মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দুর্দিন, জরুরি অবস্থা থাকুক কী না থাকুক।

August 14, 2018 9:27 pm0 commentsViews: 33
সিদ্ধার্থ ভাটিয়া, 

ত্রস্ত-ব্যস্ততা থামানোর সময় এখন। আমরা এখন ভারতে যা কিছু দেখছি তা ক্লাসিক ফ্যাসিবাদ হোক বা না হোক, তা বন্ধ করতে হবে। পরিস্থিতি ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার মতো কিনা তা নিয়ে যুক্তিতর্ক অপ্রাসঙ্গিক। ওইসব কিতাবি ধ্যান-ধারণা সেমিনার কক্ষ ও একাডেমিক আলোচনায় কথা যেতে পারে, যেখানে উচ্চমনা পণ্ডিতেরা বাস্তবতার চেয়ে তত্ত্বে মজে থাকে। কিন্তু মতপার্থক্য দমনের এই সময়ে সাধারণভাবে ওইসব সংজ্ঞা নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোচনার কোনো মানে হয় না।

বস্তুত, কেবল ভিন্নমতেরই কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে না, তথ্য পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হচ্ছে।

মিডিয়াকর্মী হিসেবে আমার সহকর্মীরা ও আমি সত্য প্রকাশ বন্ধ করতে শীতল ও শক্ত হাত অনুভব করি। পুনিয়া প্রসূন বাজপাইয়ের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করুন। তিনি জানিয়েছেন, তার শোতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নাম উল্লেখ না করার জন্য তাকে নিষেধ করেছিলেন খোদ টিভি চ্যানেলটির মালিক।

সরকারের সমালোচনাপূর্ণ প্রতিবেদনের জন্য বাজপাই ও তার সহকর্মী মিলিন্দ খানদেকারের চাকরি চলে গেছে। তাদের তথ্য ও বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদনটি ছিল ‘বাড়াবাড়ি’। এখানেই শেষ নয়। মাস্টারস্ট্রোক নামে পরিচিত বাজপাইয়ের শোটি চ্যানেলটির মর্যাদা ও ভিউয়ার বাড়িয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনুষ্ঠানটি কয়েক দিনের জন্য ক্যাবল ও স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে পাওয়া যায়নি।

এটি কেবল মিডিয়ার ক্ষেত্রেই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে কমেডিয়ান কুনাল কর্ম দেখেছেন, বাদোদারার এমএস বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শো বাতিল হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সাবেক ছাত্ররা তাকে ‘জাতীয়বিরোধী’ হিসেবে অভিহিত করায় তাকে এই অবস্থায় পড়তে হয়েছে। তারা দাবি করেন, ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে বারোদিয়ার যুবকদের মন কলুষিত করার আদর্শগত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এই শোয়ের আয়োজন করা হয়েছে। অডিটোরিয়ামের সমন্বয়কারীরা জানিয়েছেন, তাদেরকে বলা হয়েছে, তার শো ‘জাতীয়বিরোধী ও বিতর্কিত’ উপাদানে ভরা।

কিংবা ‘ডায়ালগ অন ফ্রিডম অব এক্সপ্রেসন’ শীর্ষক ইভেন্টটির কথা বিবেচনা করুন। অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের সদস্যদের প্রতিবাদের মুখে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় সেটি বাতিল করেছে। সঙ্ঘ পরিবারের অঙ্গ সংগঠন এবিভিপির কাছে অনুষ্ঠানটির শিরোনামটিই ক্রোধ সৃষ্টিকারী। প্রথমত, এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিষয়ক। এটি তাদের কাছে অভিশাপের মতো কিছু। দ্বিতীয়ত, এটি একটি সংলাপ। এটি পুরোপুরি সংগঠনটির সদস্যদের কাছে ভিন্ন। তাদের কাছে ‘কর্মকর্তাদের’ সাথে ভিন্নমত প্রকাশ করা কোনোভাবেই অনুমোদিত নয়।

যেকোনো ধরনের বক্তব্য রাখা বা ভিন্নমত প্রকাশ করার স্বাধীনতা যে কঠিন পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে, সে ব্যাপারে আমাদের উদার ও বাম বুদ্ধিজীবীদের কাছে কি আরো প্রমাণ দিতে হবে? হ্যাঁ, জরুরি অবস্থার সময় সাংবাদিকেরা জেলে ছিলেন, সংবাদপত্রকে সরকার ক্ষুব্ধ হতে পারে, এমন খবর প্রকাশের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হয়েছে। এখন সংবাদপত্রের মালিকেরা তাদের সম্পাদকদের খবর প্রচার করতে দিচ্ছেন না বা তাদের লাথি মেরে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। হঠাৎ করেই সম্পাদকেরা চাকরি হারাচ্ছেন, মিডিয়া কোম্পানিগুলোতে হানা দেয়া হচ্ছে, তাদের চ্যানেলগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে, সাংবাদিকদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি কি ভিন্ন? এখনকার চেয়ে তখনকার পরিস্থিতির তুলনা করা ঠিক নয়। কঠোর সত্য হলো, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার সব আইনই এখনো বহাল রয়েছে, সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে উচ্চস্থান থেকে আসা নির্দেশ মেনে নিতেই হচ্ছে।

