ভাষা আন্দোলন ও ভাষা ভাবনা।

February 21, 2018 4:36 pm0 commentsViews: 22

Abū Samīhah Sirājul Islām

2. মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারের দাবীতে সালাম বরকত রফিক জব্বাররা প্রাণ দিয়েছিল – এটাও মিথ্যা কথা।
3. জিন্নাহর নিজের ভাষা তিনি আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন – পুরা ফালতু কথা।
4. পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছিল – ঝুট বাত।
5. ভাষা আন্দোলন না হলে আমরা বাংলায় কথা বলতে পারতাম না – বাজে কথা।
6. সংখ্যা গরিষ্ঠের ভাষাই রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিৎ – not necessarily।

1. ১৯৪৮ – ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছে তা হল রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন। ওটা মাতৃভাষার আন্দোলন নয়। উপমহাদেশে মুসলিমদের শাসন চালু হওয়া থেকে নিয়ে ১৮৫৭ সালের বিপ্লব পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা ছিল ফারসী। এর আগে ছিল সংস্কৃত। ১৮৫৭ এর বিপ্লবের পরে ইংরেজরা সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজীকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চালু করে; একই সাথে তারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় ভাষাগুলোকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করার করার জন্য সেগুলোর স্ট্যান্ডার্ড গদ্যরূপ দিয়ে স্কুলে পড়ানোর ব্যবস্থা করে। মুঘলদের সময় থেকে রাষ্ট্রভাষা ফার্সির সাথে সাথে সারা ভারতে লোকদের লিঙ্গুয়া-ফ্রাঙ্কা হিসাবে হিন্দুস্তানী [উর্দু] ভাষার ব্যবহার শুরু হয়। ইংরেজ আমলে এই উর্দুর উপর ভিত্তি করে সংস্কৃত সমৃদ্ধ ও দেবনাগরী বর্ণমালায় লিখার ব্যবস্থা করে হিন্দী চালু করা হয়। যাই হোক ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলে রাষ্ট্রভাষার বিষয়টা উঠে আসে। সেখানে পাকিস্তানের নেতারা চিন্তা করেছেন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার, অর্থাৎ সরকারী কর্মকাণ্ডে উর্দু ব্যবহার করা হবে। এখানে মাতৃভাষার কিছু নাই। এটা দিয়ে কাউকে তার মাতৃভাষায় কথা বলা বা লিখা থেকে বিরত রাখার কোন চেষ্টা করা হয়েছে বুঝায় না। সুতরাং “ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিবার চায়” বলে যে গান বানানো হয়েছে তা জঘন্য একটা মিথ্যা কথা। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৪৮ সালে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন ভাষা নিয়ে তাতে তিনি স্পষ্ট করে করে বলেছেন যে পূর্ব্বাংলার ভাষা কী হবে তা পূর্ববাংলার জনগণ ও নেতারা ঠিক করবে, তবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু। রাষ্ট্র ভাষা আর মাতৃভাষা ভিন্ন বিষয়।

2. সালাম বরকত রফিক জব্বার কেউই মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দেন নি। আমরা আগেই বলেছি, আন্দোলনটা ছিল বাংলাকেও পাকিস্তানের অন্যতম একটা রাষ্ট্রভাষা বানানোর দাবীতে। ৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারী ছাত্ররা অবৈধভাবে গভর্ণর হাউসে আক্রমন করতে গেলে ইপিআর এর সৈন্যরা গুলি ছোঁড়ে। এতে রাস্তার পথচারী বা বাইস্ট্যান্ডার হিসাবে গুলি খেয়ে মারা যান উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ। তারা কেউই আন্দোলনকারী ছিলেন না। এরপরের কথা হল গভর্ণর ছিলেন বাঙালী – নুরুল আমীন এবং ইপিআর এর ঐ সৈন্যরাও ছিল বাঙালী।

3. #জিন্নাহ উর্দুভাষী ছিলেন না। সুতরাং তাঁর মাতৃভাষা আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছিলেন বলে যে কথা বলা হয় তা একটা ডাহা মিথ্যা কথা। জিন্নাহ সাহেবের মাতৃভাষা ছিল গুজরাতী। দেশি ভাষাগুলোর মধ্যে তিনি আরো দুইটা জানতেন; সেগুলো হল সিন্ধী ও কুচী। তিনি উর্দু জানতেন কিনা এটা কেউ জানে না। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাও ছিল ইংরেজীতে। মাতৃভাষা উর্দু ছিল দুই বাঙালী নেতার – খাজা নাজ়িমুদ্দীন ও হোসেন শহীদ সোহরাবর্দী।

4. পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছিল বলে যে কথা বলা হয় এটাও একটা জঘন্য মিথ্যা কথা। #উর্দু পশ্চিম পাকিস্তানের কোন অঞ্চলের ভাষা না। পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানীয় ভাষা হিসাবে যে সমস্ত ভাষা প্রচলিত ছিল ও আছে তা হলঃ #পাঞ্জাবী#সেরাইকী#হিন্দকো#সিন্ধী#কুচী#পশতু#বালুচী#ব্রাহুই#শিনা#কাশ্মীরী, ইত্যাদি। উর্দু হল উত্তর ভারতের দিল্লী ও তার আশ পাশের লোকদের মাতৃভাষা। তবে এটা মুসলিম আমলে এবং ইংরেজ আমলেও একমাত্র সর্বভারতীয় ভাষা হিসাবে প্রসার লাভ করে। সেজন্য উর্দু ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে আগত উত্তর ভারতীয় মুহাজিরদের মাতৃভাষা।

