রায় পৌনে দুই লাখ অবিবাহিত আমিরাতি নারী রয়েছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের লোকসংখ্যা ৮০ লাখের বেশি। এর মধ্যে মাত্র সাড়ে নয় লাখ আমিরাতি নাগরিক। অন্যরা বিদেশি। আমিরাতের পুরুষেরা এখন বিদেশি নারীদের বিয়ের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। অনেকের ধারণা, ঐতিহ্যবাহী যৌতুক প্রথার (কন্যাপণ) কারণে বিয়ের বাজারে আমিরাতি মেয়েদের এমন মন্দা দেখা দিয়েছে। ইউএইর সর্বশেষ জরিপ থেকে দেখা যায়, শতকরা ৮৭ ভাগ মানুষ অভিযোগ করেছেন, আমিরাতি নারীদের বিয়ের হার কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে মোটা অঙ্কের যৌতুক প্রদানের বিধান। সরকার সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ডলার যৌতুক নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু অনেক পরিবার বরের কাছ থেকে এক লাখ ৩৫ হাজার ডলার পর্যন্ত যৌতুক আদায় করে থাকে। এ ছাড়া আমিরাতি নারীদের অনেকে পড়াশোনা করছেন। বিয়ের আগে ক্যারিয়ার গড়ার দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন। এ জন্য অনেকের ৩০ বছর পার হয়ে যাচ্ছে। ফলে আর তাঁদের বিয়ে হচ্ছে না। ( বার্তা সংস্থা- এএফপি, দৈনিক প্রথম আলো, ঢাকা, ৫ জুলাই, ২০১২ বর্ষ ১৪, সংখ্যা ২৩৮)।
বর্তমানে খোদ সৌদি আরবে কন্যা পণের মত দেন মোহর ধার্য করা হয় বলে অনেক অবিবাহিত বিয়ে করতে পরে না। মালয়েশিয়াতেও সে রকম সমস্যা রয়েছে বলে পত্র পত্রিকা থেকে জানা যায়।
দেন মোহর সম্পর্কে একালের বিভিন্ন বিশ্লেষণ, গবেষণা ও মতামতঃ
বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি (সাবেক) মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কোরান শরিফ(সরল বঙ্গানুবাদ, প্রকাশনা সংস্থা -মাওলা ব্রাদার্স ) পুস্তকে উল্লেখ করেন,“বর পক্ষ ও মেয়ে পক্ষের সম্মতিক্রমে তৈরি করা চুক্তির মাধ্যমে মুসলিম সমাজে বিয়ে হয়।এই চুক্তির মাধ্যমে নগদ মূল্য ও বাকি মূল্য নির্ধারণ করে বধূর জন্য বরপক্ষকে ‘দেনমোহর’ দিতে হয়।ধর্মীয় বিধানে দেনমোহর খুশিমনে দেওয়ার নির্দেশণা রয়েছে।”
আইনবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান ‘আইনও শালিস কেন্দ্র’র সালমা সোবহান তার ‘বাংলাদেশে যৌতুক প্রথার উদ্ভব, এদেশ একাল’ নিবন্ধে উল্লেখ করেন ,“মেয়ের বিয়ের ফলে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি পরিবারের হয় তা পূরণের জন্য মেয়েপক্ষ যে অর্থ বা পণ দাবি করে সেটাই কন্যাপণ প্রথা ।ইসলাম পরবর্তী সময়ে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বদলে গিয়ে ‘মোহর’ এর অর্থ দাঁড়াল কনের নিজের মূল্য হিসেবে বরপক্ষের দেওয়া অর্থ। বরপণ দেওয়ার রীতি তখন ছিল না । উভয় পক্ষে উপহার আদান প্রদানের রীতি ছিল।”