যা হওয়ার কথা ছিল, সবাই হয়েছে।নরেন্দ্র মোদি যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন গুজরাটে তিনি চেপে রেখেছিলেন। গুটিকতেক যে কয়েকবার রাজ্যের বাইরে তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন, কোনোবারই তিনি তার প্রতি আক্রমণাত্মক বা বৈরী বিবেচিত কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি। তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইতেন এবং যখন তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত, তিনি অনুষ্ঠানটি বাতিল করে দিতেন। এমন ঘটনাই ঘটেছিল করন থাপারের সাথে সাক্ষাতকারের ক্ষেত্রে। তিনি কথোপকথন চালিয়ে যেতে না পেরে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বর্তমানের ভারত সরকার ইমেজ ব্যবস্থাপনার প্রতি মোহগ্রস্ত। তার মন্ত্রীরা তাকে সবসময় প্রশংসাভাজন নব-ঈশ্বর হিসেবে তুলে ধরতে ব্যস্ত।

তিনি গুজরাটে সংবাদ সম্মেলন কঠোরভাবে মোকাবিলা করতেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সাড়ে চার বছরের সময়কালে একবারও সংবাদ সম্মেলন করেননি। তিনি যে কয়েকটি সাক্ষাতকার দিয়েছেন, তার সবই দিয়েছেন নতজানু অ্যাঙ্করকে। এসব অ্যাঙ্কর তার পদতলে লুটিয়ে পড়ার দিকেই মনোযোগী ছিল।

অথচ মিডিয়ার সাথে তিক্ত সম্পর্ক রক্ষাকারী ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত ব্যক্তিগতভাবে ও সম্মিলিতভাবে মিডিয়ার সাথে কথা বলেন। কিন্তু মোদি তাদের সামনে দাঁড়াতে চান না।

তিনি মিডিয়ার সামনে আসতে না চাইলেও মিডিয়াকে তিনি কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, মিডিয়া হাউসগুলোতে নিয়মিত নির্দেশনা পাঠিয়ে থাকেন।

বাজপাইয়ের ঘটনার পর মনে হয়েছে, পেশাদার ঐক্যের কোনো আন্দোলন হবে না বা ব্যক্তিগত বা সম্মিলিতভাবে সরকারের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ হবে না। কিছু হালকা বিবৃতি দিয়েই কর্তৃব্য শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করা হবে। অথচ ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন সংবাদ সম্মেলনে সিএনএনের এক সাংবাদিককে বিদ্রুপ করেছিলেন, তখন ফক্স নিউজে তার সহকর্মী তার পক্ষাবলম্বন করেছিল, তার হয়ে প্রেসিডেন্টের মন্তব্যে আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতে তেমনটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ভারতে মিডিয়া সংস্থাগুলো ঐতিহ্যগতভাবেই দুর্বল। এখন তারা সত্যিকার অর্থেই কৌতুকে পরিণত হয়েছে।

এখানে বর্তমান পরিস্থিতির বিশ্লেষণ দেয়ার কাজ হচ্ছে না। সেটা করবে ইতিহাসবিদেরা। এখন উদ্দেশ্য হলো উঠে দাঁড়িয়ে বলা উচিত, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমনকে মেনে নেয়া হবে না। এমন দমন-নিপীড়ন ভারতের ঐতিহ্যের পরিপন্থী এবং সেইসাথে অসাংবিধানিক। সাহসী সাংবাদিকেরা কঠিন পরিস্থিতেও সবচেয়ে কঠিন দায়িত্বটি পালন করেছেন- এমন উদাহরণ অনেক আছে।

অ্যালিস যখন হামটি ডামটিকে জিজ্ঞাসা করলেন যে একটি শব্দের অনেক অর্থ থাকতে পারে কিনা: ‌‘প্রশ্ন হলো কে প্রভূ, সেটিই আসল ব্যাপার।’ যারা কথা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তারা প্রভূ হতে চায়। বিষয়টি এখন তাদের হাতে যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, গর্তে না লুকিয়ে প্রতিরোধ করতে চায়।

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 400E Mosholu Parkway South Apt # A23,The Bronx, New York 10458, USA

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com