’মাওলানা’ ও ’মৌলভী’ শব্দ দু’টির অর্থ কী? ’মৌ লোভী’ কী? এক নজরে জেনে নেই।
নিউইয়র্ক থেকে ড ওমর ফারুক কর্তৃক সম্পাদিতঃ [মাওলানা শব্দটির অর্থ কী? ‘মাদ্রাসা’ কিংবা ‘দারুল উলুম’ থেকে স্নাতক পাশ করা কিংবা কোন ধর্মীয় পণ্ডিতের ছত্রছায়ায় পাণ্ডিত্য অর্জনকারী সম্মানিত ধর্মীয় মুসলিম নেতাকে ‘মাওলানা’ বলা হয়ে থাকে।‘মাওলানা’ শব্দটির টাইটেল নামের পূর্বে মূলতঃ মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশ- ভারত ও বাংলাদেশ ব্যবহৃত হয়। সাধারণ ধর্মীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে টাইটেল হিসেবে ‘মৌলভী’ শব্দটি ব্যহৃত হয়। বাংলাদেশের সরকারি ‘আলিয়া মাদ্রাসা’র নিয়মে তাদেরকেও ‘মৌলভী’ বলা হয়- যারা ‘মৌলভী’ (basic), ‘মৌলভী আলিম’ (intermediate) অথবা ‘মৌলভী ফাজিল’ (advanced) পাশ করে।
আর ’মৌ লোভী’ এর অর্থ হল, মধু লোভী। স্বার্থান্ধ মানুষেরা যখন ইসলামকে অল্প মূল্যে বিক্রি করে এবং নিজেই অল্প মূল্যে বিক্রি হয়। সামান্য দাওয়াত খেয়ে স্বজাতির স্বার্থ, ধর্ম এবং জাতির স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়, সে সবগুলোই হল ‘মৌ লোভী।’ তারা সামান্য জাগতিক স্বার্থের বিনিময়ে আল্লাহ বিদ্রোহীদের সমর্থন ও সহযোগিতা দেয়। অন্য পাপী ও দুষ্ঠাচারদের সাথে এদের বড় পার্থক্য হল, তারা অন্য পাপাচারকারীদের চেয়েও জঘন্য। কেননা অন্যরা হয়ত না জেনে অপরাধ করে ও অপরাধীদের সমর্থন দেয়। এরা নিজেরা ইসলাম সম্মর্কে জেনে পাপিষ্ঠ বা পাপিষ্ঠাকে ইসলাম’ এর লেভেল এঁটে সমর্থন দেয়। এরা সাধারণত অল্প জ্ঞান সম্পন্ন হয়। যদিও জগত জানে যে, তারা ধর্মীয় বিষয়ে সুপণ্ডিত হয়েছে। মূলতঃ তারা মুখস্থ বিদ্যা চর্চা ও তাকওয়া নিজেদের বিদ্যার্জনে ও জীেবনে প্রতিফলন না ঘটানোর কারণে এরকম কঠিত পাপাচারী ও ধর্মান্ধ হয়ে থাকে।]
আপনি জানেন কি, মাওলানা শব্দের সঠিক অর্থ কি? কিংবা ব্যক্তিদের নামের পূর্বে মাওলানা শব্দ ব্যবহার করতে হয়?
‘মাওলানা’ টাইটেলটা বিশেষত এই মধ্য-এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ‘মাদ্রাসা’ কিংবা ‘দারুল উলুম’ থেকে স্নাতক পাশ করা কিংবা কোন ধর্মীয় পণ্ডিতের ছত্রছায়ায় পাণ্ডিত্য অর্জনকারী সম্মানিত ধর্মীয় মুসলিম নেতাকে ‘মাওলানা’ বলা হয়ে থাকে। প্রয়োগের উপর নির্ভর করে একটি শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটে। ‘মাওলানা’ শব্দটি আরবী, তবে আরব থেকে ইরান, তুর্কি, আফ্রিকা এবং ভারত উপমহাদেশ ঘুরে নানান অর্থ পরিগ্রহ করেছে। যেমন- পারস্যের (ইরানের) প্রখ্যাত কবি রুমী’র নামের আগে আমরা ‘মওলানা’ ব্যবহৃত হতে দেখি। ‘মাওলানা’ শব্দটির তুর্কি উচ্চারণ হল- ‘মেভলানা’। আফ্রিকার ‘শোয়াহিলি’ ভাষায় (Swahili language) এই শব্দটি কৃতঋণ হিসেবে কোন সম্প্রদায়ের, ধর্মের সম্মানিত নেতার নামের আগে টাইটেল হিসেবে ইংরেজি ‘স্যার’-এর মত ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের ‘হাউসা’ ভাষায় (Hausa language) ‘মাল্লাম’ এবং ‘উলুফ’ ভাষার (Wolof language) ‘মাম্মে’ শব্দটি এ সকল ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। ‘হাউসা’ ভাষার ‘মাল্লাম’ শব্দটি ইংরেজী শব্দের ‘মিস্টার’-এর সমার্থক। ‘হাউসা’ ভাষার ‘মাল্লাম’, শোয়হালি ভাষার ‘মুয়ালিমু’, আরবী ভাষার ‘মু’আল্লিম’ আর মরোক্কীয় আরবীর ‘মা’আল্লাম’ শব্দটির ইংরেজী অর্থ হয় মাস্টার কিংবা টিচার।