বাংলাদেশের লেখক সা’দউল্লাহ তার ‘নারী অধিকার ও আইন’ গ্রন্থে (সময় প্রকাশন, পৃষ্ঠা-৩৫) প্রখ্যাত ইসলামী আইনবিদ এন জে কোলসনের মেহের, মোহর বা মোহরানা সম্পর্কে অভিমত তুলে ধরেছেন, “কোরানের নির্দেশ মতে স্ত্রী স্বামীর নিকট থেকে মোহরানার অর্থ পায়। প্রাক- ইসলামী যুগে অবশ্য সময় সময় স্ত্রীকে এ অর্থ দেয়া হলেও প্রথাগত ভাবে মেয়ে বিক্রির অর্থ পিতা কিংবা নিকট আত্মীয় , বিক্রেতা হিসেবে ‘ক্রয়মূল্য’ স্বামীর কাছ থেকে আদায় করত। কোরানের এই সরল বিধানের ফলে নারী পণ্যবস্তু থেকে চুক্তিপত্রে দাত্রী হিসেবে রূপান্তরিত হল; এবং দাত্রী রূপে বিক্রয় মূল্য (কনসিডারেশন ) পেল গ্রহীতার কাছ থেকে। ক্রীত অর্থে এই মূল্য বা কনসিডারেশন দাত্রীর েেদহের ওপর গ্রহীতার অধিকার। এই বিধানে একজন নারী কোন নির্দিষ্ট পুরুষের সাথে চুক্তি করার আইনী অধিকার পেল, যা পূর্বে ছিল না।”
মোহরানা নিয়ে প্রয়াত বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর লিখিত “সম্প্রদায়গত আইনের সংস্কার ও অন্যান্য” গ্রন্থে বলেন,মুসলিম বিবাহ কোন ধর্মীয় সংস্কার নয়, বরং তা একটি চুক্তি। হিন্দু প্রথা অনুযায়ী বিবাহকালে বরের মূল্যস্বরুপ কন্যাকে যৌতুক দিতে হয়। মুসলিম বিয়েতেও জামাতাকে কনের মূল্যস্বরূপ দেনমোহর দিতে হয়। বিবাহচুক্তি সম্পাদনের সময় পুরুষকে কিছু টাকা বা সম্পত্তি প্রদানের প্রস্তাব করতে হয়, যা স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে পাওয়ার অধিকারীণী। মোহরানা হলো স্ত্রীর প্রতি সন্মানসূচক একটি আবশ্যিক দেনা, যার পরিমাণ স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উপর নির্ভর করে।এই অর্থ প্রদান তাৎক্ষণিক বা বিলম্বিত হতে পারে এবং পরবর্তীকালে তা উভয় পক্ষের সম্মতি অনুসারে পুনঃ নির্ধারিত এবং পরিবর্তিত হতে পারে। মোহরানা দাবি কখোনও বাতিল হয়ে যায় না, এমনকি বিবাহ বিচ্ছেদ কিংবা স্বামীর মৃত্যু হওয়া সত্ত্বেও। তবে স্ত্রী ইচ্ছা করলে এই দাবি মওকুফ করে দিতে পারেন। কিন্তু মোহর সংক্রান্ত এই তাত্ত্বিক বিধান নারীদের বিশেষ কোন কার্যকর সুবিধা দেয় না। কার্যত সামাজিক অপত্তি এবং এরূপ দাবি বলবৎ করতে বহু প্রকার আনুষ্ঠানিকতার জন্য উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কোন স্ত্রী এই মোহরানার দাবি উত্থাপন করেন না। স্বামীর প্রতি ভালবাসা ও মমতার জন্যও স্ত্রীরা এই দাবি পরিত্যাগ করে থাকেন। (সম্প্রদায়গত আইনের সংস্কার ও অন্যান্য ,প্রথমা প্রকাশন, পৃষ্ঠা ৫৫,৫৬,, প্রকাশকাল ডিসেম্বর , ২০১১)।
লেখক হুমায়ূন আজাদ তাঁর বিখ্যাত ‘নারী’ গ্রন্থের ‘পিতৃতন্ত্রের খরগঃ আইন বা বিধিবিধান’ শিরোনামের অধ্যায়ে বলেন,“ ইসলাম নারীকে কিছু আর্থ সুবিধা দেয়। যা অন্য কোন ধর্ম দেয় না। বিয়ের চুক্তির ফলে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে পায় দেনমোহর ; কিছু টাকা বা সম্পত্তির লিখিত প্রতিশ্রুতি। ওই দেনমোহর শুধু কাবিনে লেখা থাকে, স্ত্রী তা সাধারণত পায় না, এমনকি বিচ্ছেদ হলেও দেনমোহর সাধারনত