ভাল পাত্রকে বিয়ে করব নাকি আগে আত্মনির্ভরশীল হব?

December 18, 2017 12:08 am0 commentsViews: 29

বছর দুয়েক আগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশন কাউন্টার পার হয়ে বোর্ডিং এর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় বেশ স্মার্ট, সুশ্রী একটি মেয়ে আমার পাশে এসে বসল। আমি যাচ্ছিলাম সিঙ্গাপুরে আমার বরের কাছে আর মেয়েটি যাচ্ছিল আমেরিকায় তার শ্বশুরবাড়িতে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মেয়েটির সাথে আমার আলাপ জমে গেল। আলাপচারিতায় উঠে এল আমাদের বিবাহিত জীবন।

অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, খুব অল্প সময়ের পরিচয়েই মেয়েটি তার দাম্পত্য জীবনের অশান্তিগুলো আমার সাথে শেয়ার করতে দ্বিধা করল না। ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে পড়া অবস্থাতেই বিয়ে হয় মেয়েটির। সে সচ্ছল পরিবারের মেয়ে। কিন্তু ওই যে অ্যামেরকিান পাত্র! সেই পাত্র হাত ছাড়া করতে চায় নি মেয়েটির পরিবার। তবে পাত্রপক্ষের সাথে কথা হয়েছিল যে, আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার পর তারা মেয়েটিকে লেখাপড়া করাবে। কিন্তু বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সব কথা উল্টে গেল। লেখাপড়া তো দূরের কথা, মেয়েটির শ্বশুরবাড়ির লোকজন চায়, মেয়েটি আমেরিকায় অড জব করুক, সন্তানের মা হোক।

কথা বলতে বলতেই হঠাৎ বোর্ডিং এর জন্য ডাক পড়ল। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সামনে যখন এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন তার মলিন মুখটা আমার চোখে ভাসছিল। এরই মধ্যে আমরা ফেসবুকে নিজেদের পরিচয় শেয়ার করেছি। সিঙ্গাপুরে পোঁছানোর দিন দুয়েক পরই আমি তার কাছ থেকে বন্ধু হওয়ার আমন্ত্রণ পেলাম। এরপর কেটে গেছে বেশ কয়েক মাস। তার সাংসারিক অশান্তি কমেনি একটুও। সে অড জব করত। কিছুদিন আগে দেখলাম, সে পুত্র সন্তানেরও মা হয়েছে। দুয়ে দুয়ে চার মিলে গেল। মেয়েটির আর লেখাপড়া হল না।

তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন যা চেয়েছে, ঠিক তাই হয়েছে। নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার কোন স্বাধীনতা নেই মেয়েটির । মেয়েটির জীবনের সব সিদ্ধান্ত নেয় এখন তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। নিশ্চয়ই ভাবছেন, মেয়েটির শ্বশুরবাড়ির লোকজনের উপর আমি ভীষণ বিরক্ত, মোটেই তা নয়। সত্যি বলতে কী, আমার পরিবারের মেয়েদের এবং বান্ধবীদের শ্বশুরবাড়ির গল্প শুনতে শুনতে শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে আমার এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, এর চেয়ে ভাল কিছু আমি খুব একটা ভাবতে পারি না।

শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে যে দু’একটি ভাল গল্প শুনি, সেগুলো আমার কাছে ব্যতিক্রম। কাজেই মেয়েদের শ্বশুরবাড়ির লোকজনের প্রতি আমার প্রত্যাশা কম। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কোন মেয়ে খুব আদরে থাকবে, তার সব চাওয়া-পাওয়া পূর্ণ হবে, আমি এমনটি আশা করি না। বরং বিমানবন্দরে পরিচয় হওয়া ওই মেয়েটির সাথে যা ঘটছে, সেটাই অনেক স্বাভাবিক মনে হয়।

আর সে কারণেই আমার সমস্ত রাগ মেয়েটির বাবা-মায়ের ওপর। কেন তারা মেয়েটিকে স্নাতক পাশও করতে দিল না, তার আগেই বিয়ে দিয়ে দিল! এটি ঢাকার একটি মধ্যবিত্ত এবং শিক্ষিত পরিবারের চিত্র। শিক্ষিত বাবা-মায়েরাই যদি মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে স্বনির্ভর না করে বিয়ে দিয়ে দেয়, তাহলে অশিক্ষিত বাবা-মায়েদের দোষ দিয়ে আর কী হবে?

