মেয়েকে আনতে গিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত দুদিন ধরে উধাও।। ৪৮ ঘণ্টা পরও উদ্ধার হয় নি।
নিখোঁজ হওয়ার পর খোঁজ মেলে নি এখনও সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামানের। এ ঘটনায় থানা পুলিশের পাশাপাশি তদন্ত শুরু করেছে গোয়েন্দারাও। পেশাদার লোকজনই এ ঘটনার পেছনে রয়েছে বলে পুলিশ ও পরিবার সন্দেহ করছে। মি. জামানের রহস্যময় অন্তর্ধানের ঘটনাসহ গত কয়েকমাসে বেশ ক’জন ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক, সাংবাদিক এবং শিক্ষক নিখোঁজ হয়েছেন।এ সব ঘটনার অনেকগুলোর ক্ষেত্রেই নিখোঁজের ধরনের মিল রয়েছে বলে পুলিশ ধারণা করছে । এম. মারুফ জামান ২০০৮ ও ২০০৯ সালে ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তারও আগে তিনি কাতারের রাষ্ট্রদূত এবং যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ দূতাবাসে কাউন্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বিবিসি জানিয়েছে, ধানমণ্ডির যে বাড়িতে থাকতেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম মারুফ জামান, বুধবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা গেল একই সঙ্গে ভয় আর উদ্বেগের পরিবেশ। গত সোমবার (৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ধানমন্ডির ৯/এ সড়কের ৮৯ নম্বর বাসা থেকে বেরিয়ে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম মারুফ জামান। নিজে গাড়ি চালিয়ে বিদেশ ফেরত মেয়েকে আনতে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রওয়ানা হয়েছিলেন মি. জামান, কিন্তু এরপর থেকেই তার আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়ে সামিহা জামান বিবিসিকে বলেন, এর কোন কারণও খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁরা। তিনি বলছেন, ”আমরা সবাই মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছি। আমরা চিন্তাও করতে পারছি না যে, এরকম একটি ঘটনা আমাদের ক্ষেত্রে ঘটতে পারে। আমি শুধু চাই আমার আব্বু ফিরে আসুক।”
বিবিসি সংবাদদাতা সায়েদুল ইসলাম জানানঃ এ রকম একটি ঘটনার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে?এমন প্রশ্নের জবাবে সামিহা জামান বলছেন, ”এটাও আমার ধারণার বাইরে। আবার আব্বু বেশি একটা বাসার বাইরে যেতেন না, সামাজিকভাবেও বেশি একটা মিশতেন না। কারো কাছ থেকে ঋণ নিতেন না, কারও সাথে শত্রুতাও ছিল না। আমার আব্বুকে ধরে নেয়ার কোন কারণ বুঝতে পারছি না।”
বেলজিয়াম প্রবাসী বোনের সঙ্গে দেখা করে সোমবার বিকালে ঢাকায় ফেরেন সামিহা জামান। তাকে আনতেই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে একা গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলেন মারুফ জামান। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ বিমানবন্দরে বসে থেকেও যখন বাবার সাক্ষাৎ পান নি, তখন আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করে বাবার নিখোঁজ হবার কথা জানতে পারেন।
পরে ধানমণ্ডি থানায় তারা একটি সাধারণ ডায়রি করেন। রাত ১০টার দিকে পূর্বাচলের ৩০০ ফিট সড়কের একটি অংশে তার গাড়িটি পাওয়া যায়।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষণ করে পুলিশ জানতে পেরেছে, মি. জামানের সর্বশেষ অবস্থান ছিল ঢাকার দক্ষিণ খান এলাকায়। এরপর থেকেই তার সব মোবাইল বন্ধ রয়েছে।
বাড়িতে বেনামি টেলিফোন
তবে সোমবার সন্ধ্যার কিছু পরই অপরিচিত নাম্বার থেকে আসা ফোনে মি. জামানের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় বাসার পুরনো গৃহকর্মী লাকি আক্তারের। ফোন কলের দু’টির একটিতে ছিল এলোমেলো সংখ্যা, আরেকটিতে লেখা উঠেছে শুধুমাত্র পি বা প্রাইভেট।