আদায় করতে পারে না। দেন মোহর হয় পরিমাণে খুবই কম: হানাফি আইনে কমপক্ষে ১০ দিরহাম, মালিকি আইনে কমপক্ষে ৩ দিরহাম, আর হাদিস অনুসারে কমপক্ষে একটি লোহার আংটি। বিয়ে স্ত্রীকে খরপোষের অধিকার দেয়্; স্ত্রীকে ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বামীর। ভরণপোষেণের অধিকারের জন্য স্ত্রীকে থাকতে হবে স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত মেনে চলতে হবে স্বামীর নির্দেশ। স্বামী যেখানে থাকবে বা যেখানে থাকার জন্য স্ত্রীকে নির্দেশ দেবে, সেখানেই থাকতে হবে স্ত্রীকে; স্ত্রী তা অমান্য করলে ভরণপোষণের অধিকারী হবে না। (নারী, হুমায়ুন আজাদ, আগামী প্রকাশন, পৃষ্ঠা ৮৬)
কঙ্কর সিংহের বিরচিত “ইসলাম ও নারী” গ্রন্থে (কলকাতার র্যাডিক্যাল প্রকাশনী সংস্থা থেকে )উল্লেখ করেছেন, “ইসলামী বিবাহ প্রথায় দেনমোহর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিয়ের চুক্তির ফলে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে পায় দেন মোহর। কিছু অর্থ, অলঙ্কার বা সম্পত্তির লিখিত প্রতিশ্রুতি। যার বিনিময়ে স্বামী নামে পুরুষটি লাভ করে স্ত্রী নামে পুরুষটি লাভ করে স্ত্রী নামে নারীটির দেহের একচ্ছত্র অধিকার। তখন স্ত্রী পরিণত হয়ে যায় অনুগতা বৈধ যৌন দাসীতে। সেখানে যখন খুশী গমন করে কর্ষণ করা যায়। দেনমোহর শুধু কাবিনে লেখা থাকে। স্ত্রী সাধারণতঃ তা নগদে পায় না। এমন কী বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও তা সাধারণতঃ আদায় হয় না।”
আমি তোমার জন্য তোমাদের স্ত্রীদেরকে বৈধ করেছি যাদেরকে তুমি দেনমোহর দিয়েছ ও বৈধ কিেছ তোমার ডানহাতের অধিকারভূক্ত দাসীদেরকে।…………সুরা আহজাব,৩৩/৫০
বিভিন্ন আদালতের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে মোহর,মহরানা, দেনমোহরঃ
এলাহাবাদ হাইকোর্টের ‘ঈদান বনাম মাজাহার হোসেন (১৮৭৭)১ এলাহাৎ ৪৮৩ মামলার স্ত্রী একজন পতিতা ছিল বলে আদালত মোট দেনমোহরের এক পঞ্চমাংশকে তাৎক্ষণিক দেনমোহর হিসাবে নির্ধারণ করেন।
তউফিকুন্নেসা বনাম গোলাম কাম্বার (১৮৭৭)১ এলাহাবাদ ৫০৬ মামলায় আদালত ঘোষণা করেন যে, মোট দেনমোহরের এক- তৃতীযাংশ তাৎক্ষণিক দেনমোহর হিসেবে যুক্তিসংগত এবং অন্যান্য মোকদ্দমায়ও ওইরুপ স্থির হয়েছে। পক্ষগণ সুন্নী হলেও কাবিনে নির্দিষ্ট না থাকলে, দেনমোহরের ক্ষেত্রে সাধারণ অনুমান হবে অর্ধেক তাৎক্ষণিক ও অর্ধেক বিলম্বিত।
স্ত্রী কর্তৃক দেনমোহর মওকুফঃ
তবে স্ত্রী ইচ্ছা করলে তার স্বামীর উত্তরাধিকারীগণের পক্ষে সমগ্র দেনমোহর অথবা উহার অংশবিশেষ মওকুফ করতে পারে। কোন প্রতিদান ব্যতীত মওকুফ করা হয়ে থাকলেও উহা বৈধ হবে (২৬), বেঈলী ,৫৫৩। এ মওকুফ অবশ্যই পূর্ণ সম্মতিতে হতে হবে। স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রী যখন দুঃখে ভারাক্রান্ত, তখন দেনমোহরের টাকা মওকুফ করা হলে তা অবাধ সম্মতিসূচক নয় এবং তাতে স্ত্রী বাধ্য হবে না।
