আমেরিকায় সন্ত্রাসবাদী কার্যপলাপের পেছনে দেশের অভিবাসন নীতিই অনেকাংশে দায়ী। এমনটাই মনে করেন প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্প। এ বার তা সংস্কারে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে নতুন আইনের প্রস্তাব করলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকেই নির্বাচনী প্রচার সভাগুলোতে অভিবাসন নীতির কড়া সমালোচনায় মুখর ছিলেন ট্রাম্প। বেআইনি অভিবাসন রুখতে মেক্সিকো সীমান্তে দেওয়াল তৈরি থেকে শুরু করে একাধিক মুসলিম দেশের নাগরিকদের জন্য আমেরিকার দরজা বন্ধের কথাও বলতেন তিনি। গত ৩ মঙ্গলবার মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনের মঞ্চকে ব্যবহার করে ফের একবার দেশে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ রুখতে অভিবাসন নীতির সংস্কারের উপরই জোর দিলেন ট্রাম্প।

স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে তিনি প্রস্তাব করলেন, লটারির মাধ্যমে নয়, মেধার ভিত্তিতেই অভিবাসীদের ভিসা দেওয়া হোক। মার্কিন কংগ্রেসে এই মর্মে আইন তৈরির আর্জিও জানালেন। ট্রাম্পের মতে, সাম্প্রতিককালে নিউইয়র্কে দু’টি হামলার পেছনে রয়েছে অভিবাসন নীতির শিথিলতা। লটারির মাধ্যমে গ্রিন কার্ড বিলি করার মত নিয়ম বদল করার উপর জোর দিয়েছেন তিনি। ভিসা পেতে আবেদনকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতাকেই মূল মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করার প্রস্তাব করেছেন তিনি।

ট্রাম্পের এই প্রস্তাব আইনে পরিণত হলে সুবিধা পাবেন অসংখ্য ভারতীয় পেশাদার, যাঁরা রুজির খোঁজে প্রতি বছর  আমেরিকায় পাড়ি দেন। ফি-বছর জেনারেল ক্যাটাগরিতে ৬৫ হাজার বিদেশিকে এইচ-১বি ভিসা দেয় মার্কিন নাগরিকত্ব ও অভিবাসী পরিষেবা দফতর (ইউএসসিআইএস)। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ওই ধরনের আরও ২০ হাজার  ভিসা ইস্যু করে মার্কিন প্রশাসন। ইউএসসিআইএস-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গোটা বিশ্ব থেকে এইচ-১বি ভিসার জন্য আবেদনের বেশির ভাগটাই আসে ভারত থেকে। ২০০১ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত এইচ-১বি ভিসা নিয়ে আমেরিকায় গিয়েছেন  ৮৯ লক্ষ ২৮ হাজার ১৪ জন ভারতীয়। এই মুহূর্তে আমেরিকায় রয়েছেন প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ ভারতীয় পেশাদার।

এ দিন ট্রাম্প বলেন, “মেধানির্ভর অভিবাসন নীতির পথে এগোনোর সময় এসেছে। যাঁরা দক্ষ, কাজ করতে চান, সমাজের উন্নতিতে অবদান রাখতে চান বা আমাদের দেশের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালবাসা রয়েছে, তাঁদেরই স্বীকৃতি মিলবে।”

চিরাচরিত ভাবে বছরে এক বার দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেন দেশের প্রেসিডেন্ট। প্রথাগত ভাবে একে স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণ বলা হয়। অভিভাসন নীতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেওয়া ছাড়াও কম বয়সে মা-বাবার সঙ্গে যাঁরা বেআইনি ভাবে মার্কিন মুলুকে প্রবেশ করেছেন, ‘ড্রিমার’ বলে পরিচিত এমন ১৮ লক্ষ বেআইনি অভিবাসীদের নাগরিকত্ব নিয়েও নমনীয় হয়েছেন ট্রাম্প।