‘মাওলানা’ শব্দটি মুসলিম ধর্মীয় পণ্ডিতের ক্ষেত্রে শ্রদ্ধাপূর্ণ অর্থবহন করে, অপরদিকে যেমন ‘মোল্লা’ শব্দটি অবমাননাকর অর্থবহন করে সেই সকল ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে, যাদের মধ্যে পাণ্ডিত্যের পরিবর্তে উত্তেজিত এবং সহিংসপূর্ণ কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে ‘মৌলভী’ এবং ‘মাওলানা’ শব্দটি একে অপরের ক্ষেত্রে অদল বদল করে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিশেষত ‘মাদ্রাসা’ কিংবা ‘দারুল উলূম’ থেকে স্নাতক পাশ করা কিংবা কোন ধর্মীয় পণ্ডিতের ছত্রছায়ায় পাণ্ডিত্য অর্জনকারী সম্মানিত ধর্মীয় মুসলিম নেতাকে ‘মাওলানা’ বলা হয়ে থাকে। অপরদিকে সাধারণ ধর্মীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে টাইটেল হিসেবে ‘মৌলভী’ শব্দটি ব্যহৃত হয়। বাংলাদেশের সরকারি ‘আলিয়া মাদ্রাসা’র নিয়মে তাদেরকেও ‘মৌলভী’ বলা হয়- যারা ‘মৌলভী’ (basic), ‘মৌলভী আলিম’ (intermediate) অথবা ‘মৌলভী ফাজিল’ (advanced) পাশ করে।
অনেকেই বলে থাকেন- ‘মাওলানা’ শব্দটা মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা ঠিক না। ওই সকল ব্যক্তিদের ব্যাখ্যা হল, কোরআনে ‘মাওলানা’ বলতে আল্লাহ্-কে বোঝানো হয়েছে।
আল-কুর’আনের দ্বিতীয় সূরা আল-বাক্বারা’র শেষের আয়াতে ‘মাওলানা’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যে আয়াতটি প্রায়শই দু’আ-মুনাজাতে পাঠ করতে শুনি। আল্লাহ্ বলেনঃ “আন্তা মাওলানা ফানসুরনা ‘আলাল কাওমিল কাফিরিন।” অর্থাৎ “তুমিই আমাদের প্রভু। সুতরাং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য কর।” (সূরা বাকারা, আয়াতঃ ২৮৬) কেউ কেউ এই আয়াতটি ব্যবহার করে বোঝাতে চায়, যেই শব্দটি আল্লাহ’র ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে তা মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা মানে হল- তাকে আল্লাহ’র পর্যায়ে উত্তীর্ণ করে ফেলা। (নাউযুবিল্লাহ্)।
আবার কারো কারো যুক্তি হল, আল-কুর’আনের বার নম্বর সূরা ইউসুফ-এর ২৩ নম্বর আয়াতে হযরত ইউসুফ (আঃ) তার আশ্রয়দাতা হিসেবে আজিজ মিশরীকে ‘ইন্নাহু রাব্বি’ অর্থাৎ (‘he is my lord’) ‘সে আমার মালিক’ সম্বোধন করেছেন। আজিজ মিশরীর স্ত্রী যখন হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে কাছে ডাকল এবং খারাপ প্রস্তাব দিয়ে আহবান করল, তখন তিনি বললেনঃ “ক্বলা মা’আযাল্লাহি ইন্নাহু রব্বি আহ্সানা মাশওয়া ইয়া” অর্থাৎ “সে বললঃ আল্লাহ্ রক্ষা করুন; তোমার স্বামী আমার মালিক; তিনি আমাকে সযত্নে থাকতে দিয়েছেন।” অবশ্যই এখানে হযরত ইউসুফ (আঃ) আল্লাহর সাথে আজিজ মিশরীকে সমকক্ষ নির্ধারণ করে বলেন নি। ঠিক একই দৃষ্টিকোণ থেকে ‘মাওলানা’ শব্দটিও স্রষ্টার জন্য খাস কোন শব্দ নয় কিংবা এটা স্রষ্টার কোন নামও নয়।