দেনমোহরের মামলা এবং তামাদি আইনঃ
স্ত্রী তার দেনমোহরের টাকা না পেলে, সে এবং তার উত্তরাধিকারীগণ, তার জন্য মামলা দায়ের করতে পারেন। তাৎক্ষণিক দেনমোহর আদায়ের মামলা দায়ের করার সময় সীমা হল দেনমোহরটি দাবি ও তা প্রদানে অস্বীকৃতির তারিখ থেকে তিন বছর অথবা , যেখানে বিবাহ থাকাকালীন এ জাতীয় কোন দাবীই উত্থাপিত হয় নি, সেখানে মৃত্যু বা তালাকের ফলে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে তখন পর্যন্ত বিলম্বিত দেনমোহরটি আদায়ের সময়সীমা হল মৃত্যু অথবা তালাকের ফলে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে ওই তারিখ থেকে তিন বৎসর । তবে যেখানে তাৎক্ষণিক দেনমোহরটি নির্ধারিত হয় নি, সেখানে তাৎক্ষণিক দেনমোহরটি নির্ধারিত হয় নি, সেখানে তা আদ য়ের জন্য মামলা দায়েরের ব্যাপারে দাবী ও অস্বকৃতী কোন পূর্বশর্ত নয়। (মুহাম্মদ তকি খান-বনাম-ফারমদি বেগম, ১৯৪১ এ আইআই ৩২৬), তাৎক্ষণিক দেনমোহরের প্রযোজ্য সময়সীমাটি শুরু হয় সেটার দাবি এবং তা প্রদানে অস্বীকৃতির তারিখ থেকে। কিন্তু দাবি ও অস্বীকৃতি উভয়ই পরিষ্কার ভাবে হতে হবে। (আমতুল রসুল -বনাম- করিম বক্রাস ১৪২ আই সি ৮৩৩, ৯৩৩০,এ. পেশ ৩১;পিএলডি,১৯৭৫ লাহোর ৭৩৯; ১৯ ডিএলআর ডব্লিউ পি ৫০।
স্বামী দাম্পত্য মিলনের পূর্বে স্ত্রীকে তালাক দিলে দেনমোহরের পরিমাণ অর্ধেক হবে; কিন্তু দাম্পত্য মিলনের আগে স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রীকে সম্পূর্ণ দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে (মুহাম্মদ জামান -বনাম- নাইমা সুলতানা,১৯৫২,পেশোয়ার ৪৭)।
বাল্য বিবাহের প্রচলন সময়ে দেন মোহরের একটি ঘটনায় উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে যে, নাবালক ছেলের পক্ষে বাবাও দেন মোহরের বিষয়ে চুক্তি করতে পারতেন এবং সেটি ছেলের উপর বাধ্যকর হত। যদিও চুক্তিটি বিয়ের পর ছেলের নাবালকত্ব বহাল থাকার সময় অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
শিশু পুত্রের অভিভাবক হিসেবে কাজ করলে বাবা ব্যক্তিগত ভাবে দায়ী হবেন না। তবে এ ক্ষেত্রে যদি বাবা জামিনদার হতেন তবে ভিন্ন কথা ।
তখনকার সময় অনেক স্ত্রী তার পাওনা দেনমোহর অনেক সময় ছেড়েও দিতেন, অনেক সময় অংশিক ভাবে এবং অনেক সময় পুরোটিই। ছাড় দেয়া দেনমোহরের একটি মামলায় আদালতের সিদ্ধান্ত ছিল যে স্ত্রী ছাড় দেয়ার এ বিষযটি মুক্ত মনে স্বাধীনভাবে অন্যের বিনা প্ররোচনায় করবেন।
মহরানার সঙ্গে যৌন কর্ম ঘনিষ্ট সম্পর্কিত। যৌন সহবাসের শ্রুতিফলে মহরানা পূর্নতা অর্জন করে। পাকিস্থানের পেশোয়ার হাইকোর্ট ১৯৫২ সালে সিদ্ধান্ত দেন শারীরিক সান্নিধ্যের আগেই যদি স্বামী গত হন তবে স্ত্রী তার পূর্ন মোহরানা হারান। লাহোর হাইকোর্ট ১৯৬৬ সালে একটি মামলায় সিদ্ধান্ত দেন যে, যদি কোন স্বামী স্ত্রীকে তালাক দেন , তবে ওই তালাক যৌন কর্মের আগে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকলে স্ত্রী মহরানার অর্ধেক পাবেন। যদিও এ ক্ষেত্রে মোহরানাটি তাৎক্ষনিক হিসাবে সাব্যস্থ করা ছিল।
