মুহাম্মদ (সাঃ) কেমন চরিত্রের মহামানব ছিলেন!

June 4, 2018 12:40 am0 commentsViews: 59

।।আসমা খাতুন মণি।।

”তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্যে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে।’’ (সূরাহ আল-আহযাব-৩৩ঃ২২)

আরও এরশাদ হয়েছেঃ  ‘ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামিন।’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-১০৭)। অর্থঃ ‘হে নবী আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য কেবল রহমতরূপে প্রেরণ করেছি।’

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে পাঠানো সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী। তিনি তাঁর অনুসারীদের জীবনের ওপর যেরূপ প্রভাব বিস্তার করেচেন মানবজাতির ইতিহাসে অন্য কোন ব্যক্তিই তেমনটি পারেন নি। তিনি ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। তাঁর জীবন আমাদের অনুসরণের জন্যে সর্বোত্তম নমুনা। তিনিই আমাদেরকে তাঁর আমলের দ্বারা দেখিয়েছেন, কিভাবে বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তা’আলার আনুগত্য করতে হবে।

চারিত্রিক গুণাবলীঃ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন একজন মিষ্টভাষী, ভদ্র ও বিনয়ী, মানুষ। তিনি চিন্তা ও ধ্যান করতে ভালবাসতেন। তিনি তাঁর সমবয়সী অন্য লোকদের মত ছিলেন না। দুনিয়ার জীবনের চাকচিক্যের প্রতি তাঁর কোন আগ্রহ ছিল না। আর এটা ছিল এমন একটি বৈশিষ্ট্য যা গোটা মানবজাতির ভবিষ্যৎ পথপ্রদর্শক ও শিক্ষকের জন্য পুরোপুরি মানানসই ছিল। শৈশব থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত আমরা তাঁকে একজন উত্তম চরিত্রের অধিকারী রূপে পাই।

কৈশোর জীবনের চারিত্রিক গুণাবলীঃ কিশোর মোহাম্মদ (সাঃ) এর বয়স যখন ৮/৯ বছর, এ বয়সেই তাঁর মধুর চালচলন দেখে সবাই বিস্মিত হত। তিনি কখনও কারও সঙ্গে ঝগড়া বিবাদে জড়িত হতেন না। কোন কারণে কখনও কান্নাকাটি বা জিদ ধরতেন না। বেশির ভাগ সময় তিনি চুপ করে থাকতেন। আহারের সময় চাচার সঙ্গে বসে আদরের সঙ্গে আহার করতেন। খাওয়া নিয়ে কোন প্রকার গোলমাল করতেন না। নিরর্থক ও বাজে খেলাধূলা তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। কখনও মিথ্যা কথা বলতেন না। খুব ধীর, সৎ স্বভাব ও বুদ্ধিমান ছিলেন এবং সকলেই তাঁকে বিশ্বাস করত। এক কথায় সমস্ত সদগুণাবলীর সমাবেশ হয়েছিল তাঁর চরিত্রে। মহান আল্লাহ স্বয়ং হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কে সকল রকম জ্ঞান দিয়ে তাঁর চরিত্রের সকল মাধুর্যকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন এবং সম্পূর্ণরূপে সুশিক্ষিত করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ও আদর্শ মানব। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর বয়স যখন ১০/১২ বছর হল, তখন তিনি অন্যান্য বালকের মত ছাগল চরাতেন। নিষ্কর্মা হয়ে বসে বসে খাওয়া তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। তাই একটু সাবালক হতেই তিনি ছাগল চরাবার কাজে মন দিয়েছিলেন।

নবুওত প্রাপ্তির আগেই তিনি বিশ্বাসী  ও আমানতদার হিসেবে পরিচিতি পানঃ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এত বিশ্বাসী ও সত্যবাদী ছিলেন যে, লোকে তাঁর নাম ধরে ডাকা ছেড়ে তাঁকে আমিন ও সাদেক বলে ডাকত। ’আমিন’ শব্দের অর্থ হচ্ছেঃ বিশ্বাসী, আর সাদেক শব্দের অর্থ হচ্ছেঃ সত্যবাদী। মক্কার লোকেরা নির্ভয়ে নিজ নিজ মূল্যবান সম্পদ বিশ্বাসী মোহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে গচ্ছিত রাখত।

