ভারতের রাজস্থানে মানুষের মনে মুসলিম বিদ্বেষের বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে -বলছেন মানবাধিকার কর্মী
ভারতের রাজস্থানে এক মধ্যবয়সী মুসলমান ব্যক্তিকে নৃশংস হত্যার ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা আজ শুক্রবার এক নতুন মোড় নিয়েছে।
একদিকে পুলিশ বলছে যে হত্যাকারী আর নিহত ব্যক্তি একে অপরকে আগে থেকে চিনতই না। অন্যদিকে হত্যার কারণ হিসাবে যে লাভ-জিহাদের কথা বলেছিল ধৃত ও অভিযুক্ত খুনী, তা ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে মৃতের পরিবার।
হত্যাকারীর নৃশংসতার আরও একটি দিক আজ সামনে এসেছে।
ভিডিওর একটি অংশে আজ স্পষ্ট হয়েছে হত্যার আগে নিজের মেয়েকে কোলে বসিয়ে গেরুয়া পতাকার সামনে বসে হত্যাকারী মুসলিম বিদ্বেষী একটি লম্বা ভাষণ দিয়েছে।
রাজস্থানের মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন গত নয়মাসে এ নিয়ে সে রাজ্যে অন্তত ৫টি ঘটনায় মুসলমানদের কোনও না কোনও অজুহাতে মেরে ফেলা হয়েছে, যা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির লাগাতার মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারেরই পরিণাম।
ভাইরাল হয়ে যাওয়া ভিডিওটিতে ‘মাগো মাগো’ বলে কাকুতি জানাতে শোনা যাচ্ছে যাকে, তিনি মুহম্মদ আফরাজুল।
রাজস্থানের রাজসমুন্দ জেলায় নিহত মধ্যবয়সী ওই ব্যক্তি মুসলমান, যাকে ভিডিও ক্যামেরার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে গত বুধবার।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজসমুন্দ জেলার রাস্তার ধারে পুলিশ প্রথমে একটি অর্ধদগ্ধ মৃতদেহ পেয়েছিল। পরে ওই ভিডিও ভাইরাল হবার এবং প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহের পর পুলিশ তার পরিচয় নিশ্চিত করে।
হত্যাকারী শম্ভুলাল রেগরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কিন্তু হত্যার কারণ নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।
সে ভিডিওতে দাবী করেছিল যে জিহাদীদের ওই পরিণতিই হবে।
ভিডিওটির অন্য একটি অংশে এখন স্পষ্ট হয়েছে যে হত্যার আগে অথবা পরে নিজের ছোট মেয়েকে কোলে বসিয়ে শম্ভুলাল একটি লম্বাচওড়া ভাষণ দিয়েছিল, যেখানে তার মুসলিম বিদ্বেষ স্পষ্ট।গ্রেপ্তার হওয়া শম্ভুলাল বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রসঙ্গ এনেছে, পদ্মাবতী ছবি নিয়ে বিতর্কের কথা বলেছে, আর তারপরে উল্লেখ করেছে লাভ জিহাদের – হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো ঠিক যেভাবে প্রচার করে থাকে যে হিন্দু মেয়েদের ভালবাসার জালে ফাঁসিয়ে বিয়ে করে জেহাদে উদ্বুদ্ধ করছে কট্টর মুসলিমরা।
শম্ভুলালের পিছনে উড়তে দেখা যাচ্ছে একটি গেরুয়া পতাকা।
নিহত মুহম্মদ আফরাজুল আদতে পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার কালিয়াচক এলাকার সৈয়দপুর গ্রামের বাসিন্দা বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে।
তার ভাই, দুই জামাই সহ গ্রামের বহু মানুষই আফরাজুলের সঙ্গে কাজের সুবাদে রাজসমুন্দে বসবাস করেন।
টুনি বিবি নিহত আফরাজুলের ছোট ভাই রুম খানের স্ত্রী।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, “মোবাইলে দেখলাম ওই লোক বলছে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার কথা। উনার [মৃত আফরাজুলের] তিনটে মেয়ে আছে বড় বড়, দুই জামাই, নাতি-নাতনী আছে – তিনি কি ওইসব করতে যাবে? আর গ্রামের এত লোক এক সঙ্গে থাকে সেখানে – ওইসব হলে কেউ জানতে পারত না? আমার স্বামীও তো আমাকে অন্তত বলত যে দাদার ওইসব ব্যাপার হয়েছে! সব মিথ্যা কথা।”
টুনি বিবি আর নিহতের পরিবারের অন্য সদস্যরা বলছেন তারা শম্ভুলালের ফাঁসি দেখতে চান।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী আজ নিহত আফরাজুলের পরিবারের জন্য তিনলক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ও পরিবারের একজনকে চাকরিদেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন।
ওদিকে রাজস্থানের পুলিশসূত্রগুলিকে উদ্ধৃত করে বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম বলছে হত্যাকারী শম্ভুলাল আর নিহত আফরাজুলের আগে কোনও পরিচয়ই ছিল না।
তাহলে কেন এই নৃশংস হত্যা?
রাজস্থানের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার কর্মী ও পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজের রাষ্ট্রীয় সভানেত্রী কবিতা শ্রীবাস্তব বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন এটা হিন্দুত্ববাদীদের লাগাতার মুসলমান বিদ্বেষী প্রচারেরই ফল।
মিজ শ্রীবাস্তবের কথায়, “বেশ কিছু বছর ধরেই মানুষের মনে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৫ বছরকে কেন্দ্র করে তা আরও বেড়েছে। লাভ জিহাদের প্রশ্নে হোক আর সাধারণভাবে মুসলিম বিদ্বেষ – একটা ঘৃণা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর শম্ভুলাল রেগর একজন দলিত – পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মানুষ – তাদের মধ্যেও বর্ণহিন্দুত্বের ধারণা কীভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে – এই ঘটনা তারই প্রমাণ।”
“মুসলমানদের মনে একটা আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে, যাতে তারাও প্রত্যাঘাত করে,” বলছিলেন কবিতা শ্রীবাস্তব।
গত নয়মাসে রাজস্থানেই ৫টি ঘটনায় মুসলিম ব্যক্তিদের কখনও গরু পাচারের অজুহাতে কখনও বা লাভ জিহাদের অজুহাতে মেরে ফেলা হয়েছে বলে উল্লেখ করছিলেন মিজ শ্রীবাস্তব।
আফরাজুলের হত্যার পরে, বৃহস্পতিবার সকালে পুলিশের গুলিতে আরও এক মুসলিম ব্যক্তি আলোয়ার শহরে নিহত হয়েছেন বলেও দাবি মানবাধিকার আন্দোলনের নেত্রী কবিতা শ্রীবাস্তবের।
আর কোনও ঘটনাতেই আসল দোষীদের ধরা হচ্ছে না। তাতেই হিন্দুত্ববাদীরা এবং পুলিশ অব্যাহতি পেয়ে যাচ্ছে।
“একজন শম্ভুলালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কিন্তু যারা মানুষের মনে মুসলমানদের সম্বন্ধে এই বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছে, তাদের কী হবে?” প্রশ্ন মিজ শ্রীবাস্তবের।
রাজস্থানের অথবা জাতীয় পর্যায়ে বিজেপি আর তার সহযোগী সংগঠনগুলির বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে চেয়ে যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হয়েছি আমরা।
সূত্রঃ বিবিসি