একালে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের একটি সিদ্ধান্তে বলা হয়,দেনমোহর যদি স্বামী শোধ না করেন তাহলে তার ফল দাঁড়ায় যে যতক্ষণ না পর্যন্ত তা শোধ করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রী স্বামীর নিকট থেকে দূরে থাকতে পারবেন(৯ ডিএল আর)।শুধু তাই নয় দূরে থাকার পরেও স্বামী তার স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য(১১ ডি এল আর)।উচ্চ আদালতের আরো সিদ্ধান্ত রয়েছে যে ,এ অবস্থায় স্বামী দাম্পত্য স্বত্ব পুনরুদ্ধারের মামলায় ডিক্রি পেতে পারেন না। পাকিস্তান ল ডাইজেস্ট (১৯৫৯) লাহোর এর ৭১০ পৃষ্ঠায় সন্নিবেশিত করা হয়েছে যে স্ত্রীকে মোহরানা দেয়া হয়েছে কিনা যিনি তা পরিশোধ করেছেন তাকেই তা প্রমান করতে হবে।
ইসলামী আইনশাস্ত্র বলে যে ,মহরানা ঋনের সমতুল্য এবং এটা একটা অরক্ষিত (আনসিকিউরড) ঋন। স্বামীর মৃত্যু ঘটলে অন্যান্য পাওনাদের মতো স্ত্রী স্বামীর ভূমি অথবা অপর কোন সম্পত্তি থেকে তা আদায় করে নিতে পারবেন।তবে যেক্ষেত্রে অন্য পাওনাদার থাকে না সেক্ষেত্রে স্ত্রী তার মোহরানা আদায় না হওয়া পর্যন্ত সে সম্পত্তি শুধুমাত্র দখলে রাখতে পারবেন।
মোহরানার পরিবর্তে হিবা বিল এওয়াজের রীতিও রয়েছে। ১৯৫৫ সালে ঢাকা হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত দিয়েছেন , মোহরানার পরিবর্তে হিবা-বিল-এওয়াজ তখনই বৈধ হবে যখন স্ত্রী কোন প্রতিদান ছাড়াই স্বামীকে মোহরানা দান করে দেয় এবং পরে স্বামী স্ত্রীর দানের “এওয়াজ” স্বরূপ কোন সম্পত্তি আলাদাভাবে দান করে, কারন এটা মুসলিম আইনে একটি বিশুদ্ধ হিবা বিল এওয়াজ হবে। এমনকি যদি স্বামী স্ত্রীকে কোন কিছু দান করেন এবং স্ত্রী স্বামীর বরাবরে প্রতিদান স্বরূপ অন্য কোন দলিল মূল্যে মহরানার অধিকার ছেড়ে দেয় তবে উহা আধুনিক প্রকৃতির একটি হিবা বিল এওয়াজ ব লে গন্য হবে, পিএলডি (১৯৫৫,ঢাকা.পৃষ্ঠা ৩৯)।
মহরানার পরিবর্তে হিবা বিল এওয়াজের রীতিও রয়েছে। ১৯৫৫ সালে ঢাকা হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত দিয়েছেন , মোহরানার পরিবর্তে হিবা-বিল-এওয়াজ তখনই বৈধ হবে যখন স্ত্রী কোন প্রতিদান ছাড়াই স্বামীকে মোহরানা দান করে দেয় এবং পরে স্বামী স্ত্রীর দানের “এওয়াজ” স্বরূপ কোন সম্পত্তি আলাদাভাবে দান করে, কারন এটা মুসলিম আইনে একটি বিশুদ্ধ হিবা বিল এওয়াজ হবে। এমনকি যদি স্বামী স্ত্রীকে কোন কিছু দান করেন এবং স্ত্রী স্বামীর বরাবরে প্রতিদান স্বরূপ অন্য কোন দলিল মূল্যে মোহরানার অধিকার ছেড়ে দেয় তবে উহা আধুনিক প্রকৃতির একটি হিবা বিল এওয়াজ বলে গন্য হবে, পিএলডি (১৯৫৫,ঢাকা.পৃষ্ঠা ৩৯)।