যৌবন জীবনের চারিত্রিক গুণাবলীঃ যৌবনে পদার্পণ করে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য করার ইচ্ছা পোষণ করলেন। মক্কার এক বিদুষী নারী, যিনি ছিলেন ধনবতী ও বুদ্ধিমতী রমনীও, খাদিজা (রাঃ) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর খ্যাতি ও সুনাম শুনে মনে মনে স্থির করলেন, এমন একজন সৎ ব্যক্তিকে দিয়েই তিনি তার ব্যবসার কারবার চালু করবেন এবং তার কাছে প্রস্তাব পাঠালেন। এ সময় তাঁর ব্যবসা পরিচালনার জন্য একজন লোক দরকার ছিল। খাদিজার মত একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারীর অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে তিনি নিষ্ঠার সাথে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে থাকলেন। নিয়োগ প্রাপ্তির পরপরই  তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়ায় গমণ করেন। সিরিয়ায় উপস্থিত হয়ে তিনি এমন বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে জিনিসপত্র বিক্রয় করেছিলেন যে, সেবার বাণিজ্যে খাদিজা (রাঃ) এর প্রচুর লাভ হয়েছিল। তিনি ব্যবসার সকল হিসাব যথাযথ ভাবে খাদিজাকে বুঝিয়ে দিতেন। ভৃত্যও সফর থেকে ফিরে এসে খাদিজাকে (কর্ত্রী) যুবক মোহাম্মদ (সাঃ) এর মধুর স্বভাব ও বিচক্ষণতা সম্বন্ধে নানা কথা শোনাতেন। এই বাণিজ্য উপলক্ষে তাঁর সততা ও বিচক্ষণতার পরিচয় পেয়ে এবং ভৃত্যের মুখে তার গুণাবলী শুনে তার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। শুধু তাই নয়, নবী হওয়ার পূর্বেই তার চরিত্রের সৌন্দর্যের কথা দেশের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।

উত্তম চারিত্রিক গুণাবলীর কথা পারপাশে ছড়িয়ে পড়েঃ তিনি কখনও মিথ্যা কথা বলতেন না বা গালাগালি করতেন না। সকলের সঙ্গে হাসিমুখে কথাবার্তা বলতেন। অতি সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করতেন। সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতেন। তার মধ্যে লোভ লালসা, প্রতারণা বলে কিছু ছিল না। যুবক বয়সেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) জনকল্যাণমূলক কাজকর্ম করেছিলেন। অর্থহীন যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের এবং মজলুম, দরিদ্র ও অভাবী লোকদের সাহায্য করার জন্য তিনি হিলফুল ফুযুল নামে একটি সমিতি গঠন করেন।

যুবক মোহাম্মদের (সাঃ) এর চারিত্রিক দৃঢ়তাঃ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন সংকল্পে অটল, অবিচল; কোন প্রকার লোভ, অত্যাচার, ক্ষমতা-মোহ কিছুই তাকে সংকল্প থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি এবং সমুদয় বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে এভাবে আল্লাহর হুকুমে নিজের জীবনকে অতি মানবীয় গুণাবলীতে সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।  তাঁর অন্তঃকরণে ছিল দুর্জয় সাহস, বিপদাপদে অসীম ধৈর্য, প্রাণ জুড়ানো ব্যবহার- এসব মহৎ গুণের প্রভাবেই তিনি পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে পরিগণিত হয়ে আছেন।

স্নেহপরায়ণতাঃ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে অত্যন্ত আদর করতেন, তাদের সঙ্গে মিষ্টি কথা বলতেন এবং সময় সময় তাদের সঙ্গে খেলাও করতেন। একবার নামাযের সিজদা দিবার সময় তাঁর দৌহিত্র শিশু হুসাইন (রাঃ) তাঁর ঘাড়ে চড়ে বসেছিলেন। হুসাইনের নেমে যাওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করে তবে সিজদা থেকে মস্তক উত্তোলন করেন। তিনি অনেক সময় নিজে উট সেজে হাসান হোসাইনকে (রাঃ) সেই উটে চড়াতে ভালবাসতেন।