এমনকি খোদ কোরআনে আল্লাহ্ তা’আলা নিজের পাশপাশি ফেরেশতা জিবরাঈল (আ.) এবং মু’মিন-মুত্তাকি বান্দাদের ক্ষেত্রেও ‘মাওলা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আল-কোরআনে ৬৬ নম্বর সূরা আত-তাহরীমের ৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ “ইন তাতুবা ইলাল্লাহি ফাক্বাদ ছোয়াগাত ক্বুলুবুকুম; ওয়া ইনতা যোহারা আলাইহি ফা ইন্নাল্লাহা হুয়া ‘মাওলাহু’ ওয়া জিবরিলু ওয়া সোলিহুল মু’মিনীন; ওয়াল মালাইকাতু বা’দা যালিকা যোহিরুন।” অর্থাৎ “তোমাদের অন্তর অন্যায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে বলে যদি তোমরা উভয়ে তওবা কর, তবে ভাল কথা। আর যদি নবীর বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য কর, তবে জেনে রেখ আল্লাহ্, জিবরিল এবং সৎকর্মপরায়ন মুমিনগণ তাঁর সহায়। উপরন্তু ফেরেশতাগণও তাঁর সাহায্যকারী।” (সূরা আত-তাহরীম, আয়াতঃ ৪)। এখানে ‘মাওলা’ শব্দটি ‘সহায়’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
আর ’মৌ লোভী’ এর অর্থ হল, মধু লোভী। স্বার্থান্ধ মানুষেরা যখন ইসলামকে অল্প মূল্যে বিক্রি করে এবং নিজেই অল্প মূল্যে বিক্রি হয়। সামান্য দাওয়াত খেয়ে স্বজাতির স্বার্থ, ধর্ম এবং জাতির স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়, সে সবগুলোই হল ‘মৌ লোভী।’ তারা সামান্য জাগতিক স্বার্থের বিনিময়ে আল্লাহ বিদ্রোহীদের সমর্থন ও সহযোগিতা দেয়। অন্য পাপী ও দুষ্ঠাচারদের সাথে এদের বড় পার্থক্য হল, তারা অন্য পাপাচারকারীদের চেয়েও জঘন্য। কেননা অন্যরা হয়ত না জেনে অপরাধ করে ও অপরাধীদের সমর্থন দেয়। এরা নিজেরা ইসলাম সম্মর্কে জেনে পাপিষ্ঠ বা পাপিষ্ঠাকে ইসলাম’ এর লেভেল এঁটে সমর্থন দেয়। এরা সাধারণত অল্প জ্ঞান সম্পন্ন হয়। যদিও জগত জানে যে, তারা ধর্মীয় বিষয়ে সুপণ্ডিত হয়েছে। মূলতঃ তারা মুখস্থ বিদ্যা চর্চা ও তাকওয়া নিজেদের বিদ্যার্জনে ও জীেবনে প্রতিফলন না ঘটানোর কারণে এরকম কঠিত পাপাচারী ও ধর্মান্ধ হয়ে থাকে।
সবে শেষে মৌ লোভী নিয়ে কাজী নজরুল কি লিখে গেছে, দেখুনঃ
মৌ-লোভী যত মৌলভী আর ‘মোল-লারা’ ক’ন হাত নেড়ে,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে !’
ফতোয়া দিলাম কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও !
‘আম পারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে !’
হিন্দুরা ভাবে, ‘পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে !
আনকোরা যত ননভায়োলেন্ট নন্-কো’র দলও নন্ খুশী ।
‘ভায়োলেন্সের ভায়োলিন’ নাকি আমি, বিপ্লবী -মন তুষি ।
‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে,
‘নয় চরকরা গান কেন গা’বে ?’
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কনফুসি !
স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের অঙ্কুশি !
নর ভাবে , আমি বড় নারী -ঘেঁষা ! নারী ভাবে, নারী বিদ্বেষী ।
‘বিলেত ফেরনী ?’ প্রবাসী বন্ধু ক’ন, এই তব বিদ্যে ছি !
ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি !’-
যুগের না হই, হুজুগের কবি
বটি তো রে দাদা , আমি মনে ভাবি, আর ক’ষে কষি হৃদ- পেশী,
দু’কানে চশমা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্ বেশী !
তথ্যসূত্রঃ
১. উইকিপিডিয়া সহ বিভিন্ন ইসলামিক সাইট থেকে লেখাটি তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
২. পবিত্র কোরআনুল করীম।
৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/এমআর