আমাদের দেশে দেনমোহর আদায়ের জন্য আমাদের দেশের পারিবারিক আদালতের বিচারকগন অনেক সময়েই সাধারন বিবেচনা বোধের প্রয়োগ না করে গ্রন্থগত মুখস্ত বিদ্যার প্রয়োগ করেন।
আমাদের দেশের অধিবাংশ ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক দেনমোহর নিয়ে জটিলতা দৃশ্যমান হয় না। বিলম্বিত দেনমোহর নিয়ে ঝামেলা হয়।বিলম্বিত দেনমোহর আদায়ের জন্য অনে সময় আদালত গুলো স্বামীকে জেলে পাঠানোর আদেশ দেন। বিপত্তি ঘটে সেখানেই। অনেক স্ত্রী রয়েছেন যারা তাৎক্ষণিক লাভ ও লোভের বশবর্তী হয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে মোহরানা আদায়ের মামলা করেন। স্বামী বাধ্য হয়ে কারাগার থেকে মুক্তির আশায় স্ত্রীকে বিলম্বিত দেনমোহরের টাকা দিয়ে দেন অনেক কাঠ খর পুড়িয়ে। অনেক সময়েই এর পরিনতি দাঁড়ায় বিবাহ বিচ্ছেদে।আবার অনেক সময়এমনও হয় যে, স্ত্রী ওই টাকা পাওয়ার পর স্বাভাবিক নিয়মে তা খরচ করে ফেলেন।তাাঁদের মধ্যে যদি সত্যি সত্যিই টাকা প্রদানের পর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় তখন স্ত্রীকে খালি হাতে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে সম্বল হীন অবস্থায় বাবা, মা অন্যান্য আতœীয়ের গলগ্রহ হতে হয়। অথচ যদি দেনমোহরের দাবিটি অস্তিত্বমান থাকতো তবে তার নিরাপত্তাও থাকতো।
আমাদের দেশে দেনমোহরের মামলার আগে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে যৌতুকের দাবিতে প্রহার ও নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করেছেন।যে গুলোর মধ্যে অধিকাংশ মামলাই মিথ্যা । বেসরকারী বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, সরকারী সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রনালয়ের বিভিন্ন তদন্ত ও পরিসংখ্যানে এর প্রমান মেলে। অনেক নারী স্বামীর ক্রোধ বা স্বল্প মাত্রার অন্যায় আচরণের প্রতিশোধ নিতে গুরুতর অপরাধের ফিরিস্তি দিয়ে ১৯৯০ সালের যৌতুক আইনের ৪ ধারা বা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধিত ২০০৩ সালের আইনের ১১ ধারায় মামলা করেন,দেনমোহরের টাকা না পাওয়ার কারনে। কিন্তু এটি আইনের অপ চর্চা। আর যে কারনে সঠিক ও প্রকৃত নির্যাতকরা অন্য মিথ্যা মামলার খালাস পাওয়া স্বামীদের মতোই খালাস পেয়ে যান। অথবা উচ্চ আদালত থেকে খালাস পান। এ ধরনের মিথ্যা মামলা গুলো সত্য মামলায় অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসাবে কাজ করে। আমাদের দেশের পারিবারিক আদালতে মহর ও ভরনপোষণ আদায়ের মামলায় পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে চূড়ান্ত শুনানি অর্থাৎ সাক্ষ্য গ্রহনই শুরু হয়নি এমনও উদাহরন রয়েছে। বিচারে দীর্ঘ সূত্রিতার এ অভিযোগের সঙ্গে এ অবস্থাও রয়েছে যে আদালত গুলোতে বিচারে নারী বান্ধব কোন পরিবেশ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টরা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কথা বললেও তা কাঁচের চ্ছত্রছায়ায় তত্ত্ব চর্চা হিসাবে রয়ে গেছে। তা শেষ পর্যন্ত ময়দানে প্রায়োগিক জায়গায় গিয়ে মুষড়ে পড়েছে।
