বিশ্বনবী (সা.) কেমন মহামানব ছিলেন!
নিউইয়র্ক থেকে ড. ওমর ফারুক।
তারিখঃ ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭।
মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বগুণে গুণান্বিত অতি মহৎ একজন মানুষ ছিলেন। শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর কাছেই নয়, ধর্ম, জাতি, বর্ণ, নির্বিশেষে সকলের দৃষ্টিতেও তিনি অত্যন্ত মর্যাদাশীল ও মহামানব হিসেবে স্বীকৃত। সেটি কেন তা একটু বিশ্লেষণে যাই।
মহান আল্লাহ নিজেই বলেনঃ ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামিন।
অর্থঃ হে রাসূল (সঃ) আমি আপনাকে সমস্ত মাখলুকাতের জন্য রহমত হিসেবে পাঠিয়েছি।
যিনি স্রষ্টা, তিনিই যদি তাঁর কোন সৃষ্টি সম্পর্কে এমন করে বলেন, তাহলে সহজেই অনুমেয়, তিনি সেই সৃষ্টিকে কেমন গুণাবলী দিয়ে তৈরি করে পাঠিয়েছেন।
এন নজরে খুব সংক্ষেপে সে মহান ব্যক্তির গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।
♦ তাঁর চেহারা মোবারক পূর্ণিমার চাঁদের মত ঝলমল করত।
মাঝারি গড়নবিশিষ্ট ব্যক্তি থেকে কিছুটা লম্বা, আবার অতি লম্বা থেকে খাট ছিলেন তিনি।
♦ মাথা মুবারক সুসংগতভাবে বড় ছিল। কেশ মুবারক সামান্য কুঞ্চিত ছিল, মাথার চুলে অনিচ্ছাকৃতভাবে আপনাআপনি সিঁথি হয়ে গেলে সেভাবেই রাখতেন, অন্যথায় ইচ্ছাকৃতভাবে সিঁথি তৈরি করার চেষ্টা করতেন না। চিরুনি ইত্যাদি না থাকলে এরূপ করতেন। আর চিরুনি থাকলে ইচ্ছাকৃত সিঁথি তৈরি করতেন। কেশ মুবারক লম্বা হলে কানের লতি অতিক্রম করে যেত।
♦ শরীর মুবারকের রং ছিল অত্যন্ত উজ্জ্বল আর ললাট ছিল প্রশস্ত। ভ্রুদ্বয় বক্র, সরু ও ঘন ছিল। উভয় ভ্রু পৃথক পৃথক ছিল, মাঝখানে সংযুক্ত ছিল না। ভ্রুদ্বয়ের মাঝখানে একটি রগ ছিল, যা রাগের সময় ফুলে উঠত।
♦ তাঁর নাসিকা উঁচু ছিল, যার ওপর একপ্রকার নূর ও চমক ছিল। যে প্রথম দেখত সে তাঁকে উঁচু নাকওয়ালা ধারণা করত। কিন্তু গভীরভাবে দৃষ্টি করলে বুঝতে পারত যে সৌন্দর্য ও চমকের দরুন উঁচু মনে হচ্ছে, আসলে উঁচু নয়।
♦ দাঁড়ি মুবারক ভরপুর ও ঘন ছিল। চোখের মণি ছিল অত্যন্ত কালো। তাঁর গণ্ডদেশ সমতল ও হালকা ছিল এবং গোশত ঝুলন্ত ছিল না। তাঁর মুখ সুসংগতপূর্ণ প্রশস্ত ছিল।
♦ তাঁর দাঁত মুবারক চিকন ও মসৃণ ছিল এবং সামনের দাঁতগুলোর মধ্যে কিছু কিছু ফাঁক ছিল।
♦ তাঁর গ্রীবা মুবারক সুন্দর ও সরু ছিল। তাঁর রং ছিল রুপার মতো সুন্দর ও স্বচ্ছ। তাঁর সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সামঞ্জস্যপূর্ণ ও মাংসল ছিল।
♦ আর শরীর ছিল সুঠাম। তাঁর পেট ও বুক ছিল সমতল এবং বুক ছিল প্রশস্ত। উভয় কাঁধের মাঝখানে বেশ ব্যবধান ছিল। গ্রন্থির হাড়গুলো শক্ত ও বড় ছিল (যা শক্তি-সামর্থ্যের একটি প্রমাণ)। শরীরের যে অংশে কাপড় থাকত না, তা উজ্জ্বল দেখাত। বুক থেকে নাভি পর্যন্ত চুলের সরু রেখা ছিল। তা ছাড়া বুকের উভয় অংশ ও পেট কেশমুক্ত ছিল। তবে উভয় বাহু, কাঁধ ও বুকের উপরিভাগে চুল ছিল।
♦ তাঁর হাতের কবজি দীর্ঘ এবং হাতের তালু প্রশস্ত ছিল। শরীরের হাঁড়গুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সোজা ছিল। হাতের তালু ও উভয় পা কোমল ও মাংসল ছিল। হাত-পায়ের আঙুলগুলো পরিমিত লম্বা ছিল। পায়ের তালু কিছুটা গভীর এবং কদম মুবারক এরূপ সমতল ছিল যে পরিচ্ছন্নতা ও মসৃণতার দরুন পানি আটকে থাকত না, সঙ্গে সঙ্গে গড়িয়ে পড়ত।
♦ তিনি যখন পথ চলতেন, তখন শক্তি সহকারে পা তুলতেন এবং সামনের দিকে ঝুঁকে চলতেন, পা মাটির ওপর সজোরে না পড়ে আস্তে পড়ত। তাঁর চলার গতি ছিল দ্রুত এবং পদক্ষেপ অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ হত, ছোট ছোট কদমে চলতেন না। চলার সময় মনে হত যেন তিনি উচ্চভূমি থেকে নিম্নভূমিতে অবতরণ করছেন।