লাকি আক্তার বলছেন, ”সাড়ে ৭টার দিকে একটি এলোমেলো নাম্বার থেকে ফোন করে স্যার বলেন, আমার বাসায় কয়েকজন লোক যাবে। তাদের কাছে ল্যাপটপ আর কম্পিউটার দিয়ে দিও। তারপর থেকেই ফোন বন্ধ পেয়েছি।”
বাসার প্রধান ফটকের নিরাপত্তাকর্মীর কাছে রাত আটটার পর তিনজন লোক এসে একজন নিজেকে ‘আসিফ’ নামে পরিচয় দেন। বাসায় ঢুকে গৃহকর্মী লাকি আক্তারকে তারা বলেন, ‘স্যারের রুমে নিয়ে চল।’ ওই বাসায় তারা ৮ থেকে ১০ মিনিট অবস্থান করার পর কম্পিউটার, ল্যাপটপ, দু’টি ক্যামেরা ও দামী মোবাইল ফোন নিয়ে বের হয়ে যান। এমনকি অজ্ঞাত তিন ব্যক্তি মারুফ জামানের শোবার ঘরে তল্লাশিও চালান। তারা বেশ লম্বা চওড়া, অনেক স্মার্ট, বোঝা যায় চাকরি বাকরি করে।”
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, যে তিন ব্যক্তি ওই বাসায় গিয়েছিলেন, তারা কালো পোশাক এবং জিন্স পরিহিত ছিল।পায়ে ছিল জুতো। দেখে তাদের স্মার্ট ও সুদর্শন মনে হয়েছে। এমনকি অজ্ঞাত এই ব্যক্তিদের সুঠামদেহের বলেও আখ্যায়িত করছেন পরিবারের সদস্যরাও।
ধানমণ্ডির এ বাড়িতে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বা সিসি ক্যামেরা রয়েছে। কিন্তু সেসব ক্যামেরায় এ ব্যক্তিদের চেহারা পরিষ্কার নয়।
জিডির পর খোঁজ-খবর শুরু করা পুলিশ কর্মকর্তারা মারুফ জামানের বাসা থেকে সিসিটিভির কিছু ফুটেজ সংগ্রহ করেন। ওই ফুটেজে তিন ব্যক্তিকে বাসায় প্রবেশ এবং বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা গেলেও তাদের মুখমণ্ডল দেখা যায় নি। একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘অজ্ঞাত ওই তিন ব্যক্তি সচেতনভাবেই সিসিটিভি ক্যামেরা দেখে মুখ লুকিয়েছেন, যাতে পরবর্তীতে তাদের শনাক্ত করা না যায়।’
কিন্তু মেয়েকে আনতে গিয়ে মারুফ জামান নিজেই বাসায় ফোন করে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের কাছে নিজের ল্যাপটপ-কম্পিউটার দিতে বলা এবং বাসায় প্রবেশের সময় তিন ব্যক্তির সিসিটিভি এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল, আসলে কী ইঙ্গিত দিচ্ছে?
পুলিশের ধারণা, পেশাদার ব্যক্তিরাই এর সাথে জড়িত, কারণ আসা যাওয়ার সময় তারা সিসি ক্যামেরার বিষয়ে সতর্ক ছিলেন, যাতে তাদের চেহারা বোঝা না যায়।
নিরাপত্তা রক্ষীরা জানালেন, পায়ে হেঁটে এসেছিলেন তিনজন ব্যক্তি। প্রায় নয় মিনিট পরে আবার তারা পায়ে হেঁটেই চলে যায়। ভেতরে প্রবেশের পর তারা সিসি ক্যামেরা দেখতে পেয়ে মাথা নিচু করে রাখেন। বাসা থেকে বেরিয়ে যাবার সময় তাদের মাথায় ছিল ক্যাপ বা হুডি।
এদিকে পরিবারের সদস্যরা ধারণা করছেন, মারুফ জামান যখন বাসায় ফোন করেছিলেন তখন সম্ভবত তিনি অজ্ঞাত কোন একটি চক্রের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। যারা তাকে বাসায় ফোন করে কম্পিউটার-ল্যাপটপ দিয়ে দিতে বলেছিল। মারুফ জামান চাপের মুখে এবং বাধ্য হয়ে গৃহকর্মীকে ফোন দিয়ে এসব দিতে বলেন। মারুফ জামানের নিখোঁজ হওয়ার পর ঘটনাক্রম ও তিন জন সুঠামদেহী ব্যক্তির বাসায় গিয়ে কম্পিউটার ল্যাপটপ নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে বুধবার দুপুরে পরিবারের পক্ষ থেকে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়।