আমাদের দেশের সুশীল সমাজ, নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন নারী- পুরুষের সম অধিকার নিয়ে আন্দোলন করছেন।তারা ‘সার্বজনীন পারিবারিক আইন(ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড)’ তৈরির জন্য নানা রকমের আন্দোলন, প্রচার কাজ চালাচ্ছেন। নারী সঙগঠনগুলোর দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে নারীদের ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলার জায়গা তৈরি হয়েছে বটে। কিন্তু নারীর প্রতি বৈষম্য ও সংিহসতা খুব একটা কমেনি বরং তা প্রবল ভাবেই সমাজে অস্তিস্ত¡মান রয়েছে। যৌতুকের কারনে প্রমীলা নির্যাতন ও বধ এখানো সমাজের প্রায় অপ্রতিরোধ্য একটি চিত্র। নারী স্বার্থের আন্দোলনটি ফল বল হীন হয়ে যাচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদ ও অন্ধত্ব, গোঁড়ামি আর বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারনে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, ব্যক্তিক, সামষ্টিক মূল্যবোধের পতন, সুষ্ঠু আইনচর্চার অভাব, আইন আদালতের তার প্রতি মানুষের অনাস্থা , নারীদেরকে শিশু ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মতোই নিরাপত্তাহীন করে রেখেছে। বর্তমান ও গত সরকার নানা ভাবে নানা ঢংয়ে নারীদের অধিকারের বিষয় নিয়ে নানা রকম মাত্রায় ধর্মীয় মৌলবাদের কাছে আতœসমর্পন করছে। নারী নীতি বাস্তবায়নে তীব্র মাত্রায় আপোষও করছে। আবার এই নারী নীতির মধ্যে বিশেষত জাতিসংঘ ঘোষিত বিভিন্ন অধ্যাদেশ সমুদ্রের ওপার থেকে চাপিয়ে দেওয়া বলেও সাধারন নাগরিকদের সমালোচনা রয়েছে। ঠিকঠাকমতো আমাদের আবহাওয়ায়, আমাদের দেশের মানুষের মেজাজ,জীবন যাপন, ধর্ম পালন ও চিন্তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আইন প্রনয়ণ ও কার্যকর করার কথাও বলেন অনেকে। যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন, মোহর-ভরণপোষণ আদায় , সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে এই সব জ্যান্ত প্রহসনের অবসান ঘটবে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূল কাঠামোর পরিবর্তনের মাধ্যমে।
আমাদের বিদ্যমান সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে অনুযায়ী সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী ।সংবিধানের মৌলিক অধিকার ঘোষণার ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে ঘোষিত মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য আইন বাতিলের ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু নারীরা রয়ে গেছে অসীম তমসার মধ্যে। এ তমসায় একবিন্দু জ্যোতির্ময়তায় কিভাবে পৌঁছানো যাবে তা ভবিষ্যতই বলতে পারবে।