ভারতে সোশাল মিডিয়ার ‘ঘাতক জনতা’ ক্রমেই হুমকি হয়ে উঠছে
ক্ষতিকর আলাপ আলোচনা এবং পরস্পরের উপর অযাচিত বাক-হামলার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা রয়েছে। ভারত এ সমস্যা সম্পর্কে খুবই ওয়াকিবহাল। উদাহরণস্বরূপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের কথা উল্লেখ করা যায়। সম্প্রতি সোশাল মিডিয়ায় খোদ নিজের দলের লোকজনের হামলার শিকার হয়েছেন তিনি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেবা নিয়ে স্বরাজ টুইটারে জনতার প্রশ্নের জবাব দিয়ে থাকেন। ভিন্নধর্মের অনুসারী এক দম্পতি সম্প্রতি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলে তাদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন এক কর্মকর্তা। শাস্তিস্বরূপ তাকে বদলি করা হলে স্বরাজ স্বদলীয় নেতাকর্মীদের সমালোচনার মুখে পড়েন।
পাসপোর্ট অফিসের সিনিয়র কর্মকর্তারা যখন বদলির সিদ্ধান্ত দেন, তখন স্বরাজ দেশের বাইরে ছিলেন। কিন্তু সেটা বিজেপির সদস্য ও সমর্থকদের নিরস্ত রাখতে পারে নি। পাসপোর্ট কর্মকর্তার মুসলিম বিদ্বেষী আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য তাকে বদলির আদেশ দেয়ায় তারা স্বরাজের তীব্র সমালোচনা করেছে এবং তাকে ‘বেগম’ (মুসলিম সম্মানসূচক সম্মোধন) হিসেবে মন্তব্য করেছে। শুধু তাই নয়, তার স্বামীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে বিপথগামী হওয়ার কারণে তাকে পেটানো হয়।
গত এক দশক ধরে বিজেপি এক গ্রুপ সাইবার যোদ্ধা গড়ে তুলেছে যাদের কাজ হলো হিন্দুত্ববাদের পক্ষে প্রচারণা চালানো, সংখ্যালঘুদের অবমাননা করা, উগ্র-জাতীয়তাবাদের চর্চা করা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর কঠোর হামলা চালান। বিজেপি যখন বিরোধী দলে ছিল, তখনই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু মূলধারার মিডিয়ার ভিড়ে তাদের মত তখন তেমন একটা পাত্তা পায়নি। কিন্তু ২০১৪ সালে বিজেপি যখন ক্ষমতায় এসেছে, তখন সোশাল মিডিয়া ট্রল তাদের রাজনৈতিক প্রচারণার বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে।
এই সাইবার আর্মি এখন মদদপুষ্ট মেশিনে পরিণত হয়েছে এবং টুইটার, ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে তাদের অবস্থান এখন অনস্বীকার্য। স্বাতী চতুর্বেদী ২০১৬ সালে একটি লেখা প্রকাশ করেন যার শিরোনাম হলো ‘আই অ্যাম অ্যা ট্রল: ইনসাইড দ্য সিক্রেট ওয়ার্ল্ড অব দ্য বিজেপি’স ডিজিটাল আর্মি’। সেখানে তিনি বলেন, এই সাইবার আর্মির সদস্যরা ভাল অর্থ পায়, এক একজন একাধিক একাউন্ট ব্যাবহার করে। এরা ভারত ও ভারতের বাইরে বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত।
অর্থভোগী এই রাজনৈতিক চ্যালারা সোশাল মিডিয়ায় প্রতি ঘন্টায় ‘সিকুলার’ (সেক্যুলার), ‘লিবতার্দস’ (লিবারেল) এবং ‘খাংগ্রেসিস’ (কংগ্রেস পার্টি যারা কথিক মুসলিমপন্থী) – এদের বিরুদ্ধে অব্যাহত অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। যে কোন ব্যক্তি বা যে কোন বিষয় বিজেপির রাজনৈতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে বা তাদের চেলাদের অপছন্দের হলেই তাদের বিরুদ্ধে মুসলিম-বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া হচ্ছে। এই সাইবার সেনারা এতটাই বিকৃত মানসিকতার যে কোন ধরণের প্রতিক্রিয়া ছাড়া ভারতে সোশাল মিডিয়ায় কোন বিষয়ে লিবারেল মত প্রকাশ করাটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রতিনিয়ত এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করছি।
বিজেপির শীর্ষ পর্যায়ের সদস্য হিসেবে স্বরাজ কখনই তার দলের সাইবার সেনাদের হামলার শিকার হন নি। সম্প্রতি যেটা ঘটেছে, সেটাই তার জন্য এ ধরণের প্রথম ঘটনা। হামলার শিকার হওয়ার সাথে সাথেই টুইটারে একটা মতামত যাচাই করেছেন তিনি। যাতে হয়রানিকারীদের বিপরীতে নিজের সমর্থন অক্ষুণ্ণ রাখা যায়। মজার ব্যাপার হল ট্রলের পক্ষে ৪৩% মত এসেছে।
এর মাধ্যমে স্বরাজ যে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন, সেটা আমাদের মত বাকিদের বহু আগে থেকেই জানা। সেটা হল তার দল সোশাল মিডিয়াকে বিষাক্ত করে তুলেছে। এবং সেখানে হানা দেয়ার অর্থই হলো কোন ধরণের সুরক্ষা ছাড়াই পারমানবিক বিকীরণের মধ্যে পা ফেলা। নিশ্চিতভাবে আপনি ধ্বংস হয়ে যাবেন। ড. ভিক্টর ফ্রাঙ্কেন্সটাইন যেটা আবিষ্কার করেছিলেন, আপনি যখন কোন দানব তৈরি করবেন, এটা বাড়তে থাকবে এবং এক সময় আপনার নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।