মধ্যপ্রাচ্যে নির্যাতিত বাংলাদেশি নারী শ্রমিক।
‘আমরাও মানুষ, আর নির্যাতিত হতে চাই না। আমরা বাংলাদেশে ফিরতে চাই। মা-বাবার মুখ দেখতে চাই। স্বামীর সাথে সংসার করতে চাই। বেতন আটকে রাখছে, খাবার ঠিকমতো দেয় না। এভাবে আর কতদিন থাকব সৌদি আরবে?’
বেসরকারিভাবে দুই বছরের চুক্তিতে সৌদি আরবে গিয়ে ‘আটকে পড়া’ একাধিক বাংলাদেশি নারীকর্মী এ কথা বলেন। তাঁদের দাবি, চুক্তি অনুযায়ী দুই বছর পর বেতন ও বোনাস পরিশোধ করে তাঁদের দেশে ফেরত পাঠানোর কথা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু এখনো বেতন ও বোনাস বাকি। দেশেও ফেরানোর উদ্যোগ নিচ্ছে না ওই প্রতিষ্ঠান।
তাঁদের পাঁচজনের সঙ্গে এনটিভি অনলাইনের কথা হয়। সৌদি আরব থেকে ফোনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলে দুর্দশার কথা জানান তাঁরা।
তাঁরা জানান, সৌদি আরবের খালফা এলাকায় ২ নম্বর মিনা রোডের ম্যানপাওয়ার সার্ভিসেস কোম্পানি (ইসাদ) গ্রুপের একটি ভবনে তাঁদের আটকে রাখা হয়েছে। ওই ভবনে মোট ৪০ থেকে ৪৫ জন বাংলাদেশি নারী আছেন বলেও তাঁরা জানান। তাঁদের সাতজনের দুই বছরের চুক্তি শেষ হয়েছে।
ওই নারীদের একজন বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যখন আমরা সৌদিতে এসেছিলাম তখনই তাদের সাথে চুক্তি ছিল দুই বছর পরে বেতনসহ বোনাস পরিশোধ করে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু অনেকের এখনো বেতনই বাকি! অথচ তাদের কন্ট্রাকের মেয়াদ শেষ। আর দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তাদের কোনো উদ্যোগই নেই!’
ওই নারী আরো বলেন, দুই বছরের চুক্তি শেষে তিন হাজার রিয়াল বোনাস দেওয়ার কথা থাকলেও কাউকেই দেওয়া হয়নি বোনাস।’ ম্যানপাওয়ার সার্ভিসেস কোম্পানি (ইসাদ) অফিসে বোনাসের ব্যাপারে বারবার বলা হলেও তাঁদেরকে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন তাঁরা। বরং বিভিন্ন ছলচাতুরি করে তাঁদের আটকে রাখা হচ্ছে।
ওই নারী জানান, ভিশন ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে তাঁরা সৌদি আরবে যান। ভিশন ইন্টারন্যাশনাল আবার তাঁদের সৌদিতে অবস্থিত ম্যানপাওয়ার সার্ভিসেস কোম্পানির (ইসাদ) কাছে হস্তান্তর করে।
ওই নারী আরো জানান, এ ছাড়া আরো যে নারী গৃহকর্মীরা আছেন তাঁদের চুক্তিও আগামী মাসের ভেতরে শেষ হয়ে যাবে। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে কন্ট্রাক শেষ হওয়ার আগেই অনেকে বাংলাদেশে ফেরার জন্য আবেদন করলেও তাঁদের দেশে ফিরতে দেওয়া হয়নি। বেতন-বোনাস আটকে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া তাদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছে, যাতে তাঁরা তাঁদের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারেন। এবং তাঁদের জোর করে বাসাবাড়িতে কাজে পাঠানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে।
আনিসা বেগম (ছদ্মনাম) (১৮) নামের এক নারী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমার কন্ট্রাক শেষ হয়েছে গত নভেম্বর মাসের ১২ তারিখে। আমি ১২ তারিখ থেকেই অফিসকে বারবার জানাচ্ছি যে আমি বাংলাদেশে যেতে চাই। সেই সময় থেকেই আজ না কাল, কাল না পরশু বলে বলে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে তারা। কবে যে যেতে পারব সেটাও বুঝতে পারছি না। আসলে কখনো যেতে পারব কি না, সেই ভয়ও কাজ করছে।’
আনিসা আরো বলেন, ‘আমাদের বাংলাদেশিদের দেখাশোনা করেন রাশেদা খালা নামে এক নারী। গত দুদিন ধরে তাঁরও কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। শেষ আর কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে বিমানবন্দর থেকে আপনার নম্বর ম্যানেজ করে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আপনাদের সহযোগিতা চাচ্ছি। এখানে যাঁরা আছেন, তাঁরা কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।’