5. ভাষা আন্দোলন না হলেও আমরা বাংলায় কথা বলতাম ঠিক সেভাবে – এখনও যেভাবে বলি। রাষ্ট্রভাষার প্রভাব মানুষের উপর থাকলেও স্থানীয় ভাষা ব্যবহারে কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল না সরকারী ঘোষণাতে। তাই বাংলার ব্যবহার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে যেমন ব্যবহৃত হচ্ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্টার পরেও সেভাবে চলত। সে জন্য উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্র/জাতীয় ভাষা হলেও পূর্বোল্লিখিত স্থানীয় ভাষাগুলো এখনো সেখানে ব্যবহৃত হয়।

6. সংখ্যা গরিষ্ঠের ভাষা রাষ্ট্রভাষা হওয়া বলে অনেকে বলে থাকেন। না, এটা প্রয়োজনীয় নয়। একটা বহুভাষী রাষ্ট্রে রাষ্ট্রভাষা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় না। এটা নির্ধারিত হয় একটা ভাষার প্রচলিত বহুল ব্যবহারের উপর এবং অন্যান্য উপযোগিতার ভিত্তিতে। সংস্কৃত, পালি, ফার্সি, ইংরেজী ও উর্দু রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এগুলো কখনোই সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা ছিল না। অনেকে ইন্দোনেশিয়ার উদাহরণ দিয়ে থাকেন। ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রভাষা হল বাহাসা ইন্দোনেশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ান ভাষা, যা মূলত একটা মালয় ভাষা। এটা মালয়েশিয়ারও রাষ্ট্রভাষা এবং সেখানে বলা হয় বাহাসা মালয়েশিয়া বা মালয়েশিয়ান ভাষা। কিন্তু ভাষাটা আসলে বাহাসা মেলায়ু বা মালয় ভাষা। ইন্দোনেশিয়াতে সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষা জাভানিজ় ভাষা। তাহলে তারা মালয় ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করল কেন? কারণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দীপপুঞ্জ ও উপকুলীয় অঞ্চলগুলোতে সওদাগরী ভাষা হিসেবে মালয়ী অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল যদিও অধিকাংশ মানুষের মাতৃভাষা ভিন্ন। একইভাবে দক্ষিণ এশিয়া বা ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষিত সম্প্রদায় – হিন্দু-মুস্লিম নির্বিশেষে – উর্দু/হিন্দুস্তানী ভাষায় কথা বলত।

ভাষা আন্দোলনের এত পরে এসব কথা বলার মানে কী? আপনি কি এখন চান যে উর্দু আমাদের রাষ্ট্রভাষা করা হোক বাংলার পরিবর্তে?

উত্তর হলঃ “না”। এখানে যা বলার চেষ্টা করা হয়েছে, তা হল ইতিহাসের ভুল পাঠ দিয়ে আমাদের মাঝে যে ঘৃণার দেয়াল তুলে দেয়া হয় তার কিঞ্চিৎ সংশোধন মাত্র। রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনকে মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন নাম দিয়ে যে মিথ্যার বেসাতি করা হয় সে ক্ষেত্রে বাস্তবতার আলো নিক্ষেপ করা হল এই পোস্টের উদ্দেশ্য।

হিন্দুস্তানী [উর্দু/হিন্দী] শিখাকে আপনি কোন দৃষ্টিকোন থেকে দেখেন?

আমি এটাকে খারাপ হিসাবে দেখি না, বরং ইতিবাচক হিসাবে দেখি। আমি মনে করি হিন্দুস্তানী ভাষা সব সময় উপমহাদেশের মানুষের মাঝে সেতুবন্ধন হিসাবে কাজ করেছে। তাই আমাদের দেশেও অফিশিয়ালী এটাকে শেখানো দরকার। যাতে করে আমরা ভারতীয় ও পাকিস্তানীদের সাথে কমন একটা বন্ধনে আবারও দাঁড়াতে পারি। পাকিস্তানী ও ভারতীয়রা পরস্পরের সাথে কথা বলতে গেলে সহজেই একটা দেশি ভাষায় কথা বলতে পারেন। আমরা সে ক্ষেত্রে পারি না, অল্প কিছু মানুষ ছাড়া। আমরা যদি সাত-সমূদ্র-তের-নদীর ওপার থেকে আসা ইংরেজদের ভাষা শিখতে পারি এবং এটার ব্যবহার করতে পারি, তাহলে হিন্দুস্তানীর মত একটা দেশি ভাষা শিখতে সমস্যা কোথায়?

ভাষাভিত্তিক ও সাংস্কৃতিক জাহিলিয়াতকে আমি অবশ্যই ঘৃণা করি। আল্লাহর ঘোষণা হল আমাদের ভাষাগুলো মূলত তাঁর নিদর্শনঃ
وَمِنْ آيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّلْعَالِمِينَ (30:22)
“আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মাঝে রয়েছে আসমানগুলো ও জ়মিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা। নিশ্চয়ই জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে এতে অনেক নিদর্শন।” [আর-রূমঃ ২২

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 400E Mosholu Parkway South Apt # A23,The Bronx, New York 10458, USA

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com