অভিভাসন নীতি সংস্কারের প্রশ্নে বিরোধীদের সঙ্গেও হাতে হাত মিলিয়ে এগোতে চান ট্রাম্প। পাশাপাশি তিনি আশা প্রকাশ করেন, তাঁর প্রস্তাবে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট— দুই দলই ঠিকঠাক সমঝোতায় আসতে পারবে। এতে কোনও এক পক্ষ সুবিধা ভোগ করবে না, বরং দেশে প্রয়োজনীয় সংস্কার হবে।

অভিভাসন নীতির সংস্কারে নিজের প্রস্তাবে মূলত চারটি দিকের কথা উল্লেখ করেছেন ট্রাম্প। তিনি জানিয়েছেন, প্রথমত, ১৮ লক্ষ বেআইনি অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার রাস্তা সহজ করা হবে। যাঁরা কম বয়সে মা-বাবা বা কোনও আত্মীয়ের সঙ্গে বেআইনি ভাবে এ দেশে ঢুকেছেন, তাঁরা যদি শিক্ষা এব‌ং কাজের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তপূরণ করতে পারেন, নৈতিক চরিত্র ভাল হলে তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারবেন।

দ্বিতীয়ত, বেআইনি অভিবাসীদের মুখের উপর আমেরিকার দরজা বন্ধ করতে দেশের দক্ষিণ সীমান্ত বরাবর দেওয়াল তোলার কথাও এ দিন উল্লেখ করেছেন ট্রাম্প। অভিবাসন আইনের ফাঁকফোকর গলে দেশে যাতে অপরাধী ও সন্ত্রাসবাদীরা না ঢুকতে পারে, সে দিকে নজর দেওয়াই এই প্রস্তাবের লক্ষ্য বলে দাবি করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

তৃতীয়ত, লটারির মাধ্যমে ভিসা দেওয়ার নীতি থেকেও সরতে চাইছে ট্রাম্প প্রশাসন। ফলে গ্রিন কার্ড আবেদনকারীর শিক্ষাগত বা পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি মার্কিন নাগরিকদের সুরক্ষার দিকটিও নিশ্চিত করা যাবে বলে মনে করে সরকার।

চতুর্থত, বর্তমান আইন অনুযায়ী, এক জন অভিবাসী পরিবারের একাধিক সদস্য এমনকী দূরসম্পর্কের আত্মীয়দের সঙ্গে নিয়ে আমেরিকায় পা রাখতে পারেন। নতুন প্রস্তাবে সেই প্রথা বন্ধ হবে। ট্রাম্পের প্রস্তাব, অভিবাসীরা পরিবারের কত জন সদস্য বা শিশুদের সঙ্গে নিয়ে আমেরিকায় আসতে পারবেন, সেই সংখ্যাতে রাশ টানা হবে।

ট্রাম্পের মতে, “আমাদের অর্থনীতি তো বটেই, দেশের সুরক্ষা এবং ভবিষ্যতের জন্যও এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলি জরুরি।” দেশের অভিবাসন নীতি যে সময়োপযোগী নয় তা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “সেকেলে  অভিবাসন নিয়ননীতি পাল্টানোর সময় এসেছে। আমাদের অভিবাসন নীতি একুশ শতকের উপযোগী করতে হবে।”

ড্রিমারদের জন্য আশ্বাস নেই ট্রাম্পেরঃ

আমেরিকার স্বপ্নে এখন দেশের চেয়ে দেশের ভূমিপুত্রদের জোর বেশি, প্রথম স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন বক্তৃতায় সেটাই স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

দেশের অর্থনীতি এবং উন্নয়নের স্বার্থে এক দিকে রইল বিশ্ব অর্থনীতির অন্য শক্তিগুলির প্রতি হুঁশিয়ারি, অন্য দিকে অভিবাসনে রাশ টেনে তথাকথিত দেশবাসীদের অগ্রাধিকার।

ট্রাম্প জানিয়ে দিলেন, আমেরিকার ‘আর্থিক আত্মসমর্পণের’ যুগ শেষ। সেই সব দেশের সঙ্গেই আমেরিকার নয়া বাণিজ্যিক চুক্তি হবে, যারা ব্যবসায় স্বচ্ছ এবং পারস্পরিক নির্ভরতা বজায় রাখবে। নাম না করলেও ইঙ্গিতটা মূলত চিনের দিকে বলেই মনে করা হচ্ছে।