আমার কৈশোরের একটা বড় সময় কেটেছে মফস্বল শহরে। আমরা চার বোন এক সাথে বড় হয়েছি। পরিবারের ওপর চাপটা ছিল বেশ ভালই। তারপরও আমার বাবা আমাদের চার বোনকেই লেখাপড়া করিয়েছেন। আমাদের জীবনে তেমন কোন বিলাসিতা ছিল না। পাশের বাড়ির বান্ধবীদের দেখতাম, ক্লাস সিক্স-সেভেনে উঠতে না উঠতেই তাদের জন্য গহনা বানিয়ে রাখছে তাদের বাবা-মা। ওদের বিয়ের জন্য টাকা জমানো হচ্ছিল ব্যাংকে। অথচ, আমার বাবা-মায়ের যেন সেসব নিয়ে কোন চিন্তাই ছিল না। না ছিল আমাদের কোন গহনা, না ছিল আমাদের নামে জমানো কোন টাকা। আমাদের শুধু ছিল শিক্ষা।

আজ আমরা সবাই স্বাবলম্বী। কিন্তু আমার পাশের বাড়ির বান্ধবীদের অবস্থা বেশ নাজুক! একেকজনের বিয়েতে দুই-তিন লাখ টাকা করে যৌতুক ও গয়নাগাটি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের নিজেদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার কোন অধিকার তাদের নেই। কারণ, প্রথমত তারা শিক্ষিত নয়, দ্বিতীয়ত তারা স্বাবলম্বীও নয়। তারা তাদের স্বামীর উপর নির্ভরশীল। এই মেয়েগুলো সংসারে আছে অনেকটা পুতুলের মত। স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকজন যেখানে থাকতে বলছে, সেখানেই তারা থাকতে বাধ্য। সংসারে রান্না করা আর ঘর-গুছানো ছাড়া তাদের আর কোন ভূমিকা নেই।

আমার শাশুড়ি মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে বলেন, শ্বশুরবাড়িতে কাজ করতে করতেই তাঁর নাকি দিন কেটে গেছে। আমার বুঝতে সমস্যা হয় না, কেন তিনি এসব কথা বলেন। তিনি হয়ত চান, তার ছেলের বউরাও তার মত করে সংসারের ঘানি টানুক। কিন্তু বাস্তবতা তো একেবারেই ভিন্ন। আমার শাশুড়ির বিয়ে হয়েছিল মাত্র তের বছর বয়সে। তাঁর বাবা-মা তাঁকে লেখাপড়া করান নি। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁকে ইচ্ছে মত খাটিয়ে নিয়েছে। তাঁর প্রতিবাদ করার কোন উপায় ছিল না। কারণ, তিনি আত্মনির্ভরশীল নন।

কিন্তু আমার হাতে তো অনেক অপশন রয়েছে। আমি উপার্জন করতে পারি। সংসারের কাজগুলো নিজের ঘাড়ে না নিয়ে গৃহপরিচারিকা রেখে করাতে পারি। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি যে, এখনও অনেক পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়া করিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠানো হয় কেবল ভাল একটা পাত্রের সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য। মেয়েকে স্বাবলম্বী করার কথা ভাবে না বাবা-মায়েরা। যেন একটা মেয়ের ভাল থাকা, মন্দ থাকা, বর্তমান-ভবিষ্যৎ, সবকিছুই নির্ভর করে ভাল একটা ছেলের সাথে বিয়ের ওপর। ক্ষেত্র বিশেষে ভাল ছেলেও খোঁজার ধৈর্য থাকে না মেয়ের বাবা-মায়ের। কোন মত একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিতে পারলেই যেন বেঁচে যায় মেয়ের পরিবার।

কাজেই, শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে মেয়েদের যে ভোগান্তি, তার দায় যদি অনেকটাই মেয়ের বাবা-মায়ের ওপর গিয়ে বর্তায় তাহলে কি খুব অযৌক্তিক হয়ে যায় বিষয়টা? মোটেই না।

বিয়ে কোনভাবেই একটা মেয়ের জীবনের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হতে পারে না। কারণ, বিয়েটা আজ খুব মধুর থাকলেও কাল সেটি আর মধুর নাও থাকতে পারে। এমনকি দাম্পত্য জীবনে বিচ্ছেদও ঘটতে পারে।

তাই, একটা মেয়ের ভাল থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারে কেবল তার শিক্ষা এবং আত্মনির্ভরশীলতা। আর সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে হবে বাবার বাড়িতেই।

সূত্রঃ বিবিসি

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 400E Mosholu Parkway South Apt # A23,The Bronx, New York 10458, USA

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com