বিতর্কিত মাওলানা সাদঃ কিন্তু কেন?
১৯২০ সালে দিল্লীর নিকটবর্তী নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার (র.) মাজার সংলগ্ন মসজিদকে কেন্দ্র করে মাওলানা ইলয়াস (র.) এই নতুন পদ্ধতিতে দ্বীন প্রচার শুরু করেন। বাংলাদেশের টঙ্গীতে গত ৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া বিশ্ব ইজতেমা তারই অংশ। তাবলিগ জামাত বিশেষত গ্রামীণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে মনে করেন তাবলিগের অনুসারী ভাই ও বোনেরা। তাবলীগের অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তারা বলে থাকেন, দ্বীনের খেদমতে দল বেঁধে বিভিন্ন সময়ের জন্য দেশ-বিদেশে বের হওয়া। তাকওয়া অর্জন, দ্বীনের তালিমে অংশগ্রহণ ও আমল-আখলাক সুন্দর করার এক অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করে তাবলীগ জামাত।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কাকরাইল এলাকায় রমনা পার্কের পাশে অবস্থিত একটি মসজিদ বাংলাদেশে তাবলীগ জামাতের মারকায বা প্রধান কেন্দ্র।। এটি ১৯৫২ সালে এই মসজিদটি তাবলীগ জামাতের মারকায হিসেবে নির্ধারিত হয়। মসজিদটির আদি নাম ছিল মালওয়ালি মসজিদ। পরবর্তীতে ১৯৬০এর দশকে তাবলীগ জামাতের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ইঞ্জিনিয়ার মরহুম হাজী আব্দুল মুকিতের তত্ত্বাবধানে তিন তলা মসজিদটি পুনঃনির্মাণ করেন।
’ফাযায়েলে আমল’ নামে গ্রন্থটি এ জামাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অনুসরণীয় পবিত্র গ্রন্থ । একটু আগে যে বললাম, ইমান ও আমলের ওপর আলোচনা হবে বলে কোন মসজিদে জামায়াতে নামাজ শেষে আপনাকে বসাল। তারপর দেখবেন, মুতাকাল্লি ‘ বা আলোচক একটি বই হাতে ওঠাল।ৈ বইয়ের নাম হল ‘ফাযায়েলে আমল।’ অধিকাংশ সময় কোন কোরআন শরিফের তাফসির নয়, হাদীস গ্রন্থের কপি নয় কিংবা বিশ্বে বহুল আলোচিত কোন খ্যাতনামা চিন্তাবিদের গ্রন্থও নয়, তিনি হাতে নেবেন ‘ফাযায়েলে আমল’ নামে সেই শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে আসা এ গ্রন্থটি। এবার তিনি সেখান থেকে কিছৃ একাট পড়ে শোনালেন। এর মানেই তিনি ইমান ও আমল নিয়েূ আপনার সাথে আলোচনা করলেন। সে বয়ানের মূল কথাই হবেঃ ‘আপনাকে আল্লাহর রাস্তায় বেরুতে হবে।’ তিনদিনের জন্য, চল্লিশ দিনের জন্য, ১২০ দিন বা তিন চিল্লার জন্য, এক বছর এবং এমনকি সারা জীবনের জন্য আল্লাহর রাস্তায় বেরুতে হবে। আপনি আবার মনে করে বসবেন না যে, তাবলিগ আপনাকে জিহাদে যাওয়ার জন্য কাশ্মীর, ফিলিপানের মিন্দানাও প্রদেশ, ফিলিস্তিনের রণক্ষেত্র কিংবা মধ্য প্রাচ্যের কোন যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকায় নিয়ে যাচ্ছে। আসলে তিনি নিয়ে যাচ্ছেন বরং আপনাকে জিহাদের সেই জটিল ও কষ্টসাধ্য কার্যক্রম থেকে নিরাপদ ও আরাম আয়েশে জীবন ধারেণর জন্য। যে কোন বয়ানে আপনি মূল কথা পাবেন, আল্লাহর