আনিসা আরো বলেন, ‘আমরা ছাড়াও যাঁরা এখানে আছেন, যাদের এখনো কন্ট্রাক শেষ হয়নি, তাঁদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাঁদের বেতন আটকে রেখেছে। বিভিন্নভাবে তাঁদের নির্যাতন করা হচ্ছে। যোগাযোগ করতে দেওয়া হচ্ছে না বাড়িতেও।’
চুক্তি শেষ হওয়া কুসুম আক্তার (ছদ্মনাম) এখনো মূল বেতন পাননি। বোনাসও বাকি আছে। গত ২৯ নভেম্বর কুসুমের চুক্তি শেষ হয়েছে।
আসমা আক্তারের চুক্তিও শেষ হয়েছে গত মাসে। তাঁর এক হাজার রিয়াল পাওনা। আসমা কিডনি রোগে আক্রান্ত। তাঁর অসুস্থতার কথা বলে বারবার দেশে যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না কর্তৃপক্ষ।
তাঁদের একজন বলেন, ‘কিছুদিন আগে একটা মিডিয়া একজনের সঙ্গে কথা বলেছিল। তারপর সেই মহিলাকে মিডিয়া খারাপভাবে উপস্থাপন করেছে। সেই ঘটনার পরে ওই নারীর স্বামী তাঁকে তালাকও দিয়েছে। আর পরিবার-পরিজনের ভয় তো আছেই। কে কোনভাবে, কীভাবে তার ঠিক নেই। দেখা যাবে দেশে ফিরেও আমরা লাঞ্চিত হচ্ছি!’
তিনি আরো বলেন, ‘আর ভুল করেও যদি ইসাদ কোম্পানির লোকজন জেনে যায় যে আমরা আপনাদের সাথে যোগাযোগ করেছি তখন আমাদের মোবাইল কেড়ে নিবে। মারধর তো আছেই। সব মিলিয়ে আমরা এমন এক বিপদে আছি যে আমরা কিছুই করতে পারছি না।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা দেশে ফিরতে চাই। আজ-কালের ভিতরেই দেশে ফিরতে পারলে বেঁচে যাই। আর ভালো লাগছে না।’
ইসাদ কোম্পানির রাশেদা খাতুনের সঙ্গে চুক্তি শেষ হওয়া ওই নারীরা যোগাযোগ করলে তিনি তাঁদের জানান, ‘আপনাদের বাবা-মাকে বলেন বাংলাদেশি অফিসে যোগাযোগ করতে। তারা যদি কিছু করতে পারে তাহলে তো ভালোই হয়। আমরাও চাই আপনারা দ্রুত দেশে ফিরে যান। এখন এই অফিসের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে। জানি না কীভাবে কী করবে।’
রিক্রুটিং এজেন্সি ভিশন ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপক (জেনারেল ম্যানেজার) মো. রফিক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ম্যানপাওয়ার সার্ভিসেস কোম্পানি (ইসাদ)-এর কাছে আমরা ওই সময় নারী গৃহকর্মীদেরকে পাঠিয়েছিলাম। ইসাদ কোম্পানিকে পাঠানো তিনজন নারীর ব্যাপারে তথ্য আমাদের কাছে এসেছে। আমরা সরকারের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। সম্মানের সঙ্গে তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠাতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা চেষ্টা করছি যাতে তাদেরকে দ্রুতই দেশে আনা যায়।’
রিয়াদে অবস্থিত সৌদির বাংলাদেশ দূতাবাসের ডেপুটি সেক্রেটারি মো. সারোয়ার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ইসাদ একটি ভালো কোম্পানি, সাধারণত এমন হওয়ার কথা না। তবে ওই নারীদের অভিযোগ আমরা কালকেই তদন্ত করে দেখব। তারপরে তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে দিতে যা যা করা লাগে আমরা করব।’
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ড. নমিতা হালদার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘যে সকল রিক্রুটিং এজেন্সি ওই সকল নারীদের সৌদিতে পাঠিয়েছে এর দায় কিন্তু তাদের। তারা জানে কী কারণে তাদেরকে আসতে দিচ্ছে না। তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসার দায়িত্বটাও কিন্তু তাদের। দেখেন তাদেরকে আবার অন্য কোম্পানির কাছে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক বিক্রি করে দিয়েছে কি না!’
নমিতা হালদার আরো বলেন, ‘নাভিরা ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি রিক্রুটিং এজেন্সির নামে কিছুদিন আগে আমাদের কাছে ঠিক এমন ধরনের অভিযোগ এসেছিল। আমরা কিন্তু তাদেরকে শোকজ করেছি এবং কেন এমন হচ্ছে তা জানতে চেয়েছি। ভালো হয় ওই সকল নারীদের এখুনি সৌদি দূতাবাসের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।’