অজ্ঞাত তিন ব্যক্তি যখন মারুফ জামানের বাসায় ঢোকেন, তখন ওই ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন মফিজুল ইসলাম। তিনি বলেন,‘‘রাত আটটার পর প্রথমে আমাদের (ভবনের বাসিন্দা) একটা গাড়ি ঢুকছে। ওই গাড়ির পেছন দিয়ে তিনটা লোক ঢুকছে। আমি তাদের ডাক দিয়া বলছি, ভাই দাঁড়ান, কোথায় যান? তারা থামছে। পরে বলে যে, ‘মারুফ জামান স্যারের বাসায় যাবো’। আমি বললাম, স্যার তো বাসায় নাই। সে তো বাইরে আছে। তারপর ওরা বললো যে, ‘বাইরে গেছে সেইটা আমরা জানি। স্যার আমাদের পাঠাইয়া তার কম্পিউটার নেওয়ার জন্য বলছে।’ আমি বললাম, ঠিক আছে দাঁড়ান আমি ফোন দেই। আমি ওপরে ফোন দিছি। বুয়া ধরছে। বললাম, খালা স্যারের কম্পিউটার নেওয়ার জন্য লোক আসছে। স্যার কি কম্পিউটার নেওয়ার জন্য কিছু বইলা গেছে? বললো যে হ্যাঁ বইলা গেছে।’’
মফিজুল ইসলাম বলেন,‘‘এরপর আমি বললাম যে, আপনার নাম? বলল, ‘আসিফ।’ এরপর আমি আসিফসহ তিন জন লিখে রাখছি। ওরা ৮টা ৫মিনিটে ঢুকছে। ৮টা ১৪ তে বের হয়েছে। সম্ভবত তারা শার্টের ভেতরে কোনও গেঞ্জি পরা ছিল। আসা-যাওয়ার সময় মাথায় হুডি ছিল। তারা যখন যায়, তখন দেখে যে ওখানে ক্যামেরা আছে, তখন মাথা নিচু কইরা গেছে। বাইরে কোনও গাড়ি ছিল না, ওরা হেঁটে আসছে।’’
মারুফ জামান নিখোঁজ হবার পর ২৪ ঘণ্টা পার হলেও এখনও তার বিষয়ে পরিষ্কার কোন বক্তব্য জানাতে পারে নি পুলিশ। তবে তার সন্ধানে পুলিশ পুরো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে বলছেন ঢাকা পুলিশের মুখপাত্র মাসুদুর রহমান।
পুলিশ কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান বলছেন, ”এ ঘটনার পর ধানমণ্ডি থানায় যে জিডি হয়েছে, তার আলোকেই আমরা তদন্ত শুরু করেছি। ঘটনাস্থল থেকে সিসিটিভির কিছু ফুটেজ পেয়েছি, সেগুলোও বিশ্লেষণ চলছে। থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশও তাকে উদ্ধারে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।’
বিবিসি জানায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার মারুফ হাসান সরদার বলছেন, ‘আমরা বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। আমরা মারুফ জামানকে উদ্ধারের চেষ্টা করছি। আমাদের পুলিশ কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন।’
সোমবার সন্ধ্যা থেকে নিখোঁজ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মারুফ জামানের গাড়িটি (ঢাকা মেট্রো-গ-২১-১৩৯৯) খিলক্ষেতের তিনশ’ ফিট সড়কের একটি ফাঁকা জায়গা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। অক্ষত অবস্থায় গাড়ি উদ্ধার এবং বাসা থেকে ল্যাপটপ-কম্পিউটার উদ্ধারের বিষয়টি মারুফ জামানকে কেউ তুলে নিয়ে গেছে বলেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু কেন তাকে তুলে নেওয়া হয়েছে? মারুফ জামানের ছোট ভাই রিফাত জামান বলছেন, ‘অজ্ঞান পার্টি বা ছিনতাইকারীর কবলে পড়লে গাড়িটি নিয়ে যেত। দুর্ঘটনা ঘটলে বাসায় কেউ ল্যাপটপ-কম্পিউটার নিতে আসত না। আর মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করার ঘটনাও এটি নয়। এটি অন্য কিছু। কিন্তু আমরা কিছুতেই বুঝতে পারছি না, কেন তাকে তুলে নেওয়া হল? কারণ, আমার ভাই কোনও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত নয়।’
উল্লেখ্য, এম. মারুফ জামান ১৯৭৭ সালে সিগন্যাল কোরের সিক্স শর্ট কোর্স শেষ করে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে সেনাবাহিনীর চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ১৯৮২ সালে ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন। তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে ২০১৩ সালে অবসর নেন।
এ নিয়ে গত কয়েকমাসে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক, শিক্ষক আর সাংবাদিক নিখোঁজের ঘটনা ঘটলো, যাদের কেউ কেউ পরবর্তীতে ফিরে এলেও, অনেকের এখনো খোঁজ মেলেনি।
তাদের নিখোঁজ ঘটনাগুলোর সঙ্গে মি. জামানের নিখোঁজ এবং বাসায় তল্লাশির মত ঘটনায় অনেক মিল দেখতে পাচ্ছেন তদন্তকারীরা।