অন্য দিকে মার্কিন পরিবার এবং মার্কিন কর্মীদের স্বার্থ মাথায় রেখেই অভিবাসন নীতির ভাবনা। মঙ্গলবার হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস চেম্বার-এ সামনের সারিতে বসেছিলেন অজস্র অভিবাসী, যাঁদের ভবিষ্যৎ এই মুহূর্তে অনিশ্চিত। এঁদের অনেকেই ‘ড্রিমার’, অর্থাৎ শিশু অবস্থাতেই কোনও রকমে বেড়া ডিঙিয়ে আমেরিকায় চলে এসেছেন। এই ‘অবৈধ’ অভিবাসীরা এত দিন আইনি সুরক্ষা পেয়েছেন, ট্রাম্প তা টেনে নিয়ে যেতে রাজি নন।

 ডেমোক্র্যাটরাই এই ড্রিমারদের নিয়ে এসেছিলেন অনুষ্ঠানে, সামনের সারিতে তাঁদের বসিয়ে ট্রাম্পের উপরে চাপ তৈরি করাই ছিল উদ্দেশ্য। ওই যুবক-যুবতীরাও আশা করছিলেন, ট্রাম্প হয়তো তাঁদের জন্য কিছু বলবেন। ট্রাম্প বললেন ঠিকই, তাতে তাঁদের দুশ্চিন্তাই বাড়ল। ট্রাম্প ঘোষণা করলেন, ‘‘মার্কিনরাও তো ড্রিমার!’’
অভিবাসন নীতি নিয়ে অস্থিরতার জেরে এ বছরের গোড়াতেই তিন দিনের জন্য স্তব্ধ (শাট ডাউন) হয়ে গিয়েছিল সরকার। হাউসের সদস্যরা ‘ড্রিমার্স’ নিয়ে এখনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। ৫ মার্চের পরে এই সব অভিবাসী আমেরিকা ছাড়তে বাধ্য হবেন যদি কংগ্রেস ‘ডাকা প্রকল্প’ (ডেফার্ড অ্যাকশন ফর চাইল্ডহুড অ্যারাইভালস) নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে না পৌঁছতে পারে। দেশে এক কোটিরও বেশি অনথিভুক্ত অভিবাসীর মধ্যে শিক্ষাগত যোগ্যতা, নৈতিক চরিত্র ইত্যাদির মাপকাঠিতে ১৮ লক্ষ নাগরিকত্বের দিকে এগিয়ে যাবেন, সম্প্রতি এমন এক প্রস্তাবের কথা বলেছেন ট্রাম্প। কিন্তু কংগ্রেস কেন এ নীতি নিয়ে আলোচনা করছে বা এতে সিলমোহর দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা নিয়ে আজকের বক্তৃতায় কিছুই বলেননি তিনি।
হাউসে ‘ড্রিমার’দের পক্ষে নেত্রী ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, ‘‘ওঁরা আমেরিকাকে আরও আমেরিকান করে তোলেন।’’ রিপাবলিকানদের সবাই অবশ্য সে আশ্বাসবাণী দিচ্ছেন না। ব্যবসা ক্ষেত্রে মার্কিন কর্মীদের সুরক্ষা দিতে ট্রাম্প চান তাঁর প্রশাসন খারাপ ব্যবসায়িক চুক্তিগুলোর ত্রুটি দূর করতে সক্রিয় হোক। নতুন চুক্তিগুলো করার সময়েও যেন মার্কিন নাগরিকদের কথা মাথায় রাখা হয়, বলেছেন প্রেসিডেন্ট। তাঁর সাফ কথা, ‘‘ব্যবসায়িক নীতির কঠোর প্রয়োগ করে আমেরিকার কর্মী এবং মার্কিন মেধাস্বত্ত্ব রক্ষা করব আমরা। আর্থিক আত্মসমর্পণের যুগ একেবারে শেষ।’’ [আনন্দবাজার]