♦ যখন কোন দিকে মুখ ঘোরাতেন, তখন সম্পূর্ণ শরীরসহ ঘোরাতেন। তাঁর দৃষ্টি নত থাকত এবং আকাশ অপেক্ষা মাটির দিকে অধিক নিবদ্ধ থাকত।
♦ সাধারণত চোখের এক পার্শ্ব দিয়ে তাকাতেন। অর্থাৎ লজ্জা ও শরমের দরুন কারো প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি খুলে তাকাতে পারতেন না।
♦ চলার সময় তিনি সাহাবিদের সামনে রেখে নিজে পেছনে থাকতেন।
♦ কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনি আগে সালাম করতেন।
♦ বিশ্বনবী (সা.) সর্বদা আখিরাতের চিন্তায় মশগুল থাকতেন। সর্বক্ষণ উম্মতের কল্যাণের কথা ভাবতেন। দুনিয়াবি জিনিসের মধ্যে তিনি কোন প্রকার শান্তি ও স্বস্তি পেতেন না।
♦ বিনা প্রয়োজনে কোন কথা বলতেন না, বেশির ভাগ সময় চুপ থাকতেন। তিনি আদ্যপান্ত মুখ ভরে কথা বলতেন। জিহ্বার কোণ দিয়ে চাপা ভাষায় কথা বলতেন না যে অর্ধেক উচ্চারিত হবে আর অর্ধেক মুখের ভেতর থেকে যাবে, যেমন আজকাল অহংকারীরা করে থাকে।
♦ তিনি এমন সারগর্ভ ভাষায় কথা বলতেন, যাতে শব্দ কম কিন্তু অর্থ বেশি থাকত। তাঁর কথা একটি অন্যটি থেকে পৃথক হত। অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত কথা বলতেন না, আবার প্রয়োজন অপেক্ষা এরূপ কমও না যে উদ্দেশ্যই পরিষ্কার বোঝা যায় না।
♦ তিনি নরম মেজাজ ও স্বভাবের ছিলেন, কঠোর মেজাজি ছিলেন না। তিনি কাউকে হেয় করতেন না। আল্লাহর নিয়ামত যত সামান্যই হোক না কেন, তিনি তাকে বড় মনে করতেন। নিয়ামতের নিন্দা করতেন না, আবার মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসাও করতেন না। নিন্দা না করার কারণ যেহেতু আল্লাহ তাআলার নিয়ামত। আর অতিরিক্ত প্রশংসা না করার কারণ ছিল এই যে এতে লোভ হচ্ছে বলে সন্দেহ হতে পারে।
♦ দ্বীনি বিষয় ও হকের ওপর হস্তক্ষেপ করা হলে তাঁর ক্রোধের সামনে কেউ টিকতে পারত না, যতক্ষণ না তিনি এর প্রতিকার করতেন। দ্বীনের ব্যাপারে তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হত না।
♦ তিনি দুনিয়া বা দুনিয়ার কোন বিষয়ে রাগান্বিত হতেন না। কারণ তাঁর দৃষ্টিতে দুনিয়া ও দুনিয়াবি বিষয়ের কোনো গুরুত্ব ছিল না। তবে দ্বীনি বিষয় বা হকের ওপর কেউ হস্তক্ষেপ করলে ক্রোধে তাঁর চেহারা এরূপ পরিবর্তন হয়ে যেত যে তাঁকে কেউ চিনতে পারত না।
♦ তিনি নিজের জন্য কখনো কারো প্রতি অসন্তুষ্ট হতেন না। নিজের জন্য প্রতিশোধও নিতেন না।
♦ যখন কোন কারণে কোন দিকে ইশারা করতেন, তখন সম্পূর্ণ হাত দ্বারা ইশারা করতেন। বিনয়ের খেলাপ বলে আঙুল দ্বারা ইশারা করতেন না।
♦ তিনি আশ্চর্যবোধকালে হাত মুবারক উল্টে দিতেন। কথা বলার সময় কখনো (কথার সঙ্গে) হাত নাড়তেন, কখনো ডান হাতের তালু দ্বারা বাঁ বৃদ্ধাঙুলির পেটে আঘাত করতেন।
♦ কারো প্রতি অসন্তুষ্ট হলে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন ও অমনোযোগিতা প্রকাশ করতেন অথবা তাকে মাফ করে দিতেন।
♦ যখন তিনি খুশি হতেন, তখন লজ্জায় চোখ নিচু করে ফেলতেন। তাঁর বেশির ভাগ হাসি মুচকি হাসি হত। আর সে সময় তাঁর দাঁত মুবারক শিলার মত শুভ্র ও উজ্জ্বল দেখাত।
♦ মহানবী (সা.) ব্যক্তিগত প্রয়োজনে (অর্থাৎ আহার-নিদ্রা ইত্যাদির জন্য) ঘরে যেতেন। এ ব্যাপারে তিনি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত ছিলেন। তিনি তাঁর ঘরে থাকাকালীন তিন ভাগে ভাগ করতেন—
১. এক ভাগ আল্লাহর ইবাদতের জন্য।
২. এক ভাগ পরিবার-পরিজনের হক আদায়ের জন্য।
৩. এক ভাগ নিজের (আরাম ও বিশ্রাম ইত্যাদির) জন্য।
(সূত্র : বিদায়া নিহায়া, কানজুল উম্মাল; মাওলানা সাদ : হায়াতুস সাহাবাহ, প্রথম খণ্ড, দারুল কিতাব, ঢাকা ও শামায়েলে তিরমিজি, আল কাউসার প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৭)