রাস্তায় বের হন। এমন অনেক লোক আমি তাবলিগ জামাতের সাথে সম্পৃক্ত দেখেছি, যাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের খবর নেই। ছেলে কী করে, তার স্ত্রী কী রকম জীবনযাপন করে, মেয়ে কেমন চলাপে রা করে, সে সবের কোন খবর নেই। তিনি আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন। আল্লাহর রাস্তা মানে ঘটিবাটি ও কম্বল কাঁথা নিয়ে মসজিদে মসজিদে, শহর থেকে দূরে তেপান্তরে, দেশ হতে দেশ দেশান্তরে। এ দলের মধ্যে কিছু নেককার ও খুলুছিয়াতের লোক যে একদম নেই, তা কিন্তু নয়। এরাপরও কথা থেকে যায়, সামষ্টিক ভাবে দলের আদর্শ ও তৎপরতা কী! তাবলিগ জামাত কখনও নির্বাচনকালীন সময়ে কোন ইসলামি দলকে ভোট দিতে কাউকে উৎসাহিত করতে দেখি নি। বরং একেবারে সেকুলার দল বা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাবে, এমন সম্ভাবনাময় দলকে বেশি পছন্দ করতে দেখা যায়। এমনকি ইসলামি দলগুলোর বিরুদ্ধে তাদের বিষোদগার সেকুলার দলগুলোর চেয়েও আরও ভয়ানক হতে দেখা যায়। তাবলিগ জামাতের পুরো তৎপরতা বিশ্লেষণ করলে যে কোন আধুনিক চিন্তাভাবনার মানুষেরা ইসলামকে নিছক একটি টাল্টিবাল্টি অন্য পাদ্রীদের দ্বারা পরিচালিত ধর্মের মত কোন ধর্মই মনে করবে।
’ফাযোয়েলে আমল’ গ্রন্থের অনুসারী দল ’তাবলিগ জামাত’ এর প্রতিষ্ঠাতা হজরত ইলিয়াস শাহ (রাহ.) এর নাতি মাওলানা সাদ এখন তাদের নিজেদের মধ্যেই যথেষ্ট বিতর্কিত ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলেন। সে নিয়ে মূলতঃ বিশ্ব তাবলিগ জামাত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে।
শত বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব তাবলিগ জামাতের আমিরের দায়িত্ব পালন করেছেন ইলিয়াস (রাহ.)। এরপর আমিরের দায়িত্বে ছিলেন তাঁর ছেলে মাওলানা হারুন (রাহ.)। মাওলানা জুবায়েরুল আহসানের ইন্তেকালের পর আমিরের দায়িত্বে আসেন মাওলানা সাদ কান্ধলভী।
তাবলিগ জামাতের কোন আমির বা মুরব্বির কোন বয়ান নিয়ে এর আগে এতো বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি। যেটি হচ্ছে মাওলানা সাদের দেয়া বিভিন্ন বয়ান নিয়ে।
অভিযোগ উঠেছে তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় কুরআন, হাদিস, ইসলাম, নবি-রাসুল ও নবুয়ত এবং মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে আপত্তিকর বয়ান করেছেন। যার জন্য দেওবন্দসহ বিশ্ব আলেমদের অনেকেই এসব বয়ানের জন্য প্রকাশ্যে তাকে ক্ষমা চাইতে চলেছে।
তার দেয়া বিতর্কিত বয়ানের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো-
> ভোটের সময় চিহ্ন হিসাবে (আঙুলে) যে রং লাগানো হয়, তার কারণে নামাজ হয় না। তাই ভোট না দেয়া উচিত।
> বিভিন্ন আয়াতে তিনি বলেন, মুফাসসিরিন এই আয়াতের কোন এক তাফসির করেছেন, ওলামা কোনো এক তাফসির করে থাকেন, কিন্তু আমি এই তাফসির করে থাকি। এটা শুন। এটাই সঠিক তাফসির!
> ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল রাখা হারাম এবং পকেটে ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল রেখে নামাজ হয় না। যে আলেমগণ ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল রাখাকে ‘জায়েজ’ বলেন, তারা ‘ওলামায়ে ছু’। বার বার কসম খেয়ে তিনি বলেন, তারা হল ‘ওলামায়ে ছু’। এমন আলেমরা হলো গাধা! গাধা! গাধা!
> মোবাইলে কুরআন শরীফ পড়া এবং শোনা; প্রস্রাবের পাত্র থেকে দুধ পান করার মত!
> মাদরাসা মসজিদের বেতন বেশ্যার উপার্জনের চেয়ে খারাপ।
> কুরআন শরীফ শিখিয়ে বেতন গ্রহণ করেন, তাদের বেতন বেশ্যার উপার্জনের চেয়েও খারাপ। যে ইমাম এবং শিক্ষক বেতন গ্রহণ করেন, বেশ্যারা তাদের আগে জান্নাতে যাবে!
> কাওমি মাদরাসা বন্ধ করার অপচেষ্টা
> মাদরাসাগুলোতে জাকাত না দেয়া হোক। মাদরাসায় জাকাত দিলে জাকাত আদায় হবে না।
> রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কেবল তিনজন লোকের ‘বাইআত’ পূর্ণতা পেয়েছে। আর বাকি সবার বাইআত অপূর্ণ। সেই ৩ জন হলেন- শাহ ইসমাঈল শহীদ, মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস এবং মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ।
> মাওলানা সাদ সাহেব আযমগড়ের ইজতেমায় এবং অন্যান্য ইজতেমায় একাধিকবার সুন্নাতকে ‘৩ প্রকার’ বলে বর্ণনা করেছেন, ইবাদতের সুন্নাত, দাওয়াতের সুন্নাত এবং আচার-অভ্যাসের সুন্নাত।
> ‘দাওয়াতের পথ’ হল নবির পথ, ‘তাসাউফের পথ’ নবির পথ না।
> আজান হলো ‘তাশকিল’ (প্ল্যান-পরিকল্পনা)। নামাজ হলো ‘তারগীব’ (পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধকরণ)। আর নামাজের পর আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়া হলো ‘তারতীব’ (পরিকল্পনার মূল বাস্তবায়ন)।
> রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাওয়াত ইলাল্লাহর বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইশার নামাজকে পর্যন্ত বিলম্ব করে পড়েছেন। অর্থাৎ নামাজের চেয়ে দাওয়াতের গুরুত্ব বেশি।
> হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম ‘তোমার প্রভুর কাছে আমার কথা বল’ বলে গাইরুল্লাহর দিকে দৃষ্টি দেয়ার কারণে তাকে অতিরিক্ত ৭ বছর জেলখানায় থাকতে হয়েছে।
> হজরত জাকারিয়া আলাইহিস সালাম আল্লাহকে ছেড়ে গাছের কাছে আশ্রয় চাইলেন। ফলে শাস্তি ভোগ করতে হলো।
> মুজিজার সম্পর্ক কেবল দাওয়াতের সঙ্গে। নবুয়াতের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।
> হজরত মুসা আলাইহিস সালাম থেকে বড় এক ভুল হয়ে গেছে এবং তিনি এক অপরাধ করে ফেলেছেন- জামাআত এবং কাওমকে ছেড়ে তিনি আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য ‘নির্জনতা’ অবলম্বন করেছেন।
> হজরত মুসা আলাইহিস সালাম কর্তৃক হজরত হারুন আলাইহিস সালামকে নিজের স্থলাভিষিক্ত বানানোও অনুচিৎ কাজ হয়েছে।
হেদায়েতের সম্পর্ক যদি আল্লাহর হাতে হত; তাহলে তিনি নবি পাঠাতেন না
ছবিঃ তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস (রহ)