আত্মসম্মানবোধঃ মহানবীর আত্মসম্মানবোধ অতি প্রবল ছিল বলে ভিক্ষাবৃত্তিকে তিনি অতিশয় ঘৃণা করতেন। এক সময় এক ভিক্ষুক তাঁর কাছে উপস্থিত হলে, তিনি তাকে একখানা কুঠার দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘এটা নিয়ে কাঠ কেটে তা বিক্রি করে জীবন ধারণ করবে।’’ এছাড়া তিনি কারো দান গ্রহণ করতেন না। পারস্য দেশের এক কৃষক সন্তান সালমান নবীজীর এই মহান গুণ দেখে তাঁকে চিনতে পেরে তাঁর কাছে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।

ক্ষমাঃ ক্ষমার প্রশ্নে মুহম্মদ পৃথিবীর বুকে এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তার প্রাণঘাতী শত্রুকে পর্যন্ত বারবার হাতের মুঠোয় পেয়েও তিনি তাদের ক্ষমার স্নিগ্ধ স্পর্শ থেকে বঞ্চিত করেন নি। মক্কা বিজয় প্রাক্কালে যখন শত্রুপক্ষ প্রাণের আশঙ্কায় বিচলিত, মুহাম্মদ তাঁর চিরাচরিত স্বভাব ধর্ম অনুযায়ী তাদের সবাইকে ক্ষমা করে বিশ্বের দরবারে ক্ষমার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

সংস্কারঃ মুহাম্মদের সবচেয়ে বড় পরিচয় হল তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সার্থক এবং বিপ্লবী সংস্কারক। তিনিই তার সমাজের অচলায়তন জীর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ভেঙ্গে নতুন করে গড়ে তোলেন। লুপ্ত নারী মর্যাদাকে উদ্ধার করে তিনি নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দান করেন। নারীর শাশ্বত মাতৃত্বের পবিত্রতা ও গৌরব তিনিই প্রথম প্রচার করেন। ঘোষণা করেন জননীর পদতলে সন্তানের মুক্তি।

ধর্ম প্রচারঃ রাসূল হওয়ার পর হযরত মুহম্মদ (সা:) ইসলাম ধর্ম প্রচারে ব্রতী হন। ইসলাম অর্থ শান্তির ধর্ম। তোমরা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কারো দাসত্ব বা উপাসনা করো না’। এবং লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’’ অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই, আর মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহ তায়ালার মনোনীত রাসূল- হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহ তায়ালার এসব বাণী প্রচার করতে থাকেন।

মানবতাবাদীঃ আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে এমন কোন শিশু জন্মগ্রহণ করে নাই যে, মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু মহানবী (সাঃ) মাতৃক্রোড়েই ধাত্রী হালিমার একটি স্তন পান করে দুধ ভাইয়ের অধিকার নিশ্চিত করে মানবতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ইতিহাসে তা অদ্বিতীয়।

উপসংহারঃ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) একজন মহাজ্ঞানী, মহাসাধক, সমাজসেবক, সংস্কার, ন্যায় বিচারক, ধর্মপ্রবর্তক ও একজন বিচক্ষণ চারিত্রিক গুণের অধিকারী ছিলেন। তিনি আজীবন দীন-দরিদ্রের সেবা করে গেছেন, রুগ্ন মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, বিপদগ্রস্ত দুঃখী মানুষকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। নিজে উপবাস থেকে স্বীয় খাবার অন্যকে খাইয়েছেন। ইসলাম ধর্ম প্রচারে তার ত্যাগ তিতিক্ষা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

[সম্পাদক কর্তৃক আংশিক সম্পাদিত, পরিবর্দ্ধিত ও পরিমারিজত।]

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 400E Mosholu Parkway South Apt # A23,The Bronx, New York